Friday, 22 July 2016

“স্টিং অপারেশন” – মার্কিনীদের জঙ্গী তৈরির পদ্ধতি

২২ জুলাই ২০১৬
মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই কিভাবে জোর করে সন্ত্রাসী তৈরি করছে, সেটা দেখলে বুঝে নেয়া যাবে আমাদের দেশে কিভাবে জঙ্গী তৈরি করা হচ্ছে। সেই প্রসেসটা, যার নাম স্টিং অপারেশন, পুরো আদ্যো-পান্ত ফাঁস হয়ে পড়ে ২০১৫ সালের শুরুতে। এফবিআই সন্ত্রাসী তৈরি করছে সেটা সবাই জানতো, কিন্তু ডকুমেট-সহ বমাল সমেত ধরা পড়াটা বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।





















বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গী তৈরি করে একটা “আদর্শিক ফোড়া” তৈরি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগেই লিখেছি। জঙ্গী তৈরির জন্যে অনেক দিন ধরে টোপ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল এক “Trojan Horse”. আর আমাদের দেশের মিডিয়া এবং কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী গুলশান ৭৯ নম্বরের ঘটনার পর থেকে আদর্শিক শক্তির ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের উপরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক চাপ প্রয়োগ করে পশ্চিমা “ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতা”-প্রসূত সমাধান promote করতেও মরিয়া হয়েছেন। আজকে কথা বলবো কিভাবে “ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতা”র নিয়ন্ত্রকেরা নিজেদের সভ্যতার দুর্বলতাগুলিকে সমাধানের পথ না খুঁজে বরং সেগুলিকে মুসলিম যুবকদের জঙ্গী তৈরির টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। কিভাবে ইসলামের নামকে নষ্ট করতে জোর করে নামমাত্র মুসলিম সেকুলার সমাজ থেকে জঙ্গী তৈরি করছে তারা নিজেদের দেশের মাটিতেই। তাদের দেশে প্রয়োগ করা ফাঁস হয়ে যাওয়া সেই প্রসেস জানা থাকলে আমাদের দেশে জঙ্গী বানানোর কারখানাগুলি বন্ধ করার একটা সুযোগ আমরা পেলেও পেতে পারি।

স্টিং অপারেশন (Sting Operation) আসলে কি?

মার্কিন অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডেরাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কিভাবে সন্ত্রাসী তৈরি করছে, তার মোটামুটি একটা বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় ২০১৫ সালের শুরুতে ফাঁস হয়ে যাওয়া কিছু নথি থেকে। মার্কিন জনগণ এবং বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা চালানো একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘The Intercept’ এই নথিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। এফবিআই এই অপারেশনগুলিকে বলছে ‘স্টিং অপারেশন’ (Sting Operation)। এর মাধ্যমে মুসলিম পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করে তাদেরকে গ্রেপ্তার হবার ব্যবস্থা করা হয়। এফবিআই বলে যে এই অপারেশনগুলির মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হবার আগেই তারা ‘সন্ত্রাসী’ ধরে ফেলছে। কিন্তু ২০১৫-এর সেই ফাঁস হওয়া নথিগুলি তা সমর্থন করে না।

এই অপারেশনে মুসলিম দেশ থেকে আসা সেকুলার মূল্যবোধের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে তাদেরকে উগ্রবাদী হিসেবে তৈরি করা হয়। তাদের সামনে সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়কে তুলে ধরা হয়। মদ-জুয়া-বেশ্যাবৃত্তি-বিবাহ বিচ্ছেদ-ব্যাভিচার-সমকামিতা-র সেই সমাজে অবক্ষয় তুলে ধরা খুবই সহজ। মজার ব্যাপার হলো এফবিআই নিজের দেশের সামাজিক অবক্ষয়কে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। ইসলামকে উগ্রবাদী প্রমাণ করতে মার্কিন সরকার সকল কিছুই করতে পারে – এ অপারেশনের মাধ্যমে সেটিই বেরিয়ে আসে। সেই নথির ফাঁস হওয়া অবধি যুক্তরাষ্ট্রে ৫০৮ জনকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়; যার মাঝে ২৪৩ জনকে ধরার জন্যে এফবিআই লুকিয়ে থাকা নিজস্ব লোক ব্যবহার করে। আর ১৫৮ জনকে ধরা হয় স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে। এর মাঝে আবার ৪৯ জনকে এফবিআই-এর নিজস্ব লোকেরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হতে সরাসরি সাহায্য করে।

১৯৯২ সালে কসোভো থেকে চলে আসা মুসলিম পরিবারটি পুরোপুরি সেকুলার লাইসস্টাইলে চলছিল। তারপরেও সেই পরিবারের সন্তানকেই টার্গেট করে এফবিআই; কারণ moral দিক থেকে দুর্বল থাকে বলে সেকুলার সমাজের মানুষের ভিত নড়িয়ে ফেলা বেশ সহজ। এক্ষেত্রে নিজেদের সমাজের অনাচারকে সমাধান না করে বরং সেগুলিকেই টোপ হিসেবে মুসলিম জঙ্গী তৈরির কাজে ব্যবহার করে এফবিআই!


যেভাবে ফুসলিয়ে জঙ্গী বানায় এফবিআই

ইচ্ছাকৃতভাবেই এফবিআই শুধুমাত্র সেকুলার পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে, কারণ ইসলামিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা লোকেদের নতুন কোন মন্ত্রে দীক্ষা দেয়া অসম্ভব না হলেও অপেক্ষাকৃত কঠিন। যে ইসলামকে একেবারেই চেনে না, তাকেই বরং ভুল পথে নেয়াটা অপেক্ষাকৃত সহজ। পুরানো চিন্তা ঝেরে নতুন চিন্তায় নিয়ে আসাটা তেমন সহজ নয়। বুড়ো ঘোড়াকে নতুন জিনিস শেখানোটা একটু কঠিন। moral দিক থেকে দুর্বল থাকে বলে আর কোন ধরনের Intellecual Basis না থাকায় খুব সহজেই সেকুলার পরিবারের সদস্যদের বাগে নিয়ে আসা যায়। এভাবেই ১৯৯২ সালে কসোভো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া এক পরিবারকে টার্গেট করে তাদের সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে সন্ত্রাসী বানিয়ে ৪০ বছরের সাজা দেয়া হয়। সেই পরিবারের কেউ নামাজ পড়তো না, রোযা রাখতো না; এমনকি নিজেদের পরিবার যে রেস্টুরেন্ট চালাতো, সেখানে pork (শুকরের গোশত) পরিবেশন করতো। এই পরিবার থেকেই সেই ছেলেকে রিক্রুট করে লাল দাড়ি বিশিষ্ট এক তথাকথিত ধর্মান্তরিত মুসলিম-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকেই ছেলেটি পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে যায়। ওই লাল দাড়ির লোক কয়েকজনকে এফবিআই-এর কাছে ধরিয়ে দিয়ে এখন হাওয়া। কেউ কেউ নাকি শুনেছে সে নাকি সিরিয়া চলে গেছে। এরকম আরও ঘটনা আছে, যেখানে যুবকদের মাধা নষ্ট করা লোকগুলি এফবিআই গ্রেপ্তার তো করেইনি, বরং তাদের নিরুদ্দেশ হতে সাহায্য করেছে। এরা হয় কোথাও চলে যায়, বা মারা যায়, বা হারিয়ে যায় … একেবারে হলিউডের ড্রামা যাকে বলে আরকি।

কসোভোর ছেলেটিকে সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করতে সাহায্য করে এক এফবিআই এজেন্ট, যে কিনা অস্ত্র সরবরাহ করে। ছেলেটির কাছে টাকা না থাকায় তাকে অস্ত্র কেনার জন্যে চাকরির ব্যবস্থাও করা হয়। এক প্যালেস্টাইনি লোক এফবিআই-এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেলেটিকে চাকরি দেয়।


লাল দাড়ির সেই লোক ওই ছেলেটিকে নিয়ে যায় এক প্যালেস্টিনিয়ান লোকের কাছে, যে ছেলেটিকে চাকরি দেয়, কারণ ছেলেটির অস্ত্র কেনার কোন টাকা ছিল না। প্যালেস্টাইনি ভদ্রলোক টাকার সমস্যায় ছিলেন। এফবিআই তাকে টাকা দেয় ছেলেটিকে পারিশ্রমিক দেবার জন্যে। একইসাথে তিনি এফবিআই থেকে টাকা পান ছেলেটিকে অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যাবার জন্যে। পুরো ঘটনা ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড করা হয়েছিল আদালতের সামনে ছেলেটিকে জঙ্গী প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে – সকল ভিডিও, একেবারে এফবিআই-এর সদস্যদের নিজেদের মাঝের বেফাঁস কথা সহ সব ফাঁস হয়ে যায়; একেবারে পুরো ট্রান্সক্রিপ্ট সহ!! অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিল এফবিআই-এর নিজস্ব চর। এই অস্ত্র ব্যবসায়ীই ছেলেটিকে অস্ত্র কিভাবে চালাতে হবে সেসব প্রশিক্ষণ দেন এবং তার সুইসাইড নোট হিসেবে ভিডিওখানা রেকর্ড করেন।

স্টিং অপারেশনের শেষের দিকে কাহিনী। ছেলেটি সুইসাইড ভিডিওতে কথা বলছে। ভিডিওটি তৈরি করে দেয় ওই লোকটি যে কিনা অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। ছেলেটি জীবনে কোনদিন কোন অস্ত্র চালায়নি। ছেলেটিকে জঙ্গী বানাতে এফবিআই-এর যে কষ্ট হচ্ছিল, সেটা ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও-ভিডিও-ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে জানা যায়।


কাজেই একত্রিত করলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো – লাল দাড়ির এক লোক তাকে উগ্র বানিয়েছিল; এরপর প্যালেস্টাইনি লোক টাকার লোভে তাকে চাকুরি দেয় এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যায়; আর শেষে অস্ত্র ব্যবসায়ী তাকে অস্ত্র বিক্রি করে, ট্রেনিং দেয় এবং শেষ সুইসাইড ভিডিওটি করে দেয়। স্টিং অপারেশনে জড়িত থাকা এই তিনটি লোকই ছিল এফবিআই-এর বেতনভুক। এখানে লাল দাড়ির লোকটি ছিল সবচাইতে বিপজ্জনক; এই লোকটি যথারীতি হাওয়া হয়ে যায়। লাল দাড়ির লোকটির সাথে ওই ছেলেটির কি করে পরিচিতি হয়েছিল, সেটা জানা যায় না। এখানে ওই ছেলেটির সেকুলার জীবনের সাথে জড়িত কেউ একজন ছিল। কারণ ওই লাল দাড়ি লোকটি সেকুলার লাইফের ধারেকাছেও থাকতো না। অর্থাৎ এফবিআই-এর আরেকজন ছেলেটিকে ওই লাল দাড়ির কাছে নিয়ে যায়, যার পরিচয় জানা যায় না।

এই সেই লাল দাড়ির লোক। এফবিআই-কে বেশ কিছু লোককে গ্রেপ্তার করতে সাহায্য করে লোকটি। কিন্তু একে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই লোকগুলিই ছেলে-মেয়েদের মাথায় বিষ ঢোকায় ইসলামের পথে না নিয়ে ভুল পথে নেয়ার জন্যে। এবং সময়মত গায়েব হয়ে যায়। তবে যে এজেন্টরা সেকুলার সমাজের ছেলে-মেয়েদের রিক্রুট করে এই লোকগুলির কাছে  নিয়ে যায়, তাদেরও খোঁজ পাওয়া যায় না। ওই লোকগুলি সেকুলার সমাজের মাঝেই ঘোরাঘুরি করে।


যেভাবে ইসলামের আদেশ বিকৃত করা হয়…

ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত কম জানার জন্যেই সমাজের ‘শিক্ষিত’ তরুণেরা ভুল পথে চলে যাচ্ছে। শুধু ইসলাম সম্পর্কে কেন, কোন কিছু সম্পর্কেই আজকের তরুণেরা কিছুই জানে না। ফেসবুক-গার্লফ্রেন্ড-সেলফি-শো অফ-শপিং-রেস্টুরেন্ট চেক-ইন-পার্সোনাল গ্রুমিং, ইত্যাদির মতো সস্তা ব্যাপার নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকার ফলে আজকের যুবসমাজ চিন্তাশক্তি হারিয়েছে। যে কিছুই জানে না, এমনকি চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়েছে, তাকে ভুল পথে নেয়াটা খুবই সহজ। চিন্তা এবং জ্ঞানের পথ না খুললে সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়; বরং সমস্যারগুলিকে ব্যবহার করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে ভুল পথে নেয়া যেতে পারে। এভাবেই সমাজের অনাচার নিয়ে কথা বলে এই ছেলে-মেয়েদেরকে লাইনে নিয়ে আসা হয় ঠিকই, কিন্তু এর পরে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি ছেড়ে জঙ্গী পদ্ধতি নেয় কি করে? সেটা বুঝতে হলে ইসলামের কিছু আদেশের দিকে তাকাতে হবে, যেগুলি রিক্রুট ট্রেনিং-এর সময়ে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হয়। যেমন, ইসলামের কিছু আদেশ আমরা উল্লেখ করতে পারি, যেগুলিকে সরাসরি ভঙ্গ করা হচ্ছে তথাকথিত “জিহাদী”দের দ্বারা।

প্রথমতঃ রাসুল (সঃ) কখন জিহাদ করেছেন?

রাসুল (সাঃ) যখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তখন ইসলাম প্রচারের কারণে তাঁর এবং তাঁর সাহাবাদের উপরে নির্মম অত্যাচার করা হয়। সুমাইয়া (রাঃ)-কে হত্যা করা হয় (তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ)। উমর (রাঃ) ছিলেন একজন বিখ্যাত যোদ্ধা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পরে রাসুল (সাঃ) তো মক্কায় civil war-এর জন্ম দেয়ার চেষ্টা করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তার সাহাবাদের কাউকে প্রতিহিংসার ছলে একটা পাথরও ছুঁড়তে দেননি। বিলাল (রাঃ)-এর বুকে উপরে পাথর চড়িয়ে দেবার পরেও তিনি আবু জেহেল-এর দিকে একটা নুড়িও ছোঁড়েননি। কারণ রাসুল (সাঃ) সেই নির্দেশ তখন দেননি। অথচ রাসুল (সাঃ) বেশ কতগুলি যুদ্ধে নিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ব্যাপারটা স্ববিরোধী মনে হয় না? এটা স্ববিরোধী মনে হবে তখনই যখন কেউ ইসলামের কিছুটা নেবে, আর বাকিটা নেবে না। উপরে বর্ণিত এফবিআই-এর কাহিনীতে মাথা নষ্ট করার জন্যে ঠিক সেই কাজটিই করা হয়েছে – বিকৃত করে ইসলামকে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) যুদ্ধ করেছেন মদিনায় হিযরত করে সেখানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর; মক্কায় থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর সাহাবাদেরকে কোন ধরনের violence-এ জড়াতে দেননি। এই পদ্ধতি অনসরণ করার কারণ হলো রাসুল (সাঃ) মক্কায় থাকা অবস্থায় আল্লাহর কাছ থেকে violence-এ জড়াতে নির্দেশিত হননি। কোন মাক্কী সূরায় যুদ্ধ বা জিহাদের কথা নেই; সকল জিহাদের কথা বলা হয়েছে মাদানী সূরাতে, অর্থাৎ মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে। মনে রাখতে হবে যে আমরা এখন কুরআনকে একত্রে পাই; আর তখন কুরআনের আয়াত নাযিল হচ্ছিল প্রতিদিন। কাজেই কোন আয়াত কখন কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল, সেটা না জেনে ইসলাম বোঝার চেষ্টা করা যাবে না। সেটা করতে গেলে ইসলামকে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হবে। কোন কারণ ছাড়া ইসলামে কোন চিন্তার দেয়া হয়নি; আর কোন আদেশ ছাড়া কোন চিন্তাও ইসলামে দেয়া হয়নি। আর কারণ আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সাঃ) আমাদের বলে দিলেও অনেক কারণ আবার বলেনও নাই; তাই আমাদের সসীম বুদ্ধি দিয়ে সেগুলি বোঝার ক্ষমতাও আমাদের নাই।

ইসলামের সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী দ্বারা। মক্কায় বসে বসে চুপিসারে ট্রেনিং নিয়ে একা একা কেউ জিহাদ করেনি; চোরাগুপ্তা হামলা করেনি সাধারণ মানুষের উপর। রাসুল (সাঃ)-এর পরে যতজন খলিফা এসেছেন, তাঁরাও তাঁকেই (সাঃ) অনুসরণ করেছেন। কেউ যদি গেরিলা যুদ্ধের কথা বলেন, সেটাও রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট না হলে করা হয়নি। মোট কথা রাষ্ট্র ছাড়া ইসলামে কোন জিহাদের নজির নেই। ওযু ছাড়া যেমন নামায পড়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি, রাষ্ট্র ছাড়াও জিহাদ করা সম্ভব নয়! তাহলে জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার থিউরি এরা কোত্থেকে নিয়ে আসছেন?

তিনি তো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিভাবে করতে হবে সেটা কাজে কর্মেই দেখিয়ে দিয়েছেন। কুরআনে কোথাও তো লেখা নেই কিভাবে নামায পড়তে হবে? তাহলে মুসলিমরা নামায কিভাবে পড়েন? সেভাবেই পড়েন যেভাবে রাসুল (সাঃ) দেখিয়েছেন। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) যেভাবে দেখিয়েছেন, সেভাবে ছাড়া অন্য কোনভাবে নামায পড়া যাবে না। আমি ইচ্ছে করলেই অতি ভক্তি দেখিয়ে তিন-চারটা অতিরিক্ত সিজদা ঠুকে দিতে পারবা না। তাহলে তাঁর দেখানো পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে কেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাবো অথবা যুদ্ধ করতে যাবো? যেটা রাসুল (সঃ) নিজে করেননি, সেটা এরা কার নির্দেশে করছে? যদি আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-এর নির্দেশ তাদের পছন্দ না হয়, তাহলে একেবারে গোড়ায় গলদ রয়েছে বলতেই হবে।

দ্বিতীয়তঃ কার কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় না?

“রাসুল (সাঃ)-এর কোন এক যুদ্ধে একজন স্ত্রীলোককে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল। তখন রাসুল (সাঃ) মহিলা ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করে দিলেন”। (মুসলিম)

তাহলে এই জিহাদীরা যে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে, সেই আদেশ তারা কোন নবীর কাছ থেকে পেয়েছে, মুহম্মদ (সাঃ), নাকি অন্য কাউকে নবী বানিয়েছে তারা? কোন কিতাব তারা অনুসরণ করছে, কুরআন, নাকি অন্য কিছু? যদি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এবং আল্লাহর কালাম এরা না মানে, তাহলে প্রশ্ন করতেই হবে যে যারা এই থিউরি আবিষ্কার করেছে, এদের প্রভু আসলে কে?

তৃতীয়তঃ অমুসলিমদেরকে গণহারে মেরে ফেলার নির্দেশ কে তৈরি করলো??

মক্কা বিজয়ের পরে মুহম্মদ (সাঃ) কি মক্কার সকল অমুসলিম অধিবাসীকে মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছিলেন? এরকম হুকুম কি অন্য কোন একটি এলাকার জন্যে কোনকালেও দেয়া হয়েছিল? ইসলাম অমুসলিমদেরকে প্রতিরক্ষা দেবার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করেছে; আল্লাহু আকবার বলে কতল করে ফেলেনি। ১১৮৭ সাল থেকে ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৩১ বছর (মুহম্মদ(সঃ)-এর অনেক পরে) একনাগারে জেরুজালেম মুসলিমদের অধীনে ছিল। বহু ইহুদী সেখানে বাস করতো মুসলিম শাসনের অধীনে; কোন সমস্যা তো হয় নাই। রাসুল (সাঃ) আরবের অমুসলিমদের মেরে ফেলেননি, কারণ সবাইকে মেরে ফেললে ইসলাম কার মধ্যে প্রচার করবে? ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষই ত্রয়োদশ শতকের শুরু পর্যন্ত অমুসলিম ছিল। ১২০৬ সালে ইসলাম ভারতের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামের প্রচার সহজ হয়ে যায়। তখন মুসলিম শাসকরা অমুসলিমদের মেরে ফেলেননি, বরং তারা শুধু অমুসলিমদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর মুসলিম হোক আর অমুসলিমই হোক সকলেই মুসলিম শাসনের অধীনে প্রতিরক্ষা পেয়েছে। কারণ এটা আল্লাহর নির্দেশ।

“আর মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় পার্থনা করে, তবে তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। এটি এজন্যে যে এরা জ্ঞান রাখে না”। [সূরা তাউবা, আয়াত ৬]

তাহলে এই “কাফের হত্যা”র থিউরি কোত্থেকে এলো? যেখানে কুরআনে বলা হয়েছে কাফেরের জন্যে ইসলামকে বুঝতে পারাটা সহজ করে দেবার জন্যে, সেখানে ইসলামের নামে কাফের মেরে ফেলার কথা বলাটা ইসলামকে কলুষিত করার অপচেষ্টা ছাড়া কি বলা যায়?

স্টিং অপারেশনের পুরোটাই যে ফাঁস হতে যেতে পারে, সেটা হয়তো এফবিআই চিন্তাও করতে পারেনি। মুসলিম ছেলে-মেয়েদের সন্ত্রাসী বানিয়ে ইসলামকে কলুষিত করার জন্যে যে ডকুমেন্ট তৈরি করা হচ্ছিল, সেগুলিই এখন মার্কিন অপকর্মের দলিল হয়ে মুসলিম দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যাচ্ছে! সত্য গোপন থাকে না...... 


বাকি বিশ্বে স্টিং অপারেশন

এফবিআই যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গী বানিয়েছে জিহাদী কর্মকান্ডে জড়িত হবার মুহুর্তে তাকে অস্ত্রসহ ধরে ফেলার জন্যে। তারা নিজেরাই এদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে যাতে অস্ত্রের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। কোন জিহাদীকেই তারা কর্মক্ষম অস্ত্র দেয়নি; অর্থাৎ অস্ত্রগুলি প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর ছিল। তারা চাননি নিজেদের দেশের মানুষ জঙ্গী বানাতে গিয়ে হত্যাকান্ডের শিকার হোক। কিন্তু অন্য দেশের ক্ষেত্রে এই রুলস তারা মানবেন – এই গ্যারান্টি তারা কাকে দিয়েছে? অন্য দেশে গিয়ে তো কোন এফবিআই আক্রমণের পূর্বমুহুর্তে বমালসমেত গ্রেপ্তার করে ফেলবে না তাকে। অথবা অকার্যকর অস্ত্রও দেবে না। অর্থাৎ সেখানে নিশ্চিতভাবে হতাহতের ঘটনা ঘটবে। আর কিছুক্ষেত্রে দেখা যাবে যে মার্কিন নাগরিক; অনেকদিন ধরে নাকি watch list-এ ছিল (আসলে স্টিং অপারেশনের অংশ), তবু তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি; ঠিক যে মুহুর্তে লোকটা টার্গেট দেশে ভ্রমণ করলো, তখনই সেই দেশের মাটিতে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। এর উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয় – সেই টার্গেট দেশের উপরে চাপ সৃষ্টির একটা পদ্ধতি এটা। বাংলাদেশের উপরে এর আগেও এটা প্রয়োগ করা হয়েছিল।

জঙ্গীদেরকে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জঙ্গী বানাবার এই পদ্ধতি কাজে পরিণত করতে পারে একমাত্র ইন্টেলিজেন্সের লোকজন। এরা জানে কিভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর চোখে ধূলা দেয়া যায়। এরা জানে কিভাবে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন দলিল নকল করতে হয়। অল্প অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কিভাবে অধিক হত্যাকান্ড চালানো যায়, সেটা জানে ইন্টেলিজেন্স এবং স্পেশাল ফোর্সের লোকজন। সাধারণত ইন্টেলিজেন্সের মাঝে যারা গোপন সামরিক ট্রেনিং দিয়ে থাকে, তারা স্পেশাল ফোর্স থেকেই ইন্টেলিজেন্সে আসে। এরা বিভিন্ন ভাষা এবং সংস্কৃতির এক্সপার্ট থাকে। এরা psychological warfare-এ ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়, যাতে যে কারুর উপরে কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে। * এদেরকেই ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে গোপনে মোতায়েন করা হয় এজেন্ট প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে, অথবা সবধরণের লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দেবার জন্যে। এরা বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষক তৈরি করে দেয়, যারা পরবর্তীতে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আসল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকে, কারণ জঙ্গীদের অতটুকুই প্রশিক্ষণই দেয়া হয়, যতটুকু ব্যবহার করে তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারবে না।

ইসলামকে খাঁচায় পোরা…

নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার অনাচারকে দূর না করে বরং অনাচারকে জিইয়ে রাখার নিমিত্তে সেই অনাচারকেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে তুলে আবার তাদের ভুল পথে প্রবাহিত করে আনাচারকে আরও কয়েক যুগ প্রতিষ্ঠিত করে রাখার যে অপচেষ্টা, সেটাকে কোন খারাপ শব্দ দ্বারাই আখ্যা দেয়া সম্ভব নয় যা অভিধানে পাওয়া যায়। প্রায় সবাই বুঝতে পারছেন যে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু সেই যুদ্ধ কেন এবং কিভাবে করা হচ্ছে, সেট তো বুঝতে হবে। পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ইসলামকে কিভাবে দেখছে? রবার্ট ক্যাপলান বলছেন যে রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার দেশগুলি ইসলামের কারণে রাশিয়ার প্রতি হুমকিস্বরূপ। হেনরি কিসিঞ্জার বলছেন যে ইসলামের কারণে বিশ্বের Balance of Power নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্যামুয়েল হান্টিংটন বলছেন যে সকল মুসলিম দেশের সামরিক শক্তির উত্থান আটকাতে হবে। জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যে মুসলিম বিশ্বে আরও নতুন নতুন ইরাক-আফগানিস্তান তৈরি করতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। এরা প্রত্যেকেই ইসলামকে কি শুধুই “ধর্ম” হিসেবে দেখছেন? একটা “ধর্ম” কি করে এধরণের Geopolitical Earthquake তৈরি করতে সক্ষম, যার কারণে পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে? পৃথিবীতে তো অন্য আরও অনেক ধর্মই আছে, কোন ধর্মকে নিয়েই তো পশ্চিমাদের কোন ভাবনা নেই!

আমরা ইসলামকে “ধর্ম” নামের খাঁচায় পুরে রাখতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। প্রশ্ন করি না যে এ কি এমন ধর্ম যেখানে টয়লেট করার নিয়ম থেকে শুরু করে যুদ্ধ করার পদ্ধতি, অর্থনীতি চালাবার পদ্ধতি, জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি, সমাজে অনাচার রোধ করার পদ্ধতি, চুরি করলে শাস্তির পদ্ধতি, বৈদেশিক নীতি কোন ভিত্তির উপরে থাকবে সেটার পদ্ধতি –সকল কিছু আছে? একবারও কি প্রশ্ন করা যায় না যে ইসলাম কি আসলে শুধুই ধর্ম? আমরা ইসলামকে বুঝেও না বোঝার ভান করলেও পশ্চিমারা কিন্তু ঠিকই বুঝেছে যে ইসলাম শুধু ধর্ম নয়। তারা বহু চিন্তাভাবনা করে যেসব নিয়মকানুন বের করেছেন, সেগুলির প্রত্যেকটিরই better version ইসলামের মধ্যেই রয়েছে। তারা ইসলামকে তাদের নিজেদের আদর্শের (Ideology) বিরোধী আদর্শ হিসেবে দেখেছে। তাই ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ইসলামকেই টার্গেট করেছে। তারা জানে যে দুনিয়া চালানোর পদ্ধতি হলো আদর্শিকভাবে দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেয়া। আর সেটা একমাত্র সম্ভব যদি কোন বিরোধী আদর্শ সেখানে এসে নিজেদের আদর্শকে চ্যালেঞ্জ না করে।

জঘন্য কার্যকলাপে জড়িত করে মুসলিম বিশ্বকে ব্যস্ত রাখার এই পরিকল্পনা বুঝতে পারার সময় আমাদের এসেছে। ‘বুঝি না’ বলে বোকা বনে ভুল পথে যাওয়া যাবে না। বোকামি কোন কৈফিয়ত হতে পারে না।



*পড়ুনঃ ‘মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ – সাম্প্রতিক দেশকাল, ২২শে অক্টোবর ২০১৫

No comments:

Post a Comment