Friday, 7 April 2017

বাংলাদেশের পূর্ব ইউরোপে প্রবেশ!

০৮ এপ্রিল ২০১৭
বাংলাদেশ কেন প্রায় ৯ বছর পর তার নীতিতে পরিবর্তন আনলো, যখন কসোভো অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ? যখন বাংলাদেশ জানে যে রাশিয়া, চীন এবং ভারত এই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখন কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কি এই দেশগুলির সাথে সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলেনি?

২০১৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করে। এই স্বীকৃতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে কসোভোর সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে দেখতে হবে।

কসোভোর স্বীকৃতির ইতিহাস
কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করে ২০০৮ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী। পরের দিন ১৮ই ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, তুরস্ক, আলবেনিয়া-সহ ৮টি দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের মাঝে মোট ৫৩টি দেশ স্বীকৃতি দেয়, যার মাঝে ৩১টি ইউরোপিয়ান দেশ ছাড়াও ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও তুরস্ক। এর বাইরে সকল দেশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারগুলির মাঝে থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের মাঝ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পূর্ব এশিয়া থেকে মালয়েশিয়া স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয় আরও ১১টি দেশ, যার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে ছিল সৌদি আরব, বাহরাইন এবং জর্দান। ২০১০ সালে আরও ৮টি দেশ স্বীকৃতি দিলেও এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কোন দেশ ছিল না। ২০১১ সালে স্বীকৃতি দেয়া ১২টি দেশের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাতার, ওমান এবং কুয়েত। ততদিনে কসোভোর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই দেশগুলি এতো সময় নিয়ে স্বীকৃতি দিলেও এরা সকলেই কিন্তু মার্কিন সরকারের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই চেয়েছিল যে স্বীকৃতিগুলি আস্তে আস্তে আসুক। তবে যতোই দিন যাচ্ছিল, মার্কিন প্রভাব বলয়ের একেবারে বাইরের দিকে থাকা দেশগুলি এগুচ্ছিল স্বীকৃতি নিয়ে। তারা এগুচ্ছিল কূটনৈতিক সুযোগের সদ্যবহার করার জন্যে। এর কেউ কেউ শুধু মার্কিন না, অন্য দেশ দ্বারাও প্রভাবিত ছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষে আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। সেবছরে মোট ১১টি দেশ স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি দেয়া মোট দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫। ২০১৩ সালে স্বীকৃতি দেয়া ৮টি দেশের মাঝে ছিল মিশর ও থাইল্যান্ড। ২০১৪ সালে স্বীকৃতি দেয়া ৪টি দেশের মাঝে একটিও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল না। ২০১৫ সালে একটি মাত্র দেশ এবং ২০১৬ সালে মাত্র দুইটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে, যার মাঝে সিঙ্গাপুর কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুর ছিল জাতিসংঘের ১১০তম সদস্য দেশ; বাংলাদেশ ১১১তম। এর বাইরে চারটি দেশ এমন কিছু নেতৃত্বের কাছ থেকে আসে, যাদের নিজেদের স্বীকৃতি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে, যেমন তাইওয়ান। এগুলি যোগ করলে বাংলাদেশ ১১৫তম দেশ হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সময় নিয়েছে প্রায় ৯ বছর!


 
ফেব্রুয়ারী মাসে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং মার্চ-এপ্রিলে আইপিইউ সন্মেলনে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার মাধ্যমে সেটাকে ব্যালান্স করে বাংলাদেশ জানান দিলো যে রাশিয়া-চীন-ভারত কারুরই প্রভাব বলয়ে নেই এই রাষ্ট্র। বরং রাশিয়া-চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিকেও ব্যালান্সে ধরে রাখার সক্ষমতা এই রাষ্ট্রের রয়েছে। রাশিয়া-চীন-ভারতকে ব্যালান্সে রেখেই বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে প্রবেশ করলো। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বাংলাদেশের এই ‘কসোভো কার্ড’ একটি নতুন মাথাব্যাথার কারণ হবে।

বাংলাদেশ কেন ৯ বছর অপেক্ষা করে কসোভোকে স্বীকৃতি দিলো?
প্রায় চার বছর ধরে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ এব্যাপারে ‘নিয়ম’ ভঙ্গ করেছে। নতুন করে স্বীকৃতি দেয়ার ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখানে দেখতে হবে যে, কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে এরকম কচ্ছপের গতি কেন সকলের? উত্তর রয়েছে কসোভোর জন্মকে কে কিভাবে দেখছে, সেটার উপরে। রাশিয়া, চীন, ভারত,ইরান-সহ বেশকিছু দেশ কসোভোকে পশ্চিমা দেশগুলির অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের উদাহরণ হিসেবে দেখে। যেসব দেশে বিচ্ছন্নতাবাদী সমস্যা রয়েছে, সেসব দেশ কসোভোকে একটি বাজে উদাহরণ হিসেবে দেখে। একইসাথে রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে থাকা বেশকিছু দেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রের উপরেই স্বীকৃতি দেবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করেছিল। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশ কেন প্রায় ৯ বছর পর তার নীতিতে পরিবর্তন আনলো, যখন কসোভো অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ? যখন বাংলাদেশ জানে যে রাশিয়া, চীন এবং ভারত এই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখন কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ কি এই দেশগুলির সাথে সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলেনি?

প্রথমতঃ মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা দেশ/সরকারগুলি প্রথম চার-পাঁচ বছরের মাঝেই কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। ৯ বছর অপেক্ষা করার ফলে বাংলাদেশের মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকার ব্যাপারটি একেবারেই নাকচ হয়ে গিয়েছে। বরং সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠিন অবস্থান দেখিয়ে দেয় যে মার্কিন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ কসোভোকে অন্য দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী হস্তক্ষপের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখে রাশিয়া-চীন-ভারত। স্বীকৃতি দেয়ার মাত্র এক মাসের মাঝেই ঢাকায় ১৩৬তম ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, এবং সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয়। এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সাথে ছিল রাশিয়া, চীন এবং ভারত। অর্থাৎ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার পরেও এই তিন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অটুট রয়েছেই নয়, বরং আরও শক্ত হয়েছে।

তৃতীয়তঃ ফেব্রুয়ারী মাসে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং মার্চ-এপ্রিলে আইপিইউ সন্মেলনে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার মাধ্যমে সেটাকে ব্যালান্স করে বাংলাদেশ জানান দিলো যে রাশিয়া-চীন-ভারত কারুরই প্রভাব বলয়ে নেই এই রাষ্ট্র। বরং রাশিয়া-চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশগুলিকেও ব্যালান্সে ধরে রাখার সক্ষমতা এই রাষ্ট্রের রয়েছে। রাশিয়া-চীন-ভারতকে ব্যালান্সে রেখেই বাংলাদেশ পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিতে প্রবেশ করলো। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বাংলাদেশের এই ‘কসোভো কার্ড’ একটি নতুন মাথাব্যাথার কারণ হবে।

এখন দেখতে হবে যে, ২০১৭ সালে ‘কসোভো কার্ড’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো কেন?

সিআইএ-এর হিসেবে কসোভোর জনসংখ্যা ১৮ লক্ষের মতো। তবে কেউ কেউ ১৯ থেকে ২২ লক্ষের মতো বলছেন। এর মাঝে বিভিন্ন মতভেদে ৮৮% থেকে ৯৫% মুসলিম; যাদের আবার বেশিরভাগই জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান। আর ৪% থেকে ৮% সার্ব। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধের মাঝেই ১৯৯৬ সাল নাগাদ কসোভোর প্রতিবেশী দেশ আলবেনিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলি কসোভোকে স্বাধীন করার চেষ্টা শুরু করে দেয়। এই প্রচেষ্টায় বাইরের ইন্ধন ছিল বলে সার্বিয়ানরা এবং রাশিয়ানরা অভিযোগ করে। এর মাঝে সার্বরা কসোভারদের উপরে নির্যাতন শুরু করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যায়। এই ঘোলাটে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্বের সমর্থন না পেয়ে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে ন্যাটোকে সাথে নিয়ে ১৯৯৯ সালে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন সরকার সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে, যখন রাশিয়া-চীন এর বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। রাশিয়া-চীন এক্ষেত্রে মানবাধিকারের নামে অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছিলো। যুদ্ধের ফলে প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম কসোভো ছেড়ে যায়; মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১১ হাজার মানুষের, যাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। যুদ্ধ বন্ধের শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সার্বিয়ান সৈন্যদের কসোভো ছেড়ে যেতে বাধ্য করে এবং এর স্থলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করে। মার্কিন হস্তক্ষেপে প্রায় দুই লক্ষের মতো সার্ব কসোভো ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কসোভোকে ‘রক্ষা করা’র লক্ষ্যে পশ্চিমা বাহিনী কসোভোতে ৫০ হাজার সৈন্য পাঠায়। তবে পশ্চিমাদের ব্যালান্স করতে ‘কসোভো ফোর্স’ নামের এই বাহিনীতে রাশিয়াও ৪ হাজার সৈন্য পাঠায়। ভারত কসোভোকে স্বীকৃতি না দিলেও সেসময় ৮০০ সৈন্য পাঠায় কসোভোতে।

কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাসিম থাচি ২০১৭ সালে এসে কসোভোর সেনাবাহিনী গড়ার পেছনে জোর দেয়া শুরু করেন। ১০ই মার্চ তিনি বলেন যে তিনি এমন দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতে চাননা, যেদেশের পার্লামেন্ট নিজ দেশের কোন সামরিক বাহিনী থাকুক, সেটা চায় না। এখানেই হয়ে যায় বিপত্তি। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র এর কঠোর বিরোধিতা করে; সার্বরাও বিরোধিতা করে। এদের কেউই চাচ্ছে না যে কসোভোর সেনাবাহিনী তৈরি হোক। অর্থাৎ মার্কিনীরা, ইউরোপিয়ানরা এবং সার্বরা সকলেই এক্ষেত্রে এক পক্ষে!

কসোভোর পার্লামেন্ট কসোভোর সেনাবাহিনী রাখার বিরোধী?

কসোভোর নিরাপত্তার ভার বেশ কিছুটা কসোভো পুলিশ এবং ‘কসোভো সিকিউরিটি ফোর্স’-এর (কেএসএফ) হাতে দিলেও ২০১৬ সালেও সেখানে ৪,৬০০ বিদেশী সৈন্য মোতায়েন ছিল। ৯ হাজার পুলিশের সাথে রয়েছে কেএসএফ-এর প্রায় সাড়ে চার হাজার সদস্য, যাদেরকে কসোভো সরকার চাইছে সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করতে। তবে এখানে বাধা হলো পশ্চিমাদের তৈরি করে দেয়া সংবিধান। সংবিধান অনুযায়ী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে আলাদাভাবে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পেলে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। আর সংবিধান সংশোধন না করতে পারলে কসোভোর সেনাবাহিনীও তৈরি করা সম্ভব নয়। ১০০ জন এমপি রয়েছেন আলবেনিয়ান মুসলিম, যাদের বেশিরভাগই হয়তো সেনাবাহিনীর পক্ষে ভোট দেবেন। কিন্তু ২০ জন সংখ্যালঘু এমপির মাঝে ১০ জন রয়েছেন সার্ব, যারা কসোভোর যেকোন সামরিক বাহিনীর পুরোপুরি বিরোধী। সার্বরা চায় কসোভোর নিরাপত্তা সার্বিয়ার হাতে থাকুক, নাহলে কসোভোতে সার্বদের স্বার্থ রক্ষা হবে না। ২০ জনের মাঝে এই ১০ জন কখনোই কসোভোর সেনাবাহিনীর পক্ষে ভোট দেবেন না, অর্থাৎ কসোভোর সেনাবাহিনীর থাকার সম্ভাবনা কখনোই থাকছে না। আর এর অর্থ হলো, কসোভোররা সর্বদাই তাদের নিরাপত্তার জন্যে পশ্চিমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাসিম থাচি ২০১৭ সালে এসে কসোভোর সেনাবাহিনী গড়ার পেছনে জোর দেয়া শুরু করেন। ১০ই মার্চ তিনি বলেন যে তিনি এমন দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতে চাননা, যেদেশের পার্লামেন্ট নিজ দেশের কোন সামরিক বাহিনী থাকুক, সেটা চায় না। এখানেই হয়ে যায় বিপত্তি। ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র এর কঠোর বিরোধিতা করে; সার্বরাও বিরোধিতা করে। এদের কেউই চাচ্ছে না যে কসোভোর সেনাবাহিনী তৈরি হোক। অর্থাৎ মার্কিনীরা, ইউরোপিয়ানরা এবং সার্বরা সকলেই এক্ষেত্রে এক পক্ষে!

কসোভোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থান

কসোভোর সেনাবাহিনীর রাজনীতিকে বুঝতে হলে কসোভোর ভূকৌশলগত অবস্থান বুঝতে হবে। কসোভোর ভূকৌশলগত অবস্থান পূর্ব ইউরোপে বলকানের নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে। ১০ হাজার ৯০০ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের ছোট্ট কসোভো (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের প্রায় সমান) পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত। তবে আলবেনিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে আলবেনিয়ার মাধ্যমে কসোভো সমুদ্রের দেখা পায়। এই ছোট্ট দেশটি ইউরোপের সবচাইতে গরীব দেশ। দেশটির অর্থনীতির আকার মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার। সাড়ে তিন’শো মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করলেও আমদানি করে প্রায় ২,৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ দেশটি বৈদেশিক বাণিজ্যের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। সবচাইতে বেশি রপ্তানি হয় ইতালি, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়াতে এবং আমদানি হয় জার্মানি, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, তুরস্ক, ইতালি, আলবেনিয়া থেকে। গরীব হলেও দেশটি খণিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জাতিসংঘের মতে দেশটিতে মজুদ খণিজ সম্পদের মূল্য সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। খণিজের মাঝে রয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন টন লিগনাইট কয়লা (পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মজুদ)। কসোভোর ৯৭% বিদ্যুৎ তৈরি হয় এই কয়লা থেকে। এছাড়াও রয়েছে সীসা-জিঙ্ক-সিলভারের খণি। রয়েছে নিকেল এবং ক্রোমিয়ামের খণি। বক্সাইট এবং ম্যাগনেসিয়ামের খণিও রয়েছে এখানে। এসব খণিজ পদার্থ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরির জন্য যথেষ্ট। এর বাইরেও রয়েছে গ্রানাইট, চুনাপাথর, মার্বেল, ইত্যাদি বিভিন্ন কন্সট্রাকশন মিনারেলের খণি। এসব খণির নিয়ন্ত্রণ কার কাছে থাকবে, সেই প্রশ্ন এখন সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।
 
সার্বরা পালন করছে ১৩৮৯ সালের কসোভোর যুদ্ধের ৬২০তম বার্ষিকী। ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কাছে কসোভোর গুরুত্ব অনেক। ১৩৮৯ সালের যুদ্ধে সার্বরা হেরেছিল উসমানি সুলতান মুরাদের কাছে, তারপরেও সার্বরা মনে রাখতে চায় সেই যুদ্ধের ফলাফলের কথা। ঐ সময় থেকেই বলকানে ইসলামের আবির্ভাব হয় এবং সেখানকার ইতিহাস পালটে যায় সারাজীবনের জন্যে। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধির মাঝে ইউরোপিয়ানরা ইউরোপে ৫০০ বছরের উসমানিয়া খিলাফতের ছায়াকে দেখতে পাচ্ছে।

কসোভোর ঐতিহাসিক বাস্তবতা

এই অঞ্চলের ইতিহাস ভূরাজনৈতিক হিসেবের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলকান অঞ্চল পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতকের গোড়া অবধি ৫০০ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই তুর্কি উসমানিয়া খিলাফতের অধীনে ছিল। বলকানে ইসলামের আবির্ভাব হয় এসময়েই। বলকানের খ্রিস্টানরা হচ্ছে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান, যা পশ্চিম ইউরোপের ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের থেকে আলাদা। মুসলিমদের সাথে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সমস্যা হজরত মুহম্মদ (সঃ)-এর সময় থেকে, যখন ইস্তাম্বুল (তখনকার নাম কনস্টানটিনোপোল) ছিল ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের (বাইজ্যানটাইন এম্পায়ার) রাজধানী। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুল মুসলিমদের হাতে চলে গেলে ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া, তথা মস্কো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝ দিয়ে তুর্কি খিলাফতের পতনের সাথে সাথে বলকানের কর্তৃত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। জার্মান এবং ইটালিয়ানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত সেখানে প্রভাবশালী ছিল। ব্রিটিশ এবং ফরাসীদের প্রভাবও ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই পশ্চিমাদের ইন্ধনে এই এলাকায় সমস্যার শুরু। রাশিয়া বলকানে পশ্চিমাদের প্রভাবকে নিজের স্বার্থবিরুদ্ধ দেখতে শুরু করে বলেই বলকানের সমস্যার দুই প্রান্তে অবস্থান করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রস্থানের সাথে সাথে এখানকার ভূরাজনীতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একমত যে বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের বলকানে তুরস্কের প্রভাব প্রতিদিনই বাড়ছে। ইউরোপিয়ানরা তুরস্কের মাঝে সেই তুর্কি খিলাফতের ছায়া দেখতে পাচ্ছে, যা তাদেরকে ভীতিতে ফেলছে।

ঠিক এই সময়েই কসোভোকে স্বীকৃতি দিল বাংলাদেশ। যখন যুক্তরাষ্ট্র কসোভোকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তখন বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেয়নি। এখন সেই স্বীকৃতিই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এই স্বীকৃতিকে তার স্বার্থবিরুদ্ধ মনে করলেও তুরস্ক এই স্বীকৃতির বিরুদ্ধে না-ও থাকতে পারে। এই স্বীকৃতির মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন উপাখ্যান খুললো, কিছুদিন আগেও যার অস্তিত্বই ছিল না। বাংলাদেশের হাতে এর মাধ্যমে ‘কসোভো কার্ড’ এলো, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের উল্টোদিকে পারফেক্ট ব্যালান্সে রয়েছে রাশিয়া-চীন-ভারত। এতো বিশাল ওজনের দুই পক্ষ দুই পাশে থাকলেও ব্যালান্সে এতটুকু চাপও অনুভূত হয়নি! এতো শক্তিশালী অবস্থানকে বুঝতে পারাটা অতটা সহজ নয়, কারণ বেশিরভাগ লোকই বাংলাদেশের দৃশ্যমান আকৃতি নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।

2 comments:

  1. চমৎকার লেখনীর জন্য শুকরিয়া।
    " কারণ
    বেশিরভাগ লোকই বাংলাদেশের
    দৃশ্যমান আকৃতি নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।"

    এ সম্পর্কে যদি একটু আলোকপাত করতেন?


    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

      একটি রাষ্ট্রের শক্তি দৃশ্যমান বস্তু থেকে আসে না, আসে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে। বস্তু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে না; বরং মানুষের চিন্তা বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তুই হচ্ছে ঐ দৃশ্যমান আকৃতি। এর মাঝে রয়েছে অর্থনীতির আকৃতি, জনসংখ্যা, প্রযুক্তি, সামরিক বাহিনী, ভূকৌশলগত অবস্থান, ইত্যাদি। এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে চিন্তাগত উতকর্ষ, যা ছাড়া এগুলি মূল্যহীন। এর আগের লেখাগুলিতেও চিন্তাগত উতকর্ষের কথাই বারংবার এসেছে।

      Delete