Thursday 13 January 2022

তুরস্কে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন?

১৩ই জানুয়ারি ২০২২

তুর্কি উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘উলকুচু’ বা ‘গ্রে উল্ভস’ গ্রুপের ‘উলফ স্যালুট’। তুরস্কে সিরিয় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি ঘটনাগুলি একটা ধারাবাহিকতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। আঙ্কারায় সিরিয় শরণার্থীদের সাথে তুর্কিদের দাঙ্গার পর ‘আমরা সিরিয়দেরকে চাই না’, ‘আমরা কোন আফগান চাইনা’ এবং ‘তুরস্ক হলো শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরে যায়।

 
গত ১১ই জানুয়ারি তুরস্কের দক্ষিণের দিয়ারবাকির শহরে ১৮ বছর বয়সী একজন সিরিয় শরণার্থীকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ছুরিকাঘাত করা হয়। এর আগের দিন তুরস্কের বড় শহর ইস্তাম্বুলের বায়রামপাশা এলাকায় নাঈল আল নাঈফ নামের ১৯ বছর বয়সী আরেকজন সিরিয় শরণার্থীকে গভীর রাতে তার ঘরে ঢুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এর আগে ৯ই জানুয়ারি একজন তুর্কি নাগরিককে একজন সিরিয় শরণার্থী সিগারেট দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকায় সিরিয়দের ব্যবহৃত একটা শপিং মলে অনেকজন দুর্বৃত্ত একত্রে হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, কয়েক’শ মানুষ মিছিল করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এবং স্লোগান দিচ্ছে ‘এটা তুরস্ক; সিরিয়া নয়’। তারা একসময় রাস্তার পার্শ্ববর্তী শপিং মলে হামলা চালিয়ে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং মলের ভেতরে থাকা সিরিয়দের উপর হামলা করে। তবে সবচাইতে ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটে তুরস্কের পশ্চিমের শহর ইজমিরে। ১৬ই নভেম্বর কনস্ট্রাকশন সেক্টরে কাজ করা তিনজন সিরিয় কর্মীকে ঘুমের মাঝে পুড়িয়ে মারা হয়। প্রথমে ঘটনাটা দুর্ঘটনা বলে বলা হলেও পরে এর পিছনে হত্যার লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। পুলিশ প্রায় একমাস পর ২১শে ডিসেম্বর কেমাল কোরুকমাজ নামের ৪০ বছর বয়সী একজন তুর্কি নাগরিকের স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে হত্যাকান্ডের তদন্ত শুরু করে। ২৩ বছর বয়সী মামুন আল নাবহান, ২১ বছর বয়সী আহমেদ আল আলী, এবং ১৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল বিশ রাতের বেলায় তাদের ঘরে আগুন লাগলে আর বের হতে পারেননি। গ্রেপ্তারকৃত কেমাল কোরুকমাজ নিজেই ঘটনার দিন আরেক ব্যক্তিকে বলেছিল যে, সে সিরিয়দেরকে খুন করতে চায়। এই সূত্রে পুলিশ তার উপর নজরে রাখার পরেও ঘটনা ঘটে এবং ঘটনার দশ দিন পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, এই ঘটনাগুলি তুরস্কে শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মারাত্মক ধারাবাহিকতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। তবে এই সহিংসতা যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে।

রাজনীতিবিদেরাই যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী

তুরস্কে বর্তমানে ৬০ লাখের মতো অভিবাসী এবং শরণার্থী রয়েছে; যাদের মাঝে প্রায় ৩৬ লাখ হলো সিরিয়। তুরস্কের রাজনৈতিক মহলে অনেকেই বলতে শুরু করেছে যে, তুরস্কের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে সিরিয় শরণার্থীরাই দায়ী। ২০২১ সালে তুরস্কের একটা আদালত ইস্তাম্বুলের পূর্বের শহর বোলুর মেয়রের শরণার্থী বিরোধী কিছু সিদ্ধান্তকে খোলাখুলিভাবে বর্ণবাদী আখ্যা দিয়ে বাতিল ঘোষণা করে। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘রিপাবলিকান পিপলস পার্টি’ বা ‘সিএইচপি’র সদস্য মেয়র তানজু ওজকান সিরিয় শরণার্থীদের জন্যে ১১ গুণ বেশি মূল্যে পানি সরবরাহ করার পরিকল্পনা করেন; একইসাথে সিরিয়দের বিয়ের লাইসেন্স ১ লক্ষ লিরা ধার্য করেন। তিনি বলেন যে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে তার উদ্দেশ্য হলো সিরিয় শরণার্থীদেরকে তার শহর থেকে তাড়ানো। ‘সিএইচপি’র নেতৃত্ব ওজকানের এহেন বর্ণবাদী সিদ্ধান্তের সমর্থন না করলেও তুর্কি রাজনীতিবিদেরা অনেকেই তাদের শরণার্থী বিরোধী কথা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানুয়ারির শুরুতেই তুরস্কের পুলিশ ডানপন্থী দল ‘জাফের পার্টি’র প্রধান উমিত ওজদাগএর বিরুদ্ধে ‘মানুষের মাঝে ঘৃণা ছড়ানো’র অভিযোগ আনে। অথচ অভিযোগ দায়ের কথার তিন বছরেরও বেশি সময় আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওজদাগ দাবি করেছিলেন যে, সিরিয় শরণার্থীরা স্থূলকায় হয়ে যাচ্ছে; যেখানে তুর্কিরা দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হচ্ছে। ওজদাগ একদিন একটা সিরিয় মালিকানার দোকানে ঢুকে ট্যাক্সের কাগজ এবং পরিচয়পত্র দেখতে চান এবং পুরো ব্যাপারটাকে ভিডিও করে অনলাইনে প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দোকান মালিককে তুর্কি ভাষা না বলতে পারার জন্যে তিরস্কার করেন। তিনি টুইটারে লেখেন যে, এই দোকান মালিকের মতো আরও ৯ লক্ষ লোক তুরস্কে রয়েছে; যারা তুরস্কের জন্যে হুমকি। আরেকটা ঘটনায় গত নভেম্বরে তুরস্কের বিরোধী দল ‘আইওয়াইআই পার্টি’র সদস্য ইলায় আসকোয় ৪৫ জন সিরিয়কে তুরস্কের অর্থনীতিকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ভিডিও তৈরির অভিযোগে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। তুর্কি মিডিয়া ‘আহভাল’ বলে যে, গত অক্টোবরে তুরস্কের রাস্তায় এক ব্যক্তি মিডিয়াকে বলে যে, তুর্কিরা অর্থনৈতিকভাবে খুব খারাপ রয়েছে; অথচ তুরস্কে থাকা সিরিয়রা বেশ রয়েছে। তিনি বলেন যে, তিনি কলা কিনতে পারছেন না; অথচ সিরিয়রা কেজি কেজি কলা কিনতে পারছে। এই সাক্ষাতের পর তুরস্কে বসবাসরত কয়েকজন সিরিয় অনলাইনে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে কলা খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর অগাস্টে আঙ্কারার আলতিনদাগ এলাকায় সিরিয় শরণার্থী এবং তুর্কিদের মাঝে দ্বন্দ্ব হানাহানিতে পরিণত হয়। এর মাঝে দু’জন তুর্কি ছুরিকাহত হয়; যাদের একজন পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে। ঘটনার পর শতশত তুর্কি শহরের সিরিয় বাড়িঘর, দোকানপাট এবং গাড়ি ভাংচুর করে। এই ভাংচুরের দৃশ্য অনেকেই টুইটারে লাইভ প্রকাশ করে। ভিডিওগুলিতে অনেককেই দেখা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান ব্যবহার করতে। কেউ কেউ তাদের হাত দিয়ে ‘উলফ স্যালুট’ দিচ্ছিলো; যা হলো তুর্কি উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘উলকুচু’ বা ‘গ্রে উল্ভস’ গ্রুপের চিহ্ন। দাঙ্গার পর ‘আমরা সিরিয়দেরকে চাই না’, ‘আমরা কোন আফগান চাইনা’ এবং ‘তুরস্ক হলো শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশাল মিডিয়া ভরে যায়।

তুরস্কের শরণার্থী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘হেপিমিজ গোচমেনিজ’এর একজন সদস্য য়িলদিজ ওনেন ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, ‘আইওয়াইআই পার্টি’ বা ‘সিএইচপি’র সদস্য বোলুর মেয়র বা উমিত ওজদাগএর মতো লোকেরা যখন বারংবার বলতে থাকে যে শরণার্থীরা তুরস্কের প্রধান সমস্যা, তখন কিছু উগ্রপন্থী লোক শরণার্থীদের উপর হামলা করার কারণ পেয়ে যায়। এটা শুধু কয়েক ব্যক্তির কর্মকান্ড নয়, বরং পুরো দেশে কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক পরিবেশই এসকল ঘটনার জন্যে দায়ী। ওনেন বলছেন যে, সবচাইতে মারাত্মক ব্যাপার হলো, এই ঘটনাগুলি তুরস্কের সরকার বা মিডিয়ার কাছে তেমন কোন গুরুত্বই পায়নি; অথচ লক্ষ লক্ষ তুর্কি, যারা জার্মানিতে বসবাস করে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাদের ব্যাপারগুলি পুরোপুরি আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। যখন জার্মানিতে তুর্কিদের উপর হামলা হয়, তখন রাজনীতিবিদেরা এবং সরকার কঠোর বিবৃতি দেয়; অনেকেই রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। অথচ ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকার ভিডিওতে যখন শতশত মানুষকে সিরিয় দোকানে হামলা করতে দেখা গেলো, তখন মাত্র সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!

 
আঙ্কারার রাস্তায় 'উলফ স্যালুট' দিচ্ছে তুর্কি যুবারা। সিরিয় শরণার্থীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি তুরস্কের সরকার বা মিডিয়ার কাছে তেমন কোন গুরুত্বই পায়নি; অথচ লক্ষ লক্ষ তুর্কি, যারা জার্মানিতে বসবাস করে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাদের ব্যাপারগুলি পুরোপুরি আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে। যখন জার্মানিতে তুর্কিদের উপর হামলা হয়, তখন রাজনীতিবিদেরা এবং সরকার কঠোর বিবৃতি দেয়; অনেকেই রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। অথচ ইস্তাম্বুলের এসেনইয়ুর্ত এলাকার ভিডিওতে যখন শতশত মানুষকে সিরিয় দোকানে হামলা করতে দেখা গেলো, তখন মাত্র সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!

ইজমিরের নৃশংসতা

তুর্কি পত্রিকা ‘ইয়েনি সাফাক’ বলছে যে, ইজমিরের হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তি দেয়া কেমাল কোরুকমাজ ঘটনার ১০ দিন পর গত ২৬শে নভেম্বর দু’জন ব্যক্তিকে আলাদাভাবে ছুরিকাঘাত করে। পুলিশের সামনে সে গর্ব করে স্বীকার করে যে, এর আগে তিনজন সিরিয় নাগরিককে সে নিজেই আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তুর্কি মিডিয়া ‘এভরেনসেল’ বলছে যে, কোরুকমাজ পুলিশকে বলে যে, সে দুই দশক আগে তুরস্কের সামরিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘জেআইটিইএম’এর অধীনে গোপন মিশনে কাজ করতো। সে বলে যে, সে তার গাড়ির উইন্ডশিল্ডের উপর সিরিয়দেরকে হত্যা করার ব্যাপারে পরপর তিনটা নির্দেশনা পাবার পরেই কাজটার পরিকল্পনা শুরু করে। সে অভিযোগ করে যে, সিরিয়রা আসার পর থেকে সে চাকুরি পাচ্ছিলো না। সে মৃত ব্যক্তিদের সাথে একই বাড়িতে থাকা শুরু করে, যা কংক্রিট কোম্পানি ‘বিরলিক বেটন’এর মালিকানায় ছিলো। ঘটনার রাতে সে বের হয়ে গিয়ে পাঁচ লিটার পেট্রোল কিনে এনে বাড়িতে আগুন লাগায়।

ইজমিরে পুড়ে মারা যাওয়া সিরিয়দের একজনের ভাই আহমেদ আল বিশ তুরস্কের কুর্দি মিডিয়া ‘রুদাউ’কে বলেন যে, ভবিষ্যতে যাতে এধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য তিনি ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’, তুরস্কের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছেন। এধরনের হামলা জাতীয়তাবাদীরা করছে বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। মৃত আরেকজনের ভাই আহমেদ আল নাবহান তুর্কি মিডিয়া ‘দুভার’কে বলেন যে, পুলিশ তাকে বলেছিল যাতে সে ঘটনার ব্যাপারে চুপ থাকে। পুলিশ এক ব্যক্তিকে সন্দেহ করছে; এবং সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার হবার আগ পর্যন্ত যেন সে কাউকে কিছু না বলে। আল নাবহান আরও বলেন যে, তিনি চান সরকার যাতে সুষ্ঠু বিচার করে এবং বর্ণবাদ রোধে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাজা দেয়। তিনি বলেন যে, তুর্কি, সিরিয়, ইরাকি, জর্ডানিয়ানরা সকলেই মুসলিম। তুরস্কের ১৩টা মানবাধিকার সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে বলে যে, ইজমিরের ঘটনাটা ছিল পুরোপুরিভাবে বর্ণবাদী চিন্তা প্রসূত। তারা ঘটনা তুরস্কের জনগণ এবং মৃতদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে তুর্কি সরকারকে দায়ী করেন। তুরস্কের মানবাধিকার এসোসিয়েশন ‘আইএইচডি’র প্রধান জাফের ইনসে বলেন যে, তারা জানেন যে, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তবে দায়ী ব্যক্তি নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে এক মারাত্মক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই কাজটা করেছে। যদিও এখনও তদন্ত শুরুর দিকে রয়েছে, তথাপি এটা বোঝা যাচ্ছে যে, অনেক লোক এই ঘটনায় জড়িত।

 
তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা সিরিয় শরণার্থীদেরকে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে দায়ী করছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন তা হলো, শরণার্থী সমস্যার মাঝেই তুরস্কের জিডিপি ২০০৯ সালে সাড়ে ৬’শ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৩ সাল নাগাদ সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে পৌঁছায়। তুরস্কের অর্থনীতি যখন ভালো ছিল, তখন কেউ শরণার্থী নিয়ে কথা বলেনি; অর্থনীতি খারাপ হবার সাথেসাথেই অনেকেই এর জন্যে শরণার্থীদের দায়ী করতে থাকে।

তুরস্কের শরণার্থী রাজনীতি

২০২১এর জুলাইএ তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘সিএইচপি’র প্রধান কেমাল কিলিশদারোগলু বলেন যে, তার দলের পাঁচটা মূল লক্ষ্যের একটা হলো সিরিয় শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো। তারা ক্ষমতায় যাবার দুই বছরের মাঝেই সকল শরণার্থীকে ফেরত পাঠাবেন; এবং এব্যাপারে তাদের সকল পরিকল্পনা করাই আছে। এর জবাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, তিনি তুরস্কে আশ্রয় খোঁজা ‘আল্লাহতে বিশ্বাসী’ মানুষদেরকে খুনিদের হাতে তুলে দেবেন না। তবে এরদোগানের এই কথাগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করেন অনেকেই। ‘মাইগ্রেশন পলিসি ইন্সটিটিউট’এর লেখায় বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালে তুরস্ক ইইউএর সাথে সিরিয় শরণার্থীদের ব্যাপারে একটা চুক্তি করে। চুক্তি মোতাবেক তুরস্ক ইইউএর সীমানা থেকে শরণার্থীদেরকে দূরে রাখবে। ইইউ শরণার্থীদের জন্যে ডেবিট কার্ড ইস্যু করে তাদেরকে অর্থ সহায়তা দিতে থাকে; যা ব্যবহার করে শরণার্থীরা বাজার থেকে কেনাকাটা করতে থাকে। চুক্তির ফলে ইইউতে শরণার্থী আসা অনেক কমে যায়। চুক্তিতে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে ইইউএর উপর চাপ সৃষ্টি করতে তুরস্ক ২০২০এর প্রথমাংশে কয়েক লক্ষ শরণার্থীকে গ্রিসে পাঠানোর হুমকি দেয়। এই ঘটনা বলে দিচ্ছে যে, ইইউ এবং তুরস্কের মাঝে শরণার্থী চুক্তি একটা অস্বস্তিকর চুক্তি, যা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত।

তুরস্কের চাপের মুখে ২০২১এর জুনে ইইউ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, তারা শরণার্থীদের জন্যে তুরস্ককে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আরও ৩ বিলিয়ন ইউরো সহায়তা দেবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইইউ গত ডিসেম্বরে ঘোষণা দেয় যে, ১৫ লক্ষ শরণার্থীর ডেবিট কার্ডে ৩’শ ২৫ মিলিয়ন ইউরো দেয়া হবে; যা ব্যবহার করে তারা তাদের দরকারি খাদ্য, বাড়িভাড়া, পরিবহণ এবং ঔষধ কেনাকাটা করতে পারবে। ইইউএর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার জানেজ লেনারসিচ বলেন যে, এই অর্থ সহায়তার ফলে শরণার্থীরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে, তাদের কোন জিনিসটা সবচাইতে বেশি দরকার; এবং একইসাথে তারা তুরস্কের অর্থনীতিকে সহায়তা দিতে পারবে।

‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ইইউএর শরণার্থী দূরে রাখার প্রবণতা এবং তুরস্কে শরণার্থীদের অর্থায়নে ইইউএর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ব্যাপারে তুর্কি রাজনীতিবিদেরা সর্বদাই সমালোচনার ঝড় তুলেন। এরদোগানের তুর্কি সরকারের অভিযোগ যে, ইইউ তুরস্ককে যে পরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা না দিয়ে গ্রিসকে অর্থায়ন করে যাচ্ছে। চুক্তির পাঁচ বছর পর শরণার্থী নীতির ব্যাপারে ইইউ আগের চাইতে অনেক বেশি বিভাজিত; এবং চুক্তির শর্তগুলি এখন ভেঙ্গে পড়ছে।

 
তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল উগ্র জাতীয়তাবাদী 'সিএইচপি'র প্রধান কেমাল কিলিশদারোগলু। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’ শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করেনি। অপরদিকে তুরস্কের বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না পেয়ে দায়ভার চাপিয়েছে শরণার্থীদের উপর; যা কিনা তাদেরকে ডানপন্থীদের ভোট পেতে সহায়তা করবে। মোটকথা সিরিয় শরণার্থীরা এবং ডানপন্থী উগ্রবাদীরা এখন তুরস্কের রাজনৈতিক ময়দানে খেলার গুটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার নেপথ্যে

‘ডেইলি সাবাহ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১১ সালে সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত তুরস্কে ৬০ হাজার অভিবাসী প্রত্যাশী ছিল। এখন তুরস্কে প্রায় ৬০ লক্ষ অভিবাসী বসবাস করছে; যার মাঝে প্রায় ৪০ লক্ষই এসেছে সিরিয়া থেকে। আর ২০১৬ সালে ইইউএর সাথে শরণার্থী চুক্তি করার পর তুরস্কে আরও ২০ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নেয়। রেড ক্রিসেন্ট বলছে যে, তুরস্কে শরণার্থীদের অর্ধেকই প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড় করতে পারছে না। আর করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে শরণার্থীদের উপর ঋণের বোঝা আগের চাইতে দ্বিগুণ হয়েছে। আর গত অগাস্টে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নের পর তুরস্কে আবারও নতুন করে শরণার্থী আসার শংকা শুরু হয়। এই শংকাকে কেন্দ্র করে তুরস্কে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আরেক দফা শরণার্থী বিরোধী কর্মকান্ড দানা বাঁধে। তুরস্কের ‘রিসার্চ সেন্টার ফর এসাইলাম এন্ড ইমিগ্রেশন’ বা ‘আইজিএএম’এর প্রধান মেতিন কোরাবাতির ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদের পিছনে রাজনীতিবিদদের একটা বড় অবদান রয়েছে। তারা অনেকেই ২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখেই শরণার্থীদেরকে দেশে ফেরত পাঠাবার কথা বলছেন। সমাজ গবেষক উলাস সুনাতাও বলছেন যে, রাজনীতিবিদেরা যখন বারংবার বলছেন যে, শরণার্থীরা দেশে ফেরত পাঠানো হবে, তখন সামনের দিনগুলিতে আরও মারাত্মক সহিংসতা অপেক্ষা করবে।

তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা সিরিয় শরণার্থীদেরকে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার জন্যে দায়ী করছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন তা হলো, শরণার্থী সমস্যার মাঝেই তুরস্কের জিডিপি ২০০৯ সালে সাড়ে ৬’শ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৩ সাল নাগাদ সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে পৌঁছায়। তবে অর্থনৈতিক অবব্যস্থাপনার কারণে তুরস্কের জিডিপি কমে এখন ৭’শ বিলিয়নে নেমে এসেছে। বিশেষ করে ২০১৮ সাল থেকে তুর্কি লিরার ব্যাপক দরপতন ঠেকাতে না পারার ফলশ্রুতিতে মারাত্মক মূল্যস্ফীতি গ্রাস করেছে তুরস্কের অর্থনীতিকে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, তুরস্কের অর্থনীতি যখন ভালো ছিল, তখন কেউ শরণার্থী নিয়ে কথা বলেনি; অর্থনীতি খারাপ হবার সাথেসাথেই অনেকেই এর জন্যে শরণার্থীদের দায়ী করতে থাকে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’ শরণার্থীদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করেনি। এরদোগান একদিকে যেমন সিরিয় শরণার্থীদেরকে সীমানা অতিক্রম করে ইউরোপে যাবার ট্রানজিট দিয়ে ইইউকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করেছেন, তেমনি সিরিয় শরণার্থীদেরকে তিনি ‘আল্লাহতে বিশ্বাসী’ শরণার্থী বলেই থাকতে দিয়েছেন বলে তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়েছেন। একইসাথে বিরোধী জাতীয়তাবাদী দলগুলিকে তিনি আক্রমণ করেছেন ‘বিশ্বাসী জনগণ’কে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করার জন্যে। এগুলি তিনি করেছেন তার ভোট ব্যাংক বাড়াবার উদ্দেশ্যেই। এরদোগানের সরকার শরণার্থীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক, তা ইজমিরে তিনজন সিরিয় কর্মীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে তার সরকারের প্রায় একমাস গোপন রাখার মাঝেই বোঝা যায়। অপরদিকে তুরস্কের বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না পেয়ে দায়ভার চাপিয়েছে শরণার্থীদের উপর; যা কিনা তাদেরকে ডানপন্থীদের ভোট পেতে সহায়তা করবে। মোটকথা সিরিয় শরণার্থীরা এবং ডানপন্থী উগ্রবাদীরা এখন তুরস্কের রাজনৈতিক ময়দানে খেলার গুটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

No comments:

Post a Comment