Saturday 8 January 2022

কাজাখস্তানের রাস্তায় সহিংসতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

০৮ই জানুয়ারি ২০২২

কাজাখস্তানের আলমাতির পথে বিমানে উঠছে রুশ প্যারাট্রুপাররা। কাজাখস্তানের সহিংসতা এমন সময়ে এলো, যখন ইউক্রেনের সীমানায় সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে রুশ সরকার ন্যাটোকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। ইউক্রেন এবং মধ্য এশিয়ার দুই সীমানাকে একত্রে নিয়ন্ত্রণে আনা রাশিয়ার জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ। আলমাতির বিক্ষোভ হয়তো রাশিয়াকে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে প্রভাবিত করতে পারে।


গত ৬ই জানুয়ারি থেকে মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে সহিংসতায় পুলিশ এবং সাধারণ জনগণ সহ কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, তিন দশক আগে দেশটার জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটা সবচাইতে মারাত্মক সহিংসতা। ১ কোটি ৯০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটায় এলপিজির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আলমাতির সরকারি অফিসগুলিতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের মতে, হাইড্রোকার্বন রপ্তানিকারী দেশ কাজাখস্তানের জন্যে এই মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক। কাজাখস্তানে পেট্রোলের চাইতে কমদামি এলপিজি গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাজাখস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয় যে, প্রধান শহর আলমাতি এবং পশ্চিমের মানগিসতাউ প্রদেশে দুই হাজার দুই শ’র অধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কমপক্ষে ১৮ জন সদস্য নিহত হওয়া ছাড়াও ৭’শ ৪৮ জন আহত হয়েছে বলে বলছে রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’। পুলিশের গুলিতে ২৬ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শতশত সাধারণ মানুষ আহত হয়েছে; কমপক্ষে ৬০ জন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকাইয়েভ বিক্ষোভ ঠেকাতে সরকার ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি বিক্ষোভকারীদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশও দিয়েছেন। একইসাথে তিনি দুই সপ্তাহের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ছাড়াও রাশিয়াকে সেদেশে সেনা মোতায়েন করতে অনুরোধ করেন। তোকাইয়েভ বলেন যে, ২০ হাজার বিক্ষোভকারী পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আলমাতির উপর হামলা করেছে। তাদের মাঝে যথেষ্ট সমন্বয় এবং সামরিক প্রস্তুতি রয়েছে।

রুশ বার্তা সংস্থা ‘আরআইএ’ বলছে যে, রুশ নেতৃত্বে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অরগানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’ প্রায় আড়াই হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করবে। তারা হয়তো সেখানে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্যে মোতায়েন থাকবে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কনাশেনকভ বলেন যে, রুশ প্যারাট্রুপাররা বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে আলমাতির বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সেনাদের উপর সশস্ত্র হামলা হলে তারা গুলি চালাতে পারবে বলেও বলা হয়। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, দেশটার প্রথম প্রেসিডেন্ট নূরসুলতান নাজারবায়েভ প্রায় ২৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৯ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তবে অনেকের ধারণা তিনি এখনও তার নিজের নির্বাচিত বর্তমান প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে দেশ চালাচ্ছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কাজাখস্তানে কোন মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে কিনা, অথবা রুশ সেনারা সেখানে কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় সংস্থার দখল নেয় কিনা, সেব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন সাংবাদিকদের বলেন যে, ইতিহাস বলে দেয় যে, রুশরা একবার কোন দেশে ঢুকলে তাদেরকে সেখান থেকে বের করা কঠিন হয়ে যায়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয় যে, ব্রিটেন কোন সহিংসতা এবং জনগণের সম্পদের ধ্বংসের বিরোধী। ব্রিটেন চায় কাজাখ সরকার ইন্টারনেট সার্ভিস খুলে দিক এবং জনগণের বাকস্বাধীনতার অধিকারকে মান্য করুক। অপরদিকে তুরস্কের কমিউনিকেন্স ডিরেকটিভ থেকে বলা হয় যে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান কাজাখ প্রেসিডেন্টকে ফোন করে তুরস্কের পুরোপুরি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।

 
এলপিজির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আলমাতির সরকারি অফিসগুলিতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। আফগানিস্তান থেকে পলায়নের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মধ্য এশিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবেই রয়ে গেছে। তবে আলমাতির সহিংসতার ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে মধ্য এশিয়ায় সৃষ্ট শূণ্যস্থান পূরণের প্রতিযোগিতার একটা লক্ষণও বটে, যা আঞ্চলিক অস্থিরতাকে বৃদ্ধি করবে।

রাশিয়ার দক্ষিণ সীমানায় কাজাখস্তানের এই সমস্যা এমন সময়ে এলো, যখন রাশিয়ার পূর্বদিকে ইউক্রেনের সীমানায় রুশ সেনা মোতায়েন নিয়ে ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা চলছে। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব জেন পিসাকি সাংবাদিকদের বলেন যে, কাজাখস্তানের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, পরবর্তী সপ্তাহে জেনেভায় ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর আলোচনা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে।

কাজাখস্তান বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উৎপাদনকারী দেশগুলির একটি। পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী কোম্পানি ‘কাজাটমপ্রম’ বলছে যে, বিক্ষোভে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। তবে ‘প্ল্যাটস’এর হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরেনিয়ামের মূল্য কিছুটা বেড়েছে। অপরদিকে দৈনিক ১৬ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদনকারি কাজাখস্তানের সবচাইতে বড় বিদেশী তেল কোম্পানি ‘শেভরন’ বলছে যে, কিছু কনট্রাকটর বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে রেললাইন উপড়ে ফেলায় ‘তেনগিজ’ তেলখনিতে উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে।

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কাজাখস্তানের সহিংসতার কারণে দেশটায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ হুমকির মাঝে পড়েছে। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ হাব হলো চীন এবং ইউরোপের মাঝে অবস্থিত কাজাখস্তান। সেখানে চীনারা ১৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলছে যে, চীনা ব্যবসাগুলি এখনও কোন সমস্যায় পড়েনি; আর কাজাখস্তান থেকে চীন পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইনগুলি বিক্ষোভের শহরগুলি থেকে দূরে থাকায় খুব সম্ভবতঃ নিরাপদেই থাকবে। ২০১৯ সালের ১১ মাসে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ছিল প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। একই বছরে চীনারা কাজাখস্তান হয়ে সাড়ে ১৪ লক্ষ টিইউএস কনটেইনার রেলপথে ইউরোপে পাঠিয়েছে।

 
আলমাতি শহরটা কাজাখস্তানের একেবারে পূর্বে; যেখানে দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ থাকে। শহরটা কিরগিজস্তান এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফারগানা ভ্যালির দেশ উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং চীনের উইঘুরের খুব কাছে। মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চল আফগানিস্তানের সীমানায়। রাশিয়া একারণেই তার দক্ষিণ সীমানায়, বিশেষ করে আলমাতি বা মধ্য এশিয়ায় কোন অস্থিরতা চায় না।

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক পিটার জেইহান কাজাখস্তানের সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন যে, আলমাতি শহরটা কাজাখস্তানের একেবারে পূর্বে; যেখানে দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ থাকে। শহরটা কিরগিজস্তান এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফারগানা ভ্যালির দেশ উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং চীনের উইঘুরের খুব কাছে। মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চল আফগানিস্তানের সীমানায়। রাশিয়া একারণেই তার দক্ষিণ সীমানায়, বিশেষ করে আলমাতি বা মধ্য এশিয়ায় কোন অস্থিরতা চায় না। ওয়াশিংটনে রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ ‘নিউজউইক’কে বলেন যে, কাজাখস্তানের সমস্যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ফলাফল। দুই দশক ধরে পশ্চিম এবং মধ্য এশিয়ায় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ অস্থিরতাকে উস্কে দিয়েছে। তাঁর ধারণা, মধ্য এশিয়াতে উগ্রবাদী ধর্মীয় আদর্শ ছড়িয়ে পড়ার হুমকি রয়েছে।

কাজাখস্তানের সহিংসতা এমন সময়ে এলো, যখন ইউক্রেনের সীমানায় সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে রুশ সরকার ন্যাটোকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। ইউক্রেন এবং মধ্য এশিয়ার দুই সীমানাকে একত্রে নিয়ন্ত্রণে আনা রাশিয়ার জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ। আলমাতির বিক্ষোভ হয়তো রাশিয়াকে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে প্রভাবিত করতে পারে। আফগানিস্তান থেকে পলায়নের পরেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মধ্য এশিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবেই রয়ে গেছে। তবে আলমাতির সহিংসতার ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে মধ্য এশিয়ায় সৃষ্ট শূণ্যস্থান পূরণের প্রতিযোগিতার একটা লক্ষণও বটে, যা আঞ্চলিক অস্থিরতাকে বৃদ্ধি করবে।

No comments:

Post a Comment