Tuesday, 29 March 2016

আদর্শিক যুদ্ধের পুনরাবির্ভাবঃ আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

৩০শে মার্চ ২০১৬
 

ষোড়শ শতকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরের ছোট্ট জায়গা আচেহ যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা আজ নতুন করে দেখতে হচ্ছে ২১ শতকের চোখ দিয়ে

ইন্দোনেশিয়া – সাড়ে চার’শ বছর আগের কথা

১৫১১ সালে মালয় উপদ্বীপে (বর্তমান মালেশিয়া) যখন পর্তুগীজরা জেঁকে বসে, তখন থেকেই বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর উপকূলের ছোট্ট আচেহ রাজ্যের সুলতানগণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই পশ্চিমা বিষফোঁড়া থেকে উদ্ধার পেতে। ছোট হলেও তারাই ইন্দোনেশিয়াতে প্রথম ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাই তাদের দায়িত্ব তারা বেশ ভালোই বুঝেছিলেন। কৌশলগত দিক থেকে মালাক্কা প্রণালী যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তারা বুঝতে দেরি করেননি। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও তারা কেউই পর্তুগীজদের বিরূদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। পর্তুগীজরা মালয়ের লোকদেরকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করাতে পেরেছিল, এবং মালয়ের সৈন্যদের ব্যবহার করেই তারা আচেনীজ মুসলিমদের যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারছিল। অবশেষে আসে ১৫৬৪ সাল। আচেহ সুলতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন আল-কাহহার পর্তুগীজদের উত্থান রোধ করতে ইস্তাম্বুলে সুলতান সুলাইমান (যাকে ইউরোপীয়রা সন্মান করে বলতো Suleiman the Magnificent) বরাবর তার দূত পাঠান। আচেহ-র সুলতানরা ১৫৩০-এর দশক থেকেই সুলাইমানকে ইসলামের খলিফা বলে মানতেন। আল-কাহহার জানতেন যে খলিফা হিসেবে সুলাইমান তাকে ফিরিয়ে দেবেন না। সুলাইমান কথা রাখলেও তার সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৫৬৬ সালে সুলাইমান পরলোকগমণ করেন। তবে সুলাইমান জীবিত থাকা অবস্থাতেই বেশ কয়েক’শ মুসলিম যোদ্ধা জাহাজে চেপে আচেহ-র পথে পাড়ি জমান। এসব যোদ্ধাদের মাঝে ছিল তুর্কী, সোয়াহিলি (তাঞ্জানিয়া-কেনিয়ার উপকূলের মানুষ), সোমালি, সিন্ধি (বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলের মানুষ), ভারতের গুজরাট, সুরাট এবং মালাবার উপকূলের মুসলিমগণ। তবে এই সাহায্য পর্তুগীজদের বিরূদ্ধে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারেনি।

নতুন খলিফা দ্বিতীয় সেলিম ১৫৬৬-৬৭ সালে লোহিত সাগর থেকে ১৫টি জাহাজের এক শক্তিশালী নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যাত্রার সাথেসাথেই ইয়েমেনের আদেনে বিদ্রোহের খবর চলে আসায় গুরুত্ব বুঝে এই নৌবহরকে ইয়েমেনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু খলিফা সেলিম আচেনীজদের দায়িত্ব ভুলে যাননি। তিনি কুরতোগলু হিজির রাইস-এর অধীনে দু’টা জাহাজ পাঠানের সিদ্ধান্ত নেন। এই দু’টা জাহাজই ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস পরিবর্তন করে ফেলে। এই জাহাজ দু’টিতে খুব বিশাল সংখ্যক সৈন্য না থাকলেও ছিল ইঞ্জিনিয়ারের একটা দল, যারা কামান তৈরি করার পদ্ধতি জানতেন। ষোড়শ শতকে কামান ছিল খুবই শক্তিশালী একটা অস্ত্র, যা ছাড়া আচেনীজদের পক্ষে পর্তুগীজদের মোকাবিলা করা ছিল অসম্ভব। এই ইঞ্জিনিয়াররা আচেনীজদের কামান তৈরিতে সাহায্য করলেন এবং সপ্তদশ শতকের শুরুর নাগাদ আচেনীজ সুলতান ইসকান্দার মুদা-র হাতে ছিল ১,২০০ কামান এবং আরও ৮০০ ছোট ধরনের কামান। এই কামানের বহরের মাধ্যমে সুলতান মুদা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং তাদের আগ্রাসন রুখে দেন, যদিও মালয়রা উলটো পক্ষ নেয়ার কারণে পর্তুগীজদের কৌশলগত মালাক্কা প্রণালী বিতাড়িত করতে ব্যর্থ হন তিনি।

তবে পর্তুগীজরা বুঝে গিয়েছিল যে ভারত মহাসাগরে তাদের বাণিজ্যের মনোপলি রচনা করার পেছনে সবচাইতে বড় বাধা হলো আচেনীজ সুলতানের ইস্তাম্বুলে আসীন খলিফার সাথে যোগাযোগ রক্ষা, যা কিনা মহাসাগরের বিশাল জলরাশিকে বাধা না ভেবে আলিঙ্গন করেছিল। খলিফার নির্দেশে জাহাজে করে আসা মুসলিম ইঞ্জিনিয়াররা ছোট্ট আচেনীজ সালতানাতকে রাতারাতি বিরাট সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ইয়েমেনের বিদ্রোহের সময়ে খলিফা দ্বিতীয় সেলিম ইচ্ছে করলে আচেহ-তে জাহাজ না-ও পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি দুনিয়ার মুসলিমদের প্রতি তার আদর্শিক দায়িত্বের গুরুত্ব তিনি ভুলে যাননি। তিনি এমন একটি দল পাঠিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আচেনীজরা নিজেরাই তাদের বাহিনী তৈরি করে নিতে পেরেছিল। যদি খলিফা শুধু যুদ্ধাস্ত্র পাঠাতেন, তাহলে আচেনীজরা বছরের পর বছর খলিফার দিকে চেয়ে থাকতেন এবং ভারত মহাসাগরের ওপাড় থেকে সাহায্য আসতে আসতে বছর পার হয়ে যেতো। ইঞ্জিনিয়ারদের পাঠানোর মাধ্যমে খলিফা যে কাজটি করেছিলেন, সেটা একটা বিশেষ ধরনের কৌশলগত চিন্তা। এই চিন্তা পরবর্তীতে আরও অনেকেই অনুসরণ করলেও সেটা এই আদর্শিক যোগাযোগের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যাবে না।
  
আচেনীজরা যখন ষোড়শ শকতে পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধের জন্যে ইস্তাম্বুলে খলিফার নিকটে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন খলিফা দ্বিতীয় সেলিমের হস্তক্ষেপের আদর্শিক সিদ্ধান্ত ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার পরবর্তী পাঁচ শতকের ইতিহাস পরিবর্তন করেছিল

আদর্শিক কারণেই আচেনীজরা সাহায্য পেয়েছিল এবং নিজেরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে বছরের পর বছর। যে অনুপ্রেরণা বা motivation এখানে কাজ করেছে, সেটা এসেছিল সেই আদর্শিক কারণেই; অর্থনৈতিক বা অন্য কোন কারণে হলে এই যুদ্ধের ধরণ হতো পুরোপুরি অন্যরকম। আচেনীজদের পক্ষে খলিফা দ্বিতীয় সেলিমের আদর্শিক হস্তক্ষেপের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আচেনীজদের সাথে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের কারণে পর্তুগীজরা মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। পর্তুগীজ-স্প্যানিসরা ছিল ক্যাথোলিক, এবং তারা পুরো ষোড়শ শতক জুড়ে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের পৃথিবীব্যাপী স্বার্থরক্ষা করেছে। ব্রিটিশ-ডাচ-ফরাসীরা সপ্তদশ শতক থেকে উঠতে থাকে, যাদের উত্থান মূলত হয়েছিল সেকুলার আদর্শ থেকে, অর্থাৎ মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রীস্টান ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচার জন্যেই তাদের (সেকুলারদের) উত্থান ছিল। কাজেই খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারে ব্রিটিশ-ডাচ-ফরাসীরা ছিল অপেক্ষাকৃত কম উতসাহী। ধর্মান্তরিত না করে বরং সেকুলার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়াতেই তারা বেশি আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে পর্তুগীজ-স্প্যানিসরা যেখানে থেকেছে, সেখানেই ক্যাথোলিক খ্রীস্টান সম্প্রদায় তৈরি করতে তারা ভোলেনি। ঠিক একারণেই ফিলিপাইনে বেশিরভাগই ক্যাথোলিক; ল্যাটিন আমেরিকাতেও; অথচ প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ শাসনে থাকার পরেও ভারতের খুব কম লোকই খ্রীস্টান। ডাচরা ইন্দোনেশিয়া দখলে নিয়েছিল; ব্রিটিশরা নিয়েছিল মালেশিয়া-সিঙ্গাপুর। কিন্তু এখনো মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতে বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং মালেশিয়া (যেখানে বর্তমানে সবচাইতে বেশি মুসলিম থাকে) পর্তুগীজদের অধীনে চলে গেলে এই এলাকার অমুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে থেকে বড়সড় একটা ক্যাথোলিক খ্রীস্টান সমাজ তৈরি হতে পারতো, কারণ ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়ার সবাই তখনো ইসলাম নেয়নি। একই এলাকায় মুসলিম-ক্যাথোলিক সম্প্রদায়ের বিস্ফোরন্মুখ বসবাস এখানকার ইতিহাস পরিবর্তন করে দিতে পারতো, যেটা হয়েছিল নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে; সাবেক যুগোস্লাভিয়ার ক্ষেত্রে। ষোড়শ শতকে খলিফার আদর্শিক সিদ্ধান্ত মহাসাগর পেরিয়ে যে কৌশলগত ভূমিকা রেখেছিল, সেটা নিয়ে আরও কিছু চিন্তা-ভাবনার দরকার এখন এসেছে, কারণ একুশ শতকের যুদ্ধক্ষেত্র এমন কিছু কৌশল দেখবে, যার সাথে ষোড়শ শতকের বহু মিল পাওয়া যাবে।
 
প্রায় সবাই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বাইরের অংশটুকুই দেখেছে। কিন্তু যেটা খুব অল্প লোকের কাছে বোধগম্য ছিল তা হলো - যুক্তরাষ্ট্র খুব সফলতার সাথে কমিউনিজমের অগ্রযাত্রাকে আটকে দিয়েছিল ভিয়েতনামের মাটি কামড়ে এক যুগ পরে ত্থাকার কারণে। আদর্শিক যুদ্ধের ফলাফল বেশিরভাগের কাছেই স্পষ্ট হয় না।

ভিয়েতনাম – দৃশ্যত যা অদৃশ্য
  
ষোড়শ শতকের আদর্শিক যুদ্ধের চার’শ বছর পরে আসা যাক। ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়া থেকে বেশি দূরে নয়। ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলেছে এক যুগ ধরে। ৫৮ হাজার মার্কিন সেনার জীবনাবসান হলো; কিন্তু কিসের জন্যে? অনেকেই প্রশ্ন করলো। সবাই বললো – মার্কিনীরা হেরেছে সেই যুদ্ধ। কিন্তু আদর্শিক দিক থেকে দেখলে অন্য একটা ছবি পাওয়া যাবে। ভিয়েতনামে হাজার হাজার সৈন্য বলি দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে কমিউনিজমের হাতে চলে যেতে দেয়নি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র খুব সফলতার সাথে কমিউনিজমের অগ্রযাত্রা থামিয়েছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামীদের ব্যবহার করেছে ভিয়েতনামীদেরই বিরূদ্ধে। ত্রিশ লক্ষ ভিয়েতনামীর লাশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল তুচ্ছ। এক যুগ ধরে চলা এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে রক্ষা করেছে, কারণ এই পুরো এলাকা কমিউনিস্ট হয়ে গেলে সেটা বাকি বিশ্বের জন্যে উদাহরণ হিসেবে কাজ করতো। চার শতকের ব্যবধানের দুই আদর্শিক যুদ্ধ থেকে আমরা যা পাই তা হচ্ছে, প্রথমতঃ মহাসাগরের বিশাল জলরাশির পক্ষেও আদর্শিক যুদ্ধকে থামানো সম্ভব নয়; এটার কোন ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক বাউন্ডারি নেই। দ্বিতীয়তঃ আদর্শিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘ক্ষয়ক্ষতি’-র হিসেব অন্য রকম; সকল ক্ষতিই এর কাছে তুচ্ছ। আদর্শিক শক্তি যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে এটা করতে হবে, তখন এটা করতেই হবে! আর তৃতীয়তঃ আদর্শিক যুদ্ধের অনুপ্রেরণা লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শক্তি যোগায়। অন্ততঃ এক পক্ষের মূল আদর্শিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এধরনের আদর্শিক যুদ্ধ যখন বর্তমান সময় এবং সামনের দিনগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তখন আমাদের এই যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার; কারণ এধরনের যুদ্ধই পৃথিবীকে গ্রাস করবে। যারা আগে থেকেই সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন, তারা নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবেন; চিন্তায় পিছিয়ে থাকা মানে হেরে যাওয়া। 
 
জর্জ ফ্রীডম্যান প্রথম সাড়ির পশ্চিমা চিন্তাবিদদের একজন। তিনি খুব চমতকারভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে ২১ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে যুদ্ধ বাজিয়ে রেখে বিশ্বব্যাপী তাদের কর্তিত্ব বজায় রাখবে।

 
এখানে মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যানের কিছু কথা না তুলে পারছিনা। তিনি তার “The Next 100 Years” বইতে লিখেন যে “The United States had the ultimate aim of preventing the emergence of any major power in Eurasia. The paradox however, is as follows. The goal of these interventions was never to achieve something whatever the political rhetoric might have said, but to prevent something. The United States wanted to prevent stability in areas where another power might emerge. Its goal was not to stabilize, but to destabilize.” ফ্রীডম্যানের এই কথাগুলি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অদ্ভুত ঠেকবে, কারণ কেউই ২-৪-৫ বছরের বেশি সামনে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন না। ফ্রীডম্যান শুধু বর্ণনা করেছেন কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার আদর্শকে দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত, এমনকি যে যুদ্ধ সবাই জানে যে যুক্তরাষ্ট্র জিততে পারবে না, সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে আদর্শিক কারণে। যুদ্ধ জয় মার্কিন নীতির অংশ নয়, বরং তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখাই তার মূল নীতি। তাই “The United States also has no interest in winning a war outright. As with Vietnam and Korea, the purpose of these conflicts is simply to block a power, to destabilize the region, not to impose order. In due course, even outright American defeat is acceptable.” হেরে যাওয়া যুদ্ধও মার্কিনীরা করবে, কারণ সেটা তাদেরকে আরও কয়েক যুগ দুনিয়ার উপরে নিজেদের শাসন কায়েম রাখতে সহায়তা করবে। ফ্রীডম্যান সামনের দিনগুলি নিয়ে বলেছেন যে, “There will be numerous Kosovos, Iraqs in unanticipated places and in unexpected times. …… the interventions would be quite rational. It would never appear to really yield anything near a solution and will always be done with insufficient force to be decisive.” এর মানে হচ্ছে বহু ছোট ছোট যুদ্ধ ইউরেশিয়াকে (ইউরোপের বলকান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া-সহ পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) ব্যস্ত রাখবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র খুব কম শক্তি ক্ষয় করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। স্পেশাল ফোর্স এবং এধরনের কিছু বাহিনী ব্যবহার করে কম খরচে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, যেখানে মার্কিনীদের হয়ে মূল যুদ্ধ করবে স্থানীয় লোকজন*। ঠিক যেভাবে উপরে বর্ণনা করা ষোড়শ শতকের মালয়ের যুদ্ধে পর্তুগীজরা মালয়ের মানুষদের ব্যবহার করেছিল; ঠিক যেভাবে মার্কিনীরা দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের সামরিক বাহিনী গড়ে দিয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামীদের বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্যে; ঠিক যেভাবে মাত্র কয়েক হাজার ব্রিটিশ সৈন্য কোটি মানুষের ভারতকে দু’শ বছর শাসন করেছিল; ঠিক সেটাই এখন মার্কিনীরা করছে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, মালি, সুদান এবং আরও অনেক মুসলিম দেশে। এই লিস্টে মুসলিম দেশের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা এখনো বাকি আছে, তারা যদি মনে করেন যে তারা নিরাপদ, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবেন।
 
সিরিয়ার যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে গুলতি বা sling, যার মাধ্যমে নিজেদের তৈরি গ্রেনেডগুলি আসাদ বাহিনীর উপরে ছুঁড়ে দেয়া যায়। প্রাচীন পদ্ধতি হলেও এটা সিরিয়াতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, কারণ এখানে বছরের পর বছর যুদ্ধ হচ্ছে শহরের অলিতে-গলিতে; এখানে খোলা মাঠে বীরের বেশে ট্যাঙ্ক চালানোর সম্ভাবনা সীমিত।

সিরিয়া – আজকের আদর্শিক যুদ্ধ

এবারে বর্তমানে সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকা একটা যুদ্ধ সামনে আনা যাক, যার রয়েছে আদর্শিক সকল লক্ষণ। পাঁচ বছর ধরে চলছে সিরিয়ার যুদ্ধ। একবার এগিয়ে থাকছে সিরিয়ার সরকার; আরেকবার বিদ্রোহীরা। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই, যদিও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সীমাহীন। পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের রক্তের নহর বয়ে গেছে; স্বজন-হারার কান্নার জন্যে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে দেশছাড়া। এতে জড়িয়ে গেছে সাগর-মহাসাগরের ওপারের মানুষ; রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক সীমানা কাউকে যুদ্ধে জড়ানো থেকে আটকাতে পারেনি। কেউ হাল ছাড়ার পাত্র নয়; সকল ক্ষতি উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে পড়ে আছে সবাই বছরের পর বছর। এখানে আবার যুক্তরাষ্ট্র বেনামে বিদ্রোহীদের কাউকে কাউকে এমন অস্ত্র দিচ্ছে, যা কিনা যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারবে না**; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র চায় না যে বিদ্রোহীরা সামরিক জয় পেয়ে যাক। আবার যখন রাশিয়ার বিমান বাহিনীর মূল আক্রমণ আইসিস নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপরে না হয়ে সিরিয় বিদ্রোহীদের উপরে শাণিত হয়, তখন রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়া প্রকাশ হয়ে যায়। মুখে অত্যাচারী বাশার আল-আসাদের বিরূদ্ধে কথা বললেও আলোচনার টেবিলে বসে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে একত্রে আসাদ সরকারের থাকার পক্ষে রায় দেয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার জানে যে আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় রাখা মানেই হচ্ছে যুদ্ধকে লম্বা করা। যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার এই প্রবণতা উপরে বর্ণিত আদর্শিক যুদ্ধের আলোচনাকেই মনে করিয়ে দেয়। শান্তিপূর্ণ সিরিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদর্শিক হুমকির জন্ম দিতে পারে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ডে পরিষ্কার হচ্ছে। সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বে একটা আদর্শিক উত্থানের উদাহরণ তৈরি করতে চাচ্ছে না, যা কিনা তার বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্বে অবসান ঘটাতে পারে।

সিরিয় বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে tunnel bomb. এই যুদ্ধের আগে মানুষ ভুলেই গিয়েছিল এর কথা। অনেক পুরাতন অস্ত্র এবং কৌশল সিরিয়াতে পুণরায় আবির্ভূত হয়েছে।

সিরিয়ার যুদ্ধ যে কতটা একগুঁয়ে রকমের, তা আরও পরিষ্কার হবে যখন আমরা দেখবো সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার পুরো যুদ্ধটাই হচ্ছে শহর এলাকার দখল নিয়ে। অর্থাৎ যেখানে জনবসতি, সেখানেই যুদ্ধ। খোলা জায়গায় ট্যাঙ্ক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি এই যুদ্ধের জন্যে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার হাতে কোন শহরের পতন হয়, সে এগিয়ে যায়। কাজেই শহরের ভগ্ন বিল্ডিংগুলি দখলে রাখতে দু’পক্ষই সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। মাসের পর মাস ধরে একই এলাকায় যুদ্ধ চলছে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে যায় গৌণ। বাড়িতে তৈরি করা অস্ত্র যখন বিল্ডিং-এর আড়াল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই তখন শত্রুর জন্যে হয়ে যাচ্ছে প্রাণঘাতী। বিল্ডিংগুলি সৈন্যদেরকে সাঁজোয়া যানের মতো রক্ষা করছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিং-এর বেজমেন্টে স্থাপন করা হয়েছে অস্ত্রের কারখানা, যেখানে লেদ মেশিনে তৈরি হচ্ছে মর্টার, আর্টিলারি রকেট, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি আর্টিলারি, এন্টি-ম্যাটেরিয়েল স্নাইপার রাইফেল, শক্তিশালী বিস্ফোরক, গ্রেনেড লঞ্চার, প্রাচীনযুগে ব্যবহৃত ক্যাটাপাল্ট-এর আধুনিক সংস্করণ, ইত্যাদি। এসব অস্ত্র তৈরি জন্যে ধারণা এবং প্রযুক্তি আসছে সীমানা পার হয়ে। প্যালেস্টাইনের মানুষ অস্ত্র চোরাচালানের জন্যে সুরঙ্গ খুঁড়তে বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সিরিয় বিদ্রোহীরা সেটাকে নিয়ে গেছে আরও এক ধাপ। তারা শতশত মিটার সুরঙ্গ খুঁড়ে নিয়ে গেছে সিরিয় সরকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির নিচে, যেটা কিনা বিদ্রোহীরা বহুদিন ধরেও দখলে নিতে পারছিলো না। সেই সুরঙ্গের ভেতরে ৪০ থেকে ৬০ টন বিস্ফোরক ভরে দিয়ে – বুম!! মোটামুটি একটা ভূমিকম্পসম বিস্ফোরণের পরে বিদ্রোহীদের এগুনোর পথ খুলে যায়। এধরনের আক্রমণ বিদ্রোহীরা বেশকিছু শহরে করেছে; মাসের পর মাস ধরে চলেছে গোপন খোঁড়াখুঁড়ি; এ মহা ধৈর্য্যের এক ব্যাপার। Moral Cause না থাকলে এ ধরনের চেষ্টা চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিখা যুদ্ধের সময় এধরনের tunnel bomb ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই ইতিহাস আবার নতুন করে লিখা হচ্ছে।
 
বাসাবাড়ির জ্বালানি গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বানিয়েছে 'Hell Cannon'। এটাই আসাদের বাহিনীর বিরূদ্ধে বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত সবচাইতে কার্যকর আর্টিলারি। সারা দুনিয়া অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কিভাবে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কিছু না থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর যুদ্ধে চালিয়ে নিচ্ছে, যা আদর্শিক যুদ্ধের একটা লক্ষণ।


যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন কোন আর্টিলারি ছিলনা বিদ্রোহীদের হাতে। এখন তাদের হাতে রয়েছে নিজেদের তৈরি শতশত মর্টার, রকেট, এবং উদ্ভট এক আর্টিলারি, যার নাম ‘জাহান্নামের কামান’ (Hell Cannon)। এই কামানের গোলা তৈরি করা হচ্ছে সিরিয়াতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত রান্না করার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। শহুরে এলাকায় বিল্ডিং-এর মাঝে শত্রুর শক্তিশালী ঘাটিকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতে এই অস্ত্র বিশেষ পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। তবে দেড় কিলোমিটার পাল্লার এই অস্ত্র খোলা জায়গায় খুবই দুর্বল। তারা যে আর্টিলারি রকেট তৈরি করছে, তা হুবহু প্যালেস্টাইনে তৈরি রকেটের মতো। সিরিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা এখন সবচাইতে বড় যোদ্ধা। কেউ কেউ আবার কোন বিশেষ শিক্ষা ছাড়াই ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছেন ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে। সিরিয় সেনাবাহিনীর অস্ত্র দখল করা ছাড়াও আসাদের বিমান বাহিনীর ফেলা অবিস্ফোরিত বোমাগুলিকে কুড়িয়ে নিয়ে বিদ্রোহীরা নিজেদের কারখানায় কাজে লাগাচ্ছে। লেদ মেশিনে তৈরি মর্টারের গোলা এখন সিরিয় সরকারী বাহিনীর জন্যে ত্রাস। মর্টার হলো indirect গোলা বর্ষণের এক অস্ত্র, যার মাধ্যমে বিল্ডিং বা দেয়ালের ওপারে আশ্রয় নেয়া শত্রুর উপরে গোলা বর্ষণ করা যায়। অর্থাৎ মর্টার সিরিয়ার শহরের ভেতরে যুদ্ধের জন্যে সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র।

‘Age of Empires’ কম্পিউটার গেম দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ কেউ তৈরি করেছেন মধ্যযুগীয় অস্ত্র trebuchet, যা কিনা একটা গোলাকে অনেক দূরে ছুঁড়ে দিতে পারে। এই অস্ত্রের হলিউড ভার্সন দেখতে পাবেন ‘Lord of the Rings’ ছবিতে, যেখানে বিরাট এক যন্ত্র ব্যবহৃত হয় বিশাল পাথরের চাং দুর্গের ভেতরে ছুঁড়তে। সিরিয়ার যন্ত্রগুলি ছোট, কিন্তু বাড়িতে তৈরি কয়েক কেজি ওজনের বোমাগুলিকে বেশ কিছুদূরে ছুঁড়ে দেবার জন্যে এটা বেশ ভালোই কার্যকরী। Trebuchet-এর মতোই কিছুটা কম জটিল catapult, যেগুলি একই কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এগুলি সংখ্যায় কম হলেও sling বা গুলতির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে সিরিয়াতে। প্রায় প্রতি রাস্তার আনাচে কানাচে ঘরে তৈরি গ্রেনেড দূরে ছুঁড়ে মারতে ব্যবহৃত হচ্ছে গুলতি। প্যালেস্টাইনের যুবকরা ইস্রাইলি সেনাদের বিরূদ্ধে গুলতি ব্যবহার করছে অনেকদিন ধরে, তবে সিরিয়ার গুলতিগুলি গ্রেনেড ছুঁড়ে আরও অনেক সাংঘাতিক হয়েছে। প্রাচীন যুগের এই অস্ত্র এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধে, যেখানে আদর্শকে জয়ী করা আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের বড়াই থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জার্মান leFH-18 ১০৫মিমি আর্টিলারিও সিরিয়াতে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে; দেখা গেছে অতি পুরাতন Mosin Nagant rifle (১৮৮০-এর দশকে ডিজাইন করা), MAS-36 rifle (১৯৩৬ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), M1 Garand rifle (১৯৩৬ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), PTRS-41 14.5mm sniper rifle (১৯৩৮ সালে ডিজাইন করা), Beretta 1938/44 submachine gun (১৯৩৮ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), STG-44 assault rifle (১৯৪৩ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), Browning M1919 7.62mm medium machine gun (১৯১৯ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), Degtyaryov DP-28 light machine gun (১৯২৮ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), ইত্যাদি। বাকি বিশ্ব যখন বিলিয়ন ডলার খরচ করে স্টিলথ বিমান তৈরিতে মগ্ন, তখন কিছু লোক অদর্শকে কেন্দ্র করে প্রাচীন প্রযুক্তি ব্যবহারে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে সকল সমরবিদদের চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।


সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ট্যাবলেট এবং app ব্যাবহার করে নিজেদের ওয়ার্কশপে বানানো একটা মর্টার টার্গেটিং করছে। একুশ শতকের আদর্শিক যুদ্ধে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে অলিতে-গলিতে।

তবে একুশ শতকের মানুষের প্রযুক্তি জ্ঞানকে কম করে দেখলে কিন্তু হবে না। যুদ্ধের প্রথম দিকে ডিজাইন করা অস্ত্র আর পরের দিকে ডিজাইন করা অস্ত্রের মাঝে বিস্তর ফারাক। অভিজ্ঞতা মানুষকে বানিয়েছে বিশেষজ্ঞ। তারা এখন এন্টি-ম্যাটেরিয়েল স্নাইপার রাইফেল পর্যন্ত তৈরি করে ফেলছে গ্যারেজের ওয়ার্কশপে। সিরিয়াতে মর্টার, রকেট এবং Hell Cannon-এর টার্গেটিং করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্টফোন app-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এই Hell Cannon-এর projectile-এর আবার ব্যবহৃত হচ্ছে delayed action fuse, অর্থাৎ গোলাটা আঘাত হানার সাথে সাথেই বিস্ফোরিত হয় না; কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হলেই তবে ফাটে। এতে ফাটার আগে গোলাটা কোন দুর্গ-প্রমাণ বিল্ডিং-এর উপরে পরে ভরবেগের কারণে একেবারে নিচের দিকে চলে যায়; তারপর ফাটে। এতে পুরো বিল্ডিং-ই ধ্বসে যায়। তবে এই কামানের ধ্বংস-ক্ষমতা সিরিয়া এবং রাশিয়ার বিমান শক্তির কাছেধারেও পৌঁছেনি। উঁচু দিয়ে ওড়া হেলিকপ্টার থেকে ফেলা ব্যারেল বোমাতে শত শত মানুষের মৃত্যুর হয়েছে। বিদ্রোহীরা বিমান-ধ্বংসী মিসাইল তেমন একটা পাচ্ছে না, তাই আকাশ থেকে তাদের উপরে প্রতিনিয়ত বোমা পড়ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে বিদ্রোহী ইঞ্জিনিয়াররা এখন বিমান-ধ্বংসী রকেট ডিজাইনে মনোনিবেশ করেছেন। আইডিয়াটা হচ্ছে, wire-guided একখানা রকেট যদি আস্তে চলা হেলিকপ্টারের কাছাকাছি নিয়ে ফাটিয়ে দেয়া যায়, তাহলে সেটা বিস্ফোরণের ধাক্কায় বিধ্বস্ত হবে। আর সেটা না হলেও প্রথম রকেটটা কাছাকাছি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে এর সাথেসাথে আরও কমপক্ষে তিনটি রকেট টার্গেটিং করা খুব সহজ হয়ে যাবে। ২০১৫-এর শেষের দিকে বিদ্রোহীরা এই নতুন অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সিরিয়ার যুদ্ধের বিশাল এক প্রমাণ্য দলিল এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে – ছবি, ভিডিও, ইন্টারভিউ, ঘোষণা, ইত্যাদি।

তবে এখানে সিরিয়ার প্রতিবেশী ইরাকের সাথে সিরিয়ার যুদ্ধের কিছু ট্যাকটিক্যাল পার্থক্য রয়েছে। ইরাকে roadside bomb বা improvised explosive device (IED) খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কারণ মার্কিন সৈন্যরা সেখানে শুধু রাস্তা পাহাড়া দিত। ইরাকের রাস্তায় মার্কিন গাড়ির বহরের উপরে হামলা করার জন্যে কিছু অস্ত্র (নিরাপত্তার কারণে এখানে নাম উল্লেখ করছি না) খুব সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমারা সোভিয়েত আমলের সবচাইতে বাজে ডিজাইনের অস্ত্র বলতো। সেগুলিও সিরিয়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে না একই কারণে। কিন্তু সিরিয় সরকারী বাহিনী শহরাঞ্চলে বিল্ডিং পাহাড়া দিচ্ছে, তাই ইরাকে ব্যবহৃত সফলতম অস্ত্রগুলি সিরিয়া যুদ্ধে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু প্যালেস্টাইন, লেবানন এবং লিবিয়া থেকে কিন্তু অনেক প্রযুক্তি সিরিয়া পৌঁছে গেছে। এই প্রযুক্তির বিস্তার হচ্ছে আদর্শের বিস্তারের সাথেসাথেই। যুদ্ধকে চালিয়ে নেবার পেছনে প্রযুক্তি এবং আদর্শের আদান-প্রদান ষোড়শ শতকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, একুশ শতকেও তা-ই হচ্ছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহীরা নিজেদের অস্ত্র নিজেরা বানিয়ে নিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ; কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পথই সঠিক। তাদের সাথে আদর্শিক টানে দূরদূরান্ত থেকে যোগ দেয়া মানুষের সাথে এসেছে চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান, প্রযুক্তি; যা কিনা যুদ্ধের ময়দানে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা তৈরি করছে। পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিরা কিন্তু এগুলি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখছে। এখানে পেশাদারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এখনো ব্যাপকহারে সীমানা পেরোয়নি; তারপরেও অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই যুদ্ধ চালাচ্ছে বীরদর্পে। কিন্তু সামনের দিনগুলিতে মিলিশিয়ারা যে বড় কোন সাহায্য ছাড়াই যুদ্ধ করে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। আদর্শিক শক্তির vortex যে কাউকেই motivate করে ফেলতে পারে; উপরে আলোচিত ষোড়শ এবং বিংশ শতকের যুদ্ধগুলি এর স্বাক্ষী। আজ থেকে দুই দশক আগেই আদর্শিক vortex-এর sucking power-কে উপলব্ধি করে মার্কিন চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটন তার “Clash of Civilizations and the Remaking of World Order” বইতে পশ্চিমা শক্তিদের জন্যে উপদেশ দিয়েছিলেন বেশকিছু; যার মাঝে ছিল – “to restrain the development of conventional and unconventional military power of Islamic and Sinic countries”. যারা আজ বুঝবেন না, আগামীকাল তারা সেটাই বুঝবেন আরও অনেক কবর রচিত হবার পর। সেই কবরগুলির দায়ভার কি তারা নেবেন?


-----------------------------------------
*পড়ুনঃ ‘মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ – সাম্প্রতিক দেশকাল, ২২শে অক্টোবর ২০১৫

**পড়ুনঃ ‘সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহঃ মার্কিন দু’মুখো নীতির নেপথ্যে’ – সাপ্তাহিক মৌবাজার, ২৬শে মার্চ ২০১৬

5 comments:

  1. শরীফ ভাই। আপনার প্রতিটা লেখার সাথে সাথে করেসপন্ডিং যত গুলি রেফারেন্স আছে, সব যুক্ত করুন। আমরা যারা শেয়ার দেই, তারা রেফারেন্সের অভাবে লোকজনের কাছে ধোলাই খাচ্ছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তথ্যের রেফারেন্স যতদূর সম্ভব দিয়েছি; চিন্তার রেফারেন্স দেয়া সম্ভব নয়।

      কিছু তথ্যের রেফারেন্স দিইনি নিরাপত্তার ব্যাপার রয়েছে বলে। বই ছাড়া এখানে খুব কম তথ্যই রয়েছে যেগুলি পাবলিক ডোমেইন-এ পাওয়া যায় না।

      আর তথ্য সাংবাদিকতার সাথে সম্পর্কিত। এই লেখাকে সাংবাদিকতার অংশ বললে ভুল হবে। এই লেখা চিন্তার সাথে সম্পর্কিত; তথ্যের সাথে নয়। তথ্য হচ্ছে চিন্তার জন্যে কিছু উপাত্ত মাত্র; চিন্তার ভিত্তি নয়। সাংবাদিকতার ভিত্তি হলো তথ্য; চিন্তা নয়।

      Delete
  2. attanto sunder likhechen apni...apna ke dhannabad janai ....eirakam hridoy sporshi lekher jonno... islam k ideology hisabe o western civilisation r bikalpo rupe tule dharar jonno abaro dhannobad.

    ReplyDelete
  3. সিরিয়ার ব্যাপারটা বুঝলাম না। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের একটা প্রধান অংশ (যারা টানেলে হামলা করছে) নূসরা, বর্তমানে জাবহাত্‌ ফাতহা আশ্‌শাম, সাবেক আল ক্বায়েদা। নেতৃত্বে আদর্শিকভাবে কিছু পার্থক্য থাকলেও কর্মী লেভেলে এদেরকে পৃথক করা কঠিন। এদের কর্মীরা খুব সহজেই এক গ্রুপ থেকে আরেক গ্রুপে শিফট করে।

    আপনি একদিকে বলছেন এইসব আইএস আল ক্বায়েদা পশ্চিমাদের সৃষ্টি, অপরদিকে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের আদর্শিক লড়াইয়ের প্রশংসা করছেন। ব্যাপারটা ক্লিয়ার হচ্ছে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ প্রশ্নের জন্যে।
      ব্যাপারটা তেমন কঠিন হয়না যদি উপর থেকে (Bird's Eye View) দেখা হয়। এখানে ভালো-খারাপ বা প্রশংসা বা নিন্দার ব্যাপার নেই। কার কি উদ্দেশ্য সেটাই আসল। উদ্দেশ্য মানুষকে বলে কোনটা ঠিক বা কোনটা বেঠিক। আর এখানে উদ্দেশ্য পুরোপুরি আদর্শিক, যেকারণে বলেছি আদর্শিক যুদ্ধের কথা। মানুষ জীবন দিয়ে দিচ্ছে আদর্শের জন্যে, সেটা ভুল বা ঠিক যা-ই হোক না কেন। আর এখানে এক আদর্শ অপর আদর্শকে দুর্বল করার জন্যে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে, যা যেকোন স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পুরোপুরি আলাদা। এই কৌশলের একটি হলো প্রতিদ্বন্দী আদর্শের অনুরূপ একটি আদর্শ তৈরি করে potential recruit-দের ভুল পথে নিয়ে ধ্বংস করা, রিক্রুট করা কষ্ট করে ফেলা এবং শেষ পর্যন্ত আদর্শকে দুর্বল করে ফেলা।
      দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই আদর্শিক যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। ১৯৫৩-৮৯-এ ছিল সবচাইতে বেশি। সেটা আবারো ফিরে এসেছে দুনিয়াতে - অন্য নামে, কিন্তু একই ধরণ নিয়ে। সেটাই বোঝার বিষয় রয়েছে। ঠিক-বেঠিক বুঝতে পারা অনেক পরের ব্যাপার; আগে বুঝতে হবে যে আদর্শিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর পরেই শুধু আমরা ঠিক-বেঠিকের চিন্তায় যেতে পারবো।

      Delete