একটি সম্পূর্ণ অদরকারি সমঝোতা......
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের অতি আকাংক্ষিত পানির সমস্যা সমাধান না করেই দেশে ফেরত আসলেন। কাজেই এই সফরকে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ সফর বলা ছাড়া গতি থাকে না। ভারত তাঁকে ডেকে নিয়ে গেছে এমন সময়, যখন তিস্তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশের মানুষ শুধু পানির ব্যাপারেই একটি মিমাংসা চাইছিল। মূল আলোচ্য বিষয় পানিকে পাশে ঠেলে দিয়ে যখন নিরাপত্তা এবং সামরিক বিষয়ে একটি চুক্তির প্রস্তাব করা হলো, তখন সেই সফরের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। ভারত খুব ভালো করেই জানে যে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সাথে যে কোন ধরণের সামরিক সমঝোতার বিরুদ্ধতা করবে; কারণ একে তো মুসলিম বিশ্বাসের বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতের বিজেপি সরকারের মাঝে হিন্দুত্ববাদিতা দেখে, তার উপরে ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক কারণেও ভারতকে একমাত্র শত্রুদেশ হিসেবে চিন্তা করে। এমন একটি রাষ্ট্রের সাথে সামরিক সমঝোতা বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে ছোট করা হবে জেনেই ভারত এই সমঝোতায় বাংলাদেশকে চাপ দেয়।
তবে শুধু ভারতকে দোষারোপ করলেই তো হবে না। বাংলাদেশের তরফ থেকেই বা এই সমঝোতায় সই করা হলো কেন? বাংলাদেশ যখন সাবমেরিন ক্রয় করেছিল, তখন দিল্লীর নীতিনির্ধারকদের ঘর্মাক্ত শরীর জানান দিয়েছিল এমন এক বাংলাদেশের আবির্ভাবের, যা কিনা কারও দাসত্ব স্বীকার করবে না। কিন্তু এর পরবর্তীতে কি এমন ঘটে গেল যে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চীন থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে ব্যালান্স করতে গিয়ে আবার ভারতের সাথেই সামরিক সমঝোতায় বসতে হবে? চীন থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে যদি ব্যালান্স করতেই হয়, তাহলে ভারতকে দিয়ে সেই ব্যালান্স নয়, করতে হবে অন্য কাউকে দিয়ে; যাতে ভারতও ব্যালান্সে থাকে। ভারত যেসব দেশের সাথে সামরিক সমঝোতা করতে পারে, যেমন নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান – এরাও যখন ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে, তখন বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভারতের পক্ষ থেকে আসা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় সামরিক সমঝোতার প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে না পারাটা রাজনৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ। অন্তত তিস্তা চুক্তি না হবার কারণেও বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই ভারতের উপরে চাপ সৃষ্টি করে সামরিক সমঝোতা এড়ানো যেত।
ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে ইমব্যালান্স করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও পাকিস্তানের কাছ থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্যে একটি ক্ষমা প্রার্থনাও আসেনি; বরং সম্পর্ক আগের মতোই ঠান্ডা রয়ে গেছে। এই বিরোধ মিটমাট করাটাই কি সবচাইতে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল না, যা করতে পারলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ব্যালান্সটাই পরিবর্তিত হয়ে যেত। এরকম সমস্যা মিটমাট না করাটি কি ভারতের স্বার্থকেই সমুন্নত করেনি? ভারত কি নিশ্চিন্ত থাকছে না, যে বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের সাথে সে আলাদাভাবে সামরিক সংঘাতে যেতে পারবে, কারণ একজনকে আক্রমণ করলে অন্যজন ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে? বাংলাদেশের ইতিহাসেই ভারত-পাকিস্তানকে ব্যালান্স করার চমৎকার উদাহরণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে মুহুর্তে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করমর্দন করলেন এবং অনান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেন, তখন ভারতের পায়ের তলা থেকে মাটি সড়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক কূটনীতির এরূপ উদাহরণ থাকতে বাংলাদেশের চীনকে ব্যালান্স করার জন্যে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করাটা অত্যন্ত নিম্নমানের কূটনীতির পর্যায়ে পড়ে।
ভারত একটি শত্রু রাষ্ট্র
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী থাকার একমাত্র কারণ ভারত। বাংলাদেশের নেতৃবর্গকেও ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতীয় সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হবার স্থান শুধু পাকিস্তান বা চীনের সীমানা নয়; এখানে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুত্ববাদী ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কি মুচলেকা নেবে, যে ভারত তার মার্কিন-নির্মিত এপাচি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না? কোন গ্যারান্টিতে বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে যে ভারত তার পি-৮ বিমানকে বাংলাদেশের সদ্য ক্রয় করা সাবমেরিনকে খুঁজে বের করতে ব্যবহার করবে না? তাহলে বাংলাদেশই বা কেন ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করবে, যখন এটি একটি জানা ব্যাপার যে অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে এবং কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা সর্বদাই রয়েছে? ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করে বাংলাদেশ কি জানান দিলো না, যে এধরণের যেকোন আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে বাংলাদেশ ভারতের সাথেই থাকবে? আর এরকম সমঝোতার ফলাফল যদি হয় যে বাংলাদেশ তেমন কোন সংঘাতে ভারতের পাশেই থাকবে, তাহলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি ভারতের দ্বারা ঠিক করা হলো না? বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তখন কোথায় গেলো?
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর কার্যকলাপ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই যখন কথা বলেছেন, তখন কাউকে বলে দিতে হয় না যে ভারত বাংলাদেশের জন্যে একটি নিরাপত্তা সমস্যা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি করা একটি দেশের সাথে কোন ধরনের নিরাপত্তা সমঝোতা সম্ভব হতে পারে, সেটার বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা দেয়া কষ্টকর। সেই সমস্যা সৃষ্টিকারী দেশকেই আবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা দিতে হবে – সেটাই বা কোন ধরনের হীন চিন্তার ফসল? প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন যে, ‘আক্রান্ত হলে সমুচিত জবাব দেবার সক্ষমতা আমাদের আছে’, তখন তো তিনি নিশ্চয়ই ভারতকে বাদ দিয়ে বলেননি! তাহলে যার থেকে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে (সবচাইতে বেশিই রয়েছে), তার সাথেই আবার নিরাপত্তা সমঝোতায় যাওয়াটা কোন যুক্তিতে যুক্তিযুক্ত? যাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায় – এই যুক্তিতে? এটা কি মাথা নোয়াবার পর্যায়ে পড়ে যায় না? মুসলিম হিসেবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত করাটা এদেশের মানুষের বাস্তবতা হতে পারে না।
নিম্নমানের কূটনীতি এবং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্ব
পৃথিবীর সবচাইতে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব আনতে ভারতের নেতৃবর্গের লজ্জাবোধ হওয়া উচিত ছিল। জাতিসংঘের মিশনে ভারতের সৈন্য প্রেরণের পরে জাতিসংঘ বাজে মানের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে ভারতকে জরিমানা করে! আর সেই ভারত কোনরূপ লজ্জাবোধ তো দূরে থাকুক, বরং ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তির তোষণের মাঝেই তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। [১] কোন বুদ্ধিতে পানি চুক্তি না করে বরং একটি সম্পূর্ণ অদরকারি সামরিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করার জন্যে বাংলাদেশের উপরে চাপ দিয়ে তারা যেভাবে পুরো বাংলাদেশকে নিজেদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করলেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিত্বের প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ ছিল ভারতের এই কর্মকান্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ব্যর্থতার দায়ভার অনেকাংশেই ভারতের।
বাংলাদেশ শক্তিশালী হবেই। কিন্তু তাই বলে চীনকে ব্যালান্স করার নামে ভারতের সাথে সামরিক সমঝোতা করার মতো নিম্নমানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা? এধরণের সমঝোতা শক্তিশালী বাংলাদেশের পরিপন্থী, তাই এর বাস্তবায়নও বর্জনীয়। বিশেষ করে যে সমঝোতা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে এবং বিভাজনের রাজনীতিকে উস্কে দেয়, তা কোনদিনও জনকল্যানকর হতে পারে না। এই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে যাদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দিতে তাদের সাথেই নিরাপত্তা চুক্তি করাটা রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের লক্ষণ।
[১] 'যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বাড়ছে', সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬
'অতঃপর যুক্তরাষ্ট্রের ভারত জয়?', সাম্প্রতিক দেশকাল, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬
No comments:
Post a Comment