খৃষ্টীয় নতুন বছরের প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, যা কিনা ২০১৭ সালের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্ভোধন করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলা তার মূল কথাগুলির ট্রান্সক্রিপ্ট এরূপ - “বেসরকারি খাতেরও যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। শুধু নিজেরা ব্যবসাবাণিজ্য করে... নিজেরা, মানে অর্থশালী সম্পদশালী হবেন আর বড়লোক হবেন – এই চিন্তা যেন না থাকে। মনে রাখতে হবে আপনাদেরকে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দিচ্ছি অর্থাৎ আমরা সরকার হিসেবে ফ্যাসিলেটরের দায়িত্ব পালন করছি। আপনাদের সেই সুযোগ নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণ করতে হবে, দেশের মানুষের উন্নতি করতে হবে।...... আজকে যারা শিল্প কল-কারখানা গড়ে তুলবেন তাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা রফতানিকে গুরুত্ব দেই। আবার এটাও ভাবতে হবে আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নিজের দেশের মানুষের ক্রমক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমার দেশের মানুষের যদি আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে, আমার দেশের মানুষের যদি ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, তা আপনার পণ্যও বাজার পাবে, তারাও মানুষ ভালো থাকবে, আপনার শিল্পের প্রসার ঘটবে।......... বাংলাদেশের মানুষ তারা এত যোগ্য, তাদের মেধা এত ভালো একটু সুযোগ সৃষ্টি করলে যেকোন কিছু তারা উতপাদন করতে পারবে – সেই সক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে। তাদের শুধু পথ দেখাতে হবে, ট্রেনিং দিতে হবে। এটাই... মানে, আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে আপনারা কয়েকটি দেশ ঘুরে ঐ কোন দেশ জিএসপি দিল না, স্যারদের কাছে ধর্ণা দিয়ে না বেড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়ান অন্য জায়গায়। অন্য মার্কেট খোঁজেন। ওরা আপনার পিছনে দৌড়াবে। কারণ আমাদের মতন... বাংলাদেশ যত পণ্য যত দ্রুত... মানে... সরবরাহ করতে পারবে, পৃথিবীর কোন দেশ তা পারবে না। কাজেই আমাদের ব্যবসায়ীদেরকেও সে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার খুঁজে ফেরা আর আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা প্রসারিত করা। ............ কোন দেশে কোন ধরণের জিনিসের চাহিদা, কি ধরনের চাহিদা – সেটাও একটি দেখা দরকার।...... একটা সেল আপনাদের থাকা উচিত যাদের কাজ হবে গবেষণা করা, পৃথিবী বিভিন্ন দেশে... কোন দেশে কোন ধরণের পণ্যের চাহিদা... কোন ধরণের... সেই ধরনের পণ্য উতপাদন করবার মতো যোগ্যতা আমাদের দেশের আছে কিনা। আমরা মানুষকে যেমন স্বপ্ন দেখাতে পারি, আবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে পারি, যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারি – সেই ক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের আছে”।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে কে কিভাবে প্রচার করলো
এখানে প্রধানমন্ত্রীর পুরো ভাষণ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই কথাগুলিকে মিডিয়া কিভাবে উপস্থাপন করেছে। মোটামুটি বেশিরভাগ মিডিয়াই প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি থেকে নিয়েছে মোটামুটিভাবে কয়েকটি বিষয় – “জিএসপির পিছনে না ছুটে নতুন বাজার খোঁজা”, দেশের “মানুষের সক্ষমতা কাজে লাগানো”, এবং বক্তৃতার শেষের দিকে “চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যকে প্রডাক্ট অব দ্যা ইয়ার ঘোষণা”। তবে একটি হেডলাইন করলেও মোটামুটি সবাই তাদের খবরে এই মূল তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছে। শুধুমাত্র হাতে গোণা কয়টি পত্রিকা ভিন্নভাবে এই খবরটি তুলে ধরেছে। একটি পত্রিকা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে গুরুত্ব দেয়নি, কারণ তারা সরকারী দলের বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত। এটা তেমন আলাদা কিছু নয়; কারণ তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টি মোটামুটি সবাই জানেন। তবে দেশের সবচাইতে প্রভাবশালী এবং বেশি বিক্রিত দৈনিকগুলির একটি যখন ঐ একই পদ্ধতি অনুসরণ করে, তখন খবরের ধরণটি নিয়েও কথা বলাটা জরুরি হয়ে যায়। প্রভাবশালী ঐ পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলিকে এভাবে ছাপানো হয় –
“শেখ হাসিনা বলেন, গত সাড়ে চার দশকে চামড়া খাতে রপ্তানি প্রায় ৭১ গুণ বেড়েছে। প্রথম সারির বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্য এখন বাংলাদেশেই প্রস্তুত হয়। এ পণ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য সংযোজন সম্ভব হয়েছে। সরকার শুধু পোশাকশিল্পের মধ্যে রপ্তানি আয়কে সীমাবদ্ধ না রেখে রপ্তানি পণ্যের বাজার বহুমুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে। তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য বেসরকারি খাতকে আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যাঁরা শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলবেন, তাঁদের ভাবতে হবে আমার নিজের দেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নিজের দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে।’ ব্যবসায়ীদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন দেশের কোন এলাকায় কোন পণ্যের চাহিদা বেশি এবং কোন পণ্যের উৎপাদন আমাদের দেশে সম্ভব, তা আপনাদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে সেই সব পণ্য আপনাদের উৎপাদন করে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, শুধু দেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আপনারা যেন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন, সেই সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) ও বিসিআইএম-ইসির (বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর) ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কারণে দেশের শিল্পায়ন ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার রপ্তানিতে উৎসাহদানের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে ২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে”।
প্রভাবশালী পত্রিকাটিতে যা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে
এই “সংবাদ”এ সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা ছিল একটি – “জিএসপি”, যা কিনা বেশিরভাগ মিডিয়াতেই হাইলাইট করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই পত্রিকাটি “জিএসপি” শব্দটি উচ্চারণ করলো না কেন? আবার, এই শব্দটি তো কোন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ও নয় যে বিরোধী দল ঘেঁষা পত্রিকাটিও এই শব্দটি তাদের রিপোর্ট থেকে বাদ দেবে। এই পত্রিকাগুলির এরকম “এডিটিং”-এর কারণ খুঁজতে হলে বুঝতে হবে যে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে “জিএসপি”-এর অর্থ কি? তিনি বলেছেন, “আপনারা কয়েকটি দেশ ঘুরে ঐ কোন দেশ জিএসপি দিল না, স্যারদের কাছে ধর্ণা দিয়ে না বেড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়ান অন্য জায়গায়”। এখানে তিনি এই “স্যারদের” বলতে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের বোঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের উপরে ব্যবসায়ীদের নির্ভরশীলতাকে বাড়াবার কথাও বলেছেন। কথাগুলিতে খুব পরিষ্কার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নের পিছনে পশ্চিমাদের অবদান রাখার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, সেটা এখন সবাইকে বুঝতে হবে। যে চামড়া পণ্যকে “প্রডাক্ট অব দ্যা ইয়ার” ঘোষণা করা হয়েছে, সেই চামড়া শিল্প বিরাট সমস্যায় পড়েছে ইতালির কারণে। ইতালি বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সবচাইতে বড় ক্রেতা। অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে ইতালি দেশটাই এখন দেউলিয়া হবার পথে। ইতালি দেউলিয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশেরও তা-ই হতে হবে – এমন কথার কোন যৌক্তিকতা নেই। সেসব দেশের উপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে সামনের দিনগুলিতে যে বিপদে ফেলতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চামড়া শিল্প। এই শিল্পের সাথে বাংলাদেশের যত মানুষ জড়িয়ে আছে, তাদের কর্মসংস্থানকে বাঁচাতে সরকারকে বড় কিছু করতে হবে ২০১৭ সালে।
এখানে উল্লেখ্য যে এই পত্রিকার এহেন “এডিটিং” কিন্তু নতুন নয়, নিয়মিত। উদাহরণস্বরূপ, তুর্কমেনিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর বিমানের জরুরী অবতরণের পরে এ নিয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বাক্যগুলি উচ্চারণ করেন, সেখান থেকে কৌশলে একটিমাত্র বাক্য বাদ দিয়ে সংবাদটি প্রচার করা হয়। তারা শুধু ছাপায় যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা একটা যান্ত্রিক দুর্যোগ ছিল। দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখন বেঁচে আছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ”। মাঝের কথাটি থাকলে অর্থ দাঁড়াতো যে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতভাবে জানেন না যে এটি মানবসৃষ্ট ছিল নাকি দুর্ঘটনা ছিল। তারা প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা মাত্র। অথচ এখন আমরা জানি যে বিমানের বেশ কয়েকজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এখন তারা খবর প্রচার করছে যে বিমানের “অনিয়ম” ঐ ঘটনার জন্যে দায়ী, যার পেছনে রয়েছে “রাষ্টের অদক্ষতা”। প্রধানমন্ত্রীর কথা তারা “সেন্সর” করে পার পেতে পারলে অনান্য অফিশিয়ালদের ক্ষেত্রে তো সমস্যা থাকে না। যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “থার্টি-ফার্স্ট” উদযাপনের সময়ে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ করতে গিয়ে একসময় তিন বাক্যে তিনটি ব্যাপারকে নাকচ করে দেন। ঐ পত্রিকাটি মাঝের বাক্যটিকে বাদ দিয়ে প্রথম এবং তৃতীয় বাক্যটিকে ছাপায়। মাঝের বাক্যটিতে সকল মদের বার বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঐ পত্রিকা যিনি পড়বেন, তিনি ঐ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে হয়তো অজ্ঞ থাকবেন।
এই রাষ্ট্র আর তাদের রাষ্ট্র
“জিএসপি” ইস্যুটাই যখন প্রধানমন্ত্রী তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাতে, তখন ঐ পত্রিকাগুলি কেন এটা বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর খবর প্রচার করলো? বছরের প্রথম দিনে এতবড় একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটিকে কেন “সেন্সর” করা হলো, যেখানে এই কথাগুলি পুরো ২০১৭ সালে রাষ্ট্রের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে? প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলিতে ২০১৭ সালের জন্যে “টার্গেট” দেয়া হয়েছে! এই “টার্গেট” রাষ্ট্রের “টার্গেট”। এখানে কোন সরকারী-বিরোধী দলের তো কথা নেই। তাহলে কেন এখানে এই বিভেদ টানা হয়েছে ঐ পত্রিকাগুলির মাধ্যমে? উত্তর সহজ – ঐ পত্রিকাগুলির “টার্গেট” ভিন্ন। এই রাষ্ট্রের “টার্গেট” তাদের “টার্গেট” নয়। রাষ্ট্র যখন সকল চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের অপততপরতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, তখন এই পত্রিকাগুলি এই রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ে আছে। রাষ্ট্র যখন নিজ অর্থে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন এরা নানা প্রচেষ্টায় মেতেছিল পুরো প্রজেক্ট বাতিল করতে। রাষ্ট্র যখন চেষ্টা করছে “হোলি আর্টিসান”এর মতো “স্টিং অপারেশন” থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে, তখন এরাই চেয়েছে “বাংলাদেশে আইসিস আছে” – এই কথা বলে এখানে এফবিআই-কে নিয়ে আসতে। রাষ্ট্র যখন সাবমেরিন কিনেছে, তখন এরাই সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ করাটা ঠিক হবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সাথে রয়েছে। এটা পরিষ্কার যে এই পত্রিকাগুলির জন্যে “রাষ্ট্র” আসলে এই রাষ্ট্র নয়, অন্য কোন রাষ্ট্র। “বিদেশী” এই পত্রিকাগুলি থেকে রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে যে সতর্ক থাকতে হবে, তা ২০১৭ সালের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তারা নিজেরাই বলে দিল।
কোন পত্রিক??!!!!
ReplyDelete