Saturday 20 February 2021

ফ্রান্স কি উগ্রপন্থী সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে?

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২১


 
ফ্রান্সের পার্লামেন্টে নতুন একটা আইন পাস করা নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়েছে। গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৩’শ ৪৭ ভোট বনাম ১’শ ৫১ ভোটে ‘প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিগুলির উপর সন্মানের সমর্থনে’ এই নতুন বিল পাস হয়। ৬৫ জন ভোট দানে বিরত থাকে। এই আইনের মাধ্যমে ফ্রান্সের মসজিদ, স্কুল এবং স্পোর্টস ক্লাবগুলির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হবে। এটা প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের অংশ, যার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে উগ্রবাদী ইসলাম থেকে ফ্রান্সকে এবং ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শকে রক্ষা করা। বার্তা সংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, নিম্নকক্ষের পর এই বিল উচ্চকক্ষে যাবে ৩০শে মার্চ; যেখানে এই বিল প্রায় নিশ্চিতভাবেই পাস হবে। তবে ফ্রান্সের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর এই আইন ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে বলে মনে করছেন অনেকেই। একইসাথে ইসলামের প্রতি ফরাসিদের উগ্রপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিরও বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এতে।

এই আইনের বিপক্ষে থাকা রাজনীতিবিদেরা বলছেন যে, আইনে যা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মূলতঃ অন্যান্য আইনে ইতোমধ্যেই রয়েছে। এখানে অন্য কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে। বিল উত্থাপন করা ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন পার্লামেন্টে ভোটাভুটির কিছুদিন আগেই বিরোধী দলীয় উগ্র ডানপন্থী নেতা মারিন লা পেনএর দিকে আঙ্গুল তাক করে বলেন যে, লা পেন উগ্রবাদী ইসলামের প্রতি বেশ ‘নরম’ অবস্থান নিয়েছেন। তার ‘ভিটামিন দরকার’। এই মন্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, ম্যাক্রঁর সরকার উগ্রবাদী ইসলামের ব্যাপারে উগ্র ডানপন্থীদের চাইতে বেশি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে ডানপন্থী ভোটারদেরকে ম্যাক্রঁর দিকে টেনে আনা এর লক্ষ্য হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। অপরদিকে মারিন লা পেন নতুন আইনকে দুর্বল বলছেন। ‘বিএফএম’ টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লা পেনের উগ্র ডানপন্থী ‘ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট জরডান বারডেলা বলছেন যে, নতুন আইন ‘টার্গেট মিস’ করেছে; কারণ এটা উগ্রবাদী ইসলামী আদর্শকে সরাসরি আক্রমণ করেনি। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, নতুন বিলে মুসলিম বা ইসলামের নাম উচ্চারিত হয়নি। সমর্থকেরা বলছেন যে, এই বিলে ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শ এবং লিঙ্গ সমতাকেই রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ম্যাক্রঁ এই বিলকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আইন বলছেন; কারণ উগ্রবাদীদেরকে তিনি ফ্রান্সের সমাজের বিরোধিতাকারী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।

নতুন আইনে তিন বছর বয়স থেকে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে সেকুলার আদর্শ শেখাতে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে; যাতে করে শিশুর পরিবার নিজ বাড়িতে আলাদা করে কোন আদর্শিক শিক্ষা দিতে না পারে। বাড়িতে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এতে বাড়িতে শিক্ষা নেয়া ৬২ হাজার শিশুর শিক্ষা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি অর্থে চলা মসজিদ এবং মসজিদের ব্যবস্থাপনায় থাকা বিভিন্ন এসোসিয়েশনকে সেকুলারিজম মেনে চলার জন্যে ফরাসি সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। নিয়মের বাইরে গেলে সরকারি অর্থ ফেরত দিতে হবে। আর দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন হলেও ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পেলে সরকারকে জানাতে হবে; এবং বছরওয়ারি খরচের হিসেব দিতে হবে সরকারকে। পুলিশ অফিসার এবং কারাগারের কর্মচারীদের ফ্রান্সের সেকুলার সংবিধান এবং আদর্শের প্রতি নতুন করে আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিতে হবে। সরকারি অফিসে কাজ করা বা সরকারের জন্যে কাজ করা কোন ব্যক্তি তার বিশ্বাস বোঝা যায়, এমন কোন কাপড় পরতে পারবে না। এর মাধ্যমে মূলতঃ মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরাকেই বারন করা হয়েছে। একইসাথে সকল সরকারি কর্মচারীদেরকেও সেকুলারিজমের প্রশিক্ষণ দেবার কথা বলা হয়েছে। যেসকল খেলাধূলার এসোসিয়েশনকে উগ্রপন্থী বলে মনে হবে, সেগুলিকেও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আনা হবে। কোন ডাক্তার যদি কোন নারীর কুমারিত্বের সার্টিফিকেট দেয়, তবে তাকে ১৮ হাজার ডলার জরিমানা এবং ১ বছরের কারাদন্ড দেয়া হবে। কোন ব্যক্তির একসাথে দুই স্ত্রী থাকবে পারবে না; যদি কোন অভিবাসী এটা করে, তবে তাকে থাকার অনুমতি দেয়া হবে না। কোন বিবাহকে যদি জোরপূর্বক বলে মনে হয়, তাহলে আইনশৃংখলা বাহিনীকে অবহিত করা যাবে। নতুন এই আইনকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালের সেকুলারিজম আইনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে; যার মাধ্যমে চার্চ এবং রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়েছিল।

বিল পাস হবার আগেই শ’দেড়েক মানুষ প্যারিসের রাস্তায় বিলের বিপক্ষে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে গত অক্টোবরে নিহত হওয়া ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির এলাকার বাসিন্দা জেইনেব বুয়াবিবি বলছেন যে, এক ব্যাক্তির কর্মকান্ডের জন্যে পুরো মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করাটা একেবারেই অনুচিত। তিনি বলছেন যে, মুসলিম নাম হবার কারণে ইউনিভার্সিটিতে এবং কর্মক্ষেত্রে তাকে বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। অনেকেই তাকে বলেছেন যে, ‘তুমি তোমার দেশে ফেরত যাও’; যদিও বুয়াবিবির জন্ম ফ্রান্সে। আর এরকম আইন পাস হলে মুসলিমবিদ্বষ আরও বেড়ে যেতে পারে। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি এই বিলের বিপক্ষে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ১’শ জন ইমাম, ৫০ জন মুসলিম শিক্ষক এবং ৫০ জন এসোসিয়েশন প্রেসিডেন্ট।

ফ্রান্সে কত মুসলিম রয়েছে, তার সঠিক হিসেব কেউ দিতে না পারলেও তা ৩০ থেকে ৬৫ লক্ষের মাঝে হতে পারে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ফ্রান্সের সেকুলার আইনে জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। ফরাসি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটুট মনটেইন’এর করা এক জনমত জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের মুসলিমদের ২৯ শতাংশ ইসলামের শরীয়া আইনকে ফরাসি রিপাবলিকের আইনের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ৬৫ শতাংশ মুসলিম হিজাব পরার পক্ষে। উল্টোদিকে ‘লে মন্ড’ পত্রিকার জন্যে করা এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, ৬০ শতাংশ ফরাসি মনে করে যে, ফ্রান্সের সেকুলার আদর্শের সাথে ইসলাম সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের নতুন আইন নিশ্চিতভাবেই মুসলিমদের বিশ্বাসগত বাধ্যবাধকতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে, যা কিনা পশ্চিমা সেকুলার আদর্শের স্তম্ভ ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। অপরপক্ষে ম্যাক্রঁর সরকার যখন নির্বাচনে জিততে উগ্র ডানপন্থীদের দলে টানার চেষ্টা করছেন, তখন গণতান্ত্রিকভাবেই এক উগ্রপন্থী সেকুলার রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে ফ্রান্স।

No comments:

Post a Comment