Sunday 3 May 2020

করোনা পরিস্থিতিতেও অস্ট্রেলিয়ার শিপইয়ার্ডগুলি ব্যস্ত কেন?

৪ঠা মে ২০২০
   
এপ্রিল ২০২০; করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মাঝেও অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জন্যে ‘আরাফুরা-ক্লাস’এর অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলের কীল লেইং। এই জাহাজগুলি অস্ট্রেলিয়ার ৮০ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজ তৈরির পরিকল্পনার অংশ। জাহাজগুলি অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকে নতুন ধরনের সক্ষমতা দেবে; যা কিনা দেশটার নিরাপত্তা চিন্তাকেই প্রতিফলিত করে। দক্ষিণ চীন সাগর এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলায় এই জাহাজগুলি সমমনা দেশের জাহাজগুলির সাথে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর ২৭শে মার্চ ঘোষণা দেয় যে, রয়াল অস্ট্রেলিয়ান নেভির জন্যে ১২টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলের তৃতীয়টার কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়টার কাজ শুরু হয় ৯ই এপ্রিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, ২০২২ সালে এই জাহাজগুলির প্রথমটা পাবার সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়া নতুন ধরনের এক সক্ষমতা পেতে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ৮০ মিটার লম্বা ১৬’শ টনের এই জাহাজগুলি জার্মান কোম্পানি ‘লুরসেন’এর ডিজাইনে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ‘এএসসি’ শিপইয়ার্ড এবং পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ‘সিভমেক’ শিপইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে। ‘লুরসেন’ শুধু জাহাজই তৈরি করছে না, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় শিপইয়ার্ডটাও তারা তৈরি করছে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, এই জাহাজগুলি বিভিন্ন মিশন প্যাকেজ বহন করার মাধ্যমে কয়েক ধরনের বিশেষায়িত কাজ করতে সক্ষম হবে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ‘এএসসি’ শিপইয়ার্ডকে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ব্রিটিশ এরোস্পেস সিস্টেমস’এর কাছে বিক্রি করে দেয় আরেকটা বড় প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই শিপইয়ার্ডে তৈরি হতে যাচ্ছে ৯টা ‘হান্টার-ক্লাস’ ফ্রিগেট, যা ‘টাইপ-২৬’ নামে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জন্যে ৮টা এবং ‘রয়াল কানাডিয়ান নেভি’র জন্যে ১৫টা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে এই জাহাজের ডিজাইন এবং প্রোটোটাইপ তৈরির কাজ চলছে। প্রথম জাহাজটার কাজ শুরু হবে ২০২২ সালে। ২৬ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে; যার মাঝে ১ হাজার গ্র্যাজুয়েট কর্মী থাকবে। এই দুই প্রকল্প ছাড়াও ৫০ বিলিয়ন ডলারের আরেক প্রকল্পের অধীনে তৈরি হচ্ছে ১২টা ‘এটাক-ক্লাস’ সাবমেরিন। ফরাসী কোম্পানি ‘নেভাল গ্রুপ’এর ডিজাইনে এই সাবমেরিনগুলিও তৈরি হবে অস্ট্রেলিয়াতে। বর্তমানে এর ডিজাইনের কাজ চলছে ফ্রান্সে। করোনাভাইরাসের লকডাউনের মাঝেও অস্ট্রেলিয়ার শিপইয়ার্ডগুলিতে কাজ চলছে সমানে। বাজেটেরও কোন ঘাটতি নেই। কেন এতগুলি জাহাজ তৈরি করছে তারা? কি ধরনের সক্ষমতার কথাইবা বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী? একসাথে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ প্রকল্পগুলির নেপথ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা নীতি।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা নীতি

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ‘ডিফেন্স হোয়াইট পেপার’ নামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে; যেখানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামনের দিনগুলিতে প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। এতে ২০২৫-২৬ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাজেট দাঁড়াবে প্রায় ৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৩২ বিলিয়ন। জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার প্রত্যয় ব্যক্ত করার সাথে সাথে নৌবাহিনীর শক্তিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বলেন যে, যেহেতু অস্ট্রেলিয়া একটা দ্বীপ দেশ, তাই তার একটা শক্তিশালী নৌবাহিনী থাকা বাধ্যতামূলক। বর্তমানে নৌবাহিনীর ‘কলিন্স-ক্লাস’এর ৬টা সাবমেরিনকে প্রতিস্থাপন করে ‘এটাক-ক্লাস’এর ১২টা সাবমেরিন কেনার কথা বলা হয়, যাতে খরচ হবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ৮টা ‘এনজাক-ক্লাস’এর ফ্রিগেটকে প্রতিস্থাপন করতে ৯টা নতুন ফ্রিগেট তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়াও ১২টা নতুন অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল, ৭টা ‘পি-৮এ’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান, ৭২টা ‘এফ-৩৫এ’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান এবং ১২টা ‘ইএ-১৮জি গ্রাউলার’ ইলেকট্রনিক এটাক বিমান ক্রয় করার কথা বলা হয়।

‘হোয়াইট পেপার’এ মূলতঃ যে চ্যালেঞ্জগুলির কথা বলা হয়, সেগুলি হলো, প্রথমতঃ চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব; দ্বিতীয়তঃ জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন দেশের মাঝে প্রতিযোগিতার কারণে আন্তর্জাতিক আইনের উপরে ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক ব্যবস্থার দুর্বল হওয়া; তৃতীয়তঃ সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি; চতুর্থতঃ সম্পদের অসম বন্টন, সামাজিক অসঙ্গতি ও জলবায়ুগত কারণে অত্র অঞ্চলের কিছু দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে; পঞ্চমতঃ অনেকগুলি দেশের সমরশক্তির সক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধি; আর ষষ্ঠতঃ সাইবারস্পেসে হামলার আশংকা বৃদ্ধি। অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ভূখন্ডে আরেকটা দেশের সামরিক হামলার আশংকা না থাকলেও অন্য কোন স্থানে অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ হুমকির মাঝে পড়লে সেখানে হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়। বৈশ্বিক শক্তি অনেকগুলি দেশের হাতে ছড়িয়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সমুদ্রসীমা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মাঝে প্রতিযোগিতা উত্তেজনার কারণ হতে পারে; এবং সকলেই সমান্তরালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মাঝে দ্বন্দ্ব সামনের দিনগুলিতে নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে বলে প্রতিবেদনটাতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয় যে, দুই দশকের মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সারা দুনিয়ার অর্ধেক সাবমেরিন অপারেট করবে; আর এই অঞ্চলের দেশগুলির হাতে থাকবে দুনিয়ার অর্ধেক আধুনিক যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা না থাকলেও পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, সাইবারস্পেস এবং মহাকাশে এই দেশগুলির দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাবে বলে বলা হয়।

‘হোয়াইট পেপার’এ লক্ষ্য হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রের নিরাপত্তায় অংশ নেয়ার কথা বলা হয়। একইসাথে পপুয়া নিউ গিনি, তিমর-লেস্তে এবং প্রশান্ত মহাসাগরী দ্বীপ দেশগুলির নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রধান নিরাপত্তা সহযোগী হতে চায়। আরেকটা লক্ষ্য হিসেবে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক আইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতি কোন হুমকি অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থবিরুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সাথে অস্ট্রেলিয়া একত্রে হস্তক্ষেপ করবে।

ঠিক এই ব্যাপারটাই দেখা যায় ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জন্যে অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয়ের প্রকল্পে। গত অগাস্টে ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা সচিব ডেলফিন লরেনজানা ঘোষণা দেন যে, অস্ট্রেলিয় সরকারের অর্থায়নে ৬টা প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয় করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার ‘অস্টাল’ কোম্পানির ফিলিপাইন শিপইয়ার্ডে এই জাহাজগুলি তৈরি হবে বলে বলা হয়। প্রায় ৫’শ ৭১ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে ফিলিপাইনের আপাততঃ কোন অর্থ বিনিয়োগ দরকার নেই। চীনকে মোকাবিলায় এই জাহাজগুলি নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ চীন সাগরে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজগুলি যেসকল দেশের নৌবাহিনীর সাথে কাজ করবে বলে বলা হচ্ছে, তার একটা হলো ফিলিপাইন।
  
এপ্রিল ২০২০; দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দিচ্ছে মার্কিন এম্ফিবিয়াস এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’, ক্রুজার ‘বাংকার হিল’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’; সাথে অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিগেট ‘পারামাত্তা’ (সর্ববামে)। প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ায় দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দেয়ার জন্যে মার্কিন সক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বদাই কাছে পেলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়াকে ভাবাবে। এমনই একটা পরিস্থিতি পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে; যা কিনা অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানাবে।

অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে কে কি ভাবছে?

অন্যদিকে চীন অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা চিন্তাকে নিজেদের স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং সরাসরিই বলেন যে, দক্ষিণ চীন সাগর এবং চীনের সামরিক শক্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাথা ঘামানোটা চীন ভালো চোখে দেখছে না। তিনি আশা করেন যে, বিভিন্ন দেশ অত্র এলাকায় সামরিক মহড়া এবং প্যাট্রোল দেয়া বন্ধ করবে এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা বন্ধ করবে। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা চিন্তার ব্যাপারে চীনের অসন্তোষ প্রকাশের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র ‘স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ডিফেন্স স্টাডিজ সেন্টার’এর জন ব্ল্যাক্সল্যান্ড বলেন যে, চীন যে এধরণের কথাই বলবে, তা জানাই ছিল। বরং অত্র অঞ্চলের সব দেশই চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত।

যুক্তরাষ্ট্রের থিংকট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো জন লী বলছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সাথে নিরাপত্তা সম্পর্কটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। একই ধরনের আদর্শিক লক্ষ্য থাকার কারণে উভয় দেশই একত্রে কাজ করবে। অত্র অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার নৌশক্তি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যাকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের পক্ষে রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানকে মার্কিন নেতৃত্বের অধীনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ার হিসেবে দেখতে। তিনি আরও বলছেন যে, যদি চীনের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে জাপানের শক্তি বৃদ্ধি হয়, তাহলে চীনাদের এই কৌশলকে অনেকেই ভুল বলে গণ্য করতে পারেন। আর এই শক্তিগুলির সামষ্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেই বেইজিংএর আগ্রাসী ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। তবে জন লীর চিন্তায় বেইজিংকে চাপে ফেলে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার জন্যে যে চেষ্টার কথা বলা হয়েছে, সেটা চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সাম্প্রতিককালে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে কাদাছোঁড়াছুড়ির ফলে এখনও অসফল।

তবে চীনকে মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রের উপরই নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। গত জুলাই মাসে লন্ডনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, এশিয়া-প্যাসিফিক এলাকায় ব্রিটেনকে সামরিকভাবে আরও বেশি যুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন যে, এটা সন্দেহাতীত যে, বর্তমানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কৌশলগত পরিস্থিতিতে সবচাইতে বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে চীনের ব্যাপক সামরিকীকরণ এবং চীনের সাথে আশেপাশের দেশগুলির বিরোধ দেখতে পাচ্ছে। চীন এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলছে। এমতাবস্থায় মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের সাথে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’ বা ‘এফপিডিএ’ ব্যবহার করে চীনের সামরিক উত্থানের হুমকি মোকাবিলা করার কথা বলেন রেইনল্ডস। তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজ মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান এবং সেখানে ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতিকে আরও বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান। একইসাথে এব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বিশ্বের খুব কম দু’টা দেশের মাঝেই ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো কাছাকাছি সম্পর্ক রয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়া একে অপরকে বিশ্বাস করে।

   
অস্ট্রেলিয়ার আশেপাশে প্রায় ১৪টার মতো ছোট দ্বীপ দেশকে অস্ট্রেলিয়া অর্থ এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে কৌশলগত; আর এর মূলে রয়েছে চীনের প্রভাব বিস্তারকে ঠেকানো। কার কতটুকু সহায়তা প্রয়োজন, সেই হিসেব করে কখনোই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৈদেশিক সহায়তার কূটনীতি

সামরিক বাজেটের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বৈদেশিক সহায়তা। গত বছরের জুনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সময় আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই প্রতিশ্রুত অর্থ ১০ বছরে খরচ করা হবে। সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষের এই দ্বীপপুঞ্জের জিডিপি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু গর আয় প্রায় ২ হাজার ৪’শ ডলার। ১০ বছরে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার দেশটার জন্যে খুব বেশি কিছু নয়। তবে গত ছয় বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অস্ট্রেলিয়ার মোট বৈদেশিক সহায়তার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার থিংকট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর জনাথন প্রাইক বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে কৌশলগত; আর এর মূলে রয়েছে চীনের প্রভাব বিস্তারকে ঠেকানো। কার কতটুকু সহায়তা প্রয়োজন, সেই হিসেব করে কখনোই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। একারণেই দেখা যাবে যে, অস্ট্রেলিয়া তার বেশিরভাগ সহায়তা দিচ্ছে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। এই এলাকাগুলিতেই অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব এবং গুরুত্ব সবচাইতে বেশি।

২০১৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দানের ঘোষণার মাধ্যমে চীন অস্ট্রেলিয়ার নিজের উঠানেই অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছে। ঐ একই বছর অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলের জন্যে মাত্র ৮’শ ১৫ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অর্থাৎ চীন অস্ট্রেলিয়ার চার গুণ সহায়তা দিতে চাইছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ছয় বছরে অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে; যেখানে চীন প্রায় সাত বছরে দিয়েছিল সোয়া ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ থেকে ২০১৬এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ফ্রান্স এখানে তাদের সহায়তা যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’ বলছে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে অস্ট্রেলিয়ার সহায়তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনতে পারেনি। কারণ অস্ট্রেলিয়া সহায়তা দিয়েছে এমন সব সেক্টরে, যা অস্ট্রেলিয়রা মনে করছে দেয়া উচিৎ; যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুশাসন। অন্যদিকে চীনারা এই ছোট দেশগুলিকে জিজ্ঞেস করছে যে, তাদের কোন সেক্টরে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর ফলাফল হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই চীনারা এসব দেশে বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার ঠিক উত্তরেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচাইতে বড় দ্বীপ পপুয়া নিউ গিনির কথা বলা যেতে পারে। ৮৬ লক্ষ মানুষের এই দেশের জিডিপি ২১ বিলিয়ন ডলার; মাথাপিছু গড় আয় আড়াই হাজার ডলার। তবে দেশটার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। চীন মূলতঃ পপুয়া নিউ গিনিতেই সবচাইতে বড় বিনিয়োগ করছে। ২০১৭ সালে সেখানে চীনারা ৮৫ মিলিয়ন ডলার খরচে রাস্তা উন্নয়নের কাজ শেষ করেছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া এ পর্যন্ত ২’শ ১৯ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং এইডসএর সংক্রমণ রোধে। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ সহায়তা হলো অনুদান; চীনাদের বেশিরভাগ ঋণ। আইএমএফএর হিসেবে এই অঞ্চলের ১৪টা দেশের মাঝে ৬টাই ঋণের অর্থ ফেরত দেয়ার যোগ্যতা প্রায় হারিয়েছে; আরও ৩টা দেশ যোগ্যতা হারাবার পথে রয়েছে। সুতরাং এই দেশগুলিকে দেয়া চীনা ঋণের কি হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে শ্রীলংকা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারার পর চীনারা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় সেটা উদাহরণ হিসেবেই সামনে আসছে।    
জুন ২০১৭; চীনা নৌবাহিনীর কয়েকটা যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশ ভানুয়াতু সফর। অস্ট্রেলিয়া তার আশেপাশের দ্বীপ দেশগুলিকে নিজের প্রভাবের অঞ্চল হিসেবে দেখে। একইসাথে অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলির কয়েকটা এই দ্বীপগুলির মাঝ দিয়ে যাবার কারণে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। চীনারা এই দ্বীপগুলিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করার অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের দ্বন্দ্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বীপগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন?

পপুয়াতে রয়েছে স্বর্ণ, তামা, নিকেল, গ্যাস, ইত্যাদি খণিজ সম্পদ। একারণে সেখানে বিনিয়োগ করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে চীনের জন্যে। আবার প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতে অনেক চীনারাও বসবাস করে; যারা বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করার জন্যে অথবা কাজের জন্যে সেখানে গিয়েছিল। তবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই অঞ্চলে চীনের আনাগোণা বৃদ্ধির আরও বড় কারণ হতে পারে কূটনীতি। বিশ্বের মাত্র ১৬টা দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে; এর মাঝে ৬টা দেশই হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। বহু বছর ধরেই চীনারা তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পপুয়া নিউ গিনি তাদের দেশে তাইওয়ানের প্রতিনিধির বিভিন্ন কূটনৈতিক অধিকার কেড়ে নেবার পর তাইওয়ান অভিযোগ করে যে, চীনা সরকারের চাপের কারণেই পপুয়া এটা করেছে। গত সেপ্টেম্বরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সরকার তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। চীন সলোমোনের সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী; আর তারা চীনা বিনিয়োগ থেকেও বঞ্চিত হতে চায় না। ডিসেম্বরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের রাজনীতিবিদদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলে যে, চীন এবং তাইওয়ান পাল্টাপাল্টি অবস্থানে থেকে তাদেরকে লক্ষ লক্ষ ডলার ঘুষ সেধেছে তাদের পক্ষে থাকার জন্যে।

তবে এই দ্বীপগুলি নিয়ে বিরোধের পিছনে আরেকটা কারণ হিসেবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৪টা দেশের পুরো জনসংখ্যা একটা চীনা শহরের জনসংখ্যার সমান হলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের ভোট এবং এই দেশগুলির ভোট সমান ওজনের। সেই হিসেবে এই দেশগুলি তাদের আকৃতির তুলনায় চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর বাইরেও এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়াবার পিছনেও চীনের আকাংক্ষা থাকতে পারে। ২০১৮ সালে ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলের কাছে ভানুয়াতু দ্বীপের সাথে চীনের স্থায়ী সামরিক ঘাঁটির ব্যাপারে কথা হচ্ছে; যা উভয় দেশই অস্বীকার করে। ২০১৮ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইকনমিক এন্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনারা সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরো এলাকায় চীনাদের নজরদারি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যাবে; আর তা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের জন্যে হুমকি হওয়া ছাড়াও অত্র অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের মাঝে তিনটাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে। চীনারা এই বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি না করলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই অস্ট্রেলিয়া হুমকির মাঝে পড়বে।

যা চিন্তা তা-ই কাজ। গত অগাস্টে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস আনুষ্ঠানিকভাবে পপুয়া নিউ গিনির প্রায় ৩’শ কিঃমিঃ উত্তরে মানাস দ্বীপের ‘লোমব্রুম’এ নতুন নৌঘাঁটির প্রথম ধাপের উদ্ভোধন করেন। পপুয়ার সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এই ঘাঁটি অস্ট্রেলিয় এবং মার্কিন নৌবাহিনী ব্যবহার করবে। লিন্ডা রেইনল্ডস বলেন যে, কৌশলগতভাবে এই ঘাঁটি সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; এখনও রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দ্বীপে জাপানের বড় আকারের সামরিক ঘাঁটি ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া এই ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয় সরকার ‘প্যাসিফিক ম্যারিটাইম সিকিউরিটি প্রোগ্রাম’এর আওতায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩টা দেশকে ২১টা ‘গার্ডিয়ান-ক্লাস’ প্যাট্রোল বোট অনুদান দিচ্ছে। এর আগে ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের আইনে সকল দেশকে উপকূল থেকে ২’শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’এর অধিকার দেয়ার পর ১৯৮৫ এবং ১৯৯৭ সালের মাঝে অস্ট্রেলিয় সরকার ১২টা দেশকে ২২টা ‘প্যাসিফিক-ক্লাস’ প্যাট্রোল বোট তৈরি করে দান করেছিল। সেই বোটগুলিকে প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যেই ৩’শ ৩৫ মিলিয়ন ডলার খরচে ৪০ মিটার লম্বা এই বোটগুলি তৈরি করছে অস্ট্রেলিয়ার ‘অস্টাল’ শিপইয়ার্ড। এই দ্বীপ দেশগুলি থেকে যাতে ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান দিয়ে সমুদ্রে টহল বৃদ্ধি করা যায়, সেই প্রচেষ্টাও রয়েছে এই প্রকল্পের মাঝে।
   
নভেম্বর ২০১৮; পপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবির উপকূলে ‘এপেক’ শীর্ষ বৈঠকের নিরাপত্তা দিচ্ছে রয়াল অস্ট্রেলিয়ান নেভির হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘এডেলেইড’। পপুয়াতে এই বৈঠকের মাঝ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের দড়ি টানাটানির কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়; যেখানে চীনারা চাইছিলো পোর্ট মোর্সবির উন্নয়নের চেহাড়া দেখাতে; আর অস্ট্রেলিয়া চাইছিলো দেখাতে যে, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সহায়তা ছাড়া অত্র অঞ্চলের দেশগুলি অসহায়।

২০১৮ সালের নভেম্বরে পপুয়া নিউ গিনির রাজধানী পোর্ট মোর্সবিতে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কোঅপারেশন’ বা ‘এপেক’ ফোরামের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সহ ২১টা দেশের শীর্ষ নেতারা যোগ দেন। প্রায় ১৫ হাজার গেস্টের থাকার সংকুলান না হওয়ায় বন্দরে ৩টা ক্রুজ লাইনার জাহাজ ভিড়িয়ে রাখা হয়। এই বৈঠকের নিরাপত্তার খাতিরে যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং স্পেশাল ফোর্সসহ প্রায় ৪ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। ফিলিপাইনের মিডিয়া ‘র‍্যাপলার’ বলছে যে, এই বৈঠকের নিরাপত্তার দায়িত্বের পুরোটাই নেয় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া দেড় হাজার সেনাসহ রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সের ‘এফএ-১৮ সুপার হর্নেট’ ফাইটার বিমান, ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘এডেলেইড’কে মোতায়েন করে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই নিরাপত্তা মিশনে অংশ নেয়। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা থিংকট্যাঙ্ক ‘অস্ট্রেলিয়া ডিফেন্স এসোসিয়েশন’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নেইল জেমস বলেন যে, পপুয়া নিউ গিনির মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যদি বিদেশী নিরাপত্তা বাহিনীকে নিজ দেশে আসতে দিতে না চায়, তাহলে তারা কখনোই ‘এপেক’এর মতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সক্ষম হবে না। এটা কৌশলগত এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও ভালো হবে না। তবে ‘এপেক’ বৈঠকের পিছনে অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও চীনের অবদানও ছিল। বৈঠকের আগে চীনাদের অর্থায়নে পোর্ট মোর্সবির চেহাড়ার বেশ পরিবর্তন সাধিত হয়। চীনা অর্থে রাস্তা ও কনভেনশন সেন্টারের উন্নয়ন করা হয়; গেস্টদের আনা নেয়ার জন্যে কেনা হয় বাস। অনেকেই প্রশ্ন করেন যে, দেশের বহু মানুষের যখন মৌলিক চাহিদাই পূর্ণ হচ্ছে না, তখন পপুয়ার মানুষের কাছে এরকম জাঁকজমকের অর্থ কতটুকু? পপুয়াতে এই বৈঠকের মাঝ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের দড়ি টানাটানির কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়; যেখানে চীনারা চাইছিলো পোর্ট মোর্সবির উন্নয়নের চেহাড়া দেখাতে; আর অস্ট্রেলিয়া চাইছিলো দেখাতে যে, অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সহায়তা ছাড়া অত্র অঞ্চলের দেশগুলি অসহায়।

অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বেশি বাণিজ্য এশিয়ার সাথে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে পূর্ব এশিয়ায় যাবার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দু’টা নৌপথ পপুয়া নিউ গিনি এবং সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যায়। নিউ গিনি দ্বীপ ও নিউ ব্রিটেন দ্বীপের মাঝে দিয়ে দক্ষিণ রুটটা; আর নিউ ব্রিটেন ও সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বোগেনভিল দ্বীপের মাঝ দিয়ে উত্তর রুটটা গিয়েছে। মানাস দ্বীপের নৌঘাঁটিটা এই দুই সমুদ্র বাণিজ্য রুটের ঠিক মাঝখানে হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বন্দরগুলি থেকে জাহাজ মূলতঃ ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা ও লম্বক প্রণালী এবং তিমর সাগর ও আরাফুরা সাগরের মাঝ দিয়ে যায়। এই পথগুলির উপর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া।

কিন্তু চীন থেকে অস্ট্রেলিয়া কতটুকু দূরে থাকবে?

অস্ট্রেলিয়ার ‘এসবিএস নিউজ’ জানাচ্ছে যে, চীন হলো অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য দেড়’শ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মোট বাণিজ্যের ২৩ শতাংশই চীনের সাথে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; যার সাথে বাণিজ্য ৬৪ বিলিয়ন ডলার; এরপর জাপানের সাথে ৬১ বিলিয়ন; দক্ষিণ কোরিয়া সাথে ৩২ বিলিয়ন; এবং ব্রিটেনের সাথে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। সিঙ্গাপুরের সাথেও বাণিজ্য যথেষ্ট। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্য পূর্ব এশিয়ার সাথেই। এখানকার বেশিরভাগ দেশের সাথেই অস্ট্রেলিয়ার রয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। ২০০৭ সালেই চীনারা অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে জাপানকে অতিক্রম করে। অপরদিক থেকে অস্ট্রেলিয়া চীনের জন্যে সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। অস্ট্রেলিয়ার ‘মনাশ ইউনিভার্সিটি’র বাণিজ্য বিশ্লেষক জিওভানি ডে লিয়েতো বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার সকল রপ্তানি পণ্যকে ‘পাথর এবং শস্য’এর মাঝে চিন্তা করা যায়। অর্থাৎ লৌহ আকরিক, কয়লা, স্বর্ণ এবং গ্যাস হলো খণিজ পণ্য; আর গরুর গোশত, পশম, তুলা, ছোলা, ডাল, গম, চিনি এবং মদ হলো কৃষিজ পণ্য। তবে অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হলো শিক্ষা। লাখো শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াতে আসছে ইংরেজি শিখতে এবং উচ্চশিক্ষার্থে। পর্যটনেও বড় আয় রয়েছে আস্ট্রেলিয়ার। অন্যদিকে আমদানির কথা চিন্তা করলে অস্ট্রেলিয়রা বিদেশ ভ্রমণেই খরচ করে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার; গাড়ি আমদানিতে যায় ২১ বিলিয়ন; পেট্রোলিয়াম পণ্যে ১৫ বিলিয়ন; টেলিকম যন্ত্রপাতিতে ১২ বিলিয়ন; আর পণ্য পরিবহণে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের জুনে চীনা নৌবাহিনীর তিনটা যুদ্ধজাহাজ অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দর ঘুরে আসে। অস্ট্রেলিয়ার জনগণের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলেও এটা নিশ্চিত যে চীনের সাথে কোনরূপ সহিংসতা অস্ট্রেলিয়ার বাস্তবতা নয়। তবে এটা পরিষ্কার যে, অস্ট্রেলিয়া অত্র অঞ্চলে তার নিরাপত্তাকে হাল্কাভাবে নিচ্ছে না। চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে সে পাশে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতেই সে জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগ করছে। এই জাহাজ শুধু নিজের নৌবাহিনীর জন্যেই নয়; দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশের দেশগুলির জন্যেও তৈরি করতে চাইছে তারা। একইসাথে অস্ট্রেলিয়া তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পপুয়া নিউগিনি এবং সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশগুলিকে আর্থিক এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিয়ে নিজের সাথে রাখতে চাইছে। চীন অস্ট্রেলিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত না চাইলেও প্রভাব বিস্তারের খেলায় অস্ট্রেলিয়া যেমন তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে শান্তি দেবে না, তেমনি চীনও অস্ট্রেলিয়ার উঠানে ছোট দ্বীপদেশগুলিকে বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে কিনে ফেলতে চাইবে। অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বদাই কাছে পেলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়াকে ভাবাবে। এমনই একটা পরিস্থিতি পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে; যা কিনা ব্রিটিশ কমোনওয়েলথের অন্তর্গত অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানাবে। ব্রিটেনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণে ব্রিটনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার এই সম্পর্ক আরও গভীর হবে। এটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হবে যে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ অস্ট্রেলিয়ার নামমাত্র রানীই শুধু নন।

2 comments: