Monday 13 December 2021

বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে

১৩ই ডিসেম্বর ২০২১

প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক সমস্যার মাঝে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা। পশ্চিমা দেশগুলিতেই যখন গণতন্ত্র মুমুর্ষু, তখন বাকি দুনিয়াতে গণতন্ত্রের তল্পিবাহক হবার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের রয়েছে কি? গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার মতো শক্তি বাইডেনের কতটুকু রয়েছে? উত্তরটা যথেষ্টই কঠিন। কারণ গণতন্ত্রকে ‘লাইফ সাপোর্ট’এ রাখা হয়েছে; অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

 
গত ৯ এবং ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে ‘সামিট ফর ডেমোক্র্যাসি’ বা ‘গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এই অনুষ্ঠানের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে যেমন ব্যাপক আলোচনা চলছে, তেমনি এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য নিয়েও উত্তপ্ত বাক্য আদান প্রদান হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কথায়, গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকের লক্ষ্য ছিল এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দেয়া, যেখানে নেতৃবৃন্দ নিজেদের একার এবং যৌথ অঙ্গীকার, সংস্কার, এবং নতুন কোনকিছু আরম্ভ করার ঘোষণা দেবে, যেগুলির মূল লক্ষ্য হবে নিজেদের দেশে এবং বিদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে রক্ষা করা। এছাড়াও আরও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে যে, এই ফোরামের মাধ্যমে সাহসী এবং নতুন চিন্তা, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং মানবাধিকারকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। তবে সমস্যা হলো, বাইডেন প্রশাসন এই বৈঠকে ডেকেছেন এমন সকল ব্যক্তিদের, যাদের নিজেদের শাসন নিয়েই ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে।

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সাংবাদিক এবং লেখক দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বাউসুনারুকে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানোটা ছিল কৌতুককর। তিনি বলেন যে, আফগানিস্তানকে তালিবানদের হাতে তুলে দিয়ে এবং সৌদি আরবের কাছে ৬’শ ৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো মনে করছিলেন যে, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের বিরুদ্ধে মারাত্মক পদক্ষেপ নেয়া এই ব্যক্তিগুলিকে ডেকে এনে গণতন্ত্র রক্ষায় তাদেরই মতো লোকগুলিকে কিভাবে প্রতিহত করা যায়, সেব্যাপারে দুই দিনের একটা ভার্চুয়াল বৈঠক করাটা ভালো একটা চিন্তা হতে পারে। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আমন্ত্রিত ১’শ ১০টা দেশের মাঝে ৩০ শতাংশের বেশি দেশ মার্কিন সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’এর হিসেবে জনগণকে আংশিক স্বাধীনতা দেয়; আর তিনটা দেশ জনগণকে কোনরূপ স্বাধীনতাই দেয় না; যেগুলি হলো, এঙ্গোলা, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং ইরাক। তালিকার এক ডজনেরও বেশি দেশকে সুইডেনের ‘ভি ডেম ইন্সটিটিউট’ নামক সংস্থা ‘নির্বাচনী একনায়কতন্ত্র’ বলে আখ্যা দেয়; যার মাঝে রয়েছে ভারত, ফিলিপাইন এবং কেনিয়া। চৌধুরীর কথায়, তালিকায় থাকা দেশগুলিই শুধু নয়, তালিকায় না থাকা দেশগুলিও তাকে অবাক করেছে। যেমন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি; যদিও একই রকমের কর্মকান্ড করার পরেও মোদি, দুতার্তে এবং বাউসুনারুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আবার পাকিস্তানকে কি কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সেটাও অজানা; তবে পাকিস্তান এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাইডেনের লজ্জাকে লাঘব করে। মার্কিন বন্ধু দেশ একদলীয় শাসনের অধীনে থাকা সিঙ্গাপুরকেও ডাকা হয়নি।

৯ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘ইসলামাবাদ কনক্লেভ ২০২১’ অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে বলেন যে, পাকিস্তান কোন রাজনৈতিক জোটে যোগ দিতে চায় না; বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে দূরত্ব কমাতে চেষ্টা করতে চায়। ইমরান খান আরও বলেন যে, পাকিস্তানের উচিৎ হবে এধরনের জোট তৈরি বন্ধ করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো; কারণ কারুরই উচিৎ নয় কোন জোটে যোগ দেয়া। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে ঠান্ডা যুদ্ধ সারা বিশ্বের জন্যে দুর্যোগ নিয়ে এসেছিল। এবং একারণেই পাকিস্তান চাইছে না আরেকটা নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে আটকা পড়তে। পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বলছে যে, ইমরান খানের এই কথাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানের যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পরের দিনই এসেছে। এই বৈঠকে চীনের প্রতিনিধিত্ব করতে বেইজিং থেকে কাউকে না ডেকে তাইওয়ানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়; যা পাকিস্তানকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। এই মুহুর্তে চীন হলো পাকিস্তানের সবচাইতে কাছের বন্ধু; আর রাশিয়ার সাথেও পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে।

 
বাইডেন যে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বন্ধুগুলির মাঝেই রয়েছে মোদির ভারত; যেখানে মানুষের উপাসনা করার অধিকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই কর্মকান্ডগুলিকে মেনে নিচ্ছে, কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত হলো মার্কিনীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। এখানে ভূরাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ব্যাপারেই ছিল না। এটা ছিল চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন একটা জোট তৈরির চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া মিলে যেমন ‘কোয়াড’ জোট গঠন করা হয়েছে চীনকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে, ঠিক তেমনি গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক ছিল ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেল’ বা বিশাল পরিসরে আরেকটা ‘কোয়াড’ গঠন করা। বাইডেন বলছেন যে, গণতন্ত্র হেরে যাচ্ছে চীন এবং রাশিয়ার জন্যে। কিন্তু তিনি যে ব্যাপারটা চেপে যাচ্ছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বন্ধুগুলির মাঝেই রয়েছে মোদির ভারত; যেখানে মানুষের উপাসনা করার অধিকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই কর্মকান্ডগুলিকে মেনে নিচ্ছে, কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত হলো মার্কিনীদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। এখানে ভূরাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

৪ঠা ডিসেম্বর চীনের ‘স্টেট কাউন্সিল’এর তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে বলা হয় যে, চীন একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে তাদের গণতন্ত্র কাজ করছে; অর্থাৎ তা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মতো অকার্যকর অবস্থায় নেই। মার্টিন গিলেনস এবং বেঞ্জামিন পেইজের দুই দশকের ১৮’শ মার্কিন আইনের উপর করা এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, সাধারণ জনগণের আইনের ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই। শুধুমাত্র স্বল্প সংখ্যক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদশালী ব্যক্তির দ্বারাই এই আইনগুলি তৈরি হয়েছে। অপরদিকে গত অক্টোবরে ‘পিউ রিসার্চ’এর প্রকাশ করা এক গবেষণায় বলা হয় যে, অর্ধেকের বেশি মার্কিনী গণতন্ত্রের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। আর ৮৫ শতাংশ জনগণ তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বা বড় রকমের পরিবর্তন চাইছে। ৬৬ শতাংশ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছে; আর ৭৬ শতাংশ মানুষ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তন চায়। শুধু মার্কিনীরাই নয়; একই গবেষণার অন্যান্য পশ্চিমা দেশের ফলাফলও প্রায় একই। ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের ফলাফলগুলিও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীনতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে ইতালি এবং স্পেনে যথাক্রমে ৮৯ শতাংশ এবং ৮৬ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুরোপুরি বা বড় রকমের পরিবর্তন চাইছে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক সমস্যার মাঝে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা। সন্মেলনে কারা যোগদান করবে, সেই হিসেব করতে গিয়ে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তুরস্ক এবং হাঙ্গেরিকে বাদ দিয়ে নাইজেরিয়া এবং ফিলিপাইনকে আমন্ত্রণ জানানোর সমালোচনা করা হয় প্রতিবেদনে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক পশ্চিমা চিন্তাবিদদের যেমন অস্বস্তির মাঝে ফেলেছে, তেমনি পশ্চিমা মিডিয়াগুলিকেও ফেলেছে ধোঁয়াশার মাঝে। অপরদিকে চীনা শ্বেতপত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জনগণের তৈরি আইনের সংজ্ঞা হিসেবে চীনারাও গণতান্ত্রিক দেশ। আর সেক্ষেত্রে জনগণের মাঝে কতজন মানুষ সেই আইন তৈরি করতে পারবে, সেব্যাপারে পশ্চিমারা চীনাদের থেকে খুব একটা এগিয়ে নেই মোটেই। প্রশ্নটা শুধু পশ্চিমা গণতন্ত্র বা চীনা গণতন্ত্রকে নিয়ে নয়; বরং খোদ গণতন্ত্রকে নিয়েই। দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেই বিশ্বব্যাপী জনগণ এমন কিছু রাজনীতিবিদের কথায় সায় দিচ্ছে, যারা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও বেশি দুর্বল করে ফেলছে। ‘ফ্রিডম হাউস’এর হিসেবে গত ১৫ বছরের মাঝে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংখ্যক দেশে জনগণের স্বাধীনতা পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রিত। আর ‘পিউ রিসার্চ’এর গবেষণা দেখিয়ে দিচ্ছে গণতান্ত্রিকতার উপর পশ্চিমা দেশগুলির জনগণের আস্থাহীনতাকে। পশ্চিমা দেশগুলিতেই যখন গণতন্ত্র মুমুর্ষু, তখন বাকি দুনিয়াতে গণতন্ত্রের তল্পিবাহক হবার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রের রয়েছে কি? গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার মতো শক্তি বাইডেনের কতটুকু রয়েছে? উত্তরটা যথেষ্টই কঠিন। কারণ গণতন্ত্রকে ‘লাইফ সাপোর্ট’এ রাখা হয়েছে; অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment