Wednesday 26 January 2022

ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী?

২৬শে জানুয়ারি ২০২২

জানুয়ারি ২০২২। ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ায় রুশ সৈন্য। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলি থেকে দূরে রাখতেই হুমকি দিচ্ছেন, ইউক্রেনকে দখল করতে নয়; কারণ পশ্চিমা ঘেঁষা ইউক্রেনই রাশিয়ার জন্যে হুমকি।

 
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর প্রতিমন্ত্রী জেইমস হিপ্পে ২৫শে জানুয়ারি ‘দ্যা সান’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে ইন্টেলিজেন্স রয়েছে যে, রুশ সামরিক বাহিনীর সাথে যুক্ত বহু ব্যক্তি এই মুহুর্তে ইউক্রেনের ভেতরে অবস্থান করছে। এর আগে ২২শে জানুয়ারি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেন যে, ক্রেমলিন ইউক্রেনে একটা রুশ সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার আশংকায় পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করছে। এই অস্ত্রের মাঝে রয়েছে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, গ্রেনেড লঞ্চার, মেশিন গান, গোলাবারুদ, ইত্যাদি। এগুলি রুশ সামরিক আগ্রাসন থামাতে না পারলেও রাশিয়ার জন্যে সামরিক অপারেশনকে আরও কঠিন করে ফেলবে। রুশ হুমকির প্রত্যুত্তরে ন্যাটো সদস্যদেশগুলি বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়াতে যুদ্ধবিমান মোতায়েন ছাড়াও রোমানিয়াতে সৈন্য বৃদ্ধি এবং কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করছে। তবে রাশিয়াও তার সামরিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে চলেছে। ইউক্রেনের পূর্ব সীমানায় ১ লক্ষ সেনা মোতায়েন ছাড়াও উত্তরের সীমানায় বেলারুশের সাথে যৌথ মহড়ার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনে সাইবার হামলার জন্যেও রুশদেরকে দায়ী করা হচ্ছে। যুদ্ধের শংকায় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে নেবার আদেশ দেয়া হয়েছে।

ইউক্রেন ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া কে কিভাবে দেখছে?

মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বলে আসছে যে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসান চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ একত্রে দ্রুত এবং মারাত্মক প্রত্যুত্তর দেবে। তিনি আরও বলেন যে, ইউক্রেন বা অন্য কোন দেশে সেনা না পাঠিয়ে রাশিয়া যদি ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’, সাইবার হামলা বা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তাহলেও তিনি আত্মবিশ্বাসী যে ইউরোপিয় মিত্রদেরকে একত্রিত করে দ্রুত প্রত্ত্যুত্তর দেবেন তারা। তবে এই প্রত্যুত্তরের মাঝে মার্কিন সেনা মোতায়েন থাকবে কিনা, সেব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্লিংকেন অর্থনৈতিক অবরোধ ছাড়াও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়া এবং ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার কথা বলেন। তিনি ‘সিএনএন’কে বলেন যে, ন্যাটো বাস্তবসম্মত এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে; যার মাঝে সামরিক অপশনও থাকবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার কি স্বার্থ রয়েছে? রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের গুরুত্বই বা কতটুকু? যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ভার্চুয়াল টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘ম্যাককুইস্টিয়ন টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে পশ্চিম থেকে রাশিয়া চারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে; দক্ষিণ থেকে আক্রমণ হয়েছে দু’বার। রাশিয়ার অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই সীমানাগুলির উপর। এই সীমানাগুলিকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া পশ্চিমে পোল্যান্ড ও বেলারুশের সমতলভূমি, আর দক্ষিণে ককেশাস এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে মূলতঃ ইউক্রেন। ইউক্রেন যদি পশ্চিমা ঘেঁষা না হতো, তাহলে রাশিয়ার কোন সমস্যা ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলোনা বলেই তারা ইউক্রেনে জড়িয়েছে।

 
সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে পশ্চিম থেকে রাশিয়া চারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে; দক্ষিণ থেকে আক্রমণ হয়েছে দু’বার। রাশিয়ার অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই সীমানাগুলির উপর। এই সীমানাগুলিকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া পশ্চিমে পোল্যান্ড ও বেলারুশের সমতলভূমি, আর দক্ষিণে ককেশাস এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার নিরাপত্তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে মূলতঃ ইউক্রেন। ইউক্রেন যদি পশ্চিমা ঘেঁষা না হতো, তাহলে রাশিয়ার কোন সমস্যা ছিল না। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া এব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলোনা বলেই তারা ইউক্রেনে জড়িয়েছে।

কে কি করতে পারে?

মার্কিন থিংকট্যাংক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রেসিডেন্ট ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খুব সম্ভবতঃ তার কমান্ডারদের কাছ থেকে ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা চেয়েছেন। তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি হামলা করবেন। তিনি তার অপশনগুলি খোলা রাখতে চাইছেন। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে সফলতা না আসলে হয়তো উত্তেজনা আরও বাড়বে। তিনি বলছেন যে, তিনি মনে করতে পারেন না যে, সাম্প্রতিক সময়ে কবে কোন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন রাজনীতিবিদেরা এতটা একমত হতে পেরেছিল। রুশ দাবিগুলি মার্কিন রাজনৈতিক মতামতকে একত্রিত করেছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, মার্কিন নীতি সফল হবে। কারণ ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়া যতটা চিন্তিত, মার্কিনীরা ততটা চিন্তিত নয়। ইউরোপের উপর রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব যতটা রয়েছে, তার কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নেই। এর ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে খুব কম বাধাই রয়েছে। তবে সারা বিশ্বের ‘পুলিশম্যান’ থাকার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে অনীহা দেখিয়েছে, তাতে মার্কিনীদের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কোয়ালিশন তৈরি করা কঠিন হবে। তিনি পরিষ্কার করে দেন যে, যদিও অনেকেই সোশাল মিডিয়াতে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউক্রেন’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে, তথাপি এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিতে পারে, কিন্তু সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার যুদ্ধ, বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার কোন সম্ভাবনা নেই বলে তিনি বলেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনের উপর সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিয়েও হামলা না করে বরং আলোচনা করতে চাইছে। রাশিয়া দাবি করছে যে, ন্যাটো ইউক্রেনকে যেন কখনোই সদস্য হিসেবে গ্রহণ না করে; এবং ন্যাটো যেন রাশিয়ার সীমানায় অস্ত্র মোতায়েন নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া এমন একটা দাবি করেছে, যা তারা খুব ভালো করেই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র সেব্যাপারে কিছুতেই রাজি হবে না। কারণ এতে করে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। চাপের মুখে রাশিয়ার কাছে নতি স্বীকার করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একেবারেই সমীচিন নয়। ফলাফল হিসেবে এর প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী। অভ্যন্তরীণভাবেও তা যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে, যা কিনা মার্কিন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সামরিক মিশনের প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকার মানে হয় না। কারণ প্রতি মুহুর্তে ন্যাটো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে; এবং রাশিয়ার জন্যে মিশনটা প্রতি মুহুর্তে কঠিনতর হচ্ছে। তাহলে রাশিয়া কি পুরো কাজটাই করছে তথ্যযুদ্ধ হিসেবে? কিন্তু সমস্যা হলো, আরেকটা দেশে সামরিক হামলা করলে জনমত নিজের পক্ষে নিয়ে আসাটা বেশ কঠিন। হামলা করার সবচাইতে ভালো সময়টাতে হামলা না করে বসে থেকে হামলার হুমকি দেয়ার অর্থ হলো, রাশিয়া আসলে ইউক্রেনে হামলা করতে চায় না। যুদ্ধ করার নিয়ম হলো, সর্বোচ্চ সুবিধাজনক পর্যায়ে হামলা করা; এবং শত্রুকে কোন সুবিধা না দেয়া। আর কূটনীতির নিয়ম হলো, সমঝোতায় পৌঁছাবার আগে যথেষ্ট হুমকি দেয়া।

 
নভেম্বর ২০২১। ইউক্রেনের বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ। যদিও অনেকেই সোশাল মিডিয়াতে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউক্রেন’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে, তথাপি এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিতে পারে, কিন্তু সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার যুদ্ধ, বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। 

ইউক্রেনের ব্যাপারে ইউরোপের অনৈক্য

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে কথা বলার পর ২৫শে জানুয়ারি পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে বলেন যে, ইউরোপের কিছু দেশ রাশিয়ার গ্যাসের উপর প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল হবার কারণে রাশিয়ার উপর মারাত্মক কোন অর্থনৈতিক অবরোধের ব্যাপারে চিন্তিত। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জনসন মূলতঃ জার্মানিকেই বোঝাচ্ছিলেন। তিনি আরও বলেন যে, তাদের এখন কাজ হলো চিন্তিত রাষ্ট্রগুলিকে বুঝিয়ে যতদূর সম্ভব নিয়ে যাওয়া; যাতে করে রাশিয়ার উপর একটা শক্ত অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া যায়। জনসন বলেন যে, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আন্ত ব্যাংকিংএর মানি ট্রান্সফার ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বের করে দেয়া যায় কিনা, সেব্যাপারে মিত্র দেশগুলির মাঝে কথা হলেও সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। আর এব্যাপারে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ইতোমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। জনসন বলেন যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ রুশ ব্যক্তিত্ব এবং কোম্পানির উপরেই মূলতঃ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে। একইসাথে তিনি বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে ব্রিটেন পূর্ব ইউরোপে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। ‘নিউজউইক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে চাইছে না। তাদের কথা বলা হলো, এটা ইউক্রেনের জন্যে সহায়ক হবে না। বার্লিন এর বদলে ইউক্রেনকে মেডিক্যাল সহায়তা দিতে চাইছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, জার্মানির অবস্থান ঐক্যের বিরুদ্ধে এবং এতে পুতিন ইউক্রেনে নতুন করে হামলা করতে আগ্রহী হবেন। কিন্তু ব্লিংকেন ‘এনবিসি’কে বলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার সাথে একমত এবং দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারেও যে তারা একমত, সেব্যাপারেও তার কোন সন্দেহ নেই।

তবে ফ্রীডম্যান বলছেন যে, ইউরোপ রাশিয়ার ব্যাপারে একমত নয়। ইউরোপিয়রা শত শত বছর ধরে শুধু যুদ্ধই করেছে। এখনও সেই প্রতিদ্বন্দ্বিত বিদ্যমান। জার্মানি চাইছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক পশ্চাতগামীতাকে নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে। অপরদিকে পোল্যান্ড মনে করছে যে, তারা ১৯৩৯ সালে দেখেছে যে কিভাবে জার্মানি এবং রাশিয়া পোল্যান্ডকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ফ্রান্স আবার মনে করছে এই সুযোগে জার্মানিকে সরিয়ে দিয়ে ইউরোপকে নিজেদের প্রভাবে নিয়ে আসা যায় কিনা। ইউরোপ এবং ন্যাটোর দেশগুলির মাঝে দ্বন্দ্বের সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। তবে এই মুহুর্তে দুনিয়ার অপর প্রান্তে চীন নিজের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাশিয়ার দিকে সকলের চোখ যাচ্ছে।

ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থানের একটা গুরুত্ব রয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ডিরেক্টর ক্রিস মিলার এক লেখায় বলছেন যে, বিভিন্ন সময়ে উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ মান্য করা নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চলেছে। চীন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে অবরোধ মান্য করতে বাধ্য হয়েছে; যা কিনা চীনের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ইস্যুতে পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর যে অবরোধ দিয়েছিল, তা খুব একটা কঠোর ছিল না। চীন এবং রাশিয়ার বাণিজ্য সম্পর্কের উপর এই অবরোধের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এবারে যে সেটার ব্যতিক্রম হবে, তা নিশ্চিত। এবারে চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ মেনে নেয়, তাহলে সকলের চোখেই চীনের অর্থনৈতিক শক্তি যথেষ্ট দুর্বল মনে হবে; আর যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার চাইতে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেক বড়। তাই ঐ দুই দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কর্তনের জন্যে ক্ষতি খুব কম হলেও রাশিয়ার বেলায় সেটা হবে না। রাশিয়ার উপর অবরোধ চীনের অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একারণেই এবারে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক কর্তনে রাজি নাও হতে পারে। যদি চীন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে রাশিয়া তার দুর্যোগের মাঝে অনেক বড় একটা বন্ধু পাবে; আর পশ্চিমাদেরকেও একত্রে দুই ফ্রন্টে আর্থিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।

ধোঁকা না সত্যিকারের হুমকি?

ইউক্রেন রাশিয়ার জন্যে অস্তিত্বের প্রশ্ন; অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে এটা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। যদিও আফগানিস্তান থেকে পলায়নের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর দুনিয়ার ‘পুলিশম্যান’ থাকতে চাইছে না, তথাপি রাশিয়ার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে চীনের কাছে একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের অনৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা কোয়ালিশন তৈরি করতে হিমসিম খাচ্ছে। তবে রাশিয়ার হামলা বাস্তবতায় রূপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ঐকমত্য তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলি থেকে দূরে রাখতেই হুমকি দিচ্ছেন, ইউক্রেনকে দখল করতে নয়; কারণ পশ্চিমা ঘেঁষা ইউক্রেনই রাশিয়ার জন্যে হুমকি। পুতিন হয়তো তার হুমকিকে শক্ত ভিত দিতেই সামরিক পরিকল্পনার ব্যাপারে যত্নবান হয়েছেন; যাতে তার আগ্রাসী ইচ্ছাটাই পশ্চিমাদের চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু তার দাবিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন অবাস্তব মনে করছে, তখন পুতিন কি বাধ্য হবেন সামরিক মিশনে যেতে? তাতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কিছু না হারালেও রাশিয়া যথেষ্টই ক্ষতির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকেও রাশিয়ার কাছ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করবে; যদিও এবারে চীন রাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নাও মানতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সামরিক মিশনে যেতে বাধ্য করতে পারলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে অনেক বড় কৌশলগত বিজয়; যা কিনা তার আফগানিস্তানে দুই দশকের ব্যর্থতাকে ভুলতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।

No comments:

Post a Comment