Saturday, 25 June 2016

বাংলাদেশের “মিরাক্কেল”-এর উপরে টিকে আছে ভারত?

২৬শে জুন ২০১৬

http://www.thedailystar.net/sites/default/files/customphp/photo/2010/08/14/2010-08-14__si02.jpg
বাংলাদেশের কোন "মিরাক্কেল"-এর জন্যে ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ? আর এই "মিরাক্কেল" কি চিরস্থায়িত্ব পাবে?


ভূরাজনীতির ভাষাগুলি একটু অন্যরকম। এই ভাষা কিছু চিন্তার উপরে প্রতিষ্ঠিত, যা কিনা সাধারণ মানুষের কাছে উদ্ভট ঠেকে। এরকম ঠেকার কারণ সাধারণ মানুষ “বাস্তবতা”র জঞ্জাল থেকে বের হয়ে চিন্তা করতে পারে না। তারা এ-ও ভাবতে পারে না যে “বাস্তবতা” আসলে তৈরি করা একটা ভূবন, যা যেকোন সময়েই পরিবর্তিত হতে পারে। মানুষের মাঝে বাস্তবতার স্থায়িত্বকালকে চিরস্থায়িত্ব দেয়াতেই শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার আসল ভিত্তি। যা-ই হোক, ভূরাজনীতির ভাষায় বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করতে গেলে কিছু ব্যাপার সামনে আসবে যা কিনা সাধারণ মানুষ দেখবে না, অথবা তৈরি করা বাস্তবতার মারপ্যাঁচ থেকে বের হতে না পেরে আসল অবস্থা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে না।

আমরা প্রথমে দেখে নিই যে সাধারণ মানুষ কি দেখে। ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে কি কি কারণে? সাধারণ মানুষ এর উত্তর কিভাবে দেবে? তারা ভাববে, ভারত কৃতজ্ঞ থাকবে, কারণ –

১. বাংলাদেশ ভারতকে ফারাক্কা ব্যারাজ বানাতে দিয়েছে এবং চার দশক ধরে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের পরেও কঠিন কোন কূটনীতির আশ্রয় নেয়নি। ফারাক্কা ব্যারাজের উপরে ভিত্তি করে কৃত্রিম স্থানে ব্রিটিশদের তৈরি কোলকাতা বন্দর টিকে আছে; কোলকাতা বন্দরের উপরে টিকে আছে ভারতের পূর্বাংশ। শুধু ফারাক্কাই নয়, তিস্তাসহ পঞ্চাশোর্ধ অভিন্ন নদীর উপরে ভারত বাঁধ দিয়েছে, অথচ বাংলাদেশ কিছুই বলেনি ভারতকে।

২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুগ যুগ ধরে চলা ভারতের subversion-এর কোন প্রতিবাদ বাংলাদেশ করেনি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারত বুদ্ধিজীবি, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া কর্মী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এনজিওকর্মী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞাপণ নির্মাতা, অনলাইন একটিভিস্ট, ব্যাবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ইত্যাদি সেক্টরে হাজার হাজার এজেন্ট তৈরি করেছে তাদের এই subversion-কে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্যে। বাংলাদেশ এগুলির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ তো নেয়ই নি, বরং মেনে নিয়েছে এবং সহায়তা করেছে ভারতীয়দের।

৩. ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে ফেন্সিডিলের কারখানা বসিয়ে সেখানে তৈরি ফেন্সিডিল বাংলাদেশে পাঠিয়ে এদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

৪. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র পাঠিয়ে দেশের ভিতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের অস্ত্র, ট্রেনিং এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে এদেশকে ভাগ করতে চেয়েছে ভারত। বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে কিছু করেনি।

৬. বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে গিয়ে প্রচুর বাধার সন্মুখীন হয়েছে সর্বদা। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেই গিয়েছে। ভারত যখন তখন চাল, পিঁয়াজ এবং গরু রপ্তানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল করেছে, তবুও বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধু ভেবেই গেছে; কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

৭. বাংলাদেশে ভারতের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত মানুষের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের জন্যে পঞ্চম বৃহত্তম রেমিট্যান্সের উৎস। ভারতের এক্সিকিউটিভরা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করলেও বাংলাদেশ কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

৮. সীমান্তে বিএসএফ নিয়মিত গোলাগুলি করে এদেশের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে, অথচ বাংলাদেশ এব্যাপারে কঠোর হবার চেষ্টাই করেনি।

৯. বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতের ব্যাপক subversion চালানো সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভারতের সামরিক বাহিনীর সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলেছে।

১০. ভারত সর্বদাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে subversion ব্যবহার করে দেশের সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে; বাংলাদেশ কিছুই বলেনি।

১১. প্রতি বছর বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ভারতে ট্যুরিজম ও চিকিতসার জন্যে গিয়ে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করছে।

১২. বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে ভারত তার বেশিরভাগ সামরিক শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোতায়েন রাখতে পারছে।

১৩. বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ ভারতীয় জেলেরা চুরি করে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে।

১৪. বাংলাদেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি তৈরি করে সেটা নিয়ে ভারত বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এটা কঠিনভাবে নেয়নি কখনোই, যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নাক গলানোর একটা অধিকার আমরাই দিয়েছি।

১৫. উপরের এতকিছুর পরেও বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে; তা-ও আবার বিনে পয়সায়। সেই ট্রানজিটের জন্যে দরকারি বিনিয়োগও বাংলাদেশ ঋণ নিয়ে করছে। অর্থাৎ ভারতকে ট্রানজিট দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ঋণে জর্জরিত হচ্ছে।

ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি… এই লিস্ট আরও অনেক বড় করা সম্ভব। কিন্তু এগুলি জিওপলিটিক্সের ভাষায় কিছুই নয়। সেই ভাষায় অনেক খবরই খবর নয়; আবার অনেক ব্যাপারই খবর হওয়ার কথা না থাকলেও সেটা গুরুত্বপূর্ণ খবর। বিশেষ একটা দিক থেকে দেখা হয় বলেই সাধারণের সাথে এই পার্থক্য। একটা উদাহরণ দেয়া যায়, যা বোঝা সহজ – নভেম্বর মাসে বৃষ্টি হলেও বলা যায় যে এই বৃষ্টি স্থায়ী হবে না, কারণ এই ঋতুতে যে বৃষ্টি হয়না, সেই তথ্য জানা রয়েছে। আবার জুলাই মাসে বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টি যে চলতে পারে কয়েকদিন ধরে, সেটা মোটামুটিভাবে বলা যায়, কারণ তথ্যটা জানা যে এই ঋতুতে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। এই তথ্যই মানুষকে একটা বিশেষ দিক থেকে চিন্তা করায়। এই তথ্য না থাকলে তার আবহাওয়ার পূর্বাভাষ ঠিক হবে না। ভূরাজনীতিও সেরকমই। কিছু বিশেষ তথ্য একটা বিশেষ দিক থেকে মানুষকে চিন্তা করাবে। তাই সাধারণভাবে যেই equation মিলে না, সেটা তখন মোটামুটি সহজেই মিলে যাবে।

ভূরাজনীতির ভাষায় চিন্তা করলে আমরা দেখি যে, ভারত মূলত যেকারণে বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, তা হলো –

- বাংলাদেশ ভারতের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ভারতের সবচাইতে বড় ভয় হলো তার ভৌগোলিক অখন্ডতা থাকবে কি থাকবে না। বহু ভাষা, গোত্র, বর্ণ, ধর্ম এবং জাতীয়তার ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশ সর্বদা এই ক্ষেত্রে ভারতের integrity-কে “নিরবে” সন্মান করে গেছে। একবারের জন্যেও ভারতের অখন্ডতা নিয়ে বাংলাদেশ কোন “প্রকাশ্য বিবৃতি” দেয়নি। ভারতের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি এবং মানবাধিকার লংঘন নিয়ে বাংলাদেশ কোন উদ্বেগ জানায়নি কখনোই। বাংলাদেশ সাহায্য না করলে ভারতের পক্ষে তাদের অনেকগুলি প্রদেশ টিকিয়ে রাখা কঠিন হতো। এমনকি ভারতের সমস্যায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকলেও ভারতের বিপদ হয়ে যেত। আর একবার ভারতের একটা রাজ্য আলাদা হয়ে গেলে বা কোন ধর্মীয় বা বর্ণভিত্তিক কোন গোত্র বিদ্রোহ করে বসলে সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তো। অর্থাৎ ভারতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যেত। বাংলাদেশ কখনোই ভারতের অস্তিত্বের বিপক্ষে কাজ করেনি। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতের জন্যে সবচাইতে বড় উপহার। এর জন্যেই ভারত বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। বাংলাদেশের দয়ার উপরে বেঁচে আছে ভারত। এটাই হচ্ছে সেই “মিরাক্কেল”, যার কারণে এত শত বিভক্ত ভারত এখনো এক খন্ডে রয়েছে। আর ভারত সরকার আশা করবে যেন এই “মিরাক্কেল” কখনোই বন্ধ না হয়; বাংলাদেশের মানুষের এই দয়া যে শেষ না হয় কখনোই; তারা যেন দয়া করে যেতেই থাকে; যেতেই থাকে; যেতেই থাকে।

ভূরাজনীতির ভাষা এমনই। যেসব তথ্য এবং খবর উপরে বর্ণিত এই বিশেষ দিকটির কাছ দিয়ে যাবে, সেটা ভূরাজনীতির জন্যে খবর; যেগুলি ধারেকাছে থাকবে না, সেগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়।

পশ্চিমা ভূরাজনীবিদেরা আগামী কয়েক দশকের পূর্বাভাষ দিতে গিয়ে ভারতকে শক্তিশালী* দেশের তালিকায় রাখেননি। এর কারণ তারা মনে করেননা যে অভ্যন্তরীণভাবে এতটা দুর্বল একটি দেশ** সামনের দিনের বাস্তবতায় টিকে থাকতে পারবে। প্রতিবেশীদের subversion-এর মুখে পড়লে ভারতের যে টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, তা তারা বুঝতে পারছেন বলেই ভারতকে তারা সামনের দিনগুলিতে গোণায় ধরছেন না। এখন যেটা প্রশ্ন, তা হলো কি দেখে ভূরাজনীতিকেরা মনে করছেন যে ভারতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে? তারা যেই চশমাটা দিয়ে দেখছেন, তা তাদের দেখাচ্ছে যে ভারতের প্রতিবেশীরা তাদের দীর্ঘদিনের intellectual subjugation থেকে মুক্ত হবার দ্বারপ্রান্তে। ভারতের অস্তিত্বের “মিরাক্কেল”-এর আয়ু শেষ! আটলান্টিকের ওপাড়ের বড়ভাইও তাকে বাঁচাতে পারবে না। এটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

*পড়ুনঃ “শক্তিশালী ভারতের ভয়” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ০১ অক্টোবর ২০১৫
**পড়ুনঃ “চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ জুন ২০১৬


No comments:

Post a Comment