২৫শে অগাস্ট ২০১৫
বিখ্যাত মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড থেয়ার মাহান (Alfred Thayer Mahan, 1840-1914) আজকাল আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তার থিওরিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিবর্তন করেছিল। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (Theodore Roosevelt, 1858-1919; president 1901-1909) দেশের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকা হয়ে উঠতে থাকে একটা বিশ্বশক্তি বা গ্লোবাল পাওয়ার। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রে টিকে থাকার মাঝেই যে আমেরিকার ভবিষ্যত শক্তি নিহিত, সেটা মাহান-ই প্রথম বলেন। যদিও মাহানের থিওরি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্ম দিয়েছিল এবং সেজন্য তিনি বেশ সমালোচিত ছিলেন কিছু মহলে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাহানের দেখিয়ে দেয়া পথ অনুসরণ করেই আমেরিকা দুনিয়ার রাজা বনেছে; যদিও সেটাতে সময় লেগেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটা যুদ্ধকে সংগঠিত হতে হয়েছে। যাই হোক, এখনকার দুনিয়াতে অনেক দেশ সমুদ্রের দিকে ঝুঁকছে বলেই এখন ২১শতকে এসে আবারও মাহানের কথাই মনে করতে হচ্ছে।
মাহানের পূণরুত্থান
মাহান নৌ-শক্তির সাথে অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক সত্যগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। তারই সমসাময়িক ব্রিটিশ জিওপলিটিশিয়ান হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Halford Mackinder, 1861-1947) এবং এদের কিছু পরের ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তাবিদ নিকোলাস স্পাইকম্যান (Nocholas J. Spykman, 1893-1943) জিওপলিটিক্স নামে নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দেন। এদেরকে অনুসরণ করে আরও অনেকেই চিন্তায় অগ্রসর হয়েছেন। এসব চিন্তাবিদদের বেশিরভাগই পশ্চিমা দেশের। অপশ্চিমা দেশগুলিতে এরকম জিওপলিটিক্স নিয়ে চিন্তা করতে পারার মতো মানুষ তেমন একটা নেই, তবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। কয়েকশ’ বছর পশ্চিমা শাসনে বিশ্ব শাসিত হবার ফলে চিন্তার ক্ষেত্রেও এরকম মেরুকরণ হয়েছে। তবে গত দুই-তিন দশকে অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে অগ্রগতি হবার কারণে অনেক দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে এগিয়ে এসেছে। ঠিক যেভাবে মাহান শতবর্ষ আগে মার্কিন নেতৃত্বকে বলেছিলেন যে বিশ্ব-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের মাঝেই মার্কিন বিশ্ব-নেতৃত্ব নিহিত, ঠিক একই পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। মাহান বলেছিলেন যে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের মাঝেই একটা দেশ উঠবে এবং একই সাথে তার নৌ-শক্তির বিকাশ ঘটবে, যা কিনা বিশ্বব্যাপী তার শক্তিকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে। মাহানের থিওরির কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের মাঝে ব্যাপক বাণিজ্য এবং নৌ-প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা কিনা দু’টি বিশ্বযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কয়েক দশক ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মাহানের থিওরি সবাই ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন আবার সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
ইউরোপ থেকে এশিয়া
পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ঔপনিবেশিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকেই করেছে বিশ্ববাণিজ্য-নির্ভর। যেসময় ইউরোপের মানুষ বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল, সেসময় যুদ্ধের কারণে বাণিজ্যের ক্ষতি হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা হতো তাদের, ঠিক যেমনটা ডাচদের ক্ষেত্রে হয়েছিল ইংল্যান্ডের সাথে আঠারো মাস যুদ্ধের পরে (১৬৫৩-৫৪)। ঔপনিবেশিক যুগের আগে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ বহিঃবাণিজ্যের উপরে তেমন একটা নির্ভরশীল ছিল না; অন্তঃত বাণিজ্য বন্ধ হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা ছিল না। ইউরোপিয়ানরা এসে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আজ এশিয়াতে বিশ্বের বিরাট এক জনগোষ্ঠীর বসবাসের কারণে দুনিয়ার বেশিরভাগ উতপাদন আবারও এশিয়াতে ফেরত এসেছে। তবে এবার এই উতপাদন এসেছে বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপে যেমন বাণিজ্য রক্ষার কাজকে জীবন রক্ষার সম-গুরুত্ব দেওয়া হতো, ঠিক একই অবস্থা এখন এশিয়াতে বিরাজ করতে যাচ্ছে। গত দুই-তিন দশকে এশিয়ার অনেক দেশের কাছে এই উতপাদন-রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যের কারণে বিপুল সম্পদ এসে পড়েছে। এই সম্পদ যেমন তাদের অর্থনীতিকে করেছে বেগবান, একইসাথে তাদের সমাজকে করেছে শিক্ষিত। এই অর্থ এবং শিক্ষা জন্ম দিয়েছে এক জাতীয়তাবাদের, যা কিনা তাদের বেঁচে থাকার জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বহিঃবাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই উদ্বিগ্নতা বা অস্থিরতা তাদেরকে জাতীয় নিরাপত্তার দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে। বাণিজ্যের বাজার, কাঁচামালের উতস এবং বাণিজ্যপথগুলিকে নিরাপদ রাখতে সবাই নৌ-শক্তিবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করছে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর অঞ্চল পার হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এই অবস্থাই বিরাজ করছে। ছোট ছোট অনেক দেশের হাতে এখন বেশ ক্ষমতা, তবে তারা সবাই ছোট ছোট দেশে বিভক্ত এবং রাজনৈতিক হিংসার কারণে এদের একত্রে কাজ করার সম্ভাবনা খুবই কম; তাই শক্তিধর দেশগুলি এটা ভেবে চিন্তিত নয়; বরং এক দেশকে অপরের বিরূদ্ধে লাগিয়ে রাখাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। আর এরকম আঞ্চলিক সমস্যা বৃহত শক্তিগুলিকে নাক গলানোর সুযোগ দেবে। তবে এরকম আঞ্চলিক সমস্যার সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে আবার সেটা শক্তিধর দেশগুলির পক্ষেও ম্যানেজ করাটা কঠিন হয়ে যাবে, যেমনটি হয়েছে আমেরিকার ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্তান-সহ আরও বিভিন্নস্থানে একযোগে জড়িয়ে গিয়ে।
চীন – পূর্ব থেকে পশ্চিমে
পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগর অবশ্য অন্য হিসেবে পড়েছে। এখানে চীনকে একপেশে করার জন্যে অনেকেই সাধারণ (কমন) কারণ খুঁজে পেয়েছে। তবে একটি চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে সকলের চিন্তাতেই নিজেদের বহিঃবাণিজ্য সবচাইতে বড় স্থান অধিকার করে রয়েছে। মাহানীয় থিওরিতে চীনের উত্থানকে ব্যাখ্যা করা যায় – চীনের স্থলসীমানা আজ আর বিপদসংকুল নয়, তাই চীন সমুদ্রে পাল তুলতে পারছে সহজেই। চীনের বাণিজ্যিক এবং নৌ-শক্তির উত্থানের কারণে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করছে। এই অবস্থাটাই উপচে পড়ে (ওভারফ্লো) ভারত মহাসাগরে এসে হাজির হয়েছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বহুদিনের সামরিক সরবরাহকারী চীন; আর পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় ডীপ-সী পোর্ট তৈরি করেছে চীন। এসব ব্যাপার ভারতের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে মিয়ানমারের উপকূলে চীন তেলবাহী জাহাজের জন্যে ডীপ-সী পোর্ট করেছে এবং সেই পোর্টের সাথে চীনের ভূখন্ড পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন করেছে গ্যাস পাইপলাইনের পাশাপাশি। ঠিক একইভাবে পাকিস্তানে গোয়াদর পোর্ট থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ইকনমিক করিডোর করা হচ্ছে বিশাল এক প্রজেক্টের মাধ্যমে। মিয়ানমারের পাইপলাইন এবং পাকিস্তানের ইকনমিক করিডোর সাফল্য পাবে যদি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে চীনা বাণিজ্য জাহাজ ভিড়তে পারে কোন সমস্যা ছাড়াই। কিন্তু এই নিষ্কন্টক ভ্রমণের নিশ্চয়তা তো চীনকে কেউ দেয়নি। কাজেই ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজ দেখা যাবে – এটা ধরেই নেয়া যায়। একইসাথে চীন চাইবে ভারত মহাসাগরে তার বন্ধুরাষ্ট্র তৈরি করতে, যাদের সাথে চীন শুধু বাণিজ্যই করবে না, তার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি দেখভাল করবে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে বেশ কয়েকটি দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে সরাসরি বিরোধ থাকলেও হিমালয় পর্বতের কারণে ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সাথে তাদের ততটা বিরোধ নেই, শুধু ভারত ছাড়া। যদিও মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটা বিবাদ রয়েছে, সেটা ভারতের সাথে চীনের বিরোধের কাছে নস্যি। চীনের প্রতিটি পদক্ষেপ ভারত বিরোধিতা করার চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে্র ডীপ-সী পোর্ট প্রজেক্টে চীনের আগ্রহ ঠিক একইভাবে ভারতের কাছে বিপজ্জনক ঠেকবে। এমনকি ভারতের আশেপাশের দেশে চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ভারতের কাছে হুমকিস্বরূপ দেখা যাওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ এতে ভারত শুধু তার পণ্যের বাজারই হারাবে না, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারাবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভারতের অখন্ডতার জন্যেও সেটা হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দিতে পারে। যেহেতু এটা জানা কথা যে সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তাকে আগলে রেখেছে, চীনের এরকম ‘এগ্রেসিভ এপ্রোচ’ ভারতের কাছে তাই ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা দেবে। ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দেশ নিজেদের সমুদ্র-বাণিজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিলে সেটাও ভারতের কাছে সন্দেহের উদ্রেক করবে। একজনের বাণিজ্যের নিরাপত্তা আরেকজনের বাণিজ্যের প্রতি হুমকি।
মধ্যপ্রাচ্য একাধারে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্যে জ্বালানী তেলের প্রধান উতস হওয়াতে ভারত মহাসাগরে চীনের যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা বাড়ার সাথেসাথে জাপান এবং কোরিয়ার নৌবাহিনীকেও দেখা যাবে শিগগিরই। আপাতত জাপান বঙ্গোপসাগরে ‘বিগ-বি’ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এই প্রজেক্টের পিছনে পিছনে জাপানী নৌবাহিনীও ভারত মহাসাগরে আসবে। মাহানের থিওরি এখানে একেবারে চমতকারভাবে ফলতে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি এরকম নৌশক্তির জন্ম দেবে - এটা আলফ্রেড মাহান চিন্তা করতে পেরেছিলেন বলেই তার থিওরি এখন আবার নতুন করে অনেকেই পড়া শুরু করেছেন।
ভারত – দুর্বল রাষ্ট্র?
ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকে আলাদাভাবে দেখলে যে বিষয়গুলি চোখে পড়বে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলের বৈচিত্র্য। এই উপকূলের সবচাইতে বড় স্থান জুড়ে রয়েছে ভারত। তবে উলটা ত্রিভুজ আকৃতির হবার কারণে ভারতের নৌবহরকে প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করতে হচ্ছে। কাজেই বিশাল শক্তিধর নৌবাহিনী হওয়া সত্তেও ভারতের নৌবহর প্রকৃতপক্ষে আলাদা দু’টি ফ্লীট হিসেবে অপারেট করবে; এদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। এই অবস্থান ভারতের নৌবাহিনীর জন্যে বিরাট দুর্বল একটা দিক। আবার তাদের উপকূলের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে কোলকাতা ছাড়া বাকি বন্দরগুলি নদীপথে দেশের গভীরের সাথে সংযুক্ত নয়। এটা একদিকে যেমন অধিকতর ব্যয়বহুল রেলপথ এবং স্থলপথের উপরে ভারতকে নির্ভরশীল হতে বাধ্য কাছে, তেমনি আবার নদীপথের মুখের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব থেকে তাদের মুক্ত করেছে। বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দরগুলি নদীর মুখে না হবার কারণে ভারত অভ্যন্তরীণ পরিবহণের আসল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এই ভৌগোলিক নিয়তি ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা-সহ অন্যান্য নদীগুলির সঙ্গমস্থল বাংলাতে হবার কারণে বাংলা ছিল ভারতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। উর্বর ভূমি, খণিজ সম্পদ, বিশাল নদীর অববাহিকা, বৃষ্টির প্রাচুর্য্য এবং নদীগুলির সঙ্গমস্থলে সুমদ্রবন্দর থাকায় বাংলা ছিল বিদেশী শক্তির কাছে সবচাইতে লোভনীয় টার্গেট। মাহান নদী অববাহিকার মুখে বন্দরের গুরুত্ব আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। মিসিসিপি নদী, হাডসন নদী, পটোম্যাক নদী এবং সেন্ট লরেন্স নদীর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বকে তিনি হাইলাইট করেছেন। ঠিক একইভাবে ব্রিটিশরা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার সঙ্গমস্থলে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব ধরতে পেরেছিল। যেকারণেই তারা বাংলাতে এসে কলকাতা বন্দর তৈরি করেছিল, যা কিনা ওই নদীগুলির সঙ্গমস্থল থেকে অনেক পশ্চিমে, অর্থাৎ নদীগুলির প্রাকৃতিক প্রবাহের একেবারে উল্টোদিকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন বাংলার কর্তিত্ব নিয়ে নেয়, তখন এই কৃত্রিম স্থানেই ভারতের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং প্রধান শহর স্থাপন করে। কোলকাতায় প্রধান সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কারণে বাংলার পূর্বাঞ্চল থেকে পণ্য উল্টাদিকে নদীপথে পাঠাতে হতো কলকাতায়। পূর্বাঞ্চলেই চাল, পাট, চা-সহ বেশিরভাগ পণ্য উতপাদিত হতো। ব্রিটিশরা কোলকাতায় প্রধান শহর করার কারণে কোলকাতায় সকল কারখানা গড়ে উঠলো, যেগুলি বাংলার পূর্বাংশের উপরে নির্ভরশীল ছিল। আবার বাংলার পূর্বাংশে সকল নদী থাকার কারণে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ-নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরা এই শিল্পের বারোটা বাজিয়ে কোলকাতায় জাহাজ-নির্মাণ শিল্প করে, যেখানে মানুষের জীবনধারণের জন্যে জাহাজ নির্মাণ করাটা জরুরি নয়। এই ইতিহাসগুলির ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়ালো তা হলো, যখন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দেশ বিভাগ করলো, তখন ভারত কোলকাতার পশ্চাদভূমির বেশিভাগ হারালো পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ)-এর কাছে। আসামের বিশাল এক ভূমি (বর্তমানে সাতটি রাজ্য) কোলকাতা থেকে আলাদ হয়ে গেলো ব্রহ্মপুত্র নদ এবং গঙ্গা নদীকে কেটে ফেলার জন্যে। বিহার এবং উড়িষ্যাকেও বাংলা থেকে আলাদা করা হলেও সেগুলি অবশ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকলো। ব্রিটিশদের এই বিভাজন ভারতকে জন্ম থেকে দুর্বল করেছে। পশ্চাদভূমি ছাড়া আধা-গুরুত্বের কোলকাতা বন্দর পায় ভারত এবং তিনটি প্রধান নদীর সঙ্গমস্থল সমুদ্রবন্দর-সহ হারায় ভারত। ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল যে ভারতীয় উপমহাদেশের মূল শক্তি হচ্ছে বাংলা। তাই বাংলাকেই তারা প্রায় দু’শ বছর তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্ত্রভূমি করেছিল। বাকি অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাকে একটা অঞ্চল হিসেবে না রাখার ক্ষেত্রে তারা ছিল বদ্ধ পরিকর। ভারত এবং পাকিস্তান গঠনের চাইতে বাংলাকে কয়েক ভাগ করে দুই দেশের মাঝে বিতরণ করাটা বৃটিশদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাই বিপ্লব সহ উপমহাদেশের বেশিরভাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাংলাতেই সংগঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা বঙ্গোপসাগরে একটা শক্তিশালী দেশ রেখে যাবার পক্ষপাতি ছিল না; বরং এমন একটা ভারতের পক্ষপাতি ছিল যার কিনা আকারে বিশাল হলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উঠতে অনেক কষ্ট করতে হতো। বহুজাতিক এক রাষ্ট্র ভারত নিজেকে সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকবে চিরকাল। আর এরকম একটা উদ্ভট রাজনৈতিক ম্যাপ ভারতের নেতৃবৃন্দকে সারাজীবন ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তায় (যেখানে বাংলা নিয়ে চিন্তা থাকবে সবার উপরে) মশগুল রাখবে এবং তাদেরকে পশ্চিমা শক্তির কথায় চলতে বাধ্য করবে। বহু বছর আগে থেকেই চীনারা ভারতের উপরে পশ্চিমা প্রভাবের এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ভারতকে বিশ্বাস করতে ছিল অনিচ্ছুক।
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই বিন্যাসের ষোল কলা পূর্ণ করেছে ভারত নিজেই। অজায়গায় ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কোলকাতা বন্দর চালু রাখতে ভারত গঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে স্রষ্টার দেওয়া সবচাইতে বড় উপহারগুলির একটিকে ধর্ষণ করেছে। প্রাকৃতিক এই নদীকে কেটে ফেলে ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশের যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি তারা ভারতের করেছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তাতে সঠিক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পানির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েও যেতে পারে, কিন্তু ভারত সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলবে। অন্যান্য নদীর উপরে বাঁধ এবং নদী-সংযোগ প্রকল্পের মতো আত্মহননের চেষ্টা ভারতকে ডোবাবে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে এবং ভাটির দেশের উপরে চরম চাপ সৃষ্টি করে ভারতের পক্ষে বঙ্গোপসাগরের কর্তিত্ব রাখা কতোটা সম্ভব হবে, সেটা প্রশ্নাতীত নয়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের বিশাল লম্বা সমুদ্রতট রক্ষা করা ভারতের জন্যে বেশ কঠিনই হবে। এই লম্বা সমুদ্রতট তাদের বঙ্গোপসাগরের সামরিক শক্তিকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ফেলবে, যেটা তাদের ভবিষ্যতের যে কোন সামরিক পদক্ষেপে তাদের বিপক্ষে কাজ করবে। আলফ্রেড মাহান ১৮০৫ সালের ব্রিটিশদের সাথে নৌ-যুদ্ধে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের এই দুর্বলতার কথা বলেছিলেন, যেখানে ফ্রান্সের আকৃতি ভারত থেকে আরও অনেক ছোট। ভারতের সমস্যা ফ্রান্সের কয়েক গুণ হবে –এটাই স্বাভাবিক। নদী কম থাকার কারণে এই লম্বা উপকূল বরাবর কোলকাতা, বিশাখাপত্তম, চেন্নাই-সহ অনেকগুলি বন্দর রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের সাথে যোগ হয়েছে মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা থাকার কারণে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তা দেওয়া, যা কিনা বঙ্গোপসাগরে ভারতকে আরও বেশি দুর্বল করবে। বঙ্গোপসাগরে ভারত চিরকাল অকর্মণ্য শক্তির মোকাবিলা করবে বলে চিন্তা করে থাকলে সামনের দিনগুলিতে তাদের সামনে চমক অপেক্ষা করছে।
পাকিস্তান – অল্পেই সাফল্য?
পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্ম হয়েছিল এমন একটা ভূমি নিয়ে, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা নদীর (সিন্ধু নদ) মুখে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর (করাচী) তারা পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান এই নদী এবং বন্দরের পুরো সদ্যবহার করতে পারেনি। এটার কারণ হিসেবে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বিশাল ভূমি-সীমান্তের কথা বলা যায়। এতবড় ভূমিকে নিরাপত্তা দিতে পাকিস্তানের নেতৃত্বের দৃষ্টি চলে যায় ভূমির দিকে। মাত্র কিছুদিন আগে, ২০১১ সালে, পাকিস্তান সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ নদীপথ উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করে। পাকিস্তানের ৯৬% পণ্য পরিবহণ হয় স্থলপথে; বাকি ৪% রেলপথে। এর অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তান নিজেদেরকে ম্যারিটাইম শক্তি হিসেবে তৈরি করার চেষ্টাই করেনি কখনো। মাহান বলেছিলেন যে ইউরোপিয়ান ভূমির অংশ হবার কারণে ফ্রান্স নৌশক্তিতে ঠিকমতো উন্নতি করতে পারেনি; যেটা ব্রিটেন পেরেছিল দ্বীপ দেশ হবার কারণে। পাকিস্তানও ফ্রান্সের মতো তার জাতীয় শক্তির বেশিরভাগটা খরচ করবে স্থলশক্তি তৈরি করতে; অর্থাৎ পাকিস্তানের স্থলসীমানার আশেপাশের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারার চাইতে খুব বেশি ক্ষমতা থাকছে না। এরপরেও পাকিস্তান তাদের নৌবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা কিনা আরব সাগরে পাকিস্তানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ অটুট রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আর একইসাথে ভারতের নৌবহর দুই সাগরের মাঝে ভাগ হয়ে যাবার কারণে আরব সাগরে পাকিস্তান কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে। স্থলভাগে দৃষ্টি থাকার কারণে পাকিস্তান গভীর সমুদ্রে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ না করে আরব সাগরে নিজেদের বাণিজ্য রক্ষা করা এবং দরকারে আক্রমণাত্মক কাজের মাধ্যমে ভারতের আরব সাগরের বাণিজ্য ব্যাহত করবে। এক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে থাকবে, কারণ মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতের ঠিক মাঝখানে পাকিস্তানের অবস্থান। ম্যারিটাইম শক্তি না হয়েই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের যথেষ্ট ক্ষতি করা সম্ভব। আরব সাগরের বাণিজ্য রক্ষা করতে ভারতের নৌবহরের বেশিরভাগটাই লাগবে; অথচ তারা তাদের পূর্বের সমুদ্র উপকূলও খালি রাখতে পারছে না। চীন পুরো ভারত মহাসাগরে নৌশক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে ভারতকে যতটা না সমস্যায় ফেলতে পারবে, তার চাইতে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর আক্রমণাত্মক শক্তি বৃদ্ধি করে এর চাইতে অনেক সমস্যায় জর্জ্জরিত করতে পারবে – এটা চীনারা ভালোই বুঝেছে।
মিয়ানমার – উদ্দেশ্যহীন?
বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) জন্ম হয়েছে ইরাবতী নদী এবং এর দক্ষিণ প্রান্তে রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াংগন) সমুদ্রবন্দর নিয়ে। একইসাথে মিয়ানমার বিশাল এক উপকূল পেয়েছে। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশ প্রকৃতই নদীমাতৃক; নদীভিত্তিক পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই চমতকার। তবে মিয়ানমারের বিশাল উপকূলের নিরাপত্তা দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন সামরিক জান্তার অধীনে থাকার কারণে মিয়ানমার বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়নি একেবারেই। কিন্তু একইসাথে শক্তিশালী একটা দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখন্ডতা ঠিক রাখতে নিজেদের নাগরিকদের মেরে শেষ করেছে; দেশকে করেছে দুর্বল। মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে তার প্রতিবেশী চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড। মিয়ানমার ১৯৯০ সাল থেকে তার নৌবাহিনী তৈরির কাজে হাত দিয়েছে; নিজেরাই যুদ্ধজাহাজ বানাচ্ছে তারা। আপাতঃদৃষ্টিতে এই নৌবহর তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কারণ তাদের সাথে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদী সাম্প্রদায়িক সমস্যা রয়েছে। মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়বাদীরা খুবই শক্তিশালী, যা কিনা মিয়ানমারকে ভেতর থেকে দুর্বল রাখবে। কিন্তু যেহেতু মিয়ানমার সরকার দেশকে ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে তৈরির কোন চেষ্টাই কখনো করেনি, তাই তাদের এই জাহাজ নির্মাণ অন্তসারশূণ্যই মনে হয় আপাতঃদৃষ্টিতে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে না পারার কারণেই মিয়ানমার হয়তো এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেহেতু এই নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, তাই এটা বেশিদূর এগুবে বলে মনে করাটা সমীচীন হবে না। চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিলেও এখন তারা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছে, যা কিনা চীনের ভালো চোখে দেখার কথা নয়। মিয়ানমারে চীনের প্রচুর স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগ রয়েছে যেটা চীন রক্ষা করতে চাইবে যেকোন মূল্যে; বিশেষ করে যদি কোন কারণে চীন মালাক্কা প্রণালী ব্যবহারে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে মিয়ানমারে তৈরি ডীপ-সী পোর্ট হয়ে উঠবে চীনের রক্ষাকবচ। চীনের কাছে মিয়ানমারের এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণেই চীন মিয়ানমারকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রেও এই বাণিজ্যপথ রক্ষা করাটা কঠিন। কারণ এতে করে বঙ্গোপসাগরে চীনের একটা নৌবহর রাখতে হবে, যা কিনা বর্তমান বাস্তবতায় খাটে না। এমতাবস্থায় চীন বঙ্গোপসাগরে সবসময়ই যুদ্ধ এড়িয়ে চলবে।
বাংলাদেশ – ফিনিক্স ফ্রম দ্যা এশেজ?
পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জন্ম বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে। উপরেই বলেছি যে ব্রিটিশরা গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র-কে ভাগ করতেই বেশি সচেষ্ট ছিল। বহুকাল রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জ্জরিত থাকলেও গত ১৫-২০ বছরে এদেশ অর্থনৈতিকভাবে যা অর্জন করেছে, সেটা অনেক জিওপলিটিশিয়ানকে অবাক করেছে। মাত্র এক দশক আগেও বাংলাদেশ কোন হিসাবেই ছিল না; অথচ আজ সব হিসাবেই বাংলাদেশ বিদ্যমান। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া অভাব অনটন এদেশের মানুষকে আর্থিক উন্নতির জন্যে ভুভুক্ষু করেছিল। দেশ বিভাগের সময় বেশিরভাগ কারখানা রয়ে যায় কোলকাতায়, অথচ কারখানার বেশিরভাগ কাঁচামাল আসতো বাংলাদেশ থেকে। এদেশের অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলে পাকিস্তান আমলে এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হবার পরেও। শীতলযুদ্ধের প্রভাবে বৃহত শক্তিদের ততপরতায় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল রক্তাক্ত; সামরিক শাসনও ছিল বহুকাল। এদেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয় ১৯৮০-এর শেষের দিকে, যখন থেকে এদেশে তৈরি পোষাকের কারখানা স্থাপন শুরু হয়। কমদামী দর্জিগিরির কাজ হলেও এখানেই প্রকৃত বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্ভব হয় এদেশের। এই শিল্প জন্ম দেয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের এবং সেগুলি জন্ম দেয় আরও শিল্পের। বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে বহু পণ্যের রপ্তানি শুরু হয় পরবর্তী দশকগুলিতে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হয়, যারা বিভিন্ন বাণিজ্য এবং কলকারখানার হাল ধরে। ’৯০-এর দশকে কৃষিতে শুরু হয় বিপ্লব; এদেশের মাটি, আবহাওয়া এবং ব্যাপক বৃষ্টিপাত সাহায্য না করলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ হতো না, কারণ উজানে ভারত প্রায় সব নদীতে বাঁধ দিয়েছে; ব্রিটিশরা হয়তো এটা চিন্তা করেই সীমান্ত ঠিক করেছিল। ২৪,০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে কমতে কমতে চার হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে আজ, কিন্তু তারপরেও এদেশের মানুষ এখনো পানির উপরে নির্ভরশীল। গুগল আর্থের ম্যাপে গেলে বোঝা যায় যে এদেশের বিরাট একটা অংশ আসলে পানিতে ভর্তি। শুধু মানুষের চিন্তা থেকে পানিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে (কিভাবে করা হয়েছে সেটা নাহয় আরেকদিন লিখবো)। ম্যারিটাইম দেশ তৈরিতে এটা একটা বড় বাধা।
কিছুদিন আগে মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মিটমাট করার পর থেকে ম্যারিটাইম সেক্টর বেশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে। আলফ্রেড মাহান বলেছিলেন যে একটা দেশ ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে তার দরকার একটা বড় জনসংখ্যা (যেটা বাংলাদেশের আছে) এবং দেশের মানুষের পানির সাথে সম্পৃক্ততা (যেটা অনেকটাই কমে গেছে গত কয়েক দশকে)। একসময় দেশের জনস্ংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেলেও এখন এটা পরিষ্কার যে এই বিশাল জনগোষ্ঠীই এদেশের সবচাইতে বড় সম্পদ। বিশ্ব অর্থনীতি এখন দ্রুত জনবহুল দেশগুলির দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। গত এক দশকে দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্রিটিশরা ১৭৭৮ সাল থেকে বাংলায় জাহাজ নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে; তারা জানতো যে এদেশের মানুষ জাহাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করলে কি হতে পারে। এদেশে জাহাজ-নির্মাণ শিল্পের পিছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প, যেকারণে এই শিল্পের বিরূদ্ধে Subversive Activity ছিল সবচাইতে বেশি। এই শিল্প থেকে আসা স্ক্র্যাপ লোহা দিয়েই গড়ে উঠেছে দেশের কৃষি-যন্ত্র শিল্প, মেশিন শিল্প, রড তৈরি শিল্প (যা কিনা রিয়েল এস্টেটের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে)। রিয়েল এস্টেট জন্ম দিয়েছে সিমেন্ট শিল্পের, জন্ম দিয়েছে ইট তৈরি শিল্পের, কাঁচ শিল্পের, এলুমিনিয়াম শিল্পের, ইলেক্ট্রিক পণ্যের, পেইন্ট শিল্পের, স্যানিটারি ওয়্যার শিল্পের, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদির। এসব ইন্ডাস্ট্রির জন্যে লেগেছে জাহাজ – বালুবাহী জাহাজ, ড্রেজার, কার্গো জাহাজ, তেলবাহী জাহাজ, ইত্যাদি। কন্টেইনার জাহাজও তৈরি শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। এই জাহাজগুলির অনেকগুলিই ব্যবহৃত হলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মালামাল দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহণে। দেশের ৯০% তেল নদীপথে পরিবাহিত হয়। কাজের জন্যে মানুষ বিভিন্ন শহরে বসবাসের কারণে নদীপথে বহু যাত্রী পরিবাহিত হয়; যাত্রীবাহী জাহাজ তৈরিও চলছে ব্যাপক হারে। এদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ৩৫ হাজার নৌযান চলছে। এতকিছুর পরেও কেন ম্যারিটাইম দেশ নয়? কারণ এখন পর্যন্ত চিন্তায় সমুদ্র খুব অল্প স্থান জুড়ে রয়েছে; দেশের মানুষ পানিকে বন্ধু ভাবে না (সেটা অবশ্য তৈরি করা হয়েছে); ড্রেজিং-এর মাধ্যমে দেশের নদীপথ উন্নয়নে বাজেট থাকে না (যদিও সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে প্রচুর বিদেশী ডলার আসে); সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরিতে দেশীয় উদ্যোগতাদের তেমন আগ্রহ নেই (যদিও এদেশের জাহাজ ইউরোপে রপ্তানি হয়); সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে অথর্বের নীতি অনুসরণ (যদিও বন্দর বাণিজ্য বিরাট সাফল্য পেয়েছে); বঙ্গোপসাগরে খণিজ সম্পদ আহরণের কোন কিনারাই হলো না (যদিও ভারত ও মিয়ানমার এগিয়ে গেছে); গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্ট শম্ভুক গতিতে চলছে (জিওপলিটিক্সে আটকে গেছে); ইত্যাদি। উপরের লম্বা বর্ণনাতে ইন্ডাস্ট্রির সাথে সাথে জাহাজ-নির্মাণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখ করেছি, যা কিনা বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নদী এবং সমুদ্র বিষয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছে সবে; বঙ্গোপসাগরের জন্যে ফিশিং ট্রলার তৈরি শুরু হয়েছে দেশে; শিপিং লাইনারও চালু হতে চলেছে (যা কিনা মানুষকে সমুদ্রের ব্যাপারে আগ্রহী করবে); ইউরোপে মন্দার পরেও জাহাজ রপ্তানি শুরু হয়েছে আবার; যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু হয়েছে; তিনটা নদীর পলিত উপরে নির্ভরশীল বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে দ্বীপ উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে; নৌবাহিনীর মূল্যায়ন শুরু হয়েছে অবশেষে – এগুলি সামনের দিন দেখায়। তবে দেশের সরকারের সঠিক নীতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গোপসাগর – বাংলাদেশের বেসিন?
বঙ্গোপসাগরের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বাংলাদেশের মানুষের নিজেদেরকে মূল্যায়নের উপরে। ভৌগোলিক অখন্ডতার কোন প্রশ্ন এদেশের নেই; এদেশের ভূ-প্রকৃতি এবং বিশাল জনসংখ্যা যেকোন আগ্রাসী শক্তির জন্যে দুঃস্বপ্ন; ভারতের মতো সামরিক শক্তির বিভক্ত হবার সম্ভাবনাও নেই একেবারেই – এসব ব্যাপার বাংলাদশের স্থলভাগকে করবে শক্তিশালী এবং বঙ্গোপসাগর নিয়ে চিন্তায় করবে আগ্রহী। অপরদিকে ভারত তার যে অবস্থানে রয়েছে (যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে), সেখান থেকে খুব বেশি দূরে যাবার সম্ভাবনা কম। মিয়ানমার তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের দিকে। আরব সাগরে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের অবস্থানকে প্রভাবিত করলেও সেটা হবে পরোক্ষভাবে। বিশাল সম্পদশালী বাংলাকে চিরে ব্রিটিশদের স্বজত্নে তৈরি করা বাংলাদেশের হাতে এখনও রয়েছে বিশাল তিনটা নদী (যা ১৯৪৭ সালে সীমানা দিয়ে কেটে ফেলার পরেও এবং পরে উজানে বাঁধ দিয়ে আটকালেও বৃষ্টির পানিতে ভরা সম্ভব) এবং এর সঙ্গমস্থলে রয়েছে একাধিক সমুদ্রবন্দর। এদেশ এখন বহিঃবানিজ্যের উপরে এতটাই নির্ভরশীল যে বহিঃবাণিজ্যকে রক্ষা করাটা দেশের বাঁচা-মরার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহান ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে ব্রিটেন এবং হল্যান্ড কিভাবে তাদের দেশের অভাবের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয় এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। দু’টা দেশই পানির দেশ হবার কারণে এদের সাথে বাংলার সবচাইতে বেশি মিল ছিল। পার্থক্য ছিল একটাই – বাংলা ছিল সমৃদ্ধশালী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ; অপরদিকে ইউরোপিয়ানরা ছিল দরিদ্র এবং বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এ-তো ১৭৬৪ সালের আগের কথা বলছি; আজকের বাস্তবতা তো ভিন্ন। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ভুভুক্ষু বাংলাদেশ গত ১৫-২০ বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল এক দেশে পরিণত হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদেই সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট নিয়ে এই দেশের মানুষ বঙ্গোপসাগর আবিষ্কারে বের হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এদেশের বাণিজ্যিক স্বাধীনতা পূর্ণতা না পায়, ততদিন এদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরে পাড়ি জমাবে এবং এই সাগর থেকে ভারত মহাসাগরে পাড়ি জমাবে। মাহানের থিওরি এখানে পুরোপুরি সফলতা পেতে চলেছে। ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণমূলক সীমারেখা এদেশে প্রায় অর্ধশত বছর সাফল্য দেখিয়েছে; কিন্তু এখন এই নিয়ন্ত্রণই একটা এগ্রেসিভ ম্যারিটাইম দেশের জন্ম দিতে চলেছে। বিশাল এক জনগোষ্ঠী যখন ছোট্ট একটা দেশে বেঁচে থাকার চাপে থাকবে, তখন তার অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছে থাকবে প্রবল। একটা জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষিত করে Subversion-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এই শিক্ষাই একসময় মানুষকে তার ঘোর থেকে জাগিয়ে তুলে – এটা মানুষের সৃষ্টিতত্বেই নিহিত, যা কিনা অনেকেই বোঝেন না।
বিখ্যাত মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড থেয়ার মাহান (Alfred Thayer Mahan, 1840-1914) আজকাল আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তার থিওরিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিবর্তন করেছিল। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (Theodore Roosevelt, 1858-1919; president 1901-1909) দেশের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকা হয়ে উঠতে থাকে একটা বিশ্বশক্তি বা গ্লোবাল পাওয়ার। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রে টিকে থাকার মাঝেই যে আমেরিকার ভবিষ্যত শক্তি নিহিত, সেটা মাহান-ই প্রথম বলেন। যদিও মাহানের থিওরি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্ম দিয়েছিল এবং সেজন্য তিনি বেশ সমালোচিত ছিলেন কিছু মহলে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাহানের দেখিয়ে দেয়া পথ অনুসরণ করেই আমেরিকা দুনিয়ার রাজা বনেছে; যদিও সেটাতে সময় লেগেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটা যুদ্ধকে সংগঠিত হতে হয়েছে। যাই হোক, এখনকার দুনিয়াতে অনেক দেশ সমুদ্রের দিকে ঝুঁকছে বলেই এখন ২১শতকে এসে আবারও মাহানের কথাই মনে করতে হচ্ছে।
মাহান ভূরাজনীতির প্রথম দিককার চিন্তাবিদ। শীতল যুদ্ধের সময় সবাই তাকে ভুলে গেলেও নপুন বাস্তবতায় তার নাম আবারো উচ্চারিত হচ্ছে। |
মাহানের পূণরুত্থান
মাহান নৌ-শক্তির সাথে অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক সত্যগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। তারই সমসাময়িক ব্রিটিশ জিওপলিটিশিয়ান হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Halford Mackinder, 1861-1947) এবং এদের কিছু পরের ডাচ বংশোদ্ভূত মার্কিন চিন্তাবিদ নিকোলাস স্পাইকম্যান (Nocholas J. Spykman, 1893-1943) জিওপলিটিক্স নামে নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দেন। এদেরকে অনুসরণ করে আরও অনেকেই চিন্তায় অগ্রসর হয়েছেন। এসব চিন্তাবিদদের বেশিরভাগই পশ্চিমা দেশের। অপশ্চিমা দেশগুলিতে এরকম জিওপলিটিক্স নিয়ে চিন্তা করতে পারার মতো মানুষ তেমন একটা নেই, তবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। কয়েকশ’ বছর পশ্চিমা শাসনে বিশ্ব শাসিত হবার ফলে চিন্তার ক্ষেত্রেও এরকম মেরুকরণ হয়েছে। তবে গত দুই-তিন দশকে অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে অগ্রগতি হবার কারণে অনেক দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে এগিয়ে এসেছে। ঠিক যেভাবে মাহান শতবর্ষ আগে মার্কিন নেতৃত্বকে বলেছিলেন যে বিশ্ব-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের মাঝেই মার্কিন বিশ্ব-নেতৃত্ব নিহিত, ঠিক একই পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। মাহান বলেছিলেন যে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের মাঝেই একটা দেশ উঠবে এবং একই সাথে তার নৌ-শক্তির বিকাশ ঘটবে, যা কিনা বিশ্বব্যাপী তার শক্তিকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে। মাহানের থিওরির কারণে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের মাঝে ব্যাপক বাণিজ্য এবং নৌ-প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা কিনা দু’টি বিশ্বযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কয়েক দশক ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মাহানের থিওরি সবাই ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের পতনের পরে পুঁজিবাদের ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন আবার সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
ইউরোপ থেকে এশিয়া
পশ্চিমা বিশ্ব তাদের ঔপনিবেশিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকেই করেছে বিশ্ববাণিজ্য-নির্ভর। যেসময় ইউরোপের মানুষ বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল, সেসময় যুদ্ধের কারণে বাণিজ্যের ক্ষতি হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা হতো তাদের, ঠিক যেমনটা ডাচদের ক্ষেত্রে হয়েছিল ইংল্যান্ডের সাথে আঠারো মাস যুদ্ধের পরে (১৬৫৩-৫৪)। ঔপনিবেশিক যুগের আগে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ বহিঃবাণিজ্যের উপরে তেমন একটা নির্ভরশীল ছিল না; অন্তঃত বাণিজ্য বন্ধ হলে না খেয়ে থাকার অবস্থা ছিল না। ইউরোপিয়ানরা এসে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আজ এশিয়াতে বিশ্বের বিরাট এক জনগোষ্ঠীর বসবাসের কারণে দুনিয়ার বেশিরভাগ উতপাদন আবারও এশিয়াতে ফেরত এসেছে। তবে এবার এই উতপাদন এসেছে বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপে যেমন বাণিজ্য রক্ষার কাজকে জীবন রক্ষার সম-গুরুত্ব দেওয়া হতো, ঠিক একই অবস্থা এখন এশিয়াতে বিরাজ করতে যাচ্ছে। গত দুই-তিন দশকে এশিয়ার অনেক দেশের কাছে এই উতপাদন-রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যের কারণে বিপুল সম্পদ এসে পড়েছে। এই সম্পদ যেমন তাদের অর্থনীতিকে করেছে বেগবান, একইসাথে তাদের সমাজকে করেছে শিক্ষিত। এই অর্থ এবং শিক্ষা জন্ম দিয়েছে এক জাতীয়তাবাদের, যা কিনা তাদের বেঁচে থাকার জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বহিঃবাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই উদ্বিগ্নতা বা অস্থিরতা তাদেরকে জাতীয় নিরাপত্তার দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে। বাণিজ্যের বাজার, কাঁচামালের উতস এবং বাণিজ্যপথগুলিকে নিরাপদ রাখতে সবাই নৌ-শক্তিবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করছে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর অঞ্চল পার হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এই অবস্থাই বিরাজ করছে। ছোট ছোট অনেক দেশের হাতে এখন বেশ ক্ষমতা, তবে তারা সবাই ছোট ছোট দেশে বিভক্ত এবং রাজনৈতিক হিংসার কারণে এদের একত্রে কাজ করার সম্ভাবনা খুবই কম; তাই শক্তিধর দেশগুলি এটা ভেবে চিন্তিত নয়; বরং এক দেশকে অপরের বিরূদ্ধে লাগিয়ে রাখাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। আর এরকম আঞ্চলিক সমস্যা বৃহত শক্তিগুলিকে নাক গলানোর সুযোগ দেবে। তবে এরকম আঞ্চলিক সমস্যার সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে আবার সেটা শক্তিধর দেশগুলির পক্ষেও ম্যানেজ করাটা কঠিন হয়ে যাবে, যেমনটি হয়েছে আমেরিকার ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্তান-সহ আরও বিভিন্নস্থানে একযোগে জড়িয়ে গিয়ে।
মাহানের থিওরি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে নৌ-শক্তির সম্পর্ক নিয়ে। ভারত মহাসাগরে নিজেদের বাণিজ্যের নিরাপত্তায় চীনের আবির্ভাব অনেক হিসেবই পালটে দিয়েছে। |
চীন – পূর্ব থেকে পশ্চিমে
পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগর অবশ্য অন্য হিসেবে পড়েছে। এখানে চীনকে একপেশে করার জন্যে অনেকেই সাধারণ (কমন) কারণ খুঁজে পেয়েছে। তবে একটি চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে সকলের চিন্তাতেই নিজেদের বহিঃবাণিজ্য সবচাইতে বড় স্থান অধিকার করে রয়েছে। মাহানীয় থিওরিতে চীনের উত্থানকে ব্যাখ্যা করা যায় – চীনের স্থলসীমানা আজ আর বিপদসংকুল নয়, তাই চীন সমুদ্রে পাল তুলতে পারছে সহজেই। চীনের বাণিজ্যিক এবং নৌ-শক্তির উত্থানের কারণে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি করছে। এই অবস্থাটাই উপচে পড়ে (ওভারফ্লো) ভারত মহাসাগরে এসে হাজির হয়েছে। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বহুদিনের সামরিক সরবরাহকারী চীন; আর পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় ডীপ-সী পোর্ট তৈরি করেছে চীন। এসব ব্যাপার ভারতের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে মিয়ানমারের উপকূলে চীন তেলবাহী জাহাজের জন্যে ডীপ-সী পোর্ট করেছে এবং সেই পোর্টের সাথে চীনের ভূখন্ড পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন করেছে গ্যাস পাইপলাইনের পাশাপাশি। ঠিক একইভাবে পাকিস্তানে গোয়াদর পোর্ট থেকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ইকনমিক করিডোর করা হচ্ছে বিশাল এক প্রজেক্টের মাধ্যমে। মিয়ানমারের পাইপলাইন এবং পাকিস্তানের ইকনমিক করিডোর সাফল্য পাবে যদি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে চীনা বাণিজ্য জাহাজ ভিড়তে পারে কোন সমস্যা ছাড়াই। কিন্তু এই নিষ্কন্টক ভ্রমণের নিশ্চয়তা তো চীনকে কেউ দেয়নি। কাজেই ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজ দেখা যাবে – এটা ধরেই নেয়া যায়। একইসাথে চীন চাইবে ভারত মহাসাগরে তার বন্ধুরাষ্ট্র তৈরি করতে, যাদের সাথে চীন শুধু বাণিজ্যই করবে না, তার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি দেখভাল করবে। পূর্ব চীন সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে বেশ কয়েকটি দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে সরাসরি বিরোধ থাকলেও হিমালয় পর্বতের কারণে ভারত মহাসাগরের দেশগুলির সাথে তাদের ততটা বিরোধ নেই, শুধু ভারত ছাড়া। যদিও মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটা বিবাদ রয়েছে, সেটা ভারতের সাথে চীনের বিরোধের কাছে নস্যি। চীনের প্রতিটি পদক্ষেপ ভারত বিরোধিতা করার চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে্র ডীপ-সী পোর্ট প্রজেক্টে চীনের আগ্রহ ঠিক একইভাবে ভারতের কাছে বিপজ্জনক ঠেকবে। এমনকি ভারতের আশেপাশের দেশে চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ভারতের কাছে হুমকিস্বরূপ দেখা যাওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ এতে ভারত শুধু তার পণ্যের বাজারই হারাবে না, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারাবে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভারতের অখন্ডতার জন্যেও সেটা হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দিতে পারে। যেহেতু এটা জানা কথা যে সৃষ্টির পর থেকেই ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার চিন্তাকে আগলে রেখেছে, চীনের এরকম ‘এগ্রেসিভ এপ্রোচ’ ভারতের কাছে তাই ভয়ঙ্কর হিসেবে দেখা দেবে। ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দেশ নিজেদের সমুদ্র-বাণিজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিলে সেটাও ভারতের কাছে সন্দেহের উদ্রেক করবে। একজনের বাণিজ্যের নিরাপত্তা আরেকজনের বাণিজ্যের প্রতি হুমকি।
মধ্যপ্রাচ্য একাধারে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্যে জ্বালানী তেলের প্রধান উতস হওয়াতে ভারত মহাসাগরে চীনের যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা বাড়ার সাথেসাথে জাপান এবং কোরিয়ার নৌবাহিনীকেও দেখা যাবে শিগগিরই। আপাতত জাপান বঙ্গোপসাগরে ‘বিগ-বি’ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এই প্রজেক্টের পিছনে পিছনে জাপানী নৌবাহিনীও ভারত মহাসাগরে আসবে। মাহানের থিওরি এখানে একেবারে চমতকারভাবে ফলতে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি এরকম নৌশক্তির জন্ম দেবে - এটা আলফ্রেড মাহান চিন্তা করতে পেরেছিলেন বলেই তার থিওরি এখন আবার নতুন করে অনেকেই পড়া শুরু করেছেন।
প্রবাহ না দেখলে ভারতীয় উপমহাদেশে আসল শক্তির উতস যেমন নিরূপণ করা যাবে না, ঠিক তেমনি বর্তমান ভারতের কৌশলগত শক্তি বা এর দুর্বলতাও সঠিকভাবে হিসেব করা যাবে না। |
ভারত – দুর্বল রাষ্ট্র?
ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিকে আলাদাভাবে দেখলে যে বিষয়গুলি চোখে পড়বে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলের বৈচিত্র্য। এই উপকূলের সবচাইতে বড় স্থান জুড়ে রয়েছে ভারত। তবে উলটা ত্রিভুজ আকৃতির হবার কারণে ভারতের নৌবহরকে প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করতে হচ্ছে। কাজেই বিশাল শক্তিধর নৌবাহিনী হওয়া সত্তেও ভারতের নৌবহর প্রকৃতপক্ষে আলাদা দু’টি ফ্লীট হিসেবে অপারেট করবে; এদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। এই অবস্থান ভারতের নৌবাহিনীর জন্যে বিরাট দুর্বল একটা দিক। আবার তাদের উপকূলের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে কোলকাতা ছাড়া বাকি বন্দরগুলি নদীপথে দেশের গভীরের সাথে সংযুক্ত নয়। এটা একদিকে যেমন অধিকতর ব্যয়বহুল রেলপথ এবং স্থলপথের উপরে ভারতকে নির্ভরশীল হতে বাধ্য কাছে, তেমনি আবার নদীপথের মুখের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব থেকে তাদের মুক্ত করেছে। বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দরগুলি নদীর মুখে না হবার কারণে ভারত অভ্যন্তরীণ পরিবহণের আসল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অবশ্য এই ভৌগোলিক নিয়তি ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা-সহ অন্যান্য নদীগুলির সঙ্গমস্থল বাংলাতে হবার কারণে বাংলা ছিল ভারতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। উর্বর ভূমি, খণিজ সম্পদ, বিশাল নদীর অববাহিকা, বৃষ্টির প্রাচুর্য্য এবং নদীগুলির সঙ্গমস্থলে সুমদ্রবন্দর থাকায় বাংলা ছিল বিদেশী শক্তির কাছে সবচাইতে লোভনীয় টার্গেট। মাহান নদী অববাহিকার মুখে বন্দরের গুরুত্ব আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন। মিসিসিপি নদী, হাডসন নদী, পটোম্যাক নদী এবং সেন্ট লরেন্স নদীর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বকে তিনি হাইলাইট করেছেন। ঠিক একইভাবে ব্রিটিশরা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার সঙ্গমস্থলে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব ধরতে পেরেছিল। যেকারণেই তারা বাংলাতে এসে কলকাতা বন্দর তৈরি করেছিল, যা কিনা ওই নদীগুলির সঙ্গমস্থল থেকে অনেক পশ্চিমে, অর্থাৎ নদীগুলির প্রাকৃতিক প্রবাহের একেবারে উল্টোদিকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন বাংলার কর্তিত্ব নিয়ে নেয়, তখন এই কৃত্রিম স্থানেই ভারতের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং প্রধান শহর স্থাপন করে। কোলকাতায় প্রধান সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কারণে বাংলার পূর্বাঞ্চল থেকে পণ্য উল্টাদিকে নদীপথে পাঠাতে হতো কলকাতায়। পূর্বাঞ্চলেই চাল, পাট, চা-সহ বেশিরভাগ পণ্য উতপাদিত হতো। ব্রিটিশরা কোলকাতায় প্রধান শহর করার কারণে কোলকাতায় সকল কারখানা গড়ে উঠলো, যেগুলি বাংলার পূর্বাংশের উপরে নির্ভরশীল ছিল। আবার বাংলার পূর্বাংশে সকল নদী থাকার কারণে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ-নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরা এই শিল্পের বারোটা বাজিয়ে কোলকাতায় জাহাজ-নির্মাণ শিল্প করে, যেখানে মানুষের জীবনধারণের জন্যে জাহাজ নির্মাণ করাটা জরুরি নয়। এই ইতিহাসগুলির ফলশ্রুতিতে যা দাঁড়ালো তা হলো, যখন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দেশ বিভাগ করলো, তখন ভারত কোলকাতার পশ্চাদভূমির বেশিভাগ হারালো পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ)-এর কাছে। আসামের বিশাল এক ভূমি (বর্তমানে সাতটি রাজ্য) কোলকাতা থেকে আলাদ হয়ে গেলো ব্রহ্মপুত্র নদ এবং গঙ্গা নদীকে কেটে ফেলার জন্যে। বিহার এবং উড়িষ্যাকেও বাংলা থেকে আলাদা করা হলেও সেগুলি অবশ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকলো। ব্রিটিশদের এই বিভাজন ভারতকে জন্ম থেকে দুর্বল করেছে। পশ্চাদভূমি ছাড়া আধা-গুরুত্বের কোলকাতা বন্দর পায় ভারত এবং তিনটি প্রধান নদীর সঙ্গমস্থল সমুদ্রবন্দর-সহ হারায় ভারত। ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল যে ভারতীয় উপমহাদেশের মূল শক্তি হচ্ছে বাংলা। তাই বাংলাকেই তারা প্রায় দু’শ বছর তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্ত্রভূমি করেছিল। বাকি অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাকে একটা অঞ্চল হিসেবে না রাখার ক্ষেত্রে তারা ছিল বদ্ধ পরিকর। ভারত এবং পাকিস্তান গঠনের চাইতে বাংলাকে কয়েক ভাগ করে দুই দেশের মাঝে বিতরণ করাটা বৃটিশদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাই বিপ্লব সহ উপমহাদেশের বেশিরভাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাংলাতেই সংগঠিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা বঙ্গোপসাগরে একটা শক্তিশালী দেশ রেখে যাবার পক্ষপাতি ছিল না; বরং এমন একটা ভারতের পক্ষপাতি ছিল যার কিনা আকারে বিশাল হলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উঠতে অনেক কষ্ট করতে হতো। বহুজাতিক এক রাষ্ট্র ভারত নিজেকে সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকবে চিরকাল। আর এরকম একটা উদ্ভট রাজনৈতিক ম্যাপ ভারতের নেতৃবৃন্দকে সারাজীবন ভারতের অখন্ডতা বজায় রাখার চিন্তায় (যেখানে বাংলা নিয়ে চিন্তা থাকবে সবার উপরে) মশগুল রাখবে এবং তাদেরকে পশ্চিমা শক্তির কথায় চলতে বাধ্য করবে। বহু বছর আগে থেকেই চীনারা ভারতের উপরে পশ্চিমা প্রভাবের এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ভারতকে বিশ্বাস করতে ছিল অনিচ্ছুক।
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া এই বিন্যাসের ষোল কলা পূর্ণ করেছে ভারত নিজেই। অজায়গায় ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কোলকাতা বন্দর চালু রাখতে ভারত গঙ্গা নদীতে বাঁধ দিয়ে স্রষ্টার দেওয়া সবচাইতে বড় উপহারগুলির একটিকে ধর্ষণ করেছে। প্রাকৃতিক এই নদীকে কেটে ফেলে ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশের যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি তারা ভারতের করেছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তাতে সঠিক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পানির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেয়েও যেতে পারে, কিন্তু ভারত সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলবে। অন্যান্য নদীর উপরে বাঁধ এবং নদী-সংযোগ প্রকল্পের মতো আত্মহননের চেষ্টা ভারতকে ডোবাবে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে এবং ভাটির দেশের উপরে চরম চাপ সৃষ্টি করে ভারতের পক্ষে বঙ্গোপসাগরের কর্তিত্ব রাখা কতোটা সম্ভব হবে, সেটা প্রশ্নাতীত নয়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের বিশাল লম্বা সমুদ্রতট রক্ষা করা ভারতের জন্যে বেশ কঠিনই হবে। এই লম্বা সমুদ্রতট তাদের বঙ্গোপসাগরের সামরিক শক্তিকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ফেলবে, যেটা তাদের ভবিষ্যতের যে কোন সামরিক পদক্ষেপে তাদের বিপক্ষে কাজ করবে। আলফ্রেড মাহান ১৮০৫ সালের ব্রিটিশদের সাথে নৌ-যুদ্ধে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের এই দুর্বলতার কথা বলেছিলেন, যেখানে ফ্রান্সের আকৃতি ভারত থেকে আরও অনেক ছোট। ভারতের সমস্যা ফ্রান্সের কয়েক গুণ হবে –এটাই স্বাভাবিক। নদী কম থাকার কারণে এই লম্বা উপকূল বরাবর কোলকাতা, বিশাখাপত্তম, চেন্নাই-সহ অনেকগুলি বন্দর রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের সাথে যোগ হয়েছে মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা থাকার কারণে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তা দেওয়া, যা কিনা বঙ্গোপসাগরে ভারতকে আরও বেশি দুর্বল করবে। বঙ্গোপসাগরে ভারত চিরকাল অকর্মণ্য শক্তির মোকাবিলা করবে বলে চিন্তা করে থাকলে সামনের দিনগুলিতে তাদের সামনে চমক অপেক্ষা করছে।
আরব সাগরে পাকিস্তানের সাবমেরিন ভারতের বাণিজ্যপথের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই বিপদ ভারতের বিভক্ত নৌবহরকে বেশ ব্যস্ত রাখতে পারবে। |
পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্ম হয়েছিল এমন একটা ভূমি নিয়ে, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা নদীর (সিন্ধু নদ) মুখে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর (করাচী) তারা পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান এই নদী এবং বন্দরের পুরো সদ্যবহার করতে পারেনি। এটার কারণ হিসেবে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বিশাল ভূমি-সীমান্তের কথা বলা যায়। এতবড় ভূমিকে নিরাপত্তা দিতে পাকিস্তানের নেতৃত্বের দৃষ্টি চলে যায় ভূমির দিকে। মাত্র কিছুদিন আগে, ২০১১ সালে, পাকিস্তান সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ নদীপথ উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করে। পাকিস্তানের ৯৬% পণ্য পরিবহণ হয় স্থলপথে; বাকি ৪% রেলপথে। এর অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তান নিজেদেরকে ম্যারিটাইম শক্তি হিসেবে তৈরি করার চেষ্টাই করেনি কখনো। মাহান বলেছিলেন যে ইউরোপিয়ান ভূমির অংশ হবার কারণে ফ্রান্স নৌশক্তিতে ঠিকমতো উন্নতি করতে পারেনি; যেটা ব্রিটেন পেরেছিল দ্বীপ দেশ হবার কারণে। পাকিস্তানও ফ্রান্সের মতো তার জাতীয় শক্তির বেশিরভাগটা খরচ করবে স্থলশক্তি তৈরি করতে; অর্থাৎ পাকিস্তানের স্থলসীমানার আশেপাশের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারার চাইতে খুব বেশি ক্ষমতা থাকছে না। এরপরেও পাকিস্তান তাদের নৌবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা কিনা আরব সাগরে পাকিস্তানের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ অটুট রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আর একইসাথে ভারতের নৌবহর দুই সাগরের মাঝে ভাগ হয়ে যাবার কারণে আরব সাগরে পাকিস্তান কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে। স্থলভাগে দৃষ্টি থাকার কারণে পাকিস্তান গভীর সমুদ্রে যাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ না করে আরব সাগরে নিজেদের বাণিজ্য রক্ষা করা এবং দরকারে আক্রমণাত্মক কাজের মাধ্যমে ভারতের আরব সাগরের বাণিজ্য ব্যাহত করবে। এক্ষেত্রে ভারত অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে থাকবে, কারণ মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতের ঠিক মাঝখানে পাকিস্তানের অবস্থান। ম্যারিটাইম শক্তি না হয়েই পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের যথেষ্ট ক্ষতি করা সম্ভব। আরব সাগরের বাণিজ্য রক্ষা করতে ভারতের নৌবহরের বেশিরভাগটাই লাগবে; অথচ তারা তাদের পূর্বের সমুদ্র উপকূলও খালি রাখতে পারছে না। চীন পুরো ভারত মহাসাগরে নৌশক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে ভারতকে যতটা না সমস্যায় ফেলতে পারবে, তার চাইতে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর আক্রমণাত্মক শক্তি বৃদ্ধি করে এর চাইতে অনেক সমস্যায় জর্জ্জরিত করতে পারবে – এটা চীনারা ভালোই বুঝেছে।
মিয়ানমার যুদ্ধজাহাজ তৈরিতে বেশ এগুচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নীতি তাদেরকে অন্ধকারে পতিত করবে। |
মিয়ানমার – উদ্দেশ্যহীন?
বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) জন্ম হয়েছে ইরাবতী নদী এবং এর দক্ষিণ প্রান্তে রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াংগন) সমুদ্রবন্দর নিয়ে। একইসাথে মিয়ানমার বিশাল এক উপকূল পেয়েছে। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশ প্রকৃতই নদীমাতৃক; নদীভিত্তিক পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই চমতকার। তবে মিয়ানমারের বিশাল উপকূলের নিরাপত্তা দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন সামরিক জান্তার অধীনে থাকার কারণে মিয়ানমার বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয়নি একেবারেই। কিন্তু একইসাথে শক্তিশালী একটা দেশ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ভৌগোলিক অখন্ডতা ঠিক রাখতে নিজেদের নাগরিকদের মেরে শেষ করেছে; দেশকে করেছে দুর্বল। মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়েছে তার প্রতিবেশী চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড। মিয়ানমার ১৯৯০ সাল থেকে তার নৌবাহিনী তৈরির কাজে হাত দিয়েছে; নিজেরাই যুদ্ধজাহাজ বানাচ্ছে তারা। আপাতঃদৃষ্টিতে এই নৌবহর তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, কারণ তাদের সাথে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদী সাম্প্রদায়িক সমস্যা রয়েছে। মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়বাদীরা খুবই শক্তিশালী, যা কিনা মিয়ানমারকে ভেতর থেকে দুর্বল রাখবে। কিন্তু যেহেতু মিয়ানমার সরকার দেশকে ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে তৈরির কোন চেষ্টাই কখনো করেনি, তাই তাদের এই জাহাজ নির্মাণ অন্তসারশূণ্যই মনে হয় আপাতঃদৃষ্টিতে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে না পারার কারণেই মিয়ানমার হয়তো এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেহেতু এই নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, তাই এটা বেশিদূর এগুবে বলে মনে করাটা সমীচীন হবে না। চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিলেও এখন তারা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছে, যা কিনা চীনের ভালো চোখে দেখার কথা নয়। মিয়ানমারে চীনের প্রচুর স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগ রয়েছে যেটা চীন রক্ষা করতে চাইবে যেকোন মূল্যে; বিশেষ করে যদি কোন কারণে চীন মালাক্কা প্রণালী ব্যবহারে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে মিয়ানমারে তৈরি ডীপ-সী পোর্ট হয়ে উঠবে চীনের রক্ষাকবচ। চীনের কাছে মিয়ানমারের এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণেই চীন মিয়ানমারকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রেও এই বাণিজ্যপথ রক্ষা করাটা কঠিন। কারণ এতে করে বঙ্গোপসাগরে চীনের একটা নৌবহর রাখতে হবে, যা কিনা বর্তমান বাস্তবতায় খাটে না। এমতাবস্থায় চীন বঙ্গোপসাগরে সবসময়ই যুদ্ধ এড়িয়ে চলবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে জাহাজ তৈরি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপরেও ম্যারিটাইম দেশ হতে এখনও কিছু পথ পেরুতে হবে |
বাংলাদেশ – ফিনিক্স ফ্রম দ্যা এশেজ?
পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জন্ম বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে। উপরেই বলেছি যে ব্রিটিশরা গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র-কে ভাগ করতেই বেশি সচেষ্ট ছিল। বহুকাল রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জ্জরিত থাকলেও গত ১৫-২০ বছরে এদেশ অর্থনৈতিকভাবে যা অর্জন করেছে, সেটা অনেক জিওপলিটিশিয়ানকে অবাক করেছে। মাত্র এক দশক আগেও বাংলাদেশ কোন হিসাবেই ছিল না; অথচ আজ সব হিসাবেই বাংলাদেশ বিদ্যমান। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া অভাব অনটন এদেশের মানুষকে আর্থিক উন্নতির জন্যে ভুভুক্ষু করেছিল। দেশ বিভাগের সময় বেশিরভাগ কারখানা রয়ে যায় কোলকাতায়, অথচ কারখানার বেশিরভাগ কাঁচামাল আসতো বাংলাদেশ থেকে। এদেশের অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলে পাকিস্তান আমলে এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হবার পরেও। শীতলযুদ্ধের প্রভাবে বৃহত শক্তিদের ততপরতায় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল রক্তাক্ত; সামরিক শাসনও ছিল বহুকাল। এদেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয় ১৯৮০-এর শেষের দিকে, যখন থেকে এদেশে তৈরি পোষাকের কারখানা স্থাপন শুরু হয়। কমদামী দর্জিগিরির কাজ হলেও এখানেই প্রকৃত বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্ভব হয় এদেশের। এই শিল্প জন্ম দেয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের এবং সেগুলি জন্ম দেয় আরও শিল্পের। বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে বহু পণ্যের রপ্তানি শুরু হয় পরবর্তী দশকগুলিতে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হয়, যারা বিভিন্ন বাণিজ্য এবং কলকারখানার হাল ধরে। ’৯০-এর দশকে কৃষিতে শুরু হয় বিপ্লব; এদেশের মাটি, আবহাওয়া এবং ব্যাপক বৃষ্টিপাত সাহায্য না করলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ হতো না, কারণ উজানে ভারত প্রায় সব নদীতে বাঁধ দিয়েছে; ব্রিটিশরা হয়তো এটা চিন্তা করেই সীমান্ত ঠিক করেছিল। ২৪,০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে কমতে কমতে চার হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে আজ, কিন্তু তারপরেও এদেশের মানুষ এখনো পানির উপরে নির্ভরশীল। গুগল আর্থের ম্যাপে গেলে বোঝা যায় যে এদেশের বিরাট একটা অংশ আসলে পানিতে ভর্তি। শুধু মানুষের চিন্তা থেকে পানিকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে (কিভাবে করা হয়েছে সেটা নাহয় আরেকদিন লিখবো)। ম্যারিটাইম দেশ তৈরিতে এটা একটা বড় বাধা।
কিছুদিন আগে মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মিটমাট করার পর থেকে ম্যারিটাইম সেক্টর বেশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে। আলফ্রেড মাহান বলেছিলেন যে একটা দেশ ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে তার দরকার একটা বড় জনসংখ্যা (যেটা বাংলাদেশের আছে) এবং দেশের মানুষের পানির সাথে সম্পৃক্ততা (যেটা অনেকটাই কমে গেছে গত কয়েক দশকে)। একসময় দেশের জনস্ংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেলেও এখন এটা পরিষ্কার যে এই বিশাল জনগোষ্ঠীই এদেশের সবচাইতে বড় সম্পদ। বিশ্ব অর্থনীতি এখন দ্রুত জনবহুল দেশগুলির দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। গত এক দশকে দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্রিটিশরা ১৭৭৮ সাল থেকে বাংলায় জাহাজ নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে; তারা জানতো যে এদেশের মানুষ জাহাজ তৈরিতে মনোনিবেশ করলে কি হতে পারে। এদেশে জাহাজ-নির্মাণ শিল্পের পিছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্প, যেকারণে এই শিল্পের বিরূদ্ধে Subversive Activity ছিল সবচাইতে বেশি। এই শিল্প থেকে আসা স্ক্র্যাপ লোহা দিয়েই গড়ে উঠেছে দেশের কৃষি-যন্ত্র শিল্প, মেশিন শিল্প, রড তৈরি শিল্প (যা কিনা রিয়েল এস্টেটের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে)। রিয়েল এস্টেট জন্ম দিয়েছে সিমেন্ট শিল্পের, জন্ম দিয়েছে ইট তৈরি শিল্পের, কাঁচ শিল্পের, এলুমিনিয়াম শিল্পের, ইলেক্ট্রিক পণ্যের, পেইন্ট শিল্পের, স্যানিটারি ওয়্যার শিল্পের, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদির। এসব ইন্ডাস্ট্রির জন্যে লেগেছে জাহাজ – বালুবাহী জাহাজ, ড্রেজার, কার্গো জাহাজ, তেলবাহী জাহাজ, ইত্যাদি। কন্টেইনার জাহাজও তৈরি শুরু হয়েছে কিছুদিন হলো। এই জাহাজগুলির অনেকগুলিই ব্যবহৃত হলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মালামাল দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহণে। দেশের ৯০% তেল নদীপথে পরিবাহিত হয়। কাজের জন্যে মানুষ বিভিন্ন শহরে বসবাসের কারণে নদীপথে বহু যাত্রী পরিবাহিত হয়; যাত্রীবাহী জাহাজ তৈরিও চলছে ব্যাপক হারে। এদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ৩৫ হাজার নৌযান চলছে। এতকিছুর পরেও কেন ম্যারিটাইম দেশ নয়? কারণ এখন পর্যন্ত চিন্তায় সমুদ্র খুব অল্প স্থান জুড়ে রয়েছে; দেশের মানুষ পানিকে বন্ধু ভাবে না (সেটা অবশ্য তৈরি করা হয়েছে); ড্রেজিং-এর মাধ্যমে দেশের নদীপথ উন্নয়নে বাজেট থাকে না (যদিও সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নে প্রচুর বিদেশী ডলার আসে); সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরিতে দেশীয় উদ্যোগতাদের তেমন আগ্রহ নেই (যদিও এদেশের জাহাজ ইউরোপে রপ্তানি হয়); সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে অথর্বের নীতি অনুসরণ (যদিও বন্দর বাণিজ্য বিরাট সাফল্য পেয়েছে); বঙ্গোপসাগরে খণিজ সম্পদ আহরণের কোন কিনারাই হলো না (যদিও ভারত ও মিয়ানমার এগিয়ে গেছে); গভীর সমুদ্রবন্দর প্রজেক্ট শম্ভুক গতিতে চলছে (জিওপলিটিক্সে আটকে গেছে); ইত্যাদি। উপরের লম্বা বর্ণনাতে ইন্ডাস্ট্রির সাথে সাথে জাহাজ-নির্মাণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখ করেছি, যা কিনা বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নদী এবং সমুদ্র বিষয়ে পড়াশোনা শুরু হয়েছে সবে; বঙ্গোপসাগরের জন্যে ফিশিং ট্রলার তৈরি শুরু হয়েছে দেশে; শিপিং লাইনারও চালু হতে চলেছে (যা কিনা মানুষকে সমুদ্রের ব্যাপারে আগ্রহী করবে); ইউরোপে মন্দার পরেও জাহাজ রপ্তানি শুরু হয়েছে আবার; যুদ্ধজাহাজ তৈরি শুরু হয়েছে; তিনটা নদীর পলিত উপরে নির্ভরশীল বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে দ্বীপ উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে; নৌবাহিনীর মূল্যায়ন শুরু হয়েছে অবশেষে – এগুলি সামনের দিন দেখায়। তবে দেশের সরকারের সঠিক নীতি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বেঁচে থাকার তাগিদেই বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটবে। সমুদ্র বাণিজ্য এবং সমুদ্র সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এই জাতিকে যতো বেশি ভাবাবে, তারা ততো বেশি বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে বের হতে চাইবে। |
বঙ্গোপসাগর – বাংলাদেশের বেসিন?
বঙ্গোপসাগরের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বাংলাদেশের মানুষের নিজেদেরকে মূল্যায়নের উপরে। ভৌগোলিক অখন্ডতার কোন প্রশ্ন এদেশের নেই; এদেশের ভূ-প্রকৃতি এবং বিশাল জনসংখ্যা যেকোন আগ্রাসী শক্তির জন্যে দুঃস্বপ্ন; ভারতের মতো সামরিক শক্তির বিভক্ত হবার সম্ভাবনাও নেই একেবারেই – এসব ব্যাপার বাংলাদশের স্থলভাগকে করবে শক্তিশালী এবং বঙ্গোপসাগর নিয়ে চিন্তায় করবে আগ্রহী। অপরদিকে ভারত তার যে অবস্থানে রয়েছে (যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে), সেখান থেকে খুব বেশি দূরে যাবার সম্ভাবনা কম। মিয়ানমার তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের দিকে। আরব সাগরে পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের অবস্থানকে প্রভাবিত করলেও সেটা হবে পরোক্ষভাবে। বিশাল সম্পদশালী বাংলাকে চিরে ব্রিটিশদের স্বজত্নে তৈরি করা বাংলাদেশের হাতে এখনও রয়েছে বিশাল তিনটা নদী (যা ১৯৪৭ সালে সীমানা দিয়ে কেটে ফেলার পরেও এবং পরে উজানে বাঁধ দিয়ে আটকালেও বৃষ্টির পানিতে ভরা সম্ভব) এবং এর সঙ্গমস্থলে রয়েছে একাধিক সমুদ্রবন্দর। এদেশ এখন বহিঃবানিজ্যের উপরে এতটাই নির্ভরশীল যে বহিঃবাণিজ্যকে রক্ষা করাটা দেশের বাঁচা-মরার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাহান ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে ব্রিটেন এবং হল্যান্ড কিভাবে তাদের দেশের অভাবের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল হয় এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়। দু’টা দেশই পানির দেশ হবার কারণে এদের সাথে বাংলার সবচাইতে বেশি মিল ছিল। পার্থক্য ছিল একটাই – বাংলা ছিল সমৃদ্ধশালী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ; অপরদিকে ইউরোপিয়ানরা ছিল দরিদ্র এবং বহিঃবাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এ-তো ১৭৬৪ সালের আগের কথা বলছি; আজকের বাস্তবতা তো ভিন্ন। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ভুভুক্ষু বাংলাদেশ গত ১৫-২০ বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল এক দেশে পরিণত হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদেই সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট নিয়ে এই দেশের মানুষ বঙ্গোপসাগর আবিষ্কারে বের হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এদেশের বাণিজ্যিক স্বাধীনতা পূর্ণতা না পায়, ততদিন এদেশের মানুষ বঙ্গোপসাগরে পাড়ি জমাবে এবং এই সাগর থেকে ভারত মহাসাগরে পাড়ি জমাবে। মাহানের থিওরি এখানে পুরোপুরি সফলতা পেতে চলেছে। ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণমূলক সীমারেখা এদেশে প্রায় অর্ধশত বছর সাফল্য দেখিয়েছে; কিন্তু এখন এই নিয়ন্ত্রণই একটা এগ্রেসিভ ম্যারিটাইম দেশের জন্ম দিতে চলেছে। বিশাল এক জনগোষ্ঠী যখন ছোট্ট একটা দেশে বেঁচে থাকার চাপে থাকবে, তখন তার অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছে থাকবে প্রবল। একটা জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষিত করে Subversion-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এই শিক্ষাই একসময় মানুষকে তার ঘোর থেকে জাগিয়ে তুলে – এটা মানুষের সৃষ্টিতত্বেই নিহিত, যা কিনা অনেকেই বোঝেন না।
wow
ReplyDeleteনদী না থাকার সাথে বন্দর রক্ষার কী সম্পর্ক? ফ্রান্স দ্বীপ না হলেও, ফ্রান্সের উপকূল তো অনেক ছোট নয়। তাহলেলে নৌশক্তির বিকাশ হল না কেন?
ReplyDeleteসমুদ্রবন্দরের সাথে নদীর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরের যোগাযোগ থাকলে অনেক সমুদ্রবন্দরের দরকার না-ও হতে পারে। কিন্তু যদি একটা সমুদ্রবন্দর থেকে দেশের খুব বেশি অঞ্চলে পণ্য পাঠানো সম্ভব না হয়, তাহলে অনেকগুলি সমুদ্রবন্দরের দরকার হবে। ভারতের বিশাল উপকূল বরাবর এই অবস্থাই বিরাজমান। ভৌগোলিক কারণে অল্প সংখ্যক সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ভারতের দক্ষিণের বিশাল উপদ্বীপের বাণিজ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই পুরো উপকূল জুড়েই অনেক সমুদ্রবন্দর প্রয়োজন ভারতের। আর উপকূল অনেক লম্বা হবার কারণে এই পুরো উপকূল জুড়ে সমুদ্রবন্দর পাহাড়া দেয়া একটা কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য কাজ।
Deleteফ্রান্সের লম্বা স্থলসীমানা রয়েছে। আর সেই স্থলসীমানা দিয়ে ফ্রান্স হয় ইউরোপকে আক্রমণ করেছে, নতুবা ইউরোপ থেকে আক্রান্ত হয়েছে। এই লম্বা স্থলসীমানা রক্ষা করতে ফ্রান্সের বিশাল সেনাবাহিনী রাখতে হয়েছে। রাষ্ট্রের বাজেটের বড় অংশ সেনাবাহিনী রাখার কাজে ব্যয় হওয়ায় নৌবহর বাড়ানো তাদের জন্যে কষ্টকর ছিল। তদুপরি ফ্রান্স সবসময়ই বিরাট নৌবহর রেখেছে, যদিও তা ব্রিটিশ নৌবহরকে চ্যালেঞ্জ করার মতো হয়নি কখনোই। এখনও ফ্রান্সের নৌবহর খুব ছোট নয়। বিশ্বব্যাপী একটা ম্যারিটাইম রাজত্ব তারা মেইনটেইন করছে এখনও। ব্রিটিশ এবং ডাচদের বিরোধ নিয়ে লেখাটা পড়লে একটা দেশের স্থলশক্তি আর নৌ-শক্তির ব্যালান্সের ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে আশা করি।
https://koushol.blogspot.com/2015/09/british-dutch-rivalry.html