সাবমেরিন হলো একটা ডিটারেন্ট প্ল্যাটফর্ম। অর্থাৎ শত্রু যাতে তার শত্রুতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, সেটা নিশ্চিত করে এই সাবমেরিন। শত্রু জানবে যে সে ঝামেলা করলে তাকেও ঝামেলাতে পড়তে হবে। এভাবে সাবমেরিন একটা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যাটফর্মই বটে। তবে সাবমেরিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারার মাঝেই এই ডিটারেন্ট। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে দু’টা টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন কেনার পরে বাংলাদেশের হাতেও ডিটারেন্টের একটা অপশন এসেছে। বাংলাদেশের প্রতি বৈরী আচরণকারী কোন দেশকে একটা মেসেজ দেয়ার জন্যে এই সাবমেরিনগুলির ব্যবহার হতে পারে।
বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের কিছু সমস্যা অনেক পুরোনো। এর প্রধানতম হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলিমদের নিয়ে। মিয়ানমারের এই মুসলিম নাগরিকদের প্রতি বৈরী আচরণ করার ফলে সেখান থেকে হাজারো মুসলিম নরনারীর বাংলাদেশমুখী যে ঢল সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রত্যুত্তর দিতে বাংলাদেশ তার ডিটারেন্টগুলিকে ব্যবহার করতে পারে, যার সর্বাগ্রে এখন রয়েছে সাবমেরিন-দু’টা। মিয়ানমারের সরকারকে মেসেজ পেতে হবে যে ভারত-মার্কিন ঔপনিবেশিকদের কথায় নেচে মিয়ানমার তার বিপদ ডেকে আনছে। মুখের কথায় যদি চিড়ে না ভেজে, তাহলে শক্ত হতেই হবে। এই শক্ত হবার কাজটা বাংলাদেশ আরও আগেই করতে পারতো। এর আগের বারে মিয়ানমার থেকে যখন দলে দলে মুসলিম আসা শুরু করলো, তখনই বাংলাদেশ মেসেজটা দিতে পারতো।
আগেই যা করা উচিত ছিল...
মালয়েশিয়ার একটা জাহাজ কিছু ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়েছিল তখন। ইন্দোনেশিয়ার এক মন্ত্রীও এসেছিলেন শরণার্থীদের দেখতে। কিন্তু এই কাজগুলি তখন সেই সরকারগুলি করেছিল তাদের দেশের রাস্তায় মুসলিমদের প্রতিবাদ সমাবেশ সামলাতে। আসল কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তা এখন খুবই পরিষ্কার। এধরনের কর্মকান্ডের অন্তসারশূণ্যতার একটা প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হয়ে রইলো সেটা। যা তখনই করা উচিত ছিল তা হলো –
১। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সাথে ‘লাইভ-ফায়ারিং জয়েন্ট মিলিটারি এক্সারসাইজ’ করতো।
২। তারপর মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরে যৌথভাবে ত্রাণ পাঠাবার কথা বলতো।
৩। ত্রাণবাহী জাহাজটির সাথে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার চারটা যুদ্ধজাহাজ এবং ৮টা যুদ্ধবিমান আসতো এবং
৪। সেগুলিকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী এসকর্ট করে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে আসতো।
তাহলেই বোঝা যেতো কে কার কথা শোনে। মিয়ানমার যদি বুঝতে পারতো যে এই ভীতি প্রদর্শন শুধু ফাঁকা বুলি নয়; এরা দরকার হলে সামরিক অভিযানেও পিছপা হবে না, তাহলে মিয়ানমার সরকার সত্যিকারের ভয় পেতো।
আন্ডারওয়াটার জয়েন্ট এক্সারসাইজ
তবে যেহেতু সেবারে এটা করা হয়নি, তাই এবারে আরও কঠিন হবার সময় এসেছে। মিয়ানমারের সামরিক বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার ফলে কঠিন প্রত্যুত্তর দেবারই গ্রাউন্ড প্রস্তুত হয়েছে। এই প্রত্যুত্তর দিতে হবে বাংলাদেশের ডিটারেন্ট প্ল্যাটফর্ম সাবমেরিনকে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কিনেছে অল্প কিছুদিন। তাই সাবমেরিন অপারেশনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। আবার বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার কাছ থেকেও জয়েন্ট এক্সারসাইজের মাধ্যমে সহায়তা নিতে পারে। তাদের সাবমেরিন বহরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে মহড়া দেয়া যায়। এতে সবাই উপকৃত হবে। চীনও বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। চীনের সাবমেরিন ভারত মহাসাগরে নতুন নয়। তাই চীনের সাবমেরিনের সাথেও বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রুদের স্কিল ডেভেলপ করা যেতে পারে।
আরও উন্নত প্ল্যাটফর্ম
তবে এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় গুরুত পাবে। বাংলাদেশের সাবমেরিনগুলি মোটামুটি কর্মক্ষম হলেও একেবারে লেটেস্ট মডেলের কিন্তু নয়, যা কিনা তাদের ডিটারেন্ট ভ্যালুকে কমিয়ে দেয়। কাজেই বাংলাদেশকে খুব শীঘ্রই আরও সাবমেরিন যোগাড় করতে হবে। নতুন তৈরি করে সাবমেরিন যেমন আনতে হবে, তেমনি ‘অফ-দ্যা-শেলফ’ সাবমেরিনও খুঁজতে হবে, যা কিনা প্রযুক্তির দিক থেকে টাইপ-০৩৫জি থেকে আরও উন্নত। এক্ষেত্রে চীন যেমন ভালো অপশন দেবে, তেমনি তুরস্ক বা দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও উন্নত প্রযুক্তির সাবমেরিন আনা যেতে পারে। তুরস্কের সাবমেরিনগুলি জার্মান প্রযুক্তির; তাই সন্দেহাতীতভাবে আরও শক্ত ডিটারেন্ট তৈরি করতে সক্ষম। বঙ্গোপসাগর টহল দিতে এবং বাংলাদেশের সী-লেন-কে শত্রুর ভীতি প্রদর্শন থেকে দূরে রাখতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৮ থেকে ১২টা সাবমেরিন লাগবে। আর প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলে সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হতে পারে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য যেহেতু সমুদ্রপথে হয়, তাই এর কোন বিকল্প বাংলাদেশের সামনে নেই।
আর অন্যদিকে মিয়ানমারের কৌশলগত অবস্থান খুব দুর্বল। বাংলাদেশ এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে খুব সহজেই। সিতওয়ে বন্দর খুবই দুর্বল অবস্থানে, যে বন্দরের উপরে মিয়ানমারের রাখাইনের বেশিরভাগটাই নির্ভরশীল। এরকম দুর্বল অবস্থানে থেকেও মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে ঝামেলা করতে পারছে – এটা বাংলাদেশের দুর্বল কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ তার ডিটারেন্ট তৈরিতে আরও মনোযোগী হলে, এবং বর্তমানের ডিটারেন্টগুলির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করলে মিয়ানমার এধরনের আচরণ করতে সাহস পেতো না কখনোই। মিয়ানমারকে শক্তভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তাদের ভারত-মার্কিন ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন বাংলাদেশ সহ্য করবে না।
No comments:
Post a Comment