Monday 10 January 2022

ফ্রান্স কেন ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে?

১০ই জানুয়ারি ২০২২

ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ লা রিউনিয়নে 'রাফাল' যুদ্ধবিমান। ফ্রান্স বিশ্বব্যাপী তার উপনিবেশগুলি এবং তার প্রভাবে থাকা দেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে আগের মতো নিশ্চিত নয়; বিশেষ করে দূরবর্তী ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির নিরাপত্তা ফ্রান্সের কাছে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বলেই সেখানে হাজার হাজার কিঃমিঃ পাড়ি দিয়ে ৪৮ ঘন্টার মাঝেই ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার মিশন পরিচালনা করা হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রভাবের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্যান্য শক্তির মাঝে চলছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

 
গত ৫ই জানুয়ারি ফ্রান্স একটা মহড়ার অংশ হিসেবে বিমান বাহিনীর দু’টা অত্যাধুনিক ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে তার দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় উপনিবেশ লা রিউনিয়ন দ্বীপে পাঠিয়েছে। ফরাসি সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ডাচ এভিয়েশন সোসাইটি’র ম্যাগাজিন ‘স্ক্র্যাম্বল’ এক প্রতিবেদনে বলছে যে, ‘অপারেশন ম্যারাথন’এর মাধ্যমে ‘রাফাল’ বিমানগুলির সাথে ছিল আকাশ থেকে আকাশে জ্বালানি দেবার সক্ষমতার একটা ‘এয়ারবাস এ৩৩০ এমআরটিটি’ ট্যাংকার বিমান। বিমানগুলি ফ্রান্স থেকে শুরু করে কোথাও না থেমে একবারে ৮ হাজার ৮’শ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে লা রিউনিয়ন দ্বীপে নামে। আকাশপথে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানগুলি দু’টা ট্যাংকার বিমান থেকে আকাশেই ৬ থেকে ৭ বার জ্বালানি নিয়েছে। ‘মিশন শিকরা’র অধিনে এই অপারেশন ৩রা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে; যার অধীনে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে অন্ততঃ ৫টা ভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হবে। এছাড়াও বিমানগুলি পরবর্তীতে পূর্ব আফ্রিকার জিবুতিতে ‘খামসিন’ নামের এক মহড়ায় অংশ নেবে; মিশরেও তারা যাত্রাবিরতি করবে। ফরাসি বিমান বাহিনী প্রধান জেনারেল লাভিয়েনে বলছেন যে, ফ্রান্স ২০২৩ সালে আরেকটা বড় মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে; যার উদ্দেশ্য হবে ৪৮ ঘন্টার মাঝে ২০টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান এবং তার সাথে কিছু ট্যাংকার বিমানকে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা। ‘অপারেশন ম্যারাথন’ সেই মিশনেরই একটা প্রস্তুতি। ফরাসি এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘০৬৩০ ডেল্টা’ বলছে যে, এই অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে ফ্রান্সের ‘স্ট্র্যাটেজিক এয়ার ফোর্সেস’এর অধীনে; যার মূল উদ্দেশ্য হলো ফরাসি পারমাণবিক সক্ষমতাকে জিইয়ে রাখা। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ফ্রান্স তার মূল ভূখন্ড থেকে এতদূরে এরকম মিশন পরিচালনা করছে।

বিশাল দূরত্বে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার ফরাসি মিশন এটাই প্রথম নয়। ‘স্ক্র্যাম্বল’ বলছে যে, ২০২১এর জুন মাসে ফরাসিরা ‘অপারেশন হেইফারা ওয়াকেয়া’র অধীনে ৩টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে ফ্রান্স থেকে ১৭ হাজার কিঃমিঃ দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে ফরাসি উপনিবেশ ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সাথে ছিল ৩টা ট্যাংকার বিমান এবং একটা পরিবহণ বিমান। পথিমধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নামে একবার। মিশনের মাধ্যমে তারা ৪৮ ঘন্টার মাঝে পলিনেশিয়ায় বোমাবর্ষণ করার সক্ষমতার কথা জানান দেয়। এর আগে ২০২০এর অগাস্টে ফরাসিরা গ্রিসে ২টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছিল। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস আহরণকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সাথে তুরস্কের উত্তেজনার মাঝে গ্রিসকে আস্বস্ত করা।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবিয় উপকূলে ফরাসি উপনিবেশ ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে ফ্রান্স যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। সর্বশেষ সেটা ছিল ২০২১এর নভেম্বরে। এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘এরোটাইম হাব’ বলছে যে, ফরাসি উপনিবেশ থেকে মহাকাশে ইউরোপিয়ান রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়। যখন সেখান থেকে ফরাসি সামরিক স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়, তখন এর জন্যে আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। গত নভেম্বরে ‘ভেগা’ স্পেসক্রাফটের মাধ্যমে ৩টা গোয়েন্দা স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করার সময় ৩টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান, একটা ‘সি ১৩৫’ রিফুয়েলিং বিমান এবং একটা ‘বোইং ই৩এফ’ এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং এন্ড কন্ট্রোল বিমান সেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল। এছাড়াও ২০১৮ সালে একটা মহড়ার অংশ হিসেবে তিনটা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে অস্ট্রেলিয়াতেও পাঠানো হয়; সাথে ছিল একটা ট্যাংকার এবং একটা পরিবহণ বিমান।

 
বিশ্বব্যাপী ফ্রান্সের উপনিবেশগুলির মানচিত্র। ফ্রান্সের এই বিমান মোতায়েনের দূরপাল্লার মিশনগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। শুধু পশ্চিম আফ্রিকার মালিতেই নয়, পুরো আফ্রিকা জুড়েই ফ্রান্সের প্রভাব হুমকির মাঝে পড়েছে। মোটকথা ফ্রান্সের বিশ্বব্যাপী সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচেষ্টাগুলি ফ্রান্সের শক্তি নয়, বরং দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।

ফ্রান্স তার নৌবাহিনীর ইউনিটগুলিকেও বিশ্বব্যাপী মোতায়েন রাখছে। ২০২১ সালের প্রথমভাগে ৪ মাসের জন্যে ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’কে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়। ‘ক্লিমেনসিউ ২১’ নামের সেই মিশনের প্রধান রিয়ার এডমিরাল অসেডাট বলেন যে, ২০১৫ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও একইবছর ফরাসি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনেরে’র নেতৃত্বে ফরাসি যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ ইন্দোপ্যাসিফিক ঘুরে আসে। ‘মিশন জঁ ডে আর্ক’ নামের ৫ মাসের সেই মিশনে ‘টোনেরে’ জাহাজের সাথে ছিল ফ্রিগেট ‘সুরকুফ’। তবে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে যেখানে বেশ কিছু দিন বা সপ্তাহ বা মাস সময় লাগে, বিমান বাহিনীর বিমানগুলি কয়েক ঘন্টার মাঝেই মোতায়েন করা যায়। কোন দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিমান শক্তি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্স তার বৈশ্বিক অবস্থানকে নিরাপত্তা দিতেই বিমান শক্তিকে বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করার সক্ষমতার উপর জোর দিচ্ছে; এবং একইসাথে বাকি বিশ্বকে তা জানান দিচ্ছে।

ফ্রান্সের এই বিমান মোতায়েনের দূরপাল্লার মিশনগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রায় ৯ বছর পর ফরাসি সেনারা পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির উত্তরের তিমবুকতু শহর ছেড়ে যায়। ফ্রান্সের ‘অপারেশন বারখেইন’এর কমান্ডার জেনারেল এতিয়েন দু পেইরু বলেন যে, ফ্রান্স ‘অন্যভাবে’ মালিতে তার অবস্থান ধরে রাখবে। মালির অভ্যুত্থানকারী সামরিক অফিসার আসিমি গোইতার নেতৃত্বে থাকা মালি রাশিয়ার ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর ভাড়াটে সেনাদেরকে মালির সৈন্যদের ট্রেনিং দেয়ার জন্যে মোতায়েন করছে; যা কিনা ফ্রান্সের সাথে তার প্রাক্তন উপনিবেশ মালির দূরত্ব বাড়িয়েছে। এছাড়াও মালিতে ফ্রান্স বিরোধী চিন্তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণ অনেকেই মনে করছে যে, ফরাসিরা মালির সহিংসতাকে কমাতে পারেনি; বরং তারা নিজেদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। মালির সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ বুরকিনা ফাসো এবং নিজেরএও ছড়িয়ে পড়েছে।

শুধু পশ্চিম আফ্রিকার মালিতেই নয়, পুরো আফ্রিকা জুড়েই ফ্রান্সের প্রভাব হুমকির মাঝে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ এবং পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। মাদাগাস্কারেও সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চলেছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে গৃহযুদ্ধের মাঝে রুশ ভাড়াটে সেনারা সরকারের নিরাপত্তা দিচ্ছে। মোজাম্বিকেও ফরাসি বিনিয়োগ গৃহযুদ্ধের হুমকির মাঝে রয়েছে। মোটকথা ফ্রান্সের বিশ্বব্যাপী সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচেষ্টাগুলি ফ্রান্সের শক্তি নয়, বরং দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। ফ্রান্স বিশ্বব্যাপী তার উপনিবেশগুলি এবং তার প্রভাবে থাকা দেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে আগের মতো নিশ্চিত নয়; বিশেষ করে দূরবর্তী ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির নিরাপত্তা ফ্রান্সের কাছে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বলেই সেখানে হাজার হাজার কিঃমিঃ পাড়ি দিয়ে ৪৮ ঘন্টার মাঝেই ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার মিশন পরিচালনা করা হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রভাবের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্যান্য শক্তির মাঝে চলছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

No comments:

Post a Comment