Sunday 2 January 2022

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক ফোকাসের মাঝেই বলকানে জাতিগত সমস্যার পুনরুদ্ধান

০২রা জানুয়ারি ২০২২

ডানপন্থী সার্ব জাতীয়তাবাদী নেতা মিলোরাদ দোদিক।  পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতারা যখন নতুন করে সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তখন ইন্দোপ্যাসিফিক নিয়েই ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র; ১৯৯০এর দশকে ওয়াশিংটনের ছায়াতলে স্বাক্ষরিত ডেইটন শান্তি চুক্তিকে ধরে রাখার মতো সময় তাদের নেই। বলকানে তিন দশকের ভিতরেই গণতান্ত্রিকভাবেই ভেঙ্গে পড়ছে মার্কিন রাজনৈতিক সমাধান।

 
গত ১০ই ডিসেম্বর বসনিয়ার জাতিগত সার্ব অংশের পার্লামেন্টের এক ভোটাভুটিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সার্বরা বসনিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি থেকে বের হয়ে যাবে। উত্তপ্ত বাকবিতন্ডার মাঝে ডানপন্থী সার্ব জাতীয়তাবাদী নেতা মিলোরাদ দোদিক যথেষ্ট ভোট পেয়ে সার্বদেরকে বসনিয়ার সেনাবাহিনী, আদালত এবং কর ব্যবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্যে আইন তৈরি করার জন্যে সমর্থন পেয়ে যান। ছয় মাসের মধ্যে এই প্রস্তাবগুলি আইন আকারে স্বীকৃতি পেতে পারে। বিরোধী দলীয় সাংসদ ব্রানিস্লাভ বোরেনোভিচ সমালোচনা করে বলেন যে, এই প্রস্তাবের অর্থ হলো সংঘাত; যুদ্ধ এবং মৃত্যু। তিনি দোদিককে জিজ্ঞেস করেন যে, রিপাবলিকা সার্পস্কার সেনাবাহিনী কিসের প্রতিনিধিত্ব করবে? ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমানের জন্যে অর্থ কোত্থেকে আসবে? সীমানায় চেকপোস্ট বসানোর শর্তগুলি কি হবে? এই উত্তরগুলি দোদিককে দিতে হবে বলে তিনি দাবি করেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সার্বদের এই সিদ্ধান্তের খবরটা বসনিয়ার তথা পুরো বলকানের কঠিন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বলেই উল্লেখিত হয়।

পৃথিবীর অন্যতম জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে ‘ইউরোনিউজ’ বসনিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থার বর্ণনা দিয়েছে। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধের শেষে মার্কিন মধ্যস্ততায় ডেইটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান বসনিয়া রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। এই রাষ্ট্রের মাঝে রয়েছে দু’টা আলাদা প্রশাসনিক সত্ত্বা। একটা হলো জাতিগত সার্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে রিপাবলিকা সার্পস্কা; আর অন্যটা হলো বসনিয়াক এবং ক্রোয়াটদের নিয়ে গঠিত ফেডারেশন অব বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা। জাতিগত সার্বরা হলো মূলতঃ অর্থোডক্স খ্রিস্টান; বসনিয়াকরা মূলতঃ মুসলিম; ক্রোয়াটরা মূলতঃ ক্যাথোলিক খ্রিস্টান। উভয় অঞ্চলকেই বেশকিছু ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবে বসনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার কিছু ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করে; যার মাঝে রয়েছে সেনাবাহিনী, সর্বোচ্চ আদালত এবং কর আদায়ের কাঠামো। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান হলো তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রেসিডেন্সি; যার সদস্যরা হলেন বসনিয়াক, সার্ব এবং ক্রোয়াট। তিন জাতির মানুষের ভোটের দ্বারা তারা আলাদাভাবে নির্বাচিত হন। বর্তমানে এর বসনিয়াক সদস্য হলেন শেফিক জাফেরোভিচ; আর ক্রোয়াট সদস্য জেলিকো কমসিচ। উগ্র জাতীয়তাবাদী অচরণের জন্যে তারা পশ্চিমা দেশগুলির কাছে দোদিক এবং তার সমর্থকদের উপর চাপ সৃষ্টির আনুরোধ জানিয়ে আসছেন। ২০১৩ সালের শুমারি অনুযায়ি বসনিয়ার প্রায় ৩৩ লক্ষ জনসংখ্যার মাঝে ৫০ শতাংশ হলো বসনিয়াক; সার্বরা হলো প্রায় ৩১ শতাংশ; ক্রোয়াটরা ১৫ শতাংশের মতো। ১৯৯০এর দশকে সাবেক ইউগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে যাবার পর ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে ১ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধের মাঝে ভয়ংকর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বসনিয়ার স্রেব্রেনিসা শহরে সার্বদের হাতে ৮ হাজার নিরপরাধ বসনিয়াক মুসলিমের মৃত্যুর ঘটনা এখনও ভয়াবহ এক উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে।

মিলোরাদ দোদিক ২০১০ সালে গণতান্ত্রিক ভোটে রিপাবলিকা সার্পস্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বসনিয়ার প্রেসিডেন্সির সদস্য নির্বাচিত হবার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। এই পদে থাকার সময়েই তিনি বারংবার রিপাবলিকা সার্পস্কাকে বসনিয়ার রাষ্ট্রকাঠামো থেকে আলাদা করে ফেলার কথা বলেন। ডেইটন শান্তি চুক্তিকে হুমকিতে ফেলার কারণে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন সরকার দোদিকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেয় এবং তার সাথে কোন মার্কিন ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু দোদিক বলেন যে তিনি তার উপর অবরোধের কোন তোয়াক্কা করেন না। তিনি বসনিয়ার প্রেসিডেন্সির সদস্য হবার পর থেকে তার জাতীয়তাবাদী কথার তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। ‘ইউরোনিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রিপাবলিকা সার্পস্কার আলাদা সেনাবাহিনী, আদালত এবং কর কাঠামো তৈরি করার পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। তবে তিনি বলেন যে, এসব পরিকল্পনা বসনিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার প্রচেষ্টা নয়, অথবা নতুন করে যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনাকেও উস্কে দেবে না।

 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অব ফরে রিলেশন্স’ বা ‘সিএফআর’এর এক লেখায় চার্লস কুপচান বলছেন যে, ডেইটন চুক্তি অনুসারে বসনিয়ার রাজনীতিটাই হলো জাতিগত। আর সার্বদের নতুন সিদ্ধান্তের অর্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন যে, পুরো বলকান অঞ্চলেই এখন জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ সার্বিয়াও দ্রুত নিজেদের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করছে এবং দেশটার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুনিয়ার সকল সার্বদের একত্রিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন। সার্বিয়া এখনও ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর সহায়তায় সার্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আলবেনিয় মুসলিম অধ্যুষিত কসভোকে স্বীকৃতি দেয়নি; এবং এখনও সার্বিয়ার সাথে কসভোর সম্পর্ক বেশ খারাপ। একইসাথে অত্র অঞ্চলে রাশিয়াও অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মাঝে তার প্রভাব বিস্তার করছে; যার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে ইইউ এবং ন্যাটো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে রাশিয়া। এর মাঝে ইইউ বলকানের ব্যাপারে খুব বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে না; আর যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দোপ্যাসিফিক নিয়ে ব্যস্ত। রাশিয়ার সাথেও চলছে উত্তেজনা। এমতাবস্থায় দোদিকের জাতীয়তাবাদী কর্মকান্ডের ফলে রিপাবলিকা সার্পস্কা যদি বসনিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায়, তাহলে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে; যা বসনিয়ার সীমানার বাইরেও ছড়িয়ে যেতে পারে।

কুপচান বলকানের বেশ কয়েকটা দেশের ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্য হওয়াকে সেখানকার উন্নয়ন আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইইউ এবং ন্যাটো সদস্য দেশ হাঙ্গেরির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবানই যখন উগ্রপন্থী কথা বলছেন, তখন ইউরোপের গণতান্ত্রিকতার মাঝেই জাতীয়তাবাদী সমস্যার গভীরতা নতুধাবন করা যায়। বুদাপেস্টে এক ভাষণে তিনি বলেন যে, বসনিয়াকে যদি ইইউএর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে ২০ লক্ষ মুসলিমের কারণে নিরাপত্তার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। গত ডিসেম্বরে এক সংবাদ সন্মেলনে অরবান বলেন যে, তিনি রিপাবলিকা সার্পস্কাকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছেন এবং তিনি মিলোরাদ দোদিকের উপর অবরোধের বিরোধী। অরবান জার্মানির প্রতি দোদিকের বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকান্ডের কারণে শাস্তি না দিয়ে বরং আলিঙ্গন করার আহ্বান জানান। পূর্ব ইউরোপে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতারা যখন নতুন করে সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তখন ইন্দোপ্যাসিফিক নিয়েই ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র; ১৯৯০এর দশকে ওয়াশিংটনের ছায়াতলে স্বাক্ষরিত ডেইটন শান্তি চুক্তিকে ধরে রাখার মতো সময় তাদের নেই। বলকানে তিন দশকের ভিতরেই গণতান্ত্রিকভাবেই ভেঙ্গে পড়ছে মার্কিন রাজনৈতিক সমাধান।

No comments:

Post a Comment