Thursday, 5 January 2017

জ্বালানি সম্পদ যেভাবে বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করবে

০৫ জানুয়ারী ২০১৭
গ্যস ফুরিয়ে যাচ্ছে; গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে - - এভাবে মাতম জুড়ে দিয়েছে অনেকে। তাহলে প্রশ্ন হলো আফ্রিকার যে দেশগুলিতে প্রাকৃতিক সম্পদের শেষ নেই, তারা কেন অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে? আর প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই ব্রিটেন কিভাবে দু'শ বছর পৃথিবী শাসন করেছে? উত্তর হলো - প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা-না-থাকা একটি দেশকে শক্তিশালী করে না। সম্পদ ঠিক করে না যে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে কিনা; বরং শক্তিশালী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ঠিক করে যে সম্পদ নিয়ে সে কি করবে।


প্রাকৃতিক সম্পদ কি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে?

যে ব্যাপারটি মোটামুটি নিয়মিতভাবেই ‘খবর’ হিসেবে সামনে আসছে তা হলো বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে রান্না করা যাচ্ছে না। যে প্রশ্নটি বেশিরভাগ মানুষই করছে না তা হলো, ষোল কোটি মানুষের মাঝে কত কোটি আসলে গ্যাসের রান্নায় পেট ভরে। যা নিয়ে কেউ কথা বলছে না তা হলো দেশের নব্বই ভাগ মানুষ তো কোনোদিনই গ্যাসের রান্না খায়নি। তাহলে গুটিকয়েক মানুষের কথাকেই সারা দেশের মানুষের কথা বলে মিডিয়াতে প্রতিদিন জাবর কাটা হচ্ছে কেন? এর ফলস্বরূপ যা হচ্ছে তা হলো, মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তা করছে যে এদেশের গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে দেশের প্রতিটি মানুষই বিভিন্ন দ্রব্য খাচ্ছেন; যেকারণে তারা হলেন ভোক্তা। কিন্তু ভোক্তা তো তাদের পরিচয় নয়। এই মানুষগুলি তাদের জীবনে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। আর যখন তাদের চিন্তায় থাকে যে এদেশের গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই চিন্তাটা তাদের অনান্য কাজ-কর্মেও প্রকাশ পায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, গ্যাস যে ফুরিয়ে আসছে, সেটা নিয়ে মানুষ কথা বললে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে – এই বিষয়টি মাথায় থাকা মানে হলো বাংলাদেশের “সীমিত সম্পদ” ফুরিয়ে যাচ্ছে। যখন একজন মানুষ এই সম্পদ ফুরানোর চিন্তাকে অন্তরে নেবেন, তখন তার জীবনযাত্রাতেও সেটা প্রতিফলিত হবে। তিনি এই দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিছপা হবেন; নিজের সন্তানদের এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে আগ্রহ যোগাবেন না; দেশের ভালো কোনকিছু তাকে অনুপ্রাণিত করবে না। এই ব্যাপারগুলি হবে সেই “গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে” চিন্তার বাই-প্রডাক্ট। তাহলে কি কেউ গ্যাস নিয়ে চিন্তা করবে না?

মিডিয়াতে সীমিত সম্পদ নিয়ে চিন্তা করতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে। তার অর্থ হচ্ছে, সম্পদ যাদের সীমিত নয় বা অনেক বেশি আছে, তারা অনেক উন্নতি সাধন করেছে; ঠিক কিনা? তাহলে আফ্রিকার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো-কে আমরা কি বলবো? দুনিয়ার খুব কম খণিজই আছে যা সেখানে পাওয়া যায় না। দেশটিতে বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী অবস্থান করছে। খণিজ সম্পদে ভরপুর জিম্বাবুয়েকে আমরা কি বলবো, যেখানে কাগজের টাকার মূল্য নিচে নামার রেকর্ড হয়েছে? সোনা-হীরক-ইউরেনিয়াম-প্লাটিনাম দিয়ে ভরা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতেও আমাদের কয়েক হাজার শান্তিরক্ষী রয়েছে। এই প্রতিটি দেশের মানুষই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদই একটা জাতিকে উপরে তুলতে সক্ষম নয়। তবে তাহলে ব্রিটেনের কথা কোথায় স্থান পাবে? বিংশ শতকে নাহয় নর্থ সী-তে তেল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন তো এসব খণিজ ছাড়াই সারা দুনিয়ার মাতবর ছিল দু’শ বছর! তারা কি করে পারলো সেটা? এই আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা-না-থাকা একটি দেশকে শক্তিশালী করে না।

বাংলাদেশের গ্যাস শেষ হচ্ছে – এটা কোন চিন্তার কারণ হতে পারে না। এদেশের মানুষ তো দিব্যি আমদানি করা সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, পিঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা, ইত্যাদি খাচ্ছে। একবারও তো তারা চিন্তা করেনি যে এগুলির জন্যে বাংলাদেশ বাইরের উপরে নির্ভরশীল! একবারও কারও চিন্তার কারণ হয়নি যে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়! এদেশের সকল বিল্ডিং তৈরি হয়েছে আমদানি করা লোহা (রডের কাঁচামাল) আর সিমেন্টের ক্লিংকার (সিমেন্টের কাঁচামাল) থেকে। এগুলি নিয়ে তো কারুরই ঘুম হারাম হয়নি। তাহলে গ্যাস নিয়ে কেন এতো চিন্তা? আসলে “গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে” চিন্তাটা একুশ শতকে শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার বিরোধী এক চিন্তা, যা কিনা “বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকাও” মহলের গোপন কুঠুরি থেকে বের হয়েছে। সেই কুঠুরির টেলিফোন লাইনটা আটলান্টিকের ওপাড়ে সংযুক্ত। এই ফুসলানো চিন্তা থেকে দেশের মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।

এখন পরবর্তী প্রশ্ন আসে যে গ্যাস না থাকলে দেশ শক্তিশালী হবে কি করে? খুব সহজ প্রশ্ন; যার উত্তরও সহজ। চিন্তার উপরে ভিত্তি করে, যে চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করা, রক্ষা করা এবং দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয়াই একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে; করছে। তাদের চিন্তা আলাদা হতে পারে; সঠিক না-ও হতে পারে; তবে মূল কথা হলো সেগুলি শক্তিশালী চিন্তা, যা কিনা তাদেরকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে; প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য নয়। সম্পদ ঠিক করে না যে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে কিনা; বরং শক্তিশালী রাষ্ট্রের লক্ষ্য ঠিক করে যে সম্পদ নিয়ে সে কি করবে।
 
অফশোর সার্ভে কোম্পানি পোলারকাস-এর হাই-টেক সার্ভে জাহাজ 'পোলারকাস সামুর'। জাহাজটি তুরস্কের একটি কোম্পানির কাছে প্রযুক্তি, ক্রু ট্রেনিং, মেইনটেন্যান্স-সহ বিক্রি করে দেয়া হয়। তেলের বাজারে মন্দায় এরকম প্রযুক্তির অনেক হাতবদল হচ্ছে, যা কিনা অনেকের জন্যেই অফশোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্যে বিরাট সুযোগ করে দিচ্ছে। এই সুযোগ যে সবসময় আসবে না, তা মোটামুটিভাবে বলাই যায়।

বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী রাষ্ট্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে যেভাবে...

শক্তিশালী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কাজের মাঝ দিয়ে। গ্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে! তাহলে বাংলাদেশের শিল্পপতিরা কি এখন মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবেন? নাকি তেলের বাজারে যখন সবকিছু বিনে পয়সায় বেচা-বিক্রি হচ্ছে তখন সুযোগ বুঝে প্রভাব বিস্তার করবেন? পশ্চিম আফ্রিকার অয়েলফিল্ডগুলিতে বিনিয়োগের অভাব এখন। অয়েলফিল্ড সার্ভিসিং কোম্পানিগুলি জনবল ছাটাই করছে। বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকজন চাকুরি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন। দামী হাই-টেক হার্ডওয়্যারগুলি কমদামে বিক্রি করে দিয়ে সম্পদ কমিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলি। মোজাম্বিক হতে পারে বাংলাদেশের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির সরবরাহকারী। এখন কয়লাতে কেউই বিনিয়োগে উতসাহী নয়; অথচ সামনের দিনগুলিতে বাংলাদেশের দরকার হতে চলেছে কোটি কোটি টন কয়লা। একটা সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের পুরো জ্বালানি চিত্রকে পালটে দিতে পারে। বিশ্বের জ্বালানি সেক্টর তেলের মুল্যের অবনমনের কারণে কোনমতে বেঁচে আছে। এই সেক্টরের বিদেশী কোম্পানির উপরে বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? তার উপরে তেল-গ্যাস হচ্ছে কৌশলগত খণিজ, যার নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। রাষ্ট্র কখনোই তার নিজের লোক ছাড়া অন্য কাউকে এই সম্পদ হস্তান্তর করতে পারে না।
 
ভারতের ওএনজিসি-এর কর্মীরা কাজ শুরু করছেন একটে অফশোর গ্যাস রিগে। বঙ্গোপসাগরে এধরনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি ভারতীয় কোম্পানিগুলি নিজেদের দখলে নিচ্ছে। বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ কি পারে না গোঁ ধরতে যে – বঙ্গোপসাগরের মাঝে গ্যাস রিগে সামিটের নাম বড় করে লেখা থাকবে? নাকি সেখানে তারা রিলায়েন্সের নাম দেখলেও মনে করবেন যে তাদের জীবনে আর কোন সফলতা চাওয়ার নেই, তাই তারা চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন? ক্যারিয়ারের শেষে এসে আদানি-টাটা-রিলায়েন্সদের কাছে মাথা নিচু করে দুনিয়া প্রস্থান করাটা “সফলতা”, নাকি বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের মাঝে এবং আফ্রিকার মাটিতে নাম খোদাই করে বাঘের গর্জন দিয়ে প্রস্থান; কোনটা?

বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরকে শক্তিশালী ভিত্তি দেয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ বারংবার পাওয়া সম্ভব নয়। বসে থেকে সময় নষ্ট করলে পরে পস্তাতে হবেই। বাংলাদেশের শিল্পপতিরা যারা সামনের দিকে দেখতে সক্ষম, তারা কি উপরের দিকেও দেখতে সক্ষম? মানুষ সারাজীবন বাঁচে না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফলতা পেতে পেতে চুলে পাক ধরেনি – এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। যারা এখনও মনে করেন যে তাদের দেশকে এখনও কিছু দেবার রয়েছে, তারা কি সত্যিই দেখতে পাচ্ছেন যে যতদিন তারা দুনিয়াতে আছেন ততদিন তারা উপরের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন; নিচের দিকে তাকিয়ে নয়? উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ কি পারে না গোঁ ধরতে যে – বঙ্গোপসাগরের মাঝে গ্যাস রিগে সামিটের নাম বড় করে লেখা থাকবে? নাকি সেখানে তারা রিলায়েন্সের নাম দেখলেও মনে করবেন যে তাদের জীবনে আর কোন সফলতা চাওয়ার নেই, তাই তারা চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন? ক্যারিয়ারের শেষে এসে আদানি-টাটা-রিলায়েন্সদের কাছে মাথা নিচু করে দুনিয়া প্রস্থান করাটা “সফলতা”, নাকি বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের মাঝে এবং আফ্রিকার মাটিতে নাম খোদাই করে বাঘের গর্জন দিয়ে প্রস্থান; কোনটা?

No comments:

Post a Comment