Saturday 27 February 2021

ভারতের দূরপ্রাচ্যে গমন ... বৃদ্ধি পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা

২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২১


 ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা মস্কো ঘুরে এলেন। সফরে শ্রিংলা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২০২০ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক বাতিল হয়ে যাওয়ায় শ্রিংলার সফরের গুরুত্ব ছিল বেশি। সফরকালীন আলোচনার বিষয়বস্তুর মাঝে রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাথে ভারতের কৌশলগত যোগাযোগ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন মিডিয়াতে হাইলাইট করা হয়। ভারতীয় অর্থনৈতিক মিডিয়া ‘মিন্ট’ বলছে যে, এই সফরের একটা মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোর’এর চিন্তাটাকে আরও এগিয়ে নেবার মাধ্যমে দু’দেশের মাঝে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা; যা বর্তমানে ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মাঝে রয়েছে। রুশ পত্রিকা ‘কমারস্যান্ট’এর সাথে এক সাক্ষাতে শ্রিংলা বলেন যে, এই ম্যারিটাইম করিডোরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরই নয়, রাশিয়ার উত্তরের ‘নর্দার্ন সি রুট’এর সাথে যুক্ত করা যাবে। শ্রিংলা মনে করিয়ে দেন যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি ভ্লাডিভস্টকে পুতিনের সাথে আলোচনার সময় রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বন্দর ভ্লাডিভস্টককে ইউরেশিয়ার সাথে ইন্দোপ্যাসিফিকের যোগসূত্র বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যকে নিয়ে ভারতের এই পরিকল্পনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ভিভেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অজয় কুমার চতুর্বেদি বলেন যে, ‘চেন্নাই ভ্লাডিভস্টক ম্যারিটাইম করিডোর’কে এগিয়ে নেবার মাধ্যমে ভারত চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’কে চ্যালেঞ্জ করবে। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সাখালিন দ্বীপে এবং ভিয়েতনামের উপকূলে তেল গ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত এই কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিচ্ছে। সাখালিনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সময় ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলে যে, রাশিয়ার তেল গ্যাস নিয়ে ভারত এবং চীন প্রতিযোগিতা করছে।

‘সাখালিন ১’ প্রকল্পে ভারত যেমন নতুন নয়, তেমনি ভারত একাও এখানে তেমন শক্তিশালী কোন বিনিয়োগকারী নয়। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার এক খবরে বলা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা হলো মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’। ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ নিয়ে তারাই মূলত এই প্রকল্পের অপারেটর। জাপানের ‘সোডেকো’র হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ মালিকানা; ভারতের ‘ওএনজিসি’র হাতে রয়েছে ২০ শতাংশ মালিকানা; আর রাশিয়ার ‘রজনেফত’এর হাতে রয়েছে বাকি ২০ শতাংশ। ২০০১ সালে ‘ওএনজিসি’ ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে এই প্রকল্পের ২০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। ২০১৭ সালে নতুন করে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ২০৫১ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।

প্রকল্পের ওয়েবসাইট বলছে যে, ১৯৯৬ সালে এখানে তেল গ্যাসের জন্যে ড্রিলিং শুরু হয় এবং ২০০১ সালে তেল গ্যাস আহরণ শুরু হয়। ২০০৪ সালে সাখালিন দ্বীপের খনির সাথে ২’শ ৩০ কিঃমিঃ পাইপলাইন যুক্ত করে ‘দে কাস্ত্রি’ নামের টার্মিনালের সাথে যুক্ত করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তেলের জাহাজ ভর্তি করা শুরু হয়। দৈনিক আড়াই লক্ষ ব্যারেল উৎপাদন সক্ষমতার এই প্রকল্প থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩’শ ৮০টা জাহাজ ভর্তি করে তেল রপ্তানি করা হয়েছে। টার্মিনালে সাড়ে ৬ লক্ষ ব্যারেল তেল ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট ৫টা তেলের জাহাজ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয়; যেগুলির একেকটার ধারণক্ষমতা ১ লক্ষ টন, এবং এগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে শীতকালে যখন সমুদ্র বরফাচ্ছাদিত থাকবে, তখনও যেন তেল রপ্তানি করা যায়। এছাড়াও শীতকালে অপারেশন চালাবার জন্যে দু’টা আইসব্রেকার জাহাজও রাখা হয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে। এভাবে সারা বছর তেলের সরবরাহ নিশ্চিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

‘সাখালিন ১’ এখানে একমাত্র তেল গ্যাস প্রকল্প নয়। এর পাশেই ‘সাখালিন ২’ প্রকল্প হলো ব্রিটিশ কোম্পানি ‘শেল’এর তরলীকৃত গ্যাস বা এলএনজি প্রকল্প। কোম্পানির ওয়েবসাইট বলছে যে, ‘শেল’এর বিনিয়োগ এখানে সাড়ে ২৭ শতাংশ; রাশিয়ার ‘গ্যাজপ্রম’এর বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ; জাপানের ‘মিতসুই’ সাড়ে ১২ শতাংশ; এবং ‘মিতসুবিশি’ ১০ শতাংশ। প্রায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ টনের বাৎসরিক সক্ষমতার এই প্রকল্পের গ্যাস রপ্তানি শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। মূলতঃ জাপান, কোরিয়া এবং চীন হলো এই প্রকল্পের গ্যাসের সবচাইতে বড় ক্রেতা। বিশ্বের মোট এলএনজি রপ্তানির ৪ শতাংশ এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসে। এটা পরিষ্কার যে, সাখালিনের দু’টা প্রকল্পের মূল বিনিয়োগকারী হলো মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ এবং ব্রিটিশ কোম্পানি ‘শেল’। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের বরফাচ্ছাদিত এই এলাকায় পশ্চিমা বিনিয়োগের ব্যাপারে কথা হয়েছে খুব কমই। চীনের সীমানার বেশ কাছাকাছি হওয়ায় পশ্চিমাদের জন্যে এখানে প্রভাব ধরে রাখাটা রাশিয়ার সাথে শত্রুতার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘কার্নেগি মস্কো সেন্টার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে যত বিনিয়োগ হয়, তার প্রায় ৯৫ শতাংশই নামে বা বেনামে চীনা বিনিয়োগ। দূরপ্রাচ্যের মার্কিন বন্ধু দেশ জাপান এবং কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা একদিকে যেমন চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনা প্রভাব কমাতে; অন্যদিকে রাশিয়ার উপর মার্কিন অবরোধের কারণে এধরনের কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে চীনের সাথে মার্কিন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা রাশিয়াকে চাপের মাঝে রাখার চাইতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রাশিয়াও চাইছে দূরপ্রাচ্যে চীন ছাড়াও অন্যরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসুক। ‘কার্নেগি’র প্রতিবেদনে কয়েকটা পক্ষের চিন্তার সমন্বয় লক্ষ্যনীয়। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে ভারতের বিনিয়োগকে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ভালো চোখে দেখছে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই চাইছে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ভারত এই ভূরাজনৈতিক খেলায় একজন অংশগ্রহণকারী মাত্র। দূরপ্রাচ্যে নিজস্ব বিনিয়োগ করে পশ্চিমাদের সহায়তা ছাড়া সেটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা ভারতের কতটুকু রয়েছে, তা বিতর্কসাপেক্ষ। তেমনি ভারত মহাসাগরেই যেখানে চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় ‘কোয়াড’ জোটের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে ভারত, সেখানে দূরপ্রাচ্যে চীনা বিনিয়োগকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এজেন্ডা বাস্তবায়ন বাস্তবতার সাথে যায় না; বরং এহেন প্রকল্পে অংশ নেবার মাধ্যমে নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

2 comments:

  1. চমৎকার বিশ্লেষন। তবে দূরপ্রাচ্যে বিশেষ করে শাখালিন দ্বীপে তৈল বা গাস খাতে ভারতের বিনিয়োগের কারন যতটা না আর্থিক তার চেয়ে অনেক বেশী একটা ইগো তৈরী করা যে আমাকে পরাশক্তি হিসাবে বিশ্বের স্বীকৃতির আকাংখ্যা। শুনলাম মোংগলিয়ায় নাকি ভারত একটি এয়ারবেস তৈরীতে করতে আগ্রহী চীনকে চাপের মূখে রাখতে। লিন্কটি নীচে:

    https://www.deccanherald.com/content/25956/india-shelves-proposal-set-up.html

    ReplyDelete
    Replies
    1. জন্মের পর থেকেই ভারত একটা দুর্বল রাষ্ট্র; ব্রিটিশরা ভারতকে এভাবেই তৈরি করেছে। ভারতের নিজস্ব কোন ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। সুপারপাওয়ারের লক্ষ্যই ভারতের লক্ষ্য হিসেবে কাজ করেছে সর্বদা। কংগ্রেসের সময় ভারত ব্রিটেনের লক্ষ্যের বাস্তবায়ন করেছে। বিজেপির অধীনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যে বাস্তবায়নে ব্যস্ত।

      Delete