Sunday 14 February 2021

চীনের উপর ব্রিটেন চাপ বৃদ্ধি করছে কেন?

১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

চীনা মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটেন একদিকে যেমন চীনকে বাধ্য করছে প্রতিক্রিয়া দেখাতে, তেমনি হংকং এবং উইঘুর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিয়ে এসে চীনকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছে। ব্রিটেনের আদর্শিক এই আক্রমণের বিরুদ্ধে চীন এখনও কোন জবাব তৈরি করতে পারেনি। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় এগিয়ে থাকতে ব্রিটেন এই ইস্যুগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। হংকং এবং উইঘুরের জনগণের জন্যে ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে নয়, বরং পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে ব্রিটেন চীনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।


গত ১১ই ফেব্রুয়ারি চীনের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ন্যাশনাল রেডিও এন্ড টেলিভিশন এডমিনিস্ট্রেশন’ ‘এনআরটিএ’ জানায় যে, ব্রিটিশ মিডিয়া ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ’কে চীনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চীনা এই সিদ্ধান্তকে এক সপ্তাহ আগের ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এর আগে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘অফকম’ ঘোষণা দেয় যে, ব্রিটেনে চীনা সরকারি মিডিয়া ‘চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক’ বা ‘সিজিটিএন’এর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। সংস্থাটা বলে যে, তাদের তদন্তে বের হয়ে এসেছে যে, ‘সিজিটিএন’এর এডিটিংএর কাজ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টার চায়না মিডিয়া লিমিটেড’এর করার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ‘সিজিটিএন’এর নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্য কোথাও। এটা ব্রিটিশ আইনের পরিপন্থী থাকায় তারা এর লাইসেন্স বাতিল করেছে। ‘সিএনএন’ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলছে যে, ‘সিজিটিএন’এর মূল নিয়ন্ত্রক হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। তবে কর্মকর্তারা বলছেন যে, ‘সিজিটিএন’ আদালতে যেতে পারবে এবং আবারও লাইসেন্সের জন্যে আপিল করতে পারবে। ২০২০ সালে ‘অফকম’ অভিযোগ করে যে, হংকংএর আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে ‘সিজিটিএন’ মূলতঃ চীনা সরকারকে সমর্থন করেছে এবং বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়িয়ে গেছে। এটা ব্রিটিশ মিডিয়ার নিরপেক্ষতার আইনের পরিপন্থী বলে বলছেন তারা। ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, ব্রিটিশরা একদিকে মিডিয়ার স্বাধীনতার কথা বলছে; আর অন্যদিকে ‘সিজিটিএন’এর লাইসেন্স বাতিল করছে। এটা দ্বিমুখী নীতি ছাড়া কিছুই নয়। এছাড়াও এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘বিবিসি’র কর্মকান্ডের সমালোচনা করে। বলা হয় যে, ‘বিবিসি’র প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের জন্যে চীনকে দায়ী করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয় যে, এর জন্যে ‘বিবিসি’র উচিৎ চীনের বিরুদ্ধে এধরণের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা এবং জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া। ব্রিটেন এবং চীনের এহেন কাদাছোঁড়াছুড়ি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এর আগে ২রা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ এক প্রতিবেদনে বলে যে, ২০২০ সালে ব্রিটিশ সরকার তিনজন চীনা নাগরিককে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে দেশ থেকে বহিষ্কার করে, যারা সাংবাদিক ভিসায় সেদেশে কাজ করছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয় যে, তিনটা চীনা মিডিয়ার জন্যে কাজ করা এই ব্যক্তিরা প্রকৃতপক্ষে চীনা গোয়েন্দা সংস্থা ‘মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি’ বা ‘এমএসএস’এর এজেন্ট ছিল বলে বের করেছে ব্রিটিশ অভ্যন্তরীণ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এমআই৫’। চীনা দূতাবাস ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’এর এই রিপোর্টকে ‘ঠান্ডাযুদ্ধের মানসিকতা’র সাথে তুলনা করে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, কিছুদিনের মাঝেই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস এক্ট’ আইনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ১৯১১ সালে তৈরি এই আইন ১৯৮৯ সালে একবার ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা হয়। এখন পরিবর্তিত বাস্তবতায় আইনে আবারও পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, যাতে গোয়ান্দাবৃত্তির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়। অর্থনৈতিক গোয়েন্দাবৃত্তি এবং বিদেশী লবিস্ট গ্রুপগুলির কর্মকান্ডকে এর মাধ্যমে আরও কঠোরভাবে নজরদারির অধীনে আনার কথা বলা হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডসে ভোটাভুটি হয়; যার লক্ষ্য ছিল সিদ্ধান্ত নেয়া যে ব্রিটিশ হাইকোর্টকে চীনের মানবাধিকারের ব্যাপারে জড়িত করা হবে কিনা। লর্ডসএর সিদ্ধান্ত ছিল যে, চীনের সাথে ব্রিটেনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের শর্ত হিসেবে চীনের মানবাধিকার ইস্যুকে সামনে আনা উচিৎ। তারা প্রশ্ন করছে যে, একটা দেশ যদি গণহত্যায় জড়িত হয়, তাহলে তাদের সাথে বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তবে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্যরা বলছেন যে, গণহত্যার মতো ইস্যুতে জটিল তদন্ত করার মত সক্ষমতা হাইকোর্টের নেই। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা বলছেন যে, পার্লামেন্টের কমিটিরই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ; হাইকোর্টের নয়। তবে পার্লামেন্টের কট্টরপন্থীরা উইঘুরে চীনের কর্মকান্ডের ব্যাপারে সরকারের আরও কঠোর ভূমিকা চাইছেন।

৮ই ফেব্রুয়ারি চীনের উইঘুরের মুসলিমদের বিরুদ্ধে চীনা সরকারের অত্যাচারের উপর ‘বিবিসি’ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তি ছিল ‘গ্লোবাল লিগ্যাল একশন নেটওয়ার্ক’ নামের এক এনজিওর কমিশন করা একটা আইনী মতামত। এর সাথে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্ট’ এবং জার্মানি ভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস’। ‘বিবিসি’ বলছে যে, উইঘুরের ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হাইকোর্টকে জড়িত করার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটাকে বাইপাস করবে এই আইনী মতামত। এটা কোন আদালতের রায় না হলেও এর উপর ভিত্তি করে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ছয় মাস ধরে সরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাবিদ, চ্যারিটি এবং বিভিন্ন মিডিয়ার কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রমাণাদিকে ব্যবহার করে এই আইনী মতামত তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষ্য, স্যাটেলাইট ছবি এবং চীনা সরকারের দলিলপত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ‘গ্লোবাস টাইমস’এর এক লেখায় উইঘুরের ব্যাপারে ‘বিবিসি’র নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্যে চীনা সরকারকে আহ্বান জানানো হয়। তবে চীনের মাঝে অনেকেই চাইছেন ব্রিটেনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। ‘গ্লোবাল টাইমস’এর আরেক লেখায় ‘চাইনিজ একাডেমি অব সোশাল সাইন্সেস’এর এসোসিয়েট প্রফেসর লি গাং বলছেন যে, চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কোন্নয়ন ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে থেকে দুই দেশের সহযোগিতা ‘সোনালী অধ্যায়’ পার করছে। কিছু টানাপোড়েন থাকলেও দুই দেশের সম্পর্ক শক্ত ভিতের উপরেই রয়েছে। লি গাং বলছেন যে, কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আদর্শের ব্যাপারে কথা বলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করতে চাইতে পারে। আর রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হলে এর প্রভাব অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপরেও পড়তে বাধ্য।

পশ্চিমা আদর্শের ধারক ও বাহক হিসেবে ব্রিটেন পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় নিজের প্রভাব আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে চীনের সাথে এমন একটা সম্পর্ক চাইছে ব্রিটেন, যা ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; যদিও অর্থনৈতিকভাবে চীনের অর্থনীতি অনেক বড়। ‘ব্রিটিশ চেম্বার অব কমার্স ইন চায়না’র প্রধান নির্বাহী স্টিভ লিঞ্চ ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, ইইউএর বাইরে চীন ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি একদিকে যেমন করোনাভাইরাস পরবর্তী ব্রিটেনের অর্থনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হবে, তেমনি ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউজ অব কমন্স’ লাইব্রেরির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেন এবং চীনের মোট বাণিজ্য এখন প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড বা ১’শ ১০ বিলিয়ন ডলার। এর মাঝে চীনে ব্রিটেনের রপ্তানি প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার এবং ব্রিটেনে চীনের রপ্তানি প্রায় ৬৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ব্রিটেনের এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপর। চীন হলো ব্রিটেনের ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। আর ব্রিটেনের আমদানির জন্যে চীন হলো চতুর্থ বৃহত্তম আমদানি উৎস। এমতাবস্থায় চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতিকে ব্যালান্স করতে রাজনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকতে চাইছে ব্রিটেন। চীনা মিডিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটেন একদিকে যেমন চীনকে বাধ্য করছে প্রতিক্রিয়া দেখাতে, তেমনি হংকং এবং উইঘুর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিয়ে এসে চীনকে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছে। ব্রিটেনের আদর্শিক এই আক্রমণের বিরুদ্ধে চীন এখনও কোন জবাব তৈরি করতে পারেনি। চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনায় এগিয়ে থাকতে ব্রিটেন এই ইস্যুগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। হংকং এবং উইঘুরের জনগণের জন্যে ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে নয়, বরং পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে ব্রিটেন চীনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে।

2 comments:

  1. ইউরোপ বিট্রেনকে কোন চোখে দেখে। ইউরোপ বিট্রেন প্রভাব বিস্তারকে তার স্বার্থের সাথে দ্বন্দ্ব হচ্ছে কিনা

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইউরোপ গত প্রায় চার'শ বছর ধরে ব্রিটেনকে সন্দেহের চোখে দেখে। ব্রিটেনের শক্তিশালী হবার মূল ফর্মূলাই ছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিকে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে রেখে ব্যালান্স করে রাখা। এটা না করতে পারলে ইউরোপের দেশগুলি ব্রিটেনে হামলা করার পরিকল্পনা করবে। এটা বেশ কয়েকবার হয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। ব্রিটেন সর্বদাই ইউরোপের অন্য দেশগুলিকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্যে ব্যবহার করেছে। এটা ইউরোপের দেশগুলি জানে। কিন্তু নিজেদের মাঝে অনৈক্যের কারণে তারা কখনোই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে সক্ষম হয়নি। ইউরোপ ভালো করেই জানে যে, ব্রেক্সিট একটা ব্রিটিশ খেলা। তাই তারা ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনকে বাণিজ্যে কোন রকম ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয়।

      Delete