Sunday 16 January 2022

‘এরদোগানোমিকস’…… ২০২২ সালে তুরস্কের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি

১৬ই জানুয়ারি ২০২২

 
এরদোগান একটা নরম ‘প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করে নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন। আর এরদোগানের সমালোচকেরা তার তথাকথিত ‘ইসলামিস্ট’ নীতির সমালোচনা করে বলছেন যে, একুশ শতকের জটিল অর্থনীতি সপ্তম শতাব্দীর নীতি দ্বারা চালনা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ তারা সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে, এরদোগানের সুদের হার কমাবার নীতি ইসলাম সমর্থিত।


তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান সর্বদাই তার অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সমালোচিত। কারণ তিনি বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাধারণ চিন্তাগুলির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এরদোগান বলছেন যে, উচ্চ সুদের হারের কারণেই মুদ্রাস্ফীতি হয়; যদিও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সাধারণভাবে উল্টোটা মনে করা হয়। তিনি বলছেন যে, ইসলাম সুদ কমাতে বলেছে। যারা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন, তাদেরকে তিনি ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই ‘ইন্টারেস্ট রেট লবি’গুলি উচ্চ সুদের উপর ভিত্তি করে মুনাফা বাড়াতে চাইছে। এরদোগানের সমালোচকেরা অনেকেই এহেন নীতিকে ‘এরদোগানোমিকস’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এরদোগানের এই নীতিগুলির প্রভাব বুঝতে হলে তুরস্কের অর্থনীতির সূচকগুলি দেখা ছাড়াও অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

এরদোগানের ‘একে পার্টি’র নীতি … ঋণ নিয়ে খরচ করো

‘দ্যা ইকনমিস্ট’ তুরস্কের অর্থনীতির প্রধান কিছু ইস্যুকে তুলে এনেছে। তুরস্ক হলো ইউরোপের সবচাইতে বড় টেলিভিশন এবং হাল্কা বাণিজ্যিক গাড়ি নির্মাতা। বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম খাদ্য প্রস্তুতকারক এবং ৬ষ্ঠ বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র। বিশ্বের সবচাইতে বড় আড়াই’শ কন্সট্রাকশন কোম্পানির মাঝে ৪৩টাই তুরস্কের। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তুরস্কের জিডিপি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। তবে এর সাথে তুরস্কের অর্থনীতির বড় কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। দেশটার অর্থনীতি খুব বেশি ইউরোপকেন্দ্রিক। তুরস্কের মোট বহিঃবাণিজ্যের ৬০ শতাংশই হয় ইউরোপের সাথে; দেশে মোট বাইরের বিনিয়োগের তিন চতুর্থাংশও আসে ইউরোপ থেকে। একারণেই ইউরোপ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লে তা তুরস্ককেও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। তুরস্ক হয়তো গাড়ি এবং ওয়াশিং মেশিন তৈরি করতে পারে; কিন্তু নিজস্ব গবেষণা, ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং এবং মার্কেটিংএ তুর্কিরা তেমন আগাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০০২ সালের পর থেকে তুরস্কের মোট তৈরি করা রপ্তানিদ্রব্যের মাঝে মাত্র ২ শতাংশ আসে হাইটেক দ্রব্য থেকে।

এরদোগান তুরস্ককে ২০২৩ সালের মাঝে, অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের জন্মের শততম বার্ষিকীতে, বিশ্বের শীর্ষ ১০ অর্থনীতির একটা হিসেবে তৈরি করতে চান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় এসে কিছু মেগা কন্সট্রাকশন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। তুর্কি সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি’ এই মেগা প্রকল্পগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। প্রথমেই রয়েছে ইস্তাম্বুলের নতুন বিমানবন্দর। এর প্রথম স্টেজের কাজ ২০১৫এর মে মাসে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে শেষ হয়; খরচ হয় প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। তবে এর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্টেজের কাজ ২০২৫ পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। এরপর রয়েছে বসফরাস প্রণালির সমান্তরালে ৪৫ কিঃমিঃ লম্বা ইস্তাম্বুল ক্যানাল। ২০২১ সালের জুনে এরদোগান এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ছয় বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে বলছেন তিনি। তার নিজের কথায়, এটা একটা ‘উন্মাদীয় প্রকল্প’। এছাড়াও রয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটের হাই স্পিড রেলওয়ে প্রকল্প। এর অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে বসফরাস প্রণালির তলদেশ দিয়ে ‘মারমারায়’ পাতাল রেলের খরচ পড়বে ৫ বিলিয়ন ডলার। তারপর রয়েছে ইস্তাম্বুল ফাইনান্স সেন্টার; যা তৈরির মাধ্যমে এরদোগান ইস্তাম্বুলকে বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বাজারে পরিণত করতে চান। এর বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ১০ বিলিয়ন ডলার খরচে তুরস্কের মাঝ দিয়ে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানির পাইপলাইন প্রকল্প চলমান। এই সবগুলি প্রকল্পই তুরস্কের অর্থনীতিতে বিশাল ঋণ যুক্ত করেছে এবং আরও করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে করার কারণে প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঋণই হলো বেসরকারি খাতে।

 
তুরস্কের মেগা প্রকল্প ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর। মেগা প্রকল্পগুলি তুরস্কের অর্থনীতিতে বিশাল ঋণ যুক্ত করেছে এবং আরও করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে করার কারণে প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঋণই হলো বেসরকারি খাতে।

২০০২ সালে যখন ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় আসে, তখন কনজিউমার ঋণ ছিল তুরস্কের প্রতি পরিবারের গড় আয়ের প্রায় ৫ শতাংশ। ২০১৩ সাল নাগাদ এটা হয়ে যায় প্রায় ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনীতির আকার বড় করার উদ্দেশ্যে ‘একে পার্টি’ সাধারণ জনগণকে খরচ বাড়াতে উৎসাহ দিতে ব্যাপকহারে ঋণ দিতে থাকে। এই খরচার কারণে তুর্কি পরিবারগুলি নিজেদেরকে ধনী মনে করতে থাকে; কারণ এক দশকের মাঝে তাদের পারিবারিক সম্পদ বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়। তবে সমস্যা হলো এই সম্পদ তৈরি হয়েছে ঋণের উপর ভর করে। ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে সীমিত আয়ের খুব স্বল্প অংশই সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পেরেছে তারা। ২০১৪ সালে তুরস্কের জাতীয় সঞ্চয় হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৬ শতাংশ; যা কিনা বড় উঠতি অর্থনীতিগুলির মাঝে সর্বনিম্ন। ব্যবসায়ীরাও লাভের আশায় কনজিউমার দ্রব্যের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে; বড় শিল্প গড়ার উপর নয়। একারণে বাইরে থেকে আমদানি করা কনজিউমার দ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। আইএমএফএর হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মাঝে তুরস্কের ব্যংকগুলির দেয়া মোট ঋণের মাঝে কন্সট্রাকশন সেক্টরে দেয়া ঋণের অংশ ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে গিয়ে ৭০ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলি কারখানা নয়, বরং এপার্টমেন্ট বিল্ডিং, অফিস বিল্ডিং এবং শপিং কমপ্লেক্সের জন্যে ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী ছিল। একইসাথে ২০১২ সালে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিদেশী মালিকানার অনুমোদন দেয়ায় রিয়েল এস্টেটের মূল্য দ্রুত বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এক বছর আগের তুলনায় তুরস্কের বড় শহর ইস্তাম্বুলে বাড়ির মূল্য ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

বৈদেশিক ঋণের উপর ভর করে প্রবৃদ্ধি

২০০২ সালে যখন ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় আসে, তখন তুরস্কের জিডিপি ছিল আড়াই’শ বিলিয়ন ডলার। ২০১৩ সাল নাগাদ তা পৌঁছে যায় সাড়ে ৯’শ বিলিয়নে। অর্থাৎ মাত্র এক দশকে তুরস্কের অর্থনীতির আকার ৩ দশমিক ৮ গুণ বেড়ে যায়! তবে এই প্রবৃদ্ধির পিছনে ছিল ঋণের বোঝা। জাতীয় সঞ্চয় কমে যাবার কারণে দেশের কন্সট্রাকশন প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ করার মত অর্থেরও ঘাটতি পড়ে যায়। এই ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে বিদেশ থেকে ঋণ নেয়া শুরু হয়। বৈদেশিক ঋণ তুরস্কের জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ হয়ে যায়; যার বেশিরভাগই ছিল বেসরকারি ঋণ। তুরস্কের ‘আহভাল নিউজ’ বলছে যে, তুরস্কের বৈদেশিক ঋণ ২০২০ সাল নাগাদ সাড়ে ৪’শ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়; যার মাঝে বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরের ঋণই ছিল ৩’শ বিলিয়ন ডলার। এসকল ঋণ তুরস্ককে পরিশোধ করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায়; যা কিনা তুর্কি লিরার উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। তবে দুর্বল মুদ্রাব্যবস্থা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং ঘনঘন সরকারি নীতির পরিবর্তনের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশটাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল স্বল্প সময়ের মাঝে মুনাফা করে নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া।

‘আহভাল নিউজ’ বলছে যে, তুর্কি লিরার দরপতনের পর থেকে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক লিরাকে শক্তিশালী করতে ব্যাপক হারে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে থাকে। এতে লিরার মূল্য স্থিতিশীল না হলেও তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মারাত্মকভাবে কমে যায়। অপরদিকে এরদোগানের ঋণ গ্রহণ সহজ করে বেসরকারি খরচ বাড়াবার নীতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বাড়তে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝে সুদের হার ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৪ শতাংশে নিয়ে যায়; অর্থাৎ তিনগুণ করে ফেলে! কিন্তু তারপরেও ২০১৯ সালের মাঝামাঝি মুদ্রাস্ফীতি ১৪ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়ে যায়। কিন্তু ঋণের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের পিছনে খরচ হতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে রপ্তানির চাইতে আমদানি অনেক বেশি বেড়ে যায়। করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পর্যটনের মাধ্যমে তুরস্ক তার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণ করতো। ২০১৯ সালে এক পর্যটন শিল্প থেকেই এসেছিল সাড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। করোনার কারণে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ পড়তে শুরু করে। আর ২০২০এর জুলাইএ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তুরস্কের বন্ড মার্কেট থেকে ব্যাপকহারে পালাতে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট শুরু হয়।

 
সরকারি হিসেবে তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশ। বেসরকারি হিসেবে তা ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত। ২০২২ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশ হতে পারে। বাজারে ঘনঘন মূল্য তালিকা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এরদোগান তার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তুরস্কের জনগণের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়েছেন; দ্রব্যমূল্যের চাপে জনগণের জীবন হয়েছে দুর্বিসহ। তার দেশের সবচাইতে বড় হুমকি এখন তার নীতি ‘এরদোগানোমিকস’।

আকশচুম্বি মুদ্রাস্ফীতি এবং তুর্কি লিরার দরপতনের রেকর্ড

২০২১এর ডিসেম্বরে এরদোগান ২০২২ সালে ৬০ লাখের বেশি মানুষের জন্যে সর্বনিম্ন বেতন ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ হাজার ২’শ ৫৩ লিরা বা প্রায় ২’শ ৭০ ডলারে উন্নীত করেন। এটা ছিল ৫০ বছরে সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধি। ফলস্বরূপ একদিনে তুর্কি লিরার মূল্য ৫ শতাংশ কমে গিয়ে এক ডলারে সাড়ে ১৫ ছাড়িয়ে যায়; যা সর্বনিম্নের রেকর্ড। অথচ এর আগে ২০২০ সালের অগাস্টে ২০ শতাংশ মূল্য হারাবার পরেও ডলারে পাওয়া যেতো ৭ দশমিক ৪ লিরা। ২০২১ সালের মাঝে লিরার মূল্য আরও ৫০ শতাংশ পড়ে যায়। সরকারি হিসেবে গত নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশে ঠেকে। কিন্তু তুরস্কের অর্থনীতিবিদদের সংগঠন ‘ইএনএজি’র হিসেবে এই মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫৯ শতাংশ! মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক দেশেই সুদের হার যখন বাড়ানো হচ্ছে, তখন তুরস্কে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝে সুদের হার ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪ শতাংশ করা হয়। কারণ এরদোগান মনে করছেন যে, সুদের হারের কারণেই মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। ‘নিকেই এশিয়া’র সাথে সাক্ষাতে ‘ক্যাপিটাল ইকনমিকস’এর জেসন টুভে বলছেন যে, ২০২২ সালের প্রথমার্ধের মাঝে লিরার মূল্য যেমন স্থির হবার সম্ভাবনা কম, তেমনি মুদ্রাস্ফীতিও কমবে না। কাজেই এরদোগান সম্ভবতঃ তার সুদের হার কমাবার নীতি অব্যাহত রাখবেন। বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদেরাই বলছেন যে, তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালে সরকারি হিসেবে ৩০ শতাংশ হতে পারে; তবে ‘ইএনএজি’র হিসেবে তা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হতে পারে! কারণ সরকারের বেতন বৃদ্ধির প্রভাবগুলি তখন অর্থনীতিতে পড়তে থাকবে।

এদিকে তুর্কি লিরার দরপতনের কারণে তুরস্কের আমদানি ব্যয় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, দেশীয় মুদ্রার মূল্য নিম্নগামী হওয়ায় তুর্কিরা তাদের সঞ্চয় লিরা থেকে পরিবর্তন করে বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ, স্টক, ক্রিপ্টোকারেন্সি এমনকি বাড়িঘরে নিয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের ব্যাংকে সঞ্চিত সকল সম্পদের মাঝে ৬২ শতাংশই এখন বৈদেশিক মুদ্রায়। তুরস্কের ব্যাংকিং সেক্টর বিশ্লেষক উগুর গারসেস ‘নিকেই এশিয়া’কে বলছেন যে, লিরার দরপতন ঠেকানো না গেলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা আসতে পারে; আবার ব্যাংকগুলি থেকে গ্রাহকরা তাদের গচ্ছিত অর্থ ব্যাপকহারে সরিয়ে নিতে পারে। ‘ডয়েচে ব্যাংক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যেভাবে মানুষ লিরা থেকে ডলারের দিকে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে লিরার দরপতন হচ্ছে, এবং একইসাথে মুদ্রাস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে জরুরি ভিত্তিতে সুদের হার বাড়ানোটাও বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

এরদোগান নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন?

এরদোগান তার নীতিকে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক নীতির সাফল্য দেখাতে এরদোগানের সরকার পরিসংখ্যানও পরিবর্তন করেছে। ‘ব্লুমবার্গ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৬ সালে এরদোগান তুরস্কের জিডিপির হিসাবে বিরাট পরিবর্তন আনেন; যার ফলশ্রুতিতে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের চাইতে বেশি বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। নতুন হিসাবে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত ‘একে পার্টি’র সময়ে তুরস্কের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ; ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের মাঝে তা ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ হিসাব পরিবর্তনের আগে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ; আর ২০০৯ সালের পর ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিসংখ্যানও ভালো কোন প্রতিচ্ছবি দেখাতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০১৩ সালে তুরস্কের জিডিপি ছিল ৯’শ ৫৮ বিলিয়ন ডলার; ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৭’শ ২০ বিলিয়নে। অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০২০এর মাঝে তুরস্ক তার জিডিপির এক চতুর্থাংশ হারিয়েছে।

 
এরদোগান তার সুদ কমাবার নীতিকে ইসলামের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন; যদিও ইসলামে যে সুদ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। তথাপি তিনি তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ইসলামিক দেখাতে চাইছেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে জেতার জন্যে এরদোগান সকল কিছুই করবেন। যার অংশ হিসেবে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে যখন প্রতিনিয়ত দোকানে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন করতে হচ্ছে, তখন তিনি ব্যাপকহারে বেতন বৃদ্ধি করেছেন। দেশের মানুষের জাতীয়বাদ জাগিয়ে তুলতে নতুন কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও তিনি হয়তো পিছপা হবেন না।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মার্ক চ্যাম্পিয়ন ‘ব্লুমবার্গ’এর এক লেখায় বলছেন যে, এরদোগান চাইছেন নতুন করে একটা ‘নরম প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করতে; যার ভিত্তি হিসেবে তিনি কম সুদের হার এবং দ্রুত বর্ধমান কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিকে রাখতে চাইছেন। ২০২৩ সালের মাঝে এরদোগান কিছু মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কের আকৃতিই পরিবর্তন করে ফেলতে চাইছেন। অপরদিকে এরদোগান এবং তার ‘একে পার্টি’র সাথে সমমনা ‘ইসলামিস্ট’ ব্যবসায়ীরাই এর মাঝে সরকারি নীতির সুবিধা ভোগ করবে; আর তার বিরোধী কট্টর সেকুলাররা বঞ্চিত হবে। তুরস্কের কর কাঠামোগুলিকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে, যাতে করে সমাজের পুরোনো এলিটদের হাত থেকে সম্পদ নতুন এলিটদের হাতে চলে আসে। মার্ক চ্যাম্পিয়ন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তুরস্কে এহেন নীতি নতুন নয়। এরদোগানের আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা সামরিক বাহিনী এবং কট্টর সেকুলারদেরকে সুবিধা দিতো; মুদ্রানীতিও সেই আঙ্গিকেই হতো। প্রকৃতপক্ষে এরদোগান নতুন একজন ‘আতাতুর্ক’ বা নতুন এক তুরস্কের জনক হতে চাইছেন।

‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, এরদোগান যেভাবে তুরস্কের অর্থনীতির কর্তৃত্ব নিয়েছেন, তাতে নিজের সিদ্ধান্ত উল্টে ফেলে নির্বাচনের আগে সুদের হার বৃদ্ধি করা রাজনৈতিকভাবে খুবই কঠিন হবে। এরদোগান তার সুদ কমাবার নীতিকে ইসলামের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন; যদিও ইসলামে যে সুদ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। তথাপি তিনি তুর্কি জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ইসলামিক দেখাতে চাইছেন। মার্ক চ্যাম্পিয়ন বলছেন যে, এরদোগান একটা নরম ‘প্রকৃতির ইসলামিস্ট তুরস্ক’ তৈরি করে নতুন তুরস্কের জনক হতে চাইছেন। আর এরদোগানের সমালোচকেরাই তার নীতিকে ইসলামিক বলে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক লেখায় ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস এরদোগানের তথাকথিত ‘ইসলামিস্ট’ নীতির সমালোচনা করে বলছেন যে, একুশ শতকের জটিল অর্থনীতি সপ্তম শতাব্দীর নীতি দ্বারা চালনা করা সম্ভব নয়। তার কথায় অর্থনীতি চালাবার জন্যে বিজ্ঞজনদের নিয়ে এসে তাদের কথা শুনতে হবে। অর্থাৎ তিনি সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে, এরদোগানের সুদের হার কমাবার নীতি ইসলাম সমর্থিত।

২০২৩ সালের নির্বাচনে জেতার জন্যে এরদোগান সকল কিছুই করবেন। যার অংশ হিসেবে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে যখন প্রতিনিয়ত দোকানে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন করতে হচ্ছে, তখন তিনি ব্যাপকহারে বেতন বৃদ্ধি করেছেন। দেশের মানুষের জাতীয়বাদ জাগিয়ে তুলতে নতুন কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতেও তিনি হয়তো পিছপা হবেন না। কিন্তু তার ২০২৩ সালের মাঝে তুরস্ককে বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়া থেকে বহুদূরে। আইএমএফএর হিসেবে তুরস্কের অর্থনীতি ২০২১ সালে ছিল বিশ্বের ২০তম। বরং সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি তুরস্কের জনগণের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়েছেন; দ্রব্যমূল্যের চাপে জনগণের জীবন হয়েছে দুর্বিসহ। তার দেশের সবচাইতে বড় হুমকি এখন তার নীতি ‘এরদোগানোমিকস’। তুর্কি জনগণ তাদের উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর; যেই স্বপ্নকে দেখিয়েই এরদোগান তার জনমতের ভিত তৈরি করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালে ‘এরদোগানোমিকস’এর অব্যবস্থাপনার কারণে সেই স্বপ্নে ভাটা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

2 comments:

  1. বাংলাদেশ ও তো ঋনের বোঝা নিয়ে মেগা প্রজেক্ট করে মানুষদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কি তুরস্কের মত হচ্ছেনা? এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কি হতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. মূল সমস্যা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যার সংজ্ঞা এবং এর মাপকাঠি। পুঁজিবাদ মনে করে যে, মানুষের চাহিদার শেষ নেই, এবং দুনিয়ার সম্পদ সীমিত। এটাকে দুনিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বলে তারা। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধিকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখে তারা। এর ফলশ্রুতিতে একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তার উৎপাদন বৃদ্ধিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে; সেটা ঋণ নিয়ে হলেও।

      অর্থনীতি ভালো আছে কিনা, সেটা হিসেব করা হয় জিডিপি দিয়ে। মাথাপিছু জিডিপি হিসেব করা হয় সকলের আয়কে যোগ করে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে। একারণে অনেক বেশি আয় করা মানুষগুলির আয় গড়ের মাঝে পড়ে যায় এবং অতি দরিদ্র মানুষকে জিডিপির মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। জিডিপি বাড়লেই হলো; কিছু লোক না খেয়ে থাকলে সমস্যা নেই।

      এই নীতি দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রই মেনে চলছে। কারণ এই দুনিয়াটাই চলছে পুঁজিবাদী আদর্শে। মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি, বা জিডিপি বৃদ্ধি করতে ঋণ নিয়ে মেগা প্রকল্প, ইত্যাদি সকল কিছুই পুঁজিবাদী সমস্যা। তুরস্কের সমস্যা হয়তো বাংলাদেশের চাইতে কিছুটা অন্যকরকম হতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা একই - পুঁজিবাদ।

      Delete