পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি হলেও ইথিওপিয়ার রয়েছে আফ্রিকার সবচাইতে বড় এয়ারলাইন্স। ১৯৪৬ সালে এই বিমান সংস্থার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল মার্কিনীরা। মার্কিনীদের চিন্তাই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সকে এগিয়ে নিয়েছে। ইথিওপিয়া দেশটির দিকে তাকালে বিশ্বাস করা কঠিন যে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স এই একই দেশের। রাষ্ট্র হিসেবে ইথিওপিয়া রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন ঘটনাই এই এয়ারলাইন্সকে প্রভাবিত করেনি, কারণ এই এয়ারলাইন্সের সাথে দেশটির সম্পর্ক ছিল নামমাত্র। |
আফ্রিকার দেশ ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সৈন্যরা রয়েছে; পার্শ্ববর্তী দেশ দক্ষিণ সুদানেও রয়েছে। এক বছর পর পর এই সেনারা দেশে ফেরত আসেন, আর তাদের স্থলে আরেকদল সেনারা যোগ দেন। এভাবেই চলে আসছে। বাংলাদেশের সেনারা যখন আফ্রিকায় যান, তখন খুব কম লোকই জিজ্ঞেস করেন যে কোন এয়ারলাইন্সে করে তারা সেখানে পৌঁছান। যেটা সাধারণত বলা হয়, তা হলো জাতিসংঘের চার্টার করা ফ্লাইটে তারা সেখানে পৌঁছান। তবে বলাই বাহুল্য যে সেই বিমানটি কোন না কোন এয়ারলাইন্সের, যা কিনা জাতিসংঘ ভাড়া করেছে। বাংলাদেশের মানুষ যখন হজ্জ্বে যান, তখনও ব্যাপারটা ওরকমই – অন্য এয়ারলাইন্সের ভাড়া করা বিমানে সকলকে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে গন্তব্যে। জিজ্ঞেস করা ছাড়াই সকলের অনুমেয় যে সেই এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশী সেনাদের আফ্রিকার পৌঁছাবার একটি মাধ্যম হলো ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স।
দরিদ্র দেশের মালিকানায় বৃহত্তম এয়ারলাইন্স
ইথিওপিয়া পৃথিবীর সবচাইতে দরিদ্র দেশগুলির একটি বলেই সকলের কাছে পরিচিত। দেশটিতে বারংবার দুর্ভিক্ষ দুনিয়ার মানুষের আর কিছু নাহোক, অন্ততঃ সহানুভূতি কুড়িয়েছে। ১০ কোটি মানুষের দেশটির জিডিপি ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের জিডিপি ২২০ বিলিয়ন পেরিয়ে গেছে। পূর্ব আফ্রিকার এই বিরাট, কিন্তু দরিদ্র দেশটি পরাশক্তিদের প্রক্সি যুদ্ধ করেই বেশিরভাগ সময় পার করেছে। কিন্তু এই দেশটির বিমান সংস্থা আফ্রিকার বৃহত্তম। এটিতে বর্তমানে রয়েছে ৮২টি বিমান; এর গন্তব্যের সংখ্যা হচ্ছে ১১৩, যার মাঝে ৯৫টি আন্তর্জাতিক (২০১৬)। কার্গো পরিবহণেরও ৩৫টি গন্তব্য রয়েছে। তুলনামূলকভবে দেখানো যায় যে, যাত্রী পরিবহণের ক্ষেত্রে – সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের রয়েছে ৫৪টি বিমান, যা কিনা ৪২টি গন্তব্যে যায়; ইজিপ্টএয়ারের (মিশর) ৪৭টি বিমান ৭৩টি গঞ্চব্যে যায়; রয়াল এয়ার মারোক (মরক্কো)-এর ৫৫টি বিমান ৯৪টি গন্তব্যে যায়; এয়ার আলজেরির (আলজেরিয়া) ৫৪টি বিমান ৬৯টি গন্তব্যে যায়; তিউনিসএয়ারের (তিউনিসিয়া) ৩৪টি বিমান ১০১টি গন্তব্যে যায়; কেনিয়া এয়ারওয়েজের ৪৫টি বিমান ৬২টি গন্তব্যে যায়; আর নাইজেরিয়ার আরিক এয়ারের ২৪টি বিমান ২৬টি গন্তব্যে যায়। অর্থনীতির আকারের হিসেব করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ আফ্রিকা (৩২৬ বিলিয়ন), মিশর (৩৩০ বিলিয়ন), মরক্কো (১০৩ বিলিয়ন), আলজেরিয়া (১৬৮ বিলিয়ন), তিউনিসিয়া (৪২ বিলিয়ন), নাইজেরিয়া (৪৮৫ বিলিয়ন), কেনিয়া (৬৯ বিলিয়ন) – এই দেশগুলির মাঝে ইথিওপিয়া খুব একটা উপরের দিকে থাকে না। জনসংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও ইথিওপিয়ার বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র হওয়ায় এয়ারলাইন্সের অগ্রগামিতার কারণ হিসেবে আকাশ ভ্রমণের সাথে সেটাকে খুব বেশি একটা যুক্ত করা যাচ্ছে না। তাহলে একটা কারণ তো থাকতে হবে যে কেন এই দেশটির এয়ারলাইন্স আফ্রিকার বৃহত্তম। সেই কারণটি খুঁজতে যেতে হবে বহুদিন আগে।
বিংশ শতকে ইথিওপিয়া - কর্তৃত্বের বদল
ইথিওপিয়া বেশিরভাগ সময়ের জন্যেই ইউরোপিয়দের অধীনে ছিল না। তবে ইউরোপিয়দের মদদ ছাড়া সকল কার্য সম্পাদনও করতে পারতো বলে গর্ব করা যায় না, কারণ পূর্ব আফ্রিকাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইতালির মাঝে বেশ বিরোধ ছিল। ১৯৩০ সালে ইথিওপিয়ার রাজা হন হাইলে সেলাসি। তার সময়েই ১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালির নেতা বেনিতো মুসোলিনি ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন; এবং অবশেষে দেশটি সামরিকভাবে দখলও করে নেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দেশটি যখন ইতালির অধীনে ছিল, সেসময় হাইলে সেলাসিকে রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজে করে জিব্রালটার পর্যন্ত নিয়ে সেখান থেকে সাধারণ ক্রুজ লাইনারে ব্রিটেনে নিয়ে যায় ব্রিটিশ সরকার, এবং ইথিওপিয়াকে মুক্ত করার জন্যে প্রচারণা চালাতে থাকে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ১৯৪১ সালে ব্রিটিশরা ইথিওপিয়াতে ইতালিয়ানদের পরাজিত করে। তবে ব্রিটিশদের হাত থেকে ইথিওপিয়াকে “মুক্ত” করে মার্কিনীরা। হাইলে সেলাসি দেশের বাইরে থাকার সময়েই তার দেশ ফিরে পাবার জন্যে মার্কিনীরা তাকে আইনী সহায়তা দিতে থাকে। জন এইচ স্পেন্সার নামের মার্কিন সরকারের এক প্রতিনিধি সেলাসির উপদেষ্টার কাজ করতে থাকেন। বিশ্বযুদ্ধের কিছু সময় স্পেন্সার মার্কিন নৌবাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করার পর আবারও ইথিওপিয়াতে ফেরত আসেন সেলাসির উপদেষ্টা হয়ে। এবার তার কাজগুলি হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইথিওপিয়ার “স্বাধীনতা” নিশ্চিত করেন, বা অন্য অর্থে ইথিওপিয়াকে ব্রিটিশ বলয় থেকে মার্কিন বলয়ে নিয়ে আসেন। ইথিওপিয়ার পূর্বের সোমালি মুসলিম-অধ্যুষিত ওগাদেন এলাকাকে স্পেন্সার ইথিওপিয়ার অন্তর্গত করার ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, নতুন তৈরি করা জাতিসংঘের মাধ্যমে এরিত্রিয়াকেও তিনি ইথিওপিয়ার অন্তর্গত করার ব্যবস্থা করেন। পড়ে অবশ্য ত্রিশ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এরিত্রিয়া আলাদা হয়ে যায় ইথিওপিয়া থেকে। এই স্পেন্সারই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের জন্মের ভিত গড়ে দেন। ইথিওপিয়াতে এমন কোন মানুষ ছিল না যে কিনা ইথিওপিয়ার মতো দরিদ্র একটি দেশের জন্যে একটি এয়ারলাইন্সের চিন্তা করতে পারতো।
ইথিওপিয়ান নাকি মার্কিন?
স্পেন্সারের তৈরি করা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের প্রথম ফ্লাইটটি ওড়ে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রথম ফ্লাইটটিই ছিল আন্তর্জাতিক। অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা ছিল, যা কিনা রাজনৈতিক সীমানা দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল না। এটা মার্কিনীদের কারণেই সম্ভব হয়েছিল, যারা নিজেরা রাজনৈতিক সীমানা মানার কথা কোনদিনও চিন্তা করেনি; বরং অন্যদের মানতে বাধ্য করেছে সর্বদা। এয়ারলাইন্সটির প্রথম বিমানগুলি ছিল মার্কিন সরকারের দেয়া Douglas C-47 Skytrain সামরিক পরিবহণ বিমান, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশি। বিমান তো পাওয়া গেল, কিন্তু বিমান চালাবে কে? এগুলি রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনাই বা কারা করবে? এটাও মার্কিনীরা বলে দিল – মার্কিন বিমান পরিবহণ সংস্থা Trans World Airlines (TWA) ম্যানেজমেন্টের দ্বায়িত্ব নিয়ে নিল। ১৯৪৬ থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ম্যানেজ করেছে TWA, যদিও এটির কাগজে-কলমে মালিকানা ছিল ইথিওপিয়ান সরকারের। ১৯৬৬ সালে এসে প্রথম একজন ইথিওপিয়ান ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। ১৯৭০ সালে এসে TWA ম্যানেজার থেকে উপদেষ্টা পদ নেয়। আর প্রতিষ্ঠার তিন দশক পর ’৭০-এর মাঝামাঝিতে এসে সংস্থাটি পুরোপুরি ইথিওপিয়দের দ্বারা চালিত হতে থাকে। ১৯৪৬ সাল থেকে ইথিওপিয়ান অনেক বিমান কিনেছে - Douglas C-47 Skytrain, Convair CV-240, Douglas DC-3, Douglas DC-6B, Lockheed L-749, Boeing 720B, Boeing 707-320C, Boeing 767-200ER, Boeing 757-200, Boeing 737-700 – যেগুলির সবই মার্কিন। ১৯৭৫ সালে (TWA থেকে আলাদা হবার পর) ইথিওপিয়ান প্রথম De Havilland Dash-7 বিমান কেনে, যা কিনা কানাডার তৈরি। ’৮০ এবং ‘৯০-এর দশকে কাছের রুটগুলির জন্যে ATR-42, Twin Otter, Fokker 50 কেনে, যেগুলি ইউরোপে তৈরি। বর্তমান সময়ে এসে Boeing 777-200LR, Boeing 787 Dreamliner, Airbus 350-900, Bombardier বিমানও কিনছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ মার্কিন বিমান-নির্মাতাদের মনোপলি সেখানে কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছে মার্কিন ম্যানেজমেন্ট চলে যাবার পর।
১৯৬৬ সালের এই ম্যাপে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের রুটগুলি দেখানো হচ্ছে। ঔপনিবেশিক সময়ে আকাশ পরিবহণে সুযোগগুলি খুঁজতে গিয়েই ইথিওপিয়ান এই রুটগুলি ডেভেলপ করেছিল। ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরের চাহিদা ছিল খুবই নগন্য। |
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের লক্ষ্য কি ইথিওপিয়ার লক্ষ্যের সাথে যায়?
ইথিওপিয়ান যেদিন থেকে ওড়া শুরু করে (১৯৪৬), সেদিন ইথিওপিয়ার আশেপাশের বেশিরভাগ দেশই ছিল উপনিবেশিক শাসনের অধীনে। তখন ফ্লাইট যেতো মিশরে (১৯৫৩ সালের সামরিক বিদ্রোহ পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনেই ছিল), জিবুতিতে (১৯৭৭ সালে ফরাসীদের কাছ থেকে আলাদা হলেও সেখানে এখনও ফরাসী সৈন্য রয়েছে), ইয়েমেনে (১৯১৮ সালে নামমাত্র স্বাধীন হলেও ১৮৩৯ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধীনেই ছিল), সৌদি আরবে (মূলতঃ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণেই ছিল), সুদানে (১৯৫৬ সালে ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হয়), কেনিয়ায় (১৯৬৩ সালে ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হয়)। এরপর ধীরে ধীরে গ্রীস, ইতালি, পাকিস্তান, ভারত, আরব আমিরাত, ইত্যাদি দেশে যাতায়াত শুরু করে। ইথিওপিয়ান উড়তে উড়তেই অনেক দেশের মানচিত্র পরিবর্তিত হয়ে গেছে; কিন্তু তাদের ওড়া বন্ধ হয়নি।
দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা কখনোই তাদের লক্ষ্য ছিল না; অর্থাৎ দেশের মানুষকে আকাশে ওড়ানোটা তাদের চিন্তায় কোনদিনও স্থান পায়নি। নিজ দেশ থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ছিল প্রায় পুরোপুরি আলাদা। দেশটি বহু বছর যুদ্ধবিগ্রহে কাটিয়েছে, কিন্তু এই এয়ারলাইন্সের কেউ এ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক রিপোর্টে বলা হয় যে ইথিওপিয়াতে ২০১৬ সালে সহিংসতার জের ধরে জরুরী অবস্থা জারি হলেও এয়ারলাইন্সের লোকেদের এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথাই ছিল না। ১৯৪৬ সালে জন এইচ স্পেন্সার-এর সময়েই এই এয়ারলাইন্সের ভিত্তি গড়ে দেয়া হয় – সেই ভিত্তির উপরেই এরা এখনও চলছে। এয়ারলাইন্সকে শুধু বের করতে হয়েছে যে কোথায় কোথায় প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে; সেখানেই তারা ফ্লাইট অপারেট করেছে – সেসব দেশে ইথিওপিয়ানরা ছিল কিনা সেব্যপারে মাথা ঘামায়নি। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স আসলে ইথিওপিয়ার জন্যে নয় – একারণেই এটি আফ্রিকার বৃহত্তম এয়ারলাইন্স। ইথিওপিয়া দেশটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে আফ্রিকার সবচাইতে বড় এয়ারলাইন্স তৈরি করার লক্ষ্য এই দেশের ছিল না কখনোই। অন্য কোন লক্ষ্য থেকে ইথিওপিয়ানের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল বলেই তারা সফল; নাহলে এই এয়ারলাইন্সকেও অফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলির দরিদ্র অর্থনীতির মতোই দরিদ্র দেখাতো।
বাংলাদেশ বিমানের জন্যে শেখার কি কি আছে?
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের কেইস স্টাডি শেষে প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্যে এখানে কি কি শিক্ষনীয় থাকতে পারে?
১। বিমান সংস্থাকে পাখা মেলতে হলে রাজনৈতিক সীমানাকে পার হতে পারার মতো মনমানসিকতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বিদেশে কখনো না কখনো গিয়েছে। বিশ্বের ১৬০টি দেশে কোটিখানেক বাংলাদেশী রয়েছে। ৫ থেকে ৭ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর বাইরে যাচ্ছে কাজের জন্যে; ফিরেও আসছে কয়েক লক্ষ। ১৯৬টি দেশে বাংলাদেশের পণ্য যায়; পণ্যের ব্যবসায়ে প্রতি নিয়তই দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে বহু মানুষকে। দেশের বাইরে থাকা মানুষগুলিই আবার বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্রেতা হচ্ছে। বিবিএস-এর জরিপ বলছে যে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ বাইরে যাচ্ছে ঘুরতে। এর মাঝে প্রতিবছর চিকিতসার জন্যে বাইরে যাচ্ছে কমপক্ষে আড়াই লক্ষ মানুষ। কাজেই রাজনৈতিক বাউন্ডারি পার করার মতো মানসিকতা তৈরির ভিত্তি কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। এই ভিতের উপরে বিল্ডিং তৈরির কাজটা বাংলাদেশ বিমানকেই করতে হবে।
২। অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহণের গুরুত্ব থাকলেও সেটা একটি বিমান সংস্থাকে বড় করার জন্যে যথেষ্ট নয়, যদি না দেশটি হয় এতো বড় যে দেশটির এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হলে উড়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই (যেমন – যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়ার মতো বিরাট দেশ; অথবা কঙ্গো, ইথিওপিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলির মতো দেশ, যেখানে নদী কম ও রাস্তা-রেলপথ তৈরি করা ভীষণ কষ্টসাধ্য)। বড় হতে হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে আন্তর্জাতিক আকশেই ফোকাস করতে হবে।
৩। কৌশলগত অবস্থানের কারণেই যে সাফল্য আসবে, তার কোন গ্যারান্টি নেই, যদিও অবস্থান একটি বড় এয়ারলাইন্স গঠনে সহায়তা করতে পারে। উগান্ডার এনতেবে শহর কৌশলগত দিক থেকে আফ্রিকার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। আফ্রিকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনগুলির সাথে যোগাযোগ রক্ষার মূল কেন্দ্র হলো এনতেবে। কিন্তু সেদেশের এয়ারলাইন্স বড় হয়নি। কেনিয়ার নাইরোবি, নাইজেরিয়ার লেগোস, তিউনিসিয়ার তিউনিস গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার কারণে মোটামুটি আকারের একেকটি এয়ারলাইন্সের জন্ম দিলেও সেগুলির কোনটিই ইথিওপিয়ানের মতো বড় হয়নি। আকাশপথে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হবে যদি বিমান গুরুত্বপূর্ণ হয়।
৪। রাষ্ট্রের বিমান সংস্থার সাথে রাষ্ট্রের সামর্থ্য, শক্তি ও সন্মানের প্রশ্ন জড়িত। অন্য রাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজে চড়ে বিদেশ ভ্রমণ ইথিওপিয়ার রাজার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু একুশ শতকে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরের টাইগার হতে যাচ্ছে যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন অন্য রাষ্ট্রের এয়ারলাইন্সে চড়বেন – এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনারা যখন অন্য দেশের এয়ারলাইন্সে চড়ে বিদেশে যায়, তখন সেটা রাষ্ট্রের অসহায়ত্বকেই তুলে ধরে। ২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হবার পর বাংলাদেশীদের উদ্ধার করতে গিয়ে ভারত সরকারের সরণাপন্ন হতে হয়েছিল। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ এবং অন্য দেশের এয়ারলাইন্সের সহায়তায় বাংলাদেশীদের উদ্ধার করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের সামর্থ্যকে তুলে ধরতেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে শক্তিশালী হতে হবে।
৫। রাষ্ট্রের লক্ষ্যই নির্ধারণ করবে সেই দেশের আকাশ পরিবহণ কেমন হবে। ইথিওপিয়ানের মতো অন্য কারও “উপদেশে” রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সের লক্ষ্য নির্ধারণ কোন অপশন হতে পারে না। সেটা করলে সেই এয়ারলাইন্স অন্য কোন রাষ্ট্রের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে। একুশ শতকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকলেও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি সেটা হতে দিতে চাইবে না। কাজেই অন্য রাষ্ট্রের “উপদেশে” বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স চলতে পারে না।
৬। রাষ্ট্রের বিমান সংস্থা একটি পরিবহণ সংস্থা মাত্র; এটি তা-ই পরিবহণ করবে, যা সেই রাষ্ট্র চায়। রাষ্ট্র না চাইবার কারণে আফ্রিকার বৃহত্তম এয়ারলাইন্সের মালিক হবার পরেও বিশ্বে ইথিওপিয়ার প্রভাব খুবই নগন্য। অন্যদিকে আরও বড় এয়ারলাইন্স থাকলে পুরো আফ্রিকা জুড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মিশর এবং আলজেরিয়ার মতো দেশের প্রভাব হয়তো আরও বেশি হতে পারতো। এখানেই রাষ্ট্রের লক্ষ্যের সাথে বিমানের লক্ষ্যকে সমান্তরালে আসতে হবে।
রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করাটা একটা মানসিক চ্যালেঞ্জ যেটা জাতিসত্ত্বা থেকেই উতসারিত। মার্কিন নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সকে জাতীয়তার সংকোচবোধ ধরতে পারেনি। কারণ মার্কিনীরা নিজেরা রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করতে গিয়ে জাতিসত্ত্বার বাঁধনে বাঁধা পড়েনি কোনদিনও; তবে তারা অন্য সকল রাষ্ট্রকে এই শৃংখলের মাঝে থাকতে বাধ্য করেছে সময়ে সময়ে।
যেদেশের কোটিখানেক মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেদেশের বিমান সংস্থার বিমানের সংখ্যা সর্বমোট এক ডজন – এটা বিশ্বাস করানোটা কঠিন। এদেশের নিজেদেরই কয়েক লাখ মানুষ প্রতি বছর আকাশপথে দেশের বাইরে যাচ্ছে এবং আসছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিমানের ভাড়া বাবদই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কমপক্ষে এক লক্ষ বাংলাদেশী আছে, এমন দেশ এখন অনেক। এখানে ব্যবসা নেই, বা লোকসানে পড়তে হবে – এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। লক্ষ্যহীন বিমান সংস্থা রাষ্ট্রকে কিছু দিতে সক্ষম নয়। একুশ শতকে শক্তিশালী অদম্য বাংলাদেশ গড়তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকেও অদম্য হতে হবে।
No comments:
Post a Comment