স্বর্ণদ্বীপে সেনাবাহিনীর যে মহড়া অনুষ্ঠিত হলো, তা নিয়ে প্রশংসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো আর কেউ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। তবে একটি প্রশংসাকে ভবিষ্যতে আরও প্রশংসায় রূপ দিতে গঠনমূলক সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। স্বর্ণদ্বীপ এক্সারসাইজের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। বগুড়ার ১১ ডিভিশনের ৯৩ আর্মার্ড ব্রিগেড এই এক্সারসাইজে নেতৃত্ব দেয়। এধরণের একটি ইউনিটকে বঙ্গোপসাগরের মাঝের একটি দ্বীপে মোতায়েন করাটা একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে ঠিক যেভাবে এটি একটি অর্জন, ঠিক সেভাবেই এটি একটি চ্যালেঞ্জ, যা কিনা আলোচিত হয়নি। একটি বহিঃশত্রু কি করে এমন একটি দ্বীপ দখল করে নিল এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সেটা হতে দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। আবার শত্রুর হাতে থাকা একটি দ্বীপে কি করে নৌবাহিনী একটি উভচর অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীকে নামাতে সক্ষম হলো, সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। যদি শত্রুপক্ষ এতটাই শক্তিশালী হয় যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীকে এড়িয়ে তারা দ্বীপ দখল করে নিতে সক্ষম, তাহলে সেই একই শক্তিশালী শত্রুকে এড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সেই দ্বীপে কি করে নামানো গেল? আসল কথাটি হলো, সক্ষমতা কতটুকু হয়েছে তা নির্ভর করছে সত্যিকার সংঘাতের সময় সামরিক বাহিনী কতটুকু সফল হবে। স্বর্ণদ্বীপের মহড়া বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সত্যিকার কোন মেসেজ দিতে সক্ষম হচ্ছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
মহড়ায় দখলকৃত দ্বীপের উপর বিমান এবং ড্রোন সার্ভেইল্যান্সের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই সার্ভেইল্যান্স কি বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধনশীল দ্বীপমালার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম? যদি দ্বীপমালার নিরাপত্তা দেয়াটা কঠিন হয়ে থাকে, তবে গভীর সমুদ্রের সম্পদের নিরাপত্তা কি করে দেয়া সম্ভব? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অবঃ) খোরশেদ আলম চমৎকার একটি কথা বলেছেন গভীর সমুদ্রের সম্পদ সম্পর্কে। তিনি বলেছেন যে গভীর সমুদ্রের মূল্যবান এই সম্পদকে বিদেশীদের হাতে দেয়া যায় না, কারণ তারা এব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে তাঁর এই মূল্যবান মতামতকে সামনে এগিয়ে নিতে গেলে বলতে হবে যে বঙ্গোপসাগরের মাঝে যদি বাংলাদেশের কোন কোম্পানি গ্যাস রিগ বসাতে যায়, তাহলে নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী কি সেটার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম? বঙ্গোপসাগরের মাঝে মূল ভূখন্ড থেকে ৩০০ কিঃমিঃ দূরে এরকম একটি রিগের নিরাপত্তা দেয়াটা সেজায়গায় আরেকটি স্বর্ণদ্বীপের নিরাপত্তা দেয়ার শামিল হবে।
এডমিরাল খোরশেদ আলম আরও বলেছিলেন যে বাংলাদেশের সাবমেরিনগুলি গভীর সমুদ্র এক্সপ্লোর করার জন্যে দেশকে প্রস্তুত করবে। খুব ভালো কথা বলেছেন তিনি। তাহলে প্রশ্ন থাকবে যে ভবিষ্যতের আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরেশন কর্মকান্ডে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, সেটার নিরাপত্তা নৌবাহিনী দিতে সক্ষম কিনা? আরও ভেঙ্গে বলতে গেলে, গভীর সমুদ্রে এন্টি সাবমেরিন নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা নৌবাহিনীর কতটুকু আছে? এন্টি-সারফেস সক্ষমতাই বা কতটুকু আছে, যেখানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি হলো ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান? নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ সার্ভেইল্যান্স ক্ষমতাই বা কতটুকু, যখন ডরনিয়ার বিমানগুলির পাল্লা বঙ্গোপসাগরের বিশালতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল?
আলোচনার সারসংক্ষেপে বলা যায় যে বাংলাদেশের নৌশক্তি এবং বিমানশক্তির উপরে নির্ভর করছে যে ভবিষ্যতে স্বর্ণদ্বীপের মতো একটি দ্বীপকে সত্যিকার অর্থেই দখলমুক্ত রাখা সম্ভব কিনা। এই সক্ষমতাকে কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা যায় -
১। বাংলাদেশের নতুন আনা সাবমেরিনগুলি শত্রু সাবমেরিনের বিরুদ্ধে গভীর সমুদ্রের এক্সপ্লোরেশন কর্মকান্ডের নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট সক্ষম কিনা। যদি সক্ষম না হয়, তাহলে কত সময় পর্যন্ত নিরাপত্তার অভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ডীপ সি এক্সপ্লোরেশন বসে থাকবে?
২। শত্রু সাবমেরিনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর জাহাজগুলিকে গভীর সমুদ্রের এহেন কর্মকান্ডকে রক্ষা করতে যতটুকু Air Asset বহণ করতে হবে, সেটা নৌবাহিনীর বর্তমানে আছে কিনা। যদি না থাকে, তবে কি ধরনের জাহাজ এই দুর্বলতাকে দূর করতে পারে, সেটা খুঁজে দেখতে হবে।
৩। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী পুরো বঙ্গোপসাগরের উপরে কর্তৃত্ব করতে সক্ষম কিনা। যদি সক্ষম না হয়, তাহলে পুরো বঙ্গোপসাগরের উপর Combat Air Patrol (CAP) টহল দেবার মতো রেঞ্জের বিমান কেনাটা প্রক্রিয়ার মাঝে আছে কিনা।
৪। আর সবশেষে শত্রুর কোন ফ্লীট যাতে বাংলাদেশের উপকূলের কাছে বা দূরের কোন দ্বীপকে দখল করতে না আসে, সেরকম কোন Strategic Deterrent বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পেরেছে কিনা। যেটা পরিষ্কার তা হলো টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন সেটা করতে সক্ষম নয়। টাইপ-০৩৫জি-এর পরের সাবমেরিনগুলিতে টর্পেডো টিউব ছাড়া কোন মিসাইল ডেলিভারি সিস্টেম থাকবে কিনা, সেটা এধরনের একটি ডিটারেন্টের প্রশ্নের উত্তর হতে পারে।
উপসংহারে বলা যায় যে বাংলাদেশের নৌ এবং বিমান বাহিনীর গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তা দেবার সক্ষমতা এখনও অপ্রতুল। কিছু হার্ডওয়্যার ক্রয়ই এই সক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয়। এমতাবস্থায় উপকূলের কাছাকাছি মহড়া যতটাই দৃষ্টিনন্দন হোক না কেন, সেটা বহিঃশত্রুকে আক্রমণ করা থেকে দূরে রাখতে সক্ষম নয়। সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গভীর সাগরে অপারেশনের অভিজ্ঞতা বাড়াতে হবে, যা কিনা শুধুমাত্র Exclusive Economic Zone (EEZ) নামক চিন্তার মাঝে থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। সমুদ্রে Combat Air Patrol (CAP), আন্ডার-সী অপারেশন ও ডীপ-সী এক্সপ্লোরেশনের নিরাপত্তা, ডীপ-সী এয়ার অপারেশন, ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে বিশ্বের অনান্য সাগরগুলিতে নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে যৌথ মহড়াতে অংশ নেয়াতে হবে। আরব সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলকে এক্ষেত্রে অপশন হিসেবে দেখা যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment