১৭ই জুলাই ২০১৭
ইস্রাইলের জাহাজের উপরে ব্যালিস্টিক মিসাইলের গাড়ি। |
২০১৭-এর জুন মাসে ইস্রাইল সমুদ্রে একটা কনটেইনার জাহাজের ডেক থেকে সফলভাবে একটা ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করে। এর মাধ্যমে ইস্রাইল আবারও পুরোনো সেই চিন্তাকে সামনে এনে দিল – যেকোন জাহাজই আসলে যুদ্ধজাহাজ হতে পারে। ইস্রাইলের এই পরীক্ষামূলক কাজের দু’টি বিশ্লেষণ করা যায়। এক হলো, একটা কনটেইনার জাহাজে মিসাইল লুকিয়ে রাখা সম্ভব। এর অনেক আগে থেকেই রাশিয়ানরা কনটেইনার থেকে ফায়ার করার মতো মিসাইল ডেভেলপ করে চলেছে। তবে রুশদের ফোকাস ছিল মূলতঃ লুকিয়ে রাখা কনটেইনার থেকে ক্রুজ মিসাইল ফায়ার করার বিষয়ে। এই ক্রুজ মিসাইল যেকোন জাহাজে যেমন হামলা করতে পারে, তেমনি স্থলভাগেও আঘাত হানতে সক্ষম। তবে এটি ক্রুজ মিসাইল, অর্থাৎ এটি মূলতঃ একটা সুইসাইড বিমানের মতো উড়ে গিয়ে আঘাত করবে। তবে এক্ষেত্রে ব্যালিস্টিক মিসাইল অন্য এক ডিমেনশন দেয় এখানে। ইস্রাইলের পরীক্ষাটা এজন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ক্রুজ মিসাইলের চাইতে ব্যালিস্টিক মিসাইলের কৌশলগত গুরুত্ব বেশি। দ্বিতীয় দিকটি হলো, ইস্রাইলের পরীক্ষায় দেখা গেছে যে মিসাইলটি আসলে ফায়ার করা হয়েছে একটি মোবাইল মিসাইল-ক্যারিয়ার বা মিসাইলের গাড়ি থেকে। গাড়িটাকে জাহাজে উঠিয়ে ডেকের সাথে শক্ত করে সেঁটে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ স্থলভাগে ব্যবহার করা একটা অস্ত্রকে সমুদ্রের জাহাজে সেঁটে দিয়ে জাহাজটাকে যুদ্ধজাহাজে রূপান্তর করে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে গাড়িটা কিন্তু তার মূল মিশন হারিয়ে ফেলেনি। অর্থাৎ গাড়িটাকে স্থলভাগে নামিয়ে দিলে সে আবারও তার মূল মিশন পালন করতে পারবে। অন্যভাবে দেখলে, এরকম একটা জাহাজের সক্ষমতা থাকছে ব্যালিস্টিক মিসাইল বহণ করে সমুদ্র থেকে ফায়ার করার। আবার এক বন্দর থেকে মিসাইল নিয়ে অন্য বন্দরে নামিয়ে দিয়ে মিসাইলের রেঞ্জ বহুগুণে বাড়িয়ে দেবার।
এই দ্বিতীয় ব্যাপারটা হাজার বছরের পুরোনো যুদ্ধকৌশলকে সামনে নিয়ে আসে। এই কৌশলটি হলো একটি জাহাজ যা বহণ করবে, তার সক্ষমতা সেই বহণকৃত জিনিসের সমান। একটা জাহাজে স্থায়ীভাবে অস্ত্র বসাবার চিন্তাটা কিন্তু খুব বেশি পুরোনো নয় – মাত্র কয়েক’শ বছরের। অন্যদিকে জাহাজ থেকে অস্ত্র স্থলভাগে নামিয়ে স্থলযুদ্ধে ব্যবহার করে সেগুলিকে আবারও জাহাজে উঠিয়ে নিয়ে অন্যত্র ব্যবহার করার ইতিহাস হাজার বছরের। এই হাজার বছরের ইতিহাস আজকে দেখতে পাওয়া যাবে উভচর যুদ্ধের জন্যে তৈরি করা জাহাজগুলিতে। এই জাহাজগুলি বিপুল পরিমাণ সৈন্য এবং রসদ পরিবহণ করে, যা স্থলভাগে নামিয়ে দিয়ে একটা বিরাট এলাকাকেই দখলে নিয়ে নেয়া যায়। একসময় এই ব্যাপারটা সকল যুদ্ধজাহাজের জন্যেই স্বাভাবিক ছিল; শুধু উভচর যুদ্ধের জন্যে আলাদাভাবে তৈরি জাহাজের জন্যে নয়। আসলে উভচর যুদ্ধের জন্যে আলাদা করে জাহাজ ডিজানই করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। এর আগে জাহাজ উপকূলে ওঠালে কোর্ট মার্শাল করা হতো!
স্থলযুদ্ধের অস্ত্র জলযুদ্ধে
স্থলযুদ্ধের অস্ত্র জাহাজে পরিবহণ করে এবং সেগুলিকে সমুদ্রের মাঝে ব্যবহারের উপযোগী করে সেই পুরোনো যুদ্ধকৌশলকেই আবার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর একইসাথে গত এক’শ বছরে যুদ্ধজাহাজের যেসকল সংজ্ঞ্রা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলি ধ্বসে যাচ্ছে। আরও একটা উদাহরণের দিকে দেখা যেতে পারে। মিশরের নৌবাহিনী ফ্রান্স থেকে দু’টি মিস্ত্রাল-ক্লাসের উভচর যুদ্ধের উপযোগী যুদ্ধজাহাজ কিনেছে, যা কিনা প্রথমতঃ রাশিয়ার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। কিছুদিন আগে মিশরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা ভিডিওতে দেখানো হয় যে মিস্ত্রাল-ক্লাসের একটা জাহাজের ডেকে বসানো হয়েছে তিনটা ‘এভেঞ্জার’ শর্ট-রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এভেঞ্জার হলো স্থল বাহিনীর জন্যে তৈরি একটা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যা কিনা ‘হামভি’ গাড়ির উপরে বসানো হয়েছে। ঐ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে এভেঞ্জার সিস্টেম একেবারে গাড়িসুদ্ধ জাহাজের ডেকে সেঁটে দেয়া হয়েছে! অর্থাৎ অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায় যে এভাবে প্রায় যেকোন জাহাজেই এয়ার ডিফেন্স বসানো সম্ভব, যা করতে দুই মিনিট সময়ও লাগবে না! শুধু একটা মোবাইল এয়ার ডিফেন্স ইউনিট জাহাজে তুলে দিলেই হলো; ব্যাস, যুদ্ধজাহাজ তৈরি!
স্থলযুদ্ধের জন্যে তৈরি করা ক্রুজ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল বা এয়ার ডিফেন্স মিসাইলের এরকম ব্যবহার যেকোন জাহাজকেই যুদ্ধজাহাজে রূপান্তর করতে সক্ষম; তাও আবার স্বল্প সময়ের মাঝেই; তেমন কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। এরকম যুদ্ধজাহাজ সমুদ্রে যেমন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে পারে, তেমনি তার অস্ত্রগুলি স্থলভাগে নামিয়ে দিয়ে স্থলযুদ্ধের হিসেবনিকেশও পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম। একটা জাহাজ কতটুকু শক্তিশালী হবে, তা যেন নির্ভর করবে সেই জাহাজের ডেকের উপরে অস্ত্র বহণের সক্ষমতার উপর। অর্থাৎ যে জাহাজের ডেকের উপরে যত বেশি খোলা জায়গা থাকবে, সেই জাহাজের তত বেশি সক্ষমতা থাকবে সসস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের। দু’দিন আগেও যে জাহাজটা ছিল কার্গো জাহাজ, দু’দিন পরে সেই জাহাজটাই হয়ে যাবে যুদ্ধজাহাজ। তবে এরকম ক্ষেত্রে নীতিগত বেশকিছু পরিবর্তন আসবে, যা কিনা গত কয়েক’শ বছরের নীতির গোড়ায় ধাক্কা দেবে। যেমন কোন জাহাজটা আসলে যুদ্ধজাহাজ আর কোনটা বেসামরিক জাহাজ? এই প্রশ্নের উদ্রেক এর আগে বহুবার হয়েছিল। যেহেতু জাহাজের শক্তির মাপকাঠিই ছিল সেই জাহাজ কত সৈন্য বা অস্ত্র বহণ করে, সেক্ষেত্রে সেই অস্ত্র বহণ না করলে ঐ জাহাজকে তো যুদ্ধজাহাজই বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে! এখন ব্যাপারটা আরও জটিল আকার ধারণ করে যদি যুদ্ধকালীন সময়ে কোন জাহাজ গোপনে অস্ত্র বহণ করে, কিন্তু সবার সামনে বেসামরিক জাহাজের মতো চেহারা উপস্থাপন করে।
লুকিয়ে রাখা অস্ত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানি এধরণের জাহাজ ব্যবহার করেছে। এগুলিকে বলা হতো Merchant raider। এই জাহাজগুলি সাধারণ বাণিজ্য জাহাজের মতো সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতো। এগুলির ডেকের নিচে বেশ কয়েকটি কামান এবং টর্পেডো লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কাছাকাছি শত্রুপক্ষের কোন বাণিজ্য জাহাজ দেখলে এরা কাছাকাছি গিয়ে কামান এবং টর্পেডোর সহায়তায় ঐ জাহাজকে ডুবিয়ে দিতো। জার্মান নৌবাহিনীর রকম কয়েকটি জাহাজ ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। মোট ৯টা বাণিজ্যিক জাহাজকে পরিবর্তিত করে যুদ্ধজাহাজ বানানো হয়েছিল – KMS Atlantis, KMS Pinguin, KMS Kormoran, KMS Widder, KMS Thor, KMS Orion, KMS Stier, KMS Komet, KMS Michel । এই জাহাজগুলির লুকিয়ে রাখা অস্ত্রের সাথে বর্তমানে রাশিয়ানদের ডেভেলপ করা কনটেইনার-বেজড ক্রুজ মিসাইলের মিল উল্লেখ্য। একটা কনটেইনার জাহাজের উপরে কয়েক’শ কনটেইনারের মাঝে দু’টি কনটেইনারের মাঝে যদি ক্রুজ মিসাইল এবং এর কন্ট্রোল সিস্টেম লুকিয়ে রাখা হয়, তাহলে সেই জাহাজটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান নৌবাহিনীর ‘আটলান্টিস’ জাহাজের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আবার এই কন্টেইনারের মাঝে যদি ব্যালিস্টিক মিসাইল থাকে, তাহলে তো সেটা স্ট্র্যাটেজিক ডিটারেন্ট হিসেবেও কাজ করবে। কোন জাহাজে সমুদ্রের কোথায় মিসাইল ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা ধরা খুবই কষ্টকর হবে। মোট কথা যুদ্ধের হিসেবই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
কৌশল আগে না ডিজাইন আগে?
এধরণের অস্ত্র ডেভেলপ করার কারণে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। একটা পরিবর্তন যেমন বলা যেতে পারে যুদ্ধজাহাজের ডিজাইনের ব্যাপারে। আজকাল যুদ্ধজাহাজের সারভাইভাবিলিটি বাড়াতে একটা জাহাজে যে পরিমাণ ইলেকট্রনিক্স এবং অস্ত্র ভরে দেয়া হচ্ছে যে জাহাজ হয়ে যাচ্ছে ভীষণ জটিল, বিশাল এবং ব্যয়বহুল। এর ফলশ্রুতিতে জাহাজের মিশনের পরিধি কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, কারণ বেশি সংখ্যক জাহাজ তৈরি করা যাচ্ছে না। এর আগে ১০টা জাহাজ যে পরিমাণ সমুদ্র পাহাড়া দিতো, এখন ৩টা থেকে ৫টা জাহাজের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। কাজেই কতটা সমুদ্র সে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটার পরিধি কমিয়ে দেয়া হচ্ছে; মিশন রিডিজাইন করে ফেলা হচ্ছে। সমুদ্রের বিপুল জলরাশি পড়ে যাচ্ছে সেই মিশনের বাইরে। একটা জাহাজের পক্ষে তো একই সময়ে দুই জায়গায় থাকা সম্ভব নয়। উপরে আলোচিত নতুন ধরণের যুদ্ধচিন্তা জটিল এবং ব্যয়বহুল জাহাজের ডিজাইনকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং কৌশলগত চিন্তাকে আবারও জাহাজের ডিজাইন এবং প্রযুক্তির উপরে স্থান দেবে।
No comments:
Post a Comment