Tuesday 15 September 2015

ব্রিটিশ-ডাচ বিরোধ এবং আমাদের জন্য শিক্ষা

১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  
ইংলিশরা রানী এলিজাবেথের সময় তেমন শক্তিশালী না হলেও তার সময়েই ইংল্যান্ড সমুদ্রে তার প্রথম প্রতিদ্বন্দী স্পেনকে তার রাস্তা থেকে সড়াতে সক্ষম হয়।



ইউরোপের ছোট্ট রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের সারা বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাব এবং তাদের দ্বারা পরবর্তীতে বিশ্বের এক বিশাল অংশের ভাগ্য নির্ধারণী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজন এক সত্যিকারের আশ্চর্য্য ইতিহাস। দুই শতকের বেশি সময় ধরে দুনিয়ার রাজা বনে যাওয়া এই রাষ্ট্রের ইতিহাস পর্যালোচনার মাঝে নিহিত রয়েছে অনেক রাষ্ট্রের বর্তমান উত্থান বা পতনের মূল গল্প, যা কিনা সেই রাষ্ট্রসমূহের ভবিষ্যত চিন্তার পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। কিছুদিন আগে মার্কিন জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড মাহানের থিওরির উপরে ভিত্তি করে ব্রিটিশদের (তথা ইংলিশদের) ভারতীয় উপমহাদেশের সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র বাংলাকে বিভাজনের কাহিনী নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই আলোচনারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সামনের দিনগুলি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাণিজ্য জাহাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলাম। এই সমুদ্র বাণিজ্য নিয়েই আজকে কিছু কথা বলতে চাই, যা থেকে ভারত মহাসাগর এবং অন্যত্র ব্রিটিশদের সমুদ্র বাণিজ্য-কেন্দ্রিক চিন্তাধারার কিছু প্রধান দিক পাওয়া সম্ভব। আর এই চিন্তাধারাগুলি বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ভারত মহাসাগর নিয়ে চিন্তার জন্যে দেবে নতুন খোরাক।

ইংল্যান্ডের কাহিনী কি শুধু ইংল্যান্ডে?

ইংল্যান্ড নিয়ে কথা বলতে চাইলেও ইংল্যান্ডের ইতিহাস এখানে বর্ণনা করতে চাই না। বরং ইউরোপের কঠিন বাস্তবতা পেরিয়ে ইংল্যান্ড কিভাবে অন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সামনে চলে আসে, সেটা নিয়েই কথা বলবো। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের সাথে ইউরোপের অন্য দেশগুলির সম্পর্কই হবে আজকের আলোচনার মূল ভিত্তি। এর আগের লেখাগুলিতে বলার চেষ্টা করেছি যে ইংল্যান্ড (তথা ব্রিটেন) সমুদ্র বাণিজ্যকে কাজে লাগিয়ে বিশাল সম্পদের মালিক বনে যায়। সেই ইতিহাস ঘাটতে হলে ইউরোপের অন্য দেশগুলির সমুদ্র বাণিজের ইতিহাসও ঘাটতে হবে; কারণ এদের সকলের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। একজনের উত্থান আরেকজনের পতন ঘটিয়েছে। ইউরোপের এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি পুঁজিবাদের প্রধান স্তম্ভগুলিকে কাজে লাগিয়েই একে অপরকে পেছনে ফেলতে চেয়েছে। একত্রে চলার নীতি তারা পুঁজিবাদ থেকে কখনো পায়নি বলেই কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে একত্রে হতে দেখা গেলেও সেটা ছিল মূলত স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা নয়। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা বলতে রাষ্ট্রের উত্থানই তাদের একমাত্র পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ইউরোপে রেনেসাঁর সময় থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের বিরূদ্ধে সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়ায় স্পেন এবং পর্তুগাল। এই দুইটি দেশ আফ্রিকা এবং আমেরিকায় নতুন ভূমি খুঁজে পাওয়া এবং সেখানে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে বিশাল সম্পদের অধিকারী হতে থাকে। তারা পুঁজিবাদের মার্কেন্টিলিস্ট পলিসির উদাহরণ টেনে একচেটিয়া (মনোপলি) ব্যবসা করতে থাকে সেই নতুন জায়গাগুলিতে। এখানে ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চদেরকে তারা দাঁড়াতেই দেয়নি। ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি তখন দক্ষিণ ইউরোপের সাথে উত্তর এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিরে মাঝে সমুদ্র বাণিজ্য করেই দেশ চালাতো। এই বাণিজ্য তাদের জন্যে ছিল অপেক্ষাকৃত কম লাভজনক, কারণ এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ডাচদের হাতে, যারা ছিল স্প্যানিশ রাজ্যের একটা অংশ। এই ডাচদের কাহিনীই হয়ে দাঁড়ালো ইউরোপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী।

 
https://en.wikipedia.org/wiki/Anglo-Dutch_Wars
ইংলিশরা সপ্তদশ শতকে ডাচদের বিরূদ্ধে তিন দফা যুদ্ধ করেও তাদের নৌশক্তিকে পুরোপুরি খর্ব করতে ব্যর্থ হয়। তবে তৃতীয় দফা যুদ্ধই বলে দেয় যে ডাচদের দুর্বলতা কোথায়।

ডাচদের উত্থান ও পতন

ষোড়শ শতকের শেষ দিকে ইংলিশদের সাথে স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজদের বাণিজ্য দ্বন্দ শুরু হয়। ক্যাথোলিক এই দুই দেশ ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ বা আমেরিকাতে ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চদের বাণিজ্য করার অনুমতি না দেয়ায় শেষোক্ত দেশদু’টি জলদস্যুতার আশ্রয় নেয়। সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি এবং চালনায় ইংলিশরা এগিয়ে থাকায় তারাই একমাত্র স্প্যানিশদের জন্যে সত্যিকারের বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। স্পানিশরা বহু দূরদুরান্তে উপনিবেশ স্থাপন করলেও স্প্যানিশরা জাতি হিসেবে সমুদ্রের প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা রাখতো না। তাদের বাণিজ্য জাহাজের একটা বিরাট অংশ চালনা করতো ডাচরা, যারা বহু আগে থেকেই সমুদ্রগামী জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল (এ বিষয়ে এর আগেও আলোচনা করেছি)। ডাচদের সমস্যা ছিল তাদের প্রায় উন্মুক্ত স্থলসীমান্ত। স্প্যানিশরা স্থলশক্তি হওয়ায় তারা ডাচদের সীমানা প্রহরার জন্যে সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করতো, যা কিনা ডাচদের নিজেদের জন্যে ছিল বেশ কষ্টকর। ডাচরা এর বিনিময়ে স্পানিশদের সমুদ্রগামী জাহাজগুলি চালনা করতো। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপের উপকূলের ঠিক মাঝামাঝি হবার কারণে দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর-পূর্ব ইউরোপের মাঝে বেশিরভাগ বাণিজ্যই তারা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়। এর সাথে সাথে রাইন নদী নেদারল্যান্ডের মাঝে দিয়ে সমুদ্রে পড়ায় তাদের দেশের মাঝ দিয়ে এই নদী ব্যবহার করে জার্মানরা তাদের প্রায় সকল বাণিজ্য সম্পাদন করতো। রাইন ছিল মধ্য-ইউরোপের সুপার হাইওয়ে; আর সেটার চাবি ছিল ডাচদের হাতে। ডাচদের হাতে ছিল ইউরোপের সমুদ্রগামী বাণিজ্য জাহাজের বহরের বেশিরভাগ। ডাচরা আমেরিকা এবং এশিয়াতে অনেক উপনিবেশ স্থাপন করে এবং বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। তবে ডাচরা স্প্যানিশদের অধীনে থাকতে চায়নি। তারা স্প্যানিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্যে ১৫৬৮ সাল থেকে ১৬৪৮ পর্যন্ত ৮০ বছর সংগ্রাম করেছে। স্প্যানিশদের থেকে ডাচরা আলাদা হবার সাথে সাথেই ডাচদের স্থলসীমান্ত পাহাড়া দেবার দায়িত্ব পড়ে যায় নিজেদের ঘাড়ে। সেনাবাহিনীর ভার সামলাতে গিয়ে তারা নৌবাহিনীকে দুর্বল করতে বাধ্য হয়। আর শক্তিশালী নৌবহর না থাকার কারণে তাদের সমুদ্র বাণিজ্যকে শত্রু দেশগুলি থেকে রক্ষা করার কোন পদ্ধতিই রইলো না। আর অপরদিকে এমনিতেই সমুদ্রাভিমুখী না হবার কারণে স্প্যানিশরা ইংলিশদের কাছে শুধু হেরেই যাচ্ছিলো। আর ডাচদের হারিয়ে স্প্যানিশদের দুর্বল হবার ইতিহাসের শেষ হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীকে ডাচদের স্বর্ণযুগ বলা হয়; যার অবসান হয় ব্রিটিশদের সাথে টিকতে না পেরে। স্বাধীনতা পাবার পরপরেই ডাচদের উপরে চড়াও হয় ইংলিশরা। সমুদ্র বাণিজ্য থেকে ডাচদের বের করার চেষ্টায় ১৬৫২ সালে ইংলিশরা যুদ্ধ শুরু করে ডাচদের সাথে। যুদ্ধে ইংলিশরা ডাচদের ১,২০০ থেকে ১,৫০০ বাণিজ্য জাহাজ দখল করে নেয়, কিন্তু তারপরেও ১৬৫৪ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত সমুদ্র থেকে ডাচদের বিতাড়িত করতে ব্যর্থ হয়। এই কারণে ১৬৬৫-৬৭ সালের মধ্যে ইংলিশদের সাথে ডাচদের আরেক দফা যুদ্ধ হয় সমুদ্র বাণিজ্যের দখল নিয়ে। এবারেও ইংলিশরা ৪৫০টা ডাচ জাহাজ দখল করলেও যুদ্ধ জিততে ব্যর্থ হয়। পরপর দু’টা যুদ্ধ শেষপর্যন্ত ডাচদের দিকে হেলেই শেষ হয়। কিন্তু ইংলিশরা হাল ছাড়েনি। ১৬৭২ সালে ইংলিশরা ফ্রেঞ্চদের সাথে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ শুরু করে ডাচদের বিরূদ্ধে। ফ্রেঞ্চরা ডাচদের স্থলভূমি দিয়ে আক্রমণ করায় এবারে যুদ্ধের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। সমুদ্র থেকে ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ নৌবহর আক্রমণ করে ডাচদের হারাতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে গিয়ে ডাচদের সেনাবাহিনীতে বিনিয়োগ করতে হয়। ইংলিশরা ১৬৭৪ সালে যুদ্ধ থেকে ঝরে পরে, কিন্তু ফ্রেঞ্চরা ১৬৭৮ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে ডাচদের সমুদ্র শক্তি দুর্বল হতে থাকে।

 
http://skepticism.org/timeline/july-history/7162-protestant-king-william-iii-england-defeats-catholic-king-james-ii-battle-boyne.html
ডাচ রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডেরও রাজা হবার পরে ডাচদের সমুদ্রশক্তির কফিনের শেষ পেরেকগুলি গাঁথা হয়। ডাচদের রাজা হয়েও উইলিয়ামের নীতি ভেতর থেকে ডাচ শক্তির বিরূদ্ধে এজেন্টের মতো কাজ করেছে।


রাজার এক দেশ; মনে-প্রাণে দুই দেশ

১৬৮৯ সালে ডাচ রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ব্রিটিশদের আমন্ত্রণে ব্রিটিশদেরও রাজা (রাজা ছিলেন ১৬৮৯ খ্রিঃ-১৭০২ খ্রিঃ) হয়ে যান। ব্রিটিশ এবং ডাচদের নৌবাহিনী তখন একত্রিত হয়ে যায়। এসময় একই দেশের অংশ হওয়া সত্তেও ব্রিটিশরা ডাচদের নিজেদের সমকক্ষ করতে চাননি। ঠিক করা হয় যে, পুরো নৌবহরের ৮ ভাগের ৫ ভাগ হবে ব্রিটিশ এবং বাকি ৩ ভাগ হবে ডাচ। অর্থাৎ ডাচ নৌবহরের আকৃতি হবে ব্রিটিশ নৌবহরের প্রায় অর্ধেক (৩/৫), যা কিনা আগে শক্তির দিক থেকে যথেষ্ট কাছাকাছি ছিল। এভাবে একই রাজের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকেরা ডাচদের নৌবহরকে ছোট করে ফেলে। উইলিয়াম ডাচদের স্থলসীমানা রক্ষার জন্যে বড়সড় একটা সেনাবাহিনীও গড়ে তোলেন, যা কিনা বড় নৌবহর রক্ষণাবেক্ষণ করার পেছনে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। শুধু ফ্লীটের আকৃতি ছোট করাই নয়, একজন ডাচ এডমিরালকে একজন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের নিচে স্থান দেওয়া হতো। একই রাজা থাকা সত্তেও ব্রিটিশরা ডাচদেরকে সবসময়েই নিজেদের সমুদ্রনীতিতে প্রতিদ্বন্দী হিসেবেই দেখেছে। উইলিয়ামের শাসনকে ব্রিটিশরা ইতিহাসে ছোট একটা ঘটনা হিসেবে দেখেছে, তাই তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী নীতিতে পরিবর্তন আনেনি। উইলিয়ামের নীতির কারণে ইউরোপের বাণিজ্যের কেন্দ্র হল্যান্ড থেকে লন্ডনে চলে যায়। ১৭২০ সাল নাগাদ ডাচদের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায়। আর ১৭৮০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ড (এখন গ্রেট ব্রিটেন)-এর মাথাপিছু জিডিপি ডাচদের অতিক্রম করে যায়। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৪ সালের আরেক দফা যুদ্ধে ডাচরা ব্রিটিশদের বিরূদ্ধে দাঁড়ানোর সকল ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এভাবে সপ্তদশ শতকের স্বর্ণযুগের অধিকর্তা ডাচদের করুন পরিণতি হয়। ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের পর ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবে ডাচদের স্বাধীনতাও শেষ হয়ে যায়।

 
http://www.returnofkings.com/37944/10-life-lessons-from-louis-xiv
ফ্রেঞ্চ রাজা চতুর্দশ লুই ফ্রান্সকে শক্তিশালী স্থলশক্তিতে পরিণত করেন। কিন্তু একইসাথে ডাচদের বিরূদ্ধে স্থলযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ব্রিটিশ সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দেন

ব্রিটিশদের পরবর্তী শিকার – ফ্রান্স

স্প্যানিশদের থেকে আলাদা হবার সাথে সাথেই ডাচদের উপরে চড়াও হয় ইংলিশরা। ফ্রেঞ্চরা ইংলিশদের পক্ষ নেয় ডাচদের বিরূদ্ধে। আলফ্রেড মাহানের মতে এটা ছিল ফ্রেঞ্চদের একটা বিরাট ভুল। স্প্যানিশদের মতো ফ্রেঞ্চরাও ইউরোপের মূল ভূখন্ডের স্থলশক্তি ছিল; সমুদ্র ছিল তাদের জন্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। ফ্রেঞ্চরা ডাচদেরকে তাদের বন্ধু না বানিয়ে শত্রু বানিয়ে ফেলায় ফ্রেঞ্চরা একটা শক্তিশালী সমুদ্রাভিমুখী বন্ধু থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনী তৈরি করতে গিয়ে ডাচদের নৌশক্তি দুর্বল হতে থাকে এবং সমুদ্র বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই ব্রিটিশদের (তথা ইংলিশদের) নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে পর পর স্প্যানিশ এবং ডাচদের মতো দু’টা বিরাট শক্তিকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিতে সফল হয় ব্রিটিশরা। এখন তাদের সামনে রইলো শুধু ফ্রান্স। ঐতিহাসিকভাবেই ফ্রেঞ্চরা সমুদ্র বাণিজ্যকে খুব একটা গৌরবোদ্দীপ্ত কাজ মনে করতো না, সে কারণে ব্রিটিশরা যে সমুদ্রের রাণী, এটা ফ্রেঞ্চরা একরকম মেনেই নিল। একসময় ব্রিটিশদের ১৩০ খানা যুদ্ধজাহাজের বিপক্ষে ফ্রেঞ্চদের পক্ষে ৪৫টার বেশি মোতায়েন করা সম্ভব ছিল না। ফ্রান্সের প্রতাপশালী রাজা চতুর্দশ লুই-এর সময়ে (রাজা ছিলেন ১৬৪৩ খ্রিঃ- ১৭১৫ খ্রিঃ) অর্থমন্ত্রী জঁ-বাতিস্ত কলবের (মন্ত্রী ছিলেন ১৬৬৫ খ্রীঃ-১৬৮৩ খ্রীঃ) ফ্রেঞ্চ সরকারের সমুদ্র নিয়ে ভাবনায় কিছুটা পরিবর্তন আনলেও তার পরবর্তী নীতিনির্ধারকেরা তাকে অনুসরণ করেননি। যার কারণে ফ্রান্স ইউরোপের মূল ভূখন্ডে অনেক কিছু জয় করতে পারলেও ব্রিটেনের মতো সম্পদশালী হতে পারেনি কখনোই। ব্রিটেন ইংলিশ চ্যানলের ওই পাড়ে থেকেই ফ্রান্সের আশেপাশের সকল সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশরা আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়াতেও ঐপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল এবং ডাচদের ছাড়িয়ে যায়। এভাবে একে একে স্প্যানিশ, ডাচ এবং ফ্রেঞ্চদের পেছনে ফেলে উপরে উঠে আসে ব্রিটিশরা।

ডাচদের থেকে কি কিছু শেখার আছে?

ডাচদের সমুদ্রশক্তির বিরূদ্ধে ব্রিটিশদের এই গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি থেকে কিছু জিনিস বের করা যায়। প্রথমত, সমুদ্র বাণিজ্য যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা অন্যের হাতে সেটার নিয়ন্ত্রণ কখনোই ছেড়ে দেবে না। কারণ এই বাণিজ্যই হচ্ছে উতপাদন কেন্দ্র এবং পণ্যের বাজারের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র। সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার মাঝেই পুঁজিবাদী বিশ্বে একটা দেশ অন্য দেশের উপরে কর্তৃত্ব করে। নতুন কোন শক্তি যাতে সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে ভাগ বসাতে না পারে, সেটা বর্তমান কর্তারা খেয়াল রাখবে; দরকার হলে কয়েকজন একত্রিত হয় নতুন শক্তিকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়ত, সমুদ্র শক্তির একটা দেশকে সমুদ্র থেকে সরানোর একটা পদ্ধতি হলো তাকে স্থলভাগে ব্যতিব্যস্ত রাখা। ব্রিটিশরা ফ্রেঞ্চদের সাথে একত্রিত হবার সাথেসাথেই ডাচদের স্থলসীমানায় ফ্রেঞ্চদেরকে আবির্ভাব ঘটে। তৃতীয়ত, নিজেদের স্থলসীমানা নিরাপদ করতে একটা সমুদ্র-শক্তির যদি অন্য একটা স্থলশক্তির সাহায্য লাগে, সেক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তি চাইবে এই সমুদ্র-শক্তি এবং স্থলশক্তির মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে। বাইরের শক্তির উপরে নিজের সীমানা রক্ষার জন্যে নির্ভর করার কারণে ঐ সমুদ্র-শক্তি সবসময়েই বিপদের মুখে থাকবে। চতুর্থত, কোন নব্য সমুদ্রশক্তির দেশ যদি নিজেদের নীতিনির্ধারণে আরেকটি প্রতিষ্ঠিত সমুদ্রশক্তিকে ডেকে আনে বা সুযোগ করে দেয়, তাহলে সেই নব্য সমুদ্রশক্তির দেশের সমুদ্রশক্তি হবার সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।

কি করা, আর কি না করা

বাংলাদেশ এখন বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকাচ্ছে; যা নিয়ে এর আগেই বিস্তর আলোচনা করেছি। এখন এদেশের নেতৃত্বের খেয়াল রাখতে হবে যে ব্যাপারগুলির দিকে, তা হচ্ছে – এক. সমুদ্রশক্তি হতে গেলে বাধা আসবেই, এমনকি সমন্বিত বাধাও আসতে পারে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বিশ্বের শক্তিদের সাথে পেরে ওঠা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খালি নেই। নেতৃত্বের কঠোর ভূমিকাই একমাত্র দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্বে যারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে, তারা নিজেদের স্বার্থ দেখে এবং কখনো দরজা ছেড়ে সড়ে দাঁড়ায় না। আরেকজনের নিয়ন্ত্রিত দরজা দিয়ে কতদিন নিজের খেয়ালখুশিমতো যাতায়াত করা সম্ভব, সেটা প্রশ্নাতীত নয়। দুই. অপর কোন সমুদ্রশক্তিকে কোন অবস্থাতেই দেশের নীতি নির্ধারণে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সেটা দেওয়া হলে সমুদ্র বাণিজ্য তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, এমনকি তারা ছলে বলে কৌশলে দেশের স্থলসীমানায় অস্থিরতা সৃষ্টি করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ নষ্ট করার পদ্ধতি করে দিতে পারে, যাতে সমুদ্রশক্তি তৈরি করার জন্যে অর্থের সঙ্কুলান না হয়।

No comments:

Post a Comment