বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে ভারতে যাচ্ছেন বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে দিল্লীর নিরন্তর চেষ্টার ফসল হতে যাচ্ছে এই সফর – অন্তত দিল্লীর কূটনীতিকেরা এটা ভেবেই খুশি হতে চাইবেন। যদিও মনোহর পারিকরের ব্যর্থতা এবং তার ফলাফল সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল থাকবেন। আর এতোদিনে দিল্লীর বুঝে যাবার কথা যে এখন বাংলাদেশের সাথে কথা বলতে গেলে আগের ভাষায় কথা বললে চলবে না। চীন এবং ভারতের মতো দু’টি বিরাট রাষ্ট্রকে ব্যালান্স করে চলার মতো সক্ষমতা যে রাষ্ট্রের রয়েছে, তার শক্তি যাচাই করতে ভারতের হিসেব ভুল হওয়াটা একেবারেই সমীচিন নয়। দিল্লীর চিন্তাশীল মহল বোঝেন যে বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব ভারতের সকল চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারে। শক্তিশালী বাংলাদেশ মানেই ভারতের দুর্বল দিকগুলি তার জানা রয়েছে, এবং সেব্যাপারে সিদ্ধান্তও বাংলাদেশেরই। কাজেই বাংলাদেশের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যখন বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের মাটিকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেয়া হবে না, তখন দিল্লীর বোঝা উচিত যে বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটুকু।
সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা সমঝোতা নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে, তা ভারতের কাছে বার্তা হিসেবে যাওয়া উচিত যে বাংলাদেশের জনগণের মতামতের ভরবেগের বিরুদ্ধে কিছু আশা করাটা ভারতের পক্ষে সমীচিন হবে না। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ কোন কার্ডটি কোথায় খেলবে, সেটা নিতান্তই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। একটি ব্যালান্সের মাঝখানের অবস্থানটি যেমন শক্তিশালী, তেমনি দায়িত্বপূর্ণ। ব্যালান্সের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই পক্ষেরই বোঝা উচিত যে ব্যালান্সের মাঝের অবস্থানটিই সিদ্ধান্ত নেয় যে কোনদিকে দূরত্ব কমাতে বা বাড়াতে হবে। এই দূরত্বের হিসেব-নিকেশের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ চাইবে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতা করতে, যদিও সেটা বাংলাদেশের কতটুকু দরকার, তাতে প্রশ্ন থেকেই যাবে সাধারণ জনগণের মাঝে। বিশেষতঃ তিস্তার নায্য পানিবন্টনের মতো ইস্যুকে জিইয়ে রেখে প্রতিরক্ষা স্মারক স্বাক্ষর করাটা কতটা জরুরি, সেই আলোচনাটি অবান্তর নয় মোটেই। তিস্তার পানির বন্টন না করেও একগাদা হাল্কা ইস্যু নিয়ে আলোচনার কথা বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লীতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভূরাজনৈতিকভাবে অপমান করার ভারতীয় পরিকল্পনা কতটা ভুল, তা ওয়াকিবহাল মহলের কাছে পরিষ্কার। ভারতকে বুঝতে হবে যে ভারত এবং চীনের মাঝে ‘পারফেক্ট ব্যালান্স’ কোথায় হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ; ভারত নয়। এখানে ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব খুব কমই রয়েছে।
বাংলাদেশকে শক্তিশালী হতেই হবে। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের পূর্বশর্ত হলো স্থিতিশীলতা। এই স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে অনেক ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে – তথাকথিত জঙ্গীবাদ, শ্রমিক অসন্তোষ, সাম্প্রদায়িক হামলা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি, ইত্যাদি। কিন্তু সবই ভেস্তে গেছে একে একে। ভারতকে বুঝতে হবে যে সাম্রাজ্যবাদী এই চক্র চাইছে ভারত-চীনের ব্যালান্সের মাঝে অবস্থান নেয়া দায়িত্বশীল রাষ্ট্রটিকে অস্থির করে তোলা, যাতে পুরো ব্যালান্সটাই ধ্বসে যায়; উদ্দেশ্য – বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঠেকানো। ভারতকে বুঝতে হবে যে শক্তিশালী বাংলাদেশ ভারতের স্থিতিশীলতার জন্যেই জরুরি। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রই পারে ভারত এবং চীনকে ব্যালান্সে ধরে রাখতে; বঙ্গোপসাগরকে ব্যালান্সে রাখতে; ভারত মহাসাগরকে ব্যালান্সে রাখতে। নিজের স্বার্থ না বুঝে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বাস্তবায়ন ভারতের জন্যে দুঃখ ছাড়া কিছুই বয়ে আনবে না। ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সভা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সেই সভায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের কর্মকান্ড বন্ধের আহ্বান ভারতের কাছে একটি বার্তা হিসেবে যাওয়া উচিত। এর আগে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ওশান রিম এসোসিয়েশন (আইওআরএ)-এর প্রথম শীর্ষ বৈঠকও একইরকম বার্তা দিয়েছিল। ভারত তার নিজের স্বার্থেই কোন অবস্থাতেই এই বার্তাগুলি ভুল বুঝতে পারে না। এই বার্তাগুলির সঠিক অনুধাবনের মাঝেই ভারতের অস্তিত্ব নিহিত।
No comments:
Post a Comment