একুশ শতকে বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে বহু জায়গায়। তবে একটি স্থানে সবগুলি আলোচনা পাওয়া যায়না সর্বদা। এখানে এমনই একটি চেষ্টার অবতারণা করা হয়েছে।
ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের কারণে এটিই পৃথিবীর একমাত্র এলাকা যেখানে তিনটি বিশাল নদী (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক) একস্থানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। সুপেয় পানির প্রাচুর্য্যের জন্যে এখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এখানে এসে বুঝেছিল যে এই এলাকায় একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের সকল নিয়ামক রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তারা এই এলাকার শক্তি বুঝতে পেরে কোলকাতা নামের একটি বন্দর স্থাপন করে সেখানেই উপনিবেশের রাজধানী করে। |
প্রথমতঃ বঙ্গোপসাগরের ঐতিহাসিক ভূকৌশলগত গুরুত্ব
ভূকৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আছে। ভারত মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের কারণে এটিই পৃথিবীর একমাত্র এলাকা যেখানে তিনটি বিশাল নদী (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক) একস্থানে মিলিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। সুপেয় পানির প্রাচুর্য্যের জন্যে এখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এখানে এসে বুঝেছিল যে এই এলাকায় একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের সকল নিয়ামক রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তারা এই এলাকার শক্তি বুঝতে পেরে কোলকাতা নামের একটি বন্দর স্থাপন করে সেখানেই উপনিবেশের রাজধানী করে। প্রায় দু’শ বছর এই এলাকা শাসন করে যাবার আগে তারা এই এলাকাটাকেই দুই ভাগ করে দু’টি দেশের মাঝে বিতরণ করে দেয়, যাতে এখানে শক্তিশালী আরেকটি দেশের আবির্ভাব না হতে পারে। এর ফলে ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের রেখে যাওয়া এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া বাংলাদেশ স্বনির্ভর না হয়ে সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে যায়। এভাবেই বঙ্গোপসাগরে নতুন একটি নৌশক্তি আবির্ভাবের ভিত তৈরি হয়ে যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ বাণিজ্য হয় নৌপথে, তাই নৌশক্তি বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর একারণেই পৃথিবীর কোন অঞ্চলে শক্তিশালী কোন নৌশক্তির অবির্ভাব যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরুদ্ধ। একইসাথে ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় এই নৌশক্তির আবির্ভাব ভারতেরও স্বার্থবিরুদ্ধ। কাজেই একুশ শতকের বাস্তবতায় বঙ্গোপসাগরে যেকোন নৌশক্তির আবির্ভাবে ভারত বাধা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন যোগাবে।
দ্বিতীয়তঃ দু’দশকের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন
দুই দশকের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে চীনের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে মালাক্কা প্রণালীতে চীনকে আটকানোর পরিকল্পনা শুরু করে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের মোট জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত করে। এমতাবস্থায় মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করাটা চীনের জাতীয় স্বার্থের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির একটি হয়ে পড়ে। চীনারা মালাক্কাকে বাইপাস করে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে থাকে। সেই লক্ষ্যে চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত স্থলভাগের উপর দিয়ে রুটগুলিকে চীনারা ডেভেলপ করা শুরু করে। মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে সেখান থেকে মিয়ানমারের মাঝ দিয়ে তেল এবং গ্যাসের পাইপলাইন চীনের কুনমিং পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের গোয়াদরে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে সেখান থেকে একটি ব্যয়বহুল ইকনমিক করিডোর তৈরি করে সেটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যাবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আসা জাহাজগুলি যেহেতু বেশিরভাগই শ্রীলংকা হয়ে যায়, তাই চীনারা শ্রীলংকাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। আর যেহেতু মালাক্কা আটকে দেয়ার হুমকিতে ভারত মহাসাগরে চীনাদের আবির্ভাব হয়েছে, তাই ভারত স্বভাবতই চীনকে হুমকিস্বরূপ নেবে। এই হিসেবে ভারত চীনকে ঠেকাতে স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে আসে।
তাহলে এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা কোথায়? বঙ্গোপসাগরে চীনারা যা-ই চেষ্টা করুক না কেন, সেখানে ভারতের অবস্থানের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী দেশ না থাকলে ভারত চীনের এই পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করবে খুব সহজেই। আর চীনারা অতদূর থেকে ভারত মহাসাগরে এসে এই জ্বালানি রুটের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে না। তাই চীনারা চায় বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব হোক। সেই রাষ্ট্র সরাসরি চীনের পক্ষে না থাকলেও যেহেতু ভারত (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে) তার প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে দেবে না, তাই অটোমেটিকভাবে সেই রাষ্ট্র ভারতের শত্রুতে পরিণত হবে। চীন যেহেতু শুধু অর্থনৈতিক শক্তি (আদর্শিক শক্তি নয়), তাই চীনারা ভারত মহাসাগরে নতুন শক্তির সাথে সংঘাত এড়িয়ে চলবে, কারণ সেই শক্তি চীনের অতি দরকারী জ্বালানি এবং খণিজের নিয়ন্ত্রক হবে।
তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক উত্থান
গত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেটা কেউই খেয়াল করেনি। দেড় দশকে এই দেশের অর্থনীতি প্রায় চার গুণ হয়ে গিয়েছে! চীন এবং ভারতের উত্থানের তুলনায় ছোট বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষকের চোখে পড়েনি বাংলাদেশ। আবার অনেকেই ভূরাজনৈতিক জ্ঞান না রাখায় এই এলাকায় কোন নতুন অর্থনৈতিক শক্তির আবির্ভাবকে খেয়াল করেনি। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে গত বছর পাঁচেক ধরে। অনেকেই খেয়াল করা শুরু করেছে যে যখন বিশ্বের অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তিগুলি ডাবল ডিজিটে এগুচ্ছিল, তখন যেমন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ, আবার যখন বিশ্বজুড়ে মন্দা শুরু হলো, তখনও এই দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই দৃঢ়তা পশ্চিমাদের বিচলিত করে এবং এরপর থেকেই হিসেব-নিকেশ শুরু হয়ে যায় – কি করে দেশটিকে আটকানো যায়। উপরোল্লিখিত কারণগুলির সাথে অর্থনৈতিক উত্থান যোগ হলে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বঙ্গোপসাগরে একটি আঞ্চলিক শক্তির আবির্ভাব হতে পারে। Subversion-এর মাধ্যমে এই দেশটিকে দুর্বল করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছিল। তবে সেটা এখন নতুন মাত্রা নেয় যখন সেখানে “সন্ত্রাসবাদ” শব্দটি যুক্ত করা হয়।
চতুর্থতঃ আদর্শিক সংঘাত
ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বব্যাপী রাজত্বের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলামকেই দেখতে শুরু করে। মার্কিন চিন্তাবিদেরা তাই খোলাখুলিই বলতে থাকেন যে মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি কর্তন করা হোক। ৯/১১-এর পর থেকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবতারণা করে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সকল দেশে সংঘাতের সূচনা করে। লক্ষ্য – কোন শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র তৈরিতে বাধা দেয়া, যা কিনা মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে প্রতিস্থাপন করে বর্তমান Global Order-কেই পরিবর্তন করতে পারে। সে হিসেবে মুসলিম বিশ্বের জনবহুল, অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ভূকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হয়। ১৬ কোটি জনসংখ্যা, ২২০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, বঙ্গোপসাগরে ভূকৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান, এবং ভূরাজনৈতিক কারণে চীনের কাছে গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া – এসব কারণে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির একটিতে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে আটকাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সমর্থন দেয়া, মিয়ানমারকে মুসলিম-বিদ্বেষী করা, সন্ত্রাসবাদের নাম করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে হস্তক্ষেপ, ইত্যাদি নীতি নিতে থাকে।
উপরের সবগুলি কারণ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রথম কারণটি সর্বদাই ছিল, যা ব্রিটিশরা বুঝেছিল এবং সে বুঝে দেশ ভাগ করেছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কারণগুলি গত দুই দশকের মাঝে সৃষ্ট, যা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত গড়তে সহায়তা করছে। আর চতুর্থটি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে যে মুহুর্ত থেকে এখানে ইসলাম এসেছে, অর্থাৎ ১২০৬ সাল থেকে। শেষ এই কারণটি বাকি সবগুলির মালিকানা নিয়ে নেয়, কেননা প্রথম তিনটি কারণ কিছু নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে শুধুমাত্র আঞ্চলিক একটি শক্তি তৈরি করতে সক্ষম; কিন্তু চতুর্থটি একটি পরাশক্তির জন্ম দিতে সক্ষম। একুশ শতকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যখন “ট্রাম্প কার্ড” ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের উত্থান সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক উপাখ্যানের একটি।
দারুন গুরুত্ববহ পোষ্ট।
ReplyDeleteদারুণ বিশ্লেষণ
ReplyDeleteএখানে প্রতিটি পোস্ট খুবই গুরুত্বপূর্ন এবং তথ্যবহুল।
ReplyDelete