Friday 24 December 2021

কনকনে ঠান্ডার মাঝে আকাশচুম্বী জ্বালানির মূল্য ইইউএর লক্ষ্যহীনতাকেই তুলে ধরে

২৫শে ডিসেম্বর ২০২১

ইইউ এখন না পারছে জাতীয়তাবাদকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলিকে ঘুচতে; না পারছে পূর্ব ইউরোপের সীমান্তের সমস্যাগুলিকে সমাধান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। ব্রেক্সিট, করোনাভাইরাসের অব্যবস্থাপনা, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের পর নিজেদের অনৈক্য প্রসূত এই জ্বালানি সমস্যা ইইউএর লক্ষ্যগুলিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইইউ কি সমস্যার সমাধান করার জন্যে তৈরি হয়েছিল; নাকি নতুন সমস্যার জন্ম দেয়ার জন্যে?

 
ইউরোপের অনেক অঞ্চলেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাপমাত্রা শূণ্যের নিচে নেমে গেছে। এর মাঝেই চলছে মারাত্মক জ্বালানি সমস্যা। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জমে যাওয়া ঠান্ডার মাঝে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানির অকশনে গ্যাসের মূল্য এবছরের মাঝেই বেড়েছে ৬ গুণ! আর বিদ্যুতের অকশনের অবস্থাও খারাপ। জার্মানিতে বিদ্যুতের মূল্য উঠেছে প্রতি মেগাওয়াট আওয়ারে রেকর্ড ২’শ ৮৯ ডলার। ফ্রান্সেও ইতিহাসের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছে। ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস’এর হিসেবে ২২শে ডিসেম্বর ব্রিটেনে বিদ্যুতের বেইজলোড মূল্য ছিল প্রতি মেগাওয়াট আওয়ারএ প্রায় ৪’শ ৩৮ ডলার; যা ডিসেম্বর মাসের শুরুর তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। নেদারল্যান্ডসে বিদ্যুতের মূল্য ২১শে ডিসেম্বরে রেকর্ড ৪’শ ৮৭ ডলার ছোঁয়।

‘ব্লুমবার্গ’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাৎসরিক ছুটির মাসগুলির ঠিক আগেই করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ বেড়েছে ইউরোপে; যা কিনা মূদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়েছে। ট্রেডিং কোম্পানি ‘ট্রাফিগুরা গ্রুপ’এর প্রধান নির্বাহী জেরেমি উইয়ার নভেম্বরে সকলকে সাবধান করে বলেন যে, শীত বেশি পড়লে ইউরোপে লোড শেডিংএর কারণে ব্ল্যাকআউট হতে পারে। ফ্রান্সের বিদ্যুৎ কোম্পানি ‘ইলেকট্রিসিটে ডে ফ্রান্স এসএ’ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা তাদের আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধ করছে; যেগুলি কিনা ফ্রান্সের মোট আণবিক বিদ্যুতের ১০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে গ্যাসের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন পদ্ধতি খোলা থাকছে না। অথচ শীতকালের শুরুতে ইউরোপের গ্যাস স্টোরেজগুলিতে মাত্র ৬০ শতাংশ গ্যাসের মজুত রয়েছে। এর মাঝে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানিতে ইউরোপের সাথে চলছে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জ্বালানি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন যে, এশিয়াতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির চাহিদা কম থাকায় ইউরোপ হয়তো এলএনজি দিয়ে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা কিছুটা মেটাতে পারবে। তবে এশিয়া থেকে এলএনজির জাহাজগুলি ঘুরিয়ে ইউরোপে নিয়ে আসতে জানিয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এছাড়াও ইউরোপের বাতাসের গতি কম থাকার কারণে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকবে।

ইউরোপের জ্বালানি সমস্যা এখন একটা ব্যবস্থাগত সমস্যা বলে বলছেন ব্রিটেনের বাণিজ্য এসোসিয়েশনের প্রধান এমা পিঞ্চবেক। 'বিবিসি’র সাথে এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, যেসব কোম্পানি জ্বালানি সরবরাহ করে অথবা বেশি জ্বালানি ব্যবহার করে, তাদেরকে সরকারগুলি বলছে যে, তাদের কারখানাগুলি বন্ধ করে দিতে অথবা উৎপাদিত পণ্য যেন পরিবর্তন করে ফেলা হয়। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে জ্বালানির অতিরিক্ত মূল্য এবং এর ফলশ্রুতিতে চাহিদার উপর ভয়ঙ্কর প্রভাব। পিঞ্চবেকের ধারণা যে, সামনের বসন্তে ব্রিটেনে জ্বালানির খরচ ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। মহামারির মাঝে জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সাথে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মারাত্ম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। পুরো সমস্যাটাকে একটা ব্যবস্থাগত সমস্যা বলে ব্রিটিশ সরকারকে জ্বালানির উপর কর এবং ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করতে বলছেন তিনি।

অপরদিকে মার্কিন চিন্তাবিদেরা অনেকেই ইউরোপের সমস্যাকে রাশিয়া নির্ভরতার ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করছেন। ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর এসিসট্যান্ট প্রফেসর এমিলি হল্যান্ড ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই চাইছিল যে, ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাস থেকে সরে আসুক। কিন্তু এর পিছনে বড় সমস্যা হলো জ্বালানির ব্যাপারে ইউরোপিয়দের মাঝে মতানৈক্য। ইইউ যেখানে চাইছে যে, কয়লার ব্যবহার শূণ্য করে ফেলতে, সেখানে পোল্যান্ড চাইছে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার সময়সীমা বৃদ্ধি করতে। অপরদিকে জার্মানিতে এঙ্গেলা মার্কেলের প্রাক্তন সরকার এবং বর্তমান সোশাল ডেমোক্র্যাট সরকার আণবিক শক্তিকে জলবায়ু বান্ধব শক্তি হিসেবে মনে করছে না। অথচ ফ্রান্স এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি মনে করছে যে, আণবিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রীনহাউজ গ্যাসের নির্গমণ কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে মার্কিন আণবিক শক্তি কোম্পানিগুলি ইউরোপে রাশিয়ার কাছে হারানো ব্যবসা পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পেতে পারে। এমিলি হল্যান্ড মনে করছেন যে, ইউরোপের মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ হবে ইউক্রেন, মলদোভা এবং দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে কাজ করা; কারণ এই দেশগুলি রুশ হুমকির মাঝে রয়েছে।

প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ফেলো এলেন ওয়াল্ড। তিনি এক লেখায় ইউরোপের জ্বালানির উৎসকে বৈচিত্রপূর্ণ করার উপদেশ দিচ্ছেন। তার কথায় ইউরোপ একইসাথে যেমন চাইছে জলবায়ুকে রক্ষা করতে, ঠিক তেমনি চাইছে অর্থনীতিকে গতিশীল রেখে নিজেদের জীবনমান ঠিক রাখতে। এটা করতে গেলে ইউরোপকে কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে; যেমন বায়োফুয়েল হিসেবে পাম অয়েলের ব্যবহার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। এলেন ওয়াল্ড বলছেন যে, রেইপসীড এবং সয়াবিনের চাইতে পাম থেকে প্রতি হেক্টরে ৭ থেকে ১১ গুণ তেল উৎপাদন হয়। কিন্তু ইউরোপের জলবায়ু পাম অয়েলের জন্যে উপযুক্ত নয়। ইইউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাম অয়েলের আমদানি বন্ধ করে নিজস্ব বায়োফুয়েলের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। অর্থাৎ নিজেদের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গিয়ে জলবায়ুর জন্যে অপেক্ষাকৃত খারাপ জিনিসটাই ইইউকে বেছে নিতে হচ্ছে।

নিজের সাথেই যুদ্ধরত ইউরোপ। বিশ্লেষকেরা যে সমস্যাগুলি বলছেন, সেগুলি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগত সমস্যা। জনগণের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানিকে অকশনে কেনাবেচার ব্যবস্থাটা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা ইউরোপের ইতিহাসের সবচাইতে মারাত্মক জ্বালানি সমস্যাই দেখিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে ইউরোপ এখনও কয়লা, গ্যাস এবং আণবিক শক্তির ব্যবহারের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে একমত নয়। কনকনে ঠান্ডার মাঝে ইউরোপের মতানৈন্যকে ভূরাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। ইইউ এখন না পারছে জাতীয়তাবাদকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বগুলিকে ঘুচতে; না পারছে পূর্ব ইউরোপের সীমান্তের সমস্যাগুলিকে সমাধান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। ব্রেক্সিট, করোনাভাইরাসের অব্যবস্থাপনা, ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের পর নিজেদের অনৈক্য প্রসূত এই জ্বালানি সমস্যা ইইউএর লক্ষ্যগুলিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইইউ কি সমস্যার সমাধান করার জন্যে তৈরি হয়েছিল; নাকি নতুন সমস্যার জন্ম দেয়ার জন্যে?

No comments:

Post a Comment