Monday 31 January 2022

পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোতে অভ্যুত্থান … ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলাফল

৩১শে জানুয়ারি ২০২২

বুরকিনা ফাসোর রাস্তায় অভ্যুত্থান সমর্থনকারীদের হাতে লেঃ কর্নেল দামিবার পাশে মালির অভ্যুত্থানকারী নেতার ছবি। পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তিন অভ্যুত্থানের তিন নেতা বেশ ভালোই জনসমর্থন পাচ্ছেন। সেখানকার সেনা অফিসাররা একসময় শুধুমাত্র ফ্রান্সে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলেও তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ট্রেনিং পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীগুলি শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রভাবের মাঝে আর নেই। এর মাঝে সেখানে জড়িয়েছে রাশিয়া। রুশরা পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব না বাড়ালেও সামরিক অভ্যুত্থানের মতোই তারাও ফ্রান্সকে সরিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

 
গত ২৪শে জানুয়ারি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোতে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। বুরকিনা ফাসো এক বছরের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকার তৃতীয় দেশ যেখানে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো। অভ্যুত্থানের নেতা লেঃ কর্নেল পল হেনরি দামিবা তার প্রথম ভাষণে বলেন যে, দেশের প্রেসিডেন্ট রোশ কাবোরে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা ক্ষমতা নিয়েছেন। সহিংসতায় সেখানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনকে শীর্ষ লক্ষ্য আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন যে, তার সরকার গ্রামাঞ্চল পুনরুদ্ধার করবে এবং ১৫ লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে। ‘সঠিক সময়ে’ তারা দেশকে সাংবিধানিক শাসনে ফেরত নিয়ে আসবেন। সংস্কারে সম্মতি আদায়ের জন্যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করবেন বলে জানান তিনি। একইসাথে তার দেশের আগের চাইতে আরও বেশি আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার উল্লেখ করে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুরকিনা ফাসোর সংকট কাটাতে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানান। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, কর্নেল দামিবা তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে কোন কোন দেশ বুঝিয়েছেন, তা বলেননি। এই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কেননা জঙ্গিবাদ দমনে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিকে সহায়তা দানে প্রাক্তন উপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সাথে রাশিয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি, নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে ফ্রান্সের কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। অত্র অঞ্চলে ফরাসি সামরিক উপস্থিতি জনগণের অপছন্দ। ইতোমধ্যেই ফরাসিরা মালি থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নিচ্ছে; যাদের শূণ্যস্থান পূরণ করছে রাশিয়া। রুশ ভাড়াটে সেনাদের একটা অংশ বুরকিনা ফাসোর অভ্যুত্থান নেতাদের নিরাপত্তা দেয়ার অফার দিয়েছে। ‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, প্রতিবেশী মালিতে যেমন সামরিক অভ্যুত্থানের পর আঞ্চলিক জোটের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, বুরকিনা ফাসোর ক্ষেত্রেও সেটারই সম্ভাবনা রয়েছে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, অভ্যুত্থান নেতা কর্নেল দামিবা ফ্রান্সের সামরিক একাডেমি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ফ্রান্স থেকে অপরাধ বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। এছাড়াও মার্কিন সামরিক বাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, তিনি ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মাঝে বিভিন্ন মার্কিন সামরিক কোর্স এবং মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। তিনি এতদিন জঙ্গিবাদ দমনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন; এবং সেটার উপর তিনি গতবছর একটা বইও লিখেছেন। অভ্যুত্থানের দু’মাসেরও কম সময় আগে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট কাবোরে দামিবাকে রাজধানী উয়াগাডুগুসহ উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিবাদ দমনে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। গত নভেম্বরে নিরাপত্তা বাহিনীর ৫০ জন সদস্য নিহত হবার পর প্রেসিডেন্টের সেই সিদ্ধান্তকে অনেকেই সামরিক সদস্যদেরকে ঠান্ডা রাখার একটা প্রয়াস হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর এক সূত্র বলছে যে, কর্নেল দামিবা মনে করেন না যে, জঙ্গিবাদের সমস্যা শুধুমাত্র সামরিক অপারেশনের মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।

পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তিন অভ্যুত্থানের তিন নেতা বেশ ভালোই জনসমর্থন পাচ্ছেন। বুরকিনা ফাসোর রাজধানীতেও শতশত মানুষ অভ্যুত্থানের পক্ষে আনন্দ করেছে। ‘এএফপি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বুরকিনা ফাসোর রাজধানী উয়াগাডুগুর এক শিক্ষক জুলিয়েন ত্রাওরে বলেন যে, এটা তাদের চোখে কোন অভ্যুত্থান নয়। এটা হলো অক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত থেকে দেশের স্বাধীন হওয়া। উয়াগাডুগুর রাস্তায় কেউ কেউ রুশ পতাকা নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে উল্লাস করেছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, পার্শ্ববর্তী মালিতে রুশ ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর ভাড়াটে সেনারা নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং সেখানেও অনেকেই রাস্তায় রাশিয়ার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। ১৫টা ইউরোপিয় দেশ এবং কানাডা ডিসেম্বরে এক যৌথ বিবৃতিতে এব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে।

 


২৮শে জানুয়ারি পশ্চিম আফ্রিকার জোট ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’ তৃতীয় দেশ হিসেবে বুরকিনা ফাসোর সদস্যপদ স্থগিত করে। জোটের জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকে গৃহবন্দী ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টকে অবিলম্বে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়াও জোটের পক্ষ থেকে বুরকিনা ফাসোর অভ্যুত্থান নেতাদের সাথে আলোচনা করতে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জোটের বর্তমান চেয়ারম্যান ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আফুকো আদ্দো বলেন যে, এই অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক চিন্তার সাথে যায় না; এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের দিকে চেয়ে আছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে। বার্তাসংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, বুরকিনা ফাসোর উপর আরও কোন অবরোধ দেয়া হবে কিনা, সেব্যাপারে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মালির উপর ইতোমধ্যেই বিমানের ফ্লাইট বন্ধ এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও বিভিন্ন অবরোধ দিয়েছে ‘একোওয়াস’। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মালি এবং গিনির উপর অবরোধ সেখানকার বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারেনি। ‘একোওয়াস’ মালির অভ্যুত্থানকারীদের সাথে ১৮ মাসের মাঝে নির্বাচন দেয়ার চুক্তি করেছিল; যা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকেই ‘একোওয়াস’এর সমালোচনা করেছেন। মালির সামরিক নেতৃত্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতির বরাত দিয়ে চার বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। বুরকিনা ফাসোর ব্যাপারেও ভিন্ন কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

সামরিক অভ্যুত্থানের পরেও ফুটবল খেলার জন্যেই আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বুরকিনা ফাসোর নাম আসছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, মিডিয়ার কাছে আফ্রিকার অভ্যুত্থানগুলি অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল তো ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, নতুন বছরে সামরিক অভ্যুত্থান ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়াতে পারে! ১৭ মাসের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকায় চতুর্থ অভ্যুত্থানের পটভূমি মূলতঃ ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশের এলাকাগুলিতে ফ্রান্সের প্রভাব প্রতিদিনই কমছে। জঙ্গিবাদ দমনে ফরাসিরা প্রথমে মালিতে সেনা মোতায়েন করলেও সহিংসতা এখন পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েছে; এবং যুদ্ধ বন্ধের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল থেকে ফরাসি সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় সেই শূণ্যস্থান পূরণের প্রতিযোগিতা চলছে। সেখানকার সেনা অফিসাররা একসময় শুধুমাত্র ফ্রান্সে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলেও তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ট্রেনিং পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীগুলি শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রভাবের মাঝে আর নেই। এর মাঝে সেখানে জড়িয়েছে রাশিয়া। রুশরা পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক প্রভাব না বাড়ালেও সামরিক অভ্যুত্থানের মতোই তারাও ফ্রান্সকে সরিয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

1 comment:

  1. ধন্যবাদ।
    আফ্রিকায় ইদানীং বেশ কয়েকটি ক্যু ঘটেছে। এই ঘটনাগুলি কেন ঘটছে? যদি ব্যাখ্যা করতেন তো খুব ভাল হত।

    ReplyDelete