Tuesday 11 January 2022

ইউরোপজুড়ে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাকেই তুলে ধরে

১২ই জানুয়ারি ২০২২

প্যারিসের রাস্তায় ভ্যাকসিন বিরোধী অন্দোলন। ডোজের পর ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া সত্ত্বেও যখন ‘ওমিক্রণ’এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি; লিবারাল আদর্শ নয়। ফ্রান্স এবং চেক রিপাবলিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে যে, রাজনীতিবিদেরা মূলতঃ জনগণের মতামতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

 
নতুন বছরের শুরুতেই পুরো ইউরোপ উত্তপ্ত হয়েছে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনে। ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিকসহ ইউরোপের দেশগুলিতে করোনার ভ্যাকসিনের বিষয়ে সরকারি বাধ্যবাধতার বিরুদ্ধে চলছে এই বিক্ষোভ। বেশিরভাগ স্থানেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলেও কিছু শহরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভকারীরা ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর ফ্রান্সে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, এবারের বিক্ষোভ তার চাইতে চার গুণ বড় ছিল।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ৮ই জানুয়ারি ভ্যাকসিনের বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করে ফ্রান্সে ১ লক্ষ ৫ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। পুলিশ বলছে যে, রাজধানী প্যারিসে প্রচন্ড ঠান্ডা এবং বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১৮ হাজার মানুষ ‘সত্য’, ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘ভ্যাকসিন পাস মানি না’ লেখা প্লাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করে। অনেকেই তাদের ক্ষোভের কেন্দ্রে রেখেছিল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁকে। এক সপ্তাহ আগেই ম্যাক্রঁ ‘লে প্যারিসিয়ান’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে ভ্যাকসিন বিরোধীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত খারাপ শব্দ ব্যবহার করে হুমকি দেন যে, যারা ভ্যাকসিন নেবে না তিনি তাদের জীবন এতটাই দুর্বিসহ করে ফেলবেন যে, তারা বাধ্য হবে ভ্যাকসিন নিতে। আন্দোলনকারীরা ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধেও একই ধরনের খারাপ শব্দ ব্যবহার করে প্রতিবাদ করে। একজন বিক্ষোভকারী ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, এটা ছিল ম্যাক্রঁর ‘শেষ চেষ্টা’। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, সরকার তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা ছাড়াও নাগরিকদের মাঝে পার্থক্য করছে।

এই বিক্ষোভ এমন সময়ে এলো, যখন এক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সে ‘ওমিক্রন’ ভ্যারিয়্যান্টের কারণে একদিনে ৩ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। অথচ ইউরোপের দেশগুলির মাঝে ফ্রান্স সবচাইতে বেশি ভ্যাকসিন দেয়া দেশগুলির একটা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ১২ বছরের বেশি বয়সের জনগণের ৯০ শতাংশকেই পুরোপুরি ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। আইসিইউগুলি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে; হাসপাতালগুলি চাপের মাঝে রয়েছে। আর এর আগের দিন ৬ই জানুয়ারি ফ্রান্সের পার্লামেন্টে আইন পাস করে বলা হয় যে, জনগণকে রেস্টুরেন্টে খেতে, আন্তশহর বাসে চড়তে বা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন নিতে হবে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ফরাসি সিনেটে বিরোধী দলের শক্তি বেশি থাকায় সেখানে বিল পাস হতে কিছু সময় লাগতে পারে। এই আইন ১৫ই জানুয়ারি থেকেই বাস্তবায়িত হবার কথা রয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে পুলিশ ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। ১০ জন পুলিশ অফিসারও কিছুটা আহত হয়। মঁপেলিয়ে শহরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে।

অস্ট্রিয়ার পুলিশ বলছে যে, রাজধানী ভিয়েনাতে ৪০ হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। সেখানে আগামী মাস থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জার্মানিতেও অনেকগুলি শহরে বিক্ষোভ চলে। এর মাঝে সবচাইতে বড় বিক্ষোভ হয় হামবুর্গ শহরে; যেখানে ১৩ হাজার মানুষ রাস্তায় ছিল। সেখানে প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘যথেষ্ট হয়েছে; আমাদের সন্তানদেরকে রেহাই দাও’। একজন বিক্ষোভকারী তার গায়ে ইহুদিদের ‘স্টার অব ডেভিড’ বহন করছিলেন; যেখানে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন নেয়া হয়নি’। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদিদের গায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ‘স্টার অব ডেভিড’ এঁকে রাখার নির্দেশনার সাথে তুলনা দেয়া হয়। জার্মানিতে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা চলছে। সেখানে এক মাস আগে থেকে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদেরকে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ৯ই জানুয়ারি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। পুলিশ ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভকারীদের প্লাকার্ডে লেখা ছিল ‘ভ্যাকসিন একনায়কতন্ত্র’। বেলজিয়ামে রেস্টুরেন্ট, বার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কোভিড পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে এক সপ্তাহে নতুন সংক্রমণ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। চেক রিপাবলিকে ৬০ বছরের উপরে জনগণ, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দেশটার নতুন কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা নেবার আগে এই পরিকল্পনাগুলির বিরোধিতা করেছিল। এখন ক্ষমতায় গিয়ে নীতি পরিবর্তন করে তারা বিভিন্ন প্রফেশনালদের বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাইছে।

 
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন। ইউরোপের সরকারগুলি করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের দুই শতকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক চিন্তাকে জ্বলাঞ্জলি দিচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলে ধরতে চাইলেও সরকার তাদের সংখ্যাকে ছোট বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে।

ইতালির তুরিন শহরেও শতশত মানুষ বিক্ষোভ করে। সেখানে ৫০ বছরের বেশি বয়সী সকল ব্যক্তির ভ্যাকসিন নেয়া বাধ্যমূলক করা হয়েছে। আর ১১ই জানুয়ারি থেকে ইতালিতে ভ্যাকসিন না নিলে কেউ রেস্টুরেন্টে ঢুকতে পারবে না, অথবা গণপরিবহণে চড়তে পারবে না। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাক ‘ডাই আম সনটাগ’ পত্রিকাকে বলেন যে, স্বল্প সংখ্যক মানুষ সকল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করে সেচ্ছায় মিথ্যা তথ্যের মাঝে ডুবে থাকতে চাইছে। তিনি বলেন যে, ভ্যাকসিন বিরোধীরা এবং করোনাভাইরাসকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দেয়া মানুষেরা সকল মাপকাঠি এবং লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে।

‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, জার্মানির মিনডেন শহরে আড়াই হাজার এবং ড্রেসডেন শহরে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে মানব বন্ধন করে। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা ভ্যাকসিন বিরোধীদের আক্রমণের শিকার। এর মাঝে ৭ই জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার পুরোপুরি ভ্যাকসিন নেবার পর বুস্টার ডোজ নিয়েও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে ফ্রান্সের বিক্ষোভগুলি এমন সময়ে এসেছে, যখন কিছুদিন পরেই সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ ভ্যাকসিন বিরোধীদের বিরুদ্ধে খারাপ শব্দ ব্যবহার করে বেশ বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছেন।

ইউরোপের সরকারগুলি করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের দুই শতকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক চিন্তাকে জ্বলাঞ্জলি দিচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তুলে ধরতে চাইলেও সরকার তাদের সংখ্যাকে ছোট বলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ডোজের পর ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া সত্ত্বেও যখন ‘ওমিক্রণ’এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি; লিবারাল আদর্শ নয়। ফ্রান্স এবং চেক রিপাবলিকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বলে দিচ্ছে যে, রাজনীতিবিদেরা মূলতঃ জনগণের মতামতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে নেয়া সিদ্ধান্তগুলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment