স্যামুয়েল হান্টিংটনের দুই দশক আগের থিউরি আজ বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। কাজেই সেই কথাগুলিকে উদ্ভট চিন্তা বলার অবকাশ আজ আমাদের আর নেই। |
আসল লাইন কোনটা?
বিশ্ব-রাজনীতি বুঝতে আমাদের দেখতে হবে শীতল যুদ্ধের পরে বিশ্ব কোন দিকে এগুচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বিশ্ব ব্যবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, সেটা নিয়ে অনেকেই অনেক থিউরি দিয়েছেন। কিন্তু লাল ফৌজ ধ্বংসের পঁচিশ বছর পরে বুঝতে খুব একটা বাকি থাকে না কোন থিউরি বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (Samuel P Huntington) ১৯৯৩ সালে ‘The Clash of Civilizations? The Next Pattern of Conflict’ শীর্ষক একটা প্রবন্ধ লিখেন, যা বিরাট সাড়া ফেলে এবং ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয়। এই লেখার উপরে তিনি ১৯৯৬ সালে তার থিউরিকে শক্ত ফাউন্ডেশন দেওয়ার নিমিত্তে একটি বইও (The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order) লিখে ফেলেন। দুই দশক পর তার সেই থিউরিগুলি আর হাইপোথিসিস আকারে নেই; এর অনেকটাই বাস্তবায়নের আকারে এগুচ্ছে। তার পরবর্তীতে জিবিগনিউ ব্রেজিন্সকি, জর্জ ফ্রীডম্যান, হেনরি কিসিঞ্জার এবং অন্যান্যরাও মোটামুটি একই সুরে কথা বলেছেন; থিউরির কিছুটা বিরোধিতা করলেও আসল লাইন থেকে দূরে সরে যাননি একেবারেই। তাহলে এই আসল লাইনটি কি, সেটা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।
হান্টিংটনের কাছে সভ্যতার ম্যাপের বাইরে অন্য কোন জাতীয়তা গুরুত্ব পায়নি, কারণ সেসব জাতীয়তার পক্ষে বিশ্ব-রাজনীতিতে দীর্ঘ-মেয়াদী অবদান রাখা সম্ভব নয়। |
কার-কার মাঝে এই দ্বন্দ্ব?
হান্টিংটন যেটা বলতে চেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে, কমিউনিজমের পতনের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে ‘ইসলামিক সভ্যতা’। মুসলিম দেশগুলি আলাদা-আলাদা-ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকলেও তিনি পুরো মুসলিম সমাজকে একত্রেই দেখেছেন। যেহেতু পশ্চিমা সভ্যতা মুসলিমদেরকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করবে, কাজেই মুসলিমরাও প্রায় স্বভাবসিদ্ধভাবেই নিজেদেরকে একই কাতারে দেখা শুরু করবে। এটা মুসলিম দেশগুলির সরকারের ক্ষেত্রে নয়, বরং মুসলিম দেশগুলির জনগণের চিন্তায় প্রতিফলিত হবে। হান্টিংটন দেখিয়েছেন যে মুসলিম সভ্যতার সাথে সবচাইতে কম রেষারেষি হচ্ছে ‘চৈনিক সভ্যতা’র (Sinic Civilaization) বা চীনের। অর্থাৎ ইসলামিক দুনিয়াকে শক্তিশালী হতে চীন সাহায্য করতে পারে। এই গ্র্যান্ড থিউরির উপরে নির্ভর করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সভ্যতার জন্যে হান্টিংটন কিছু উপদেশ দিতেও কার্পণ্য করেননি, যেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন – “to restrain the development of the conventional and unconventional military power of Islamic and Sinic countries”. ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, এবং অন্যান্য দেশের বর্তমান অবস্থা দেখলে বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না যে হান্টিংটন-কে পশ্চিমারা হাল্কাভাবে নেয়নি এবং হান্টিংটনের পরের থিউরিস্টরাও ওই একই পথ নেয়াকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।
এখানে বলাই বাহুল্য যে হান্টিংটনের কাছে জিওপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিতে পারা শক্তি ছাড়া বাকিরা গুরুত্ব পায়নি একেবারেই। যেমন ‘আফ্রিকান সভ্যতা’ নিয়ে তিনি তেমন মাথা ঘামাননি। তবে ‘ল্যাটিন আমেরিকান সভ্যতা’-কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এই বলে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হতে পারে। রাশিয়া (পূর্ব অর্থোডক্স সভ্যতা), জাপান এবং ভারতকে (হিন্দু সভ্যতা) তিনি আলাদা শক্তি হিসেবে দেখেছেন, তবে তাদের আসল দ্বন্দ্বের (পশ্চিম বনাম ইসলাম) সাইড-শোর বাইরে গুরুত্ব দেননি। তার কথায় এরা নিজেদের স্বার্থ বুঝে প্রধান দল দু’টির (পশ্চিম এবং ইসলাম) যেকোন একটির সাথে যাবে। হান্টিংটনের লেখায় প্রথমেই প্রত্যেক মানুষকে তিনি প্রশ্ন করেছেন যে মানুষ নিজের পরিচয় সন্বন্ধে কতটা ওয়াকিবহাল। সেই পরিচয়ের উপরে নির্ভর করেই তিনি তার থিউরি সাজিয়েছেন। তিনি এক্ষেত্রে আরব মুসলিমদের জন্যে ‘আরব’-এর চাইতে ‘মুসলিম’-কে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। অর্থাৎ আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবের জাতীয়তার চাইতে মুসলিম পরিচয় বেশি গুরুত্ব বহণ করবে। এই মুসলিম পরিচয় কিন্তু শুধু আরবের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে শুধু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সকল মুসলিম-প্রধান দেশকেই বুঝিয়ে সারে। আর যখন আমরা উপরে উল্লিখিত হান্টিংটনের উপদেশের কথা মনে করি, তখন শিউরি উঠি যে এই সকল মুসলিম দেশই এই হিসাবের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। মানে সকল মুসলিম দেশকে নিরস্ত্র করার মাঝেই পশ্চিমা সভ্যতার গ্রানাইট ফাউন্ডেশন! বাংলাদেশও এই একই হিসাবের ভেতরে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে দেখানো হলেও এই জনসংখ্যার কারণেই যে এই দেশ গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে, সেটা অনেকেই হিসেব করেন না। |
যারা বিশ্বাস করতে পারেন না যে কেন ছোট্ট বাংলাদেশ এই হিসেবের মধ্যে পড়বে, তারাও হয়তো বিশ্বাস করবেন যখন এই হিসেবের সরাসরি Receiving End-এ থাকবেন। বাংলাদেশ ছোট দেশ নয়। একুশ শতকে দেশের আকার হিসেব হচ্ছে সেই দেশের জনসংখ্যা এবং সেই জনসংখ্যার প্রকৃতির উপরে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের (ভারতকেও ধরা যায় এর মধ্যে) পরপরই বাংলাদেশের স্থান। হান্টিংটন দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার দেশগুলির জিওপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনার কথা বলেছেন; কারণ যার জনসংখ্যা যত দ্রুত বাড়বে, তার কাছেই যুব সমাজের (১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স) সবচাইতে বড় অংশটা থাকবে, যারা সমাজের চালিকাশক্তি হবে। একটা দেশ কোন সমরে জড়িয়ে পড়লে এই যুব সমাজই কিন্তু জীবন দেবার জন্যে তৈরি থাকে। হান্টিংটন মুখে না বললেও বিভিন্ন গ্রাফিক্যাল এনালিসিসের মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মুসলিম বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার কারণে মুসলিম যুবসমাজ পশ্চিমের জন্যে হুমকি। জনসংখ্যার দিক থেকে বড় মুসলিম দেশগুলির কাছেই এই যুবসমাজের সবচাইতে বড় অংশটুকু রয়েছে, যা কিনা এখন টার্গেট।
একটা রাষ্ট্র বা সভ্যতা দাঁড় করাতে মানুষ লাগে। যন্ত্রপাতি লাগে সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে, কিন্তু মানুষই তো সেই যন্ত্র তৈরি করে। তালগাছ ভর্তি একটা দেশ কোন দেশ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে মানুষ বসতি স্থাপন না করে। কাজেই এই মুসলিম জনসংখ্যার কারণেই আমরা যে টার্গেট, সেটা বুঝতে বাকি থাকেনা। এই টার্গেটকে তাহলে কি করে দুর্বল করা যায়, সেটা বুঝতে পারলে টার্গেটের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব। প্রথম টার্গেট হলো জনসংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা। আমাকে কেউ যদি বড় জনসংখ্যার সমর্থক বলে ধিক্কার দিতে চান, তাহলে দিতে পারেন। কিন্তু এটা তাদের বোঝা উচিত যে চীন এবং ভারত শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে তাদের বিশাল জনসংখ্যার কারণে, জনসংখ্যা কমিয়ে রাখার কারণে নয়। আর দ্বিতীয়ত, যুবসমাজই যেহেতু মূল টার্গেট, কাজেই যুবসমাজকে অগ্রগামী হতে বাধা দেওয়া। তাদেরকে Subversion-এর মাধ্যমে বিপথে নেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি কাজে লাগানো এবং সরাসরি মাদক এবং অন্যান্য অবৈধ কাজে তাদেরকে নিয়োজিত করে ফেলে তাদের একটা শক্তি হিসেবে আবির্ভাবে বাধা প্রদান করা। তৃতীয়ত, দেশকে অকারণে একটা যুদ্ধে নিয়োজিত করা, যাতে যুবসমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শেষোক্ত এই পদ্ধতি মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই পাওয়া যাবে, যেখানে বিরাট এক যুবসমাজকে মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগিয়ে ধসংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিরিয়া এবং ইরাকে অযথা যুদ্ধ বাধিয়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সবচাইতে ভালো অংশটিকে পশ্চিমা সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই তিনটি পদ্ধতিকে একত্র করলে আমরা পশ্চিমা সভ্যতার রক্ষাকবচ বলতে যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে – মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে রাখো; যদি তারপরেও বেড়ে যায়, তাহলে তাদের যুবসমাজকে নষ্ট করো; আর তার পরেও যদি জেগে ওঠার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগিয়ে ধ্বংস করো।
ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া থেকে আমাদেরও শিক্ষা নিতে হবে। Big Picture না বুঝতে পারলে মহাবিপদের সন্মুখীন হওয়াটা আমাদের জন্যে অসম্ভব নয়। |
ভুল শুধু ভুল নয়!
বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দেশ। এদেশের ম্যারিটাইম শক্তির সম্ভাবনার উপরে আমি এর আগের কয়েকটি লেখায় আলোকপাত করেছি। এদেশের অর্থনীতির দ্রুত এগুনোর মূলে আছে এদেশের জনগণ। জনগণের বিরূদ্ধে যায় এমন যেকোন কিছু থেকে দূরে থাকাটা এই বিশ্ব-দ্বন্দ্বের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদেরকে দুনিয়া থেকে আলাদা ভেবে অন্য কোন ফর্মুলায় ফেলার বৃথা চেষ্টা করা ঠিক হবে না; কারণ উপরেই বলেছি যে বর্তমানের সব পশ্চিমা থিউরিস্টরাই ওই একই লাইনে কথা বলছেন। তারা কিন্তু তাদের কথা লুকাননি; আমরা যদি বুঝতে ভুল করি, সেই ভুল আমাদের। সাদ্দাম হোসেন ইরাকী জাতীয়তাবাদের নাম করে যুদ্ধে জড়িয়ে ইরাকের সামরিক শক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে পশ্চিমাদের খায়েস মিটিয়েছিলেন। যা বাকি ছিল, সেটা ২০০৩ সালে জর্জ বুশ ফিনিস করেছিলেন ইরাক আক্রমণ করে। এরপর ইরাক এবং সিরিয়ার পুরো যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত জেলখানায় সৃষ্ট ISIS এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চদের তৈরি সিরিয়ার আল-আসাদ পরিবারের দুষ্টচিন্তা-প্রসূত উন্মাদনার কারণে। তুরস্কও ওই যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। লিবিয়া বেসামাল; আর ইয়েমেনের যুদ্ধে জড়ানো হয়েছে পুরো আরবকে। তিউনিসিয়া এবং মিসর অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল। আফগানিস্তান আর দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্রন্দনরত। দূরবর্তী দ্বীপদেশ ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়াকে বাইরে রাখলে বাকি থাকছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের যুবসমাজকে কল্পনার জগতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে আরও আগে থেকেই। তবে এতে এখনো পুরো কাজ হয়নি। ষোল কলা পূর্ণ করতে কি দরকার? --- যুদ্ধ! নিজের দেশের উপরে আক্রমণ আসলে যুদ্ধ করতে হতেই পারে। কিন্তু সেটারও সময় আছে। দেশ সেই যুদ্ধের জন্যে কতটুকু প্রস্তুত, সেটা চিন্তা করে দেখতে হবে। প্রস্তুত হবার আগেই এড্রিনালিনের উপরে ভর করে নিজেদের গৌরব বৃদ্ধি করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়ানো হবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে বিপদের মাঝে ফেলে দেওয়া। Big picture ভুলে গিয়ে Small picture নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। সেই ভুলের মাশুল চিরকাল গুণতে হতে পারে। প্ররোচনা আসতেই পারে। কিন্তু সেই প্ররোচনা জাদুকরের ছলনা কিনা, সেটা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। জাদুকর কিন্তু মানুষের ছোট ছোট প্রবৃত্তিকেই (Instinct) কাজে লাগাবে। কাজেই কোন ধরনের আবেগের বশবর্তী না হয়ে Rational চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে Big picture চিন্তা করে সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। যেদিন আমরা জাদুকরের ছলনা পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবো, সেদিনই বুঝে নেব যে আমরা প্রস্তুত; তার আগে নয়।
Great, nice analysis.
ReplyDelete