Tuesday 2 March 2021

ইরাক ও সিরিয়াতে মুখোমুখি হতে চলেছে তুরস্ক ও ইরান

২রা মার্চ ২০২১

সিরিয়া এবং ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রকে আলাদা করা যাবে না। অর্থাৎ এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক সদস্য ও সরঞ্জামের আনানেয়া চোখে পড়বে; সিনজার ফ্রন্টের যুদ্ধ আলেপ্পো ফ্রন্টকে সরাসরি প্রভাবিত করবে। এরূপ পরিস্থিতিতে কুর্দিস্তানের ‘কেডিপি’ সরকারের ভূমিকা ছাড়াও ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া আঞ্চলিক খেলোয়াড় ইস্রাইল এবং সৌদি আরবের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। 


গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আঙ্কারাতে ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ফারাজমানাদকে ডেকে নিয়ে ইরাকের অভ্যন্তরে তুরস্কের সামরিক অপারেশনের ব্যাপারে ইরানের কর্মকর্তাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। এর একদিন আগে ইরাকে ইরানের রাষ্ট্রদূত ইরাজ মাসজেদি কুর্দি সংবাদ সংস্থা ‘রুদাউ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইরাকে তুরস্কের সামরিক অপারেশন ইরাকের সার্বভৌমত্বকে আঘাত করছে। তিনি বলেন যে, ইরাকের অভ্যন্তরে তুরস্কের সামরিক অপারেশন বা উপস্থিতিকে ইরান প্রত্যাখ্যান করছে। ইরাকের অভ্যন্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ইরাকের সামরিক বাহিনী এবং কুর্দিস্তানের শক্তিগুলি। তুর্কি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, তুরস্ক বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি ‘পিকেকে’ গেরিলা সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যারা ইরাকের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। তুরস্ক ‘পিকেকে’ সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলে থাকে। ফারাজমানাদকে তুর্কি কর্মকর্তারা আরও বলেন যে, ইরানের উচিৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধকে সমর্থন দেয়া; বিরোধিতা করা নয়। ইরাকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ফাতিহ য়িলদিজ এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ইরানের রাষ্ট্রদূতের হওয়া উচিৎ শেষ ব্যক্তি, যিনি ইরাকের সীমানা মেনে চলার জন্যে তুরস্ককে লেকচার দেবেন। একইসাথে তেহরানে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠিয়ে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলুর বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ইরানের অভ্যন্তরে ‘পিকেকে’র ঘাঁটি রয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফাতিহ য়িলদিজের বক্তব্যকেও অযাচিত বলে আখ্যা দেয়। দুই দেশের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বাড়িয়েছে। 




উত্তর ইরাকে তুর্কি সামরিক অভিযান

২০২০এর জুনে তুরস্কের সামরিক বাহিনী উত্তর ইরাকের হাফতানিন এলাকায় ‘পিকেকে’র বিরুদ্ধে ‘ক্ল টাইগার অপারেশন’ চালায়। কয়েক’শ বার বিমান হামলা ছাড়াও সেই এলাকায় স্পেশাল ফোর্স মোতায়েন করেছে তুরস্ক। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ‘পিকেকে’ তাদের সামরিক কর্মকান্ড শুরু করে ১৯৮৪ সালে। তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ ‘পিকেকে’কে সন্ত্রাসী সংস্থা বলে আখ্যা দেয়। তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত এই সংঘাতে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছে। উত্তর ইরাকের কুর্দি এলাকায় ক্ষমতায় থাকা ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব কুর্দিস্তান’ বা ‘কেডিপি’ অত্র অঞ্চলে ‘পিকেকে’র উপস্থিতিকে পছন্দ করে না। তবে উত্তর ইরাকের সামরিক ঘাঁটিগুলি থেকে ‘পিকেকে’কে উৎখাত করতেও সক্ষম হয়নি তারা। ইরাকের অভ্যন্তরে তুরস্কের সামরিক অভিযান কয়েক দশক ধরে চলছে। ‘এরাব নিউজ’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাগদাদ সরকার ইরাকের ভূমি এবং আকাশসীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তবে তুরস্ক তার অপারেশন অব্যাহত রেখেছে। গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ইরাকের দোহুক রাজ্যের গারা পার্বত্য এলাকায় তুর্কি বাহিনী একটা ব্যর্থ অপারেশন চালায়। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল বহু বছর ধরে ‘পিকেকে’র হাতে আটককৃত ১৩ জন তুর্কি নাগরিককে উদ্ধার করা। এই ব্যর্থ অপারেশনে সকল বন্দী নিহত হবার পর তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, ‘পিকেকে’ কোথাও নিরাপদ থাকবে না; সেটা কানদিল হোক, বা সিনজার হোক বা সিরিয়াই হোক। এরদোগানের কথায় ইরানের নেতৃত্ব খুশি হতে পারেনি। কানদিল হলো পূর্ব ইরাকে ইরানের সীমান্তে অবস্থিত পাহাড়ি এলাকা, যেখানে ‘পিকেকে’র মূল ঘাঁটি। আর সিনজার হলো উত্তর ইরাকের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটা অঞ্চল, যেখানে নতুন করে তুর্কি সামরিক অভিযান শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে।

১৩ই ফেব্রুয়ারি কুর্দি মিডিয়া ‘রুদাউ’ বলে যে, উত্তর ইরাকে ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্স’ বা ‘পিএমএফ’ বা ‘হাশদ আল শাবি’ নামের মিলিশিয়া সিরিয়ার সীমানার কাছাকাছি সিনজার এলাকায় তিনটা ব্রিগেড মোতায়েন করেছে। ‘পিএমএফ’এর সামরিক নেতাদের বরাত দিয়ে ‘রুদাউ’ বলে যে, ২১তম, ৩৩তম এবং ১৪তম ব্রিগেড সিনজারের আশেপাশে মোতায়েন করা হয়েছে। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘সিনজার রেজিসট্যান্স ইউনিট’ বা ‘ওয়াইবিএস’ নামের একটা ইয়াজিদি গ্রুপের কয়েক’শ সদস্য। সিনজার এলাকাটা ২০১৪ সালের পর থেকে আইসিসএর অধীনে চলে গিয়েছিল। আইসিসের হাত থেকে ইয়াজিদিদের রক্ষা করার ছুতোয় ‘পিকেকে’ সিনজারে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে। তবে আইসিসের পরাজয়ের পর থেকে এখানে অনেক ধরনের সশস্ত্র গ্রুপ অপারেট করছে। সিনজার অঞ্চলে ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় এখান থেকে চলে যাওয়া অনেক মানুষ এখনও নিজেদের বাড়িঘরে ফেরত আসেনি। ১০ই ফেব্রুয়ারি কুর্দি এলাকার সরকারপ্রধান মাসরুর বারজানি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ‘সিনজার এগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী এই এলাকা থেকে অস্ত্রধারী অবৈধ গ্রুপগুলির চলে যাবার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তার সরকার সেই চুক্তির বাস্তবায়নের দাবি করে যাবে। বারজানি মূলতঃ ‘পিকেকে’ এবং ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলির অবস্থান নিয়েই তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তুর্কি পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ’এর বিলগায় দুমান বলছেন যে, সিনজার চুক্তিতে ‘বেয়াইনী সশস্ত্র গ্রুপ’ বলতে কাদেরকে বোঝানো হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ‘পিকেকে’র ব্যাপারে সকলেই একমত হলেও ইরান সমর্থিত ‘পিএমএফ’ বা ‘হাশদ আল শাবি’ সম্পর্কে সকলের মতামত এক নয়। তবে সিনজার অঞ্চলে ইরাকি সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই তুরস্ক অত্র অঞ্চলে নিজস্ব সামরিক উপস্থিতি রাখতে চাইছে। 



সিনজার যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ‘লফেয়ার ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ‘বস্টন ইউনিভার্সিটি’র শামিরান মাকো ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, সিনজার হলো কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা এলাকা। ইরাক থেকে সিরিয়াতে ঢোকার একটা পথ এটা। ইরাকি সরকার এবং কুর্দি আঞ্চলিক সরকার উভয়েই এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। ২০২০ সালের ৯ই অক্টোবর কুর্দি আঞ্চলিক সরকারের সাথে বাগদাদ সরকারের একটা সমঝোতা হয়। এলাকাটা ইরাকের মাঝে জাতিগতভাবে সবচাইতে বেশি বিভক্ত। ইয়াজিদি, এসিরিয়ান খ্রিস্টান, তুর্কি, কাকাই এবং শাবাক জাতির লোকেরা এখানে বসবাস করে। ইরাকের মোট খনিজ তেলের রিজার্ভের ২০ শতাংশ এই এলাকার কিরকুক, আরবিল এবং মোসুলে রয়েছে, যার পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ব্যারেল হতে পারে। শুধু কিরকুকেই রয়েছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের রিজার্ভ। বিলগায় দুমান বলছেন যে, অপরদিকে সিরিয়ায় ‘পিকেকে’ সমর্থিত মিলিশিয়া ‘ওয়াইপিজি’কে সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সিনজার অঞ্চল হলো সিরিয়াতে ‘ওয়াইপিজি’কে সহায়তা দেবার লজিস্টিকস কেন্দ্র।

২০১৬ সালে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইরাক এবং সিরিয়ার মাঝ দিয়ে ইরান একটা লজিস্টিক্যাল করিডোর তৈরি করছে, যার উদ্দেশ্য হবে ইরানকে স্থলপথে ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত করা। পরের বছর ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনেও একই কথা বলা হয়। করিডোরটা ইরানের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ইরাকের বাকুবাহ হয়ে উত্তর ইরাকের সিনজার হয়ে রাবিয়া সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে সিরিয়াতে ঢুকেছে। এই করিডোর সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার এবং লেবাননের হিযবুল্লাহর সাথে ইরানের স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। আর এই পথকে তৈরি করতে সহায়তা দিচ্ছে ইরাকের ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গ্রপগুলি। আর্টিলারি, রকেট এবং বুলডোজারের মতো ভারি অস্ত্রসস্ত্র বিমানে করে সিরিয়া পর্যন্ত নেয়া যথেষ্ট কঠিন বিধায় এই স্থলপথ তৈরি করা হচ্ছিলো। ২০১১ সালেই ইরান কুর্দিস্তানের মাঝ দিয়ে লজিস্টিক্যাল করিডোর তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ‘কেডিপি’র নেতৃবৃন্দ ইরানের এই প্রকল্পে সম্মতি দেয়নি। ২০১৪ সালে আইসিসের আবির্ভাবের কারণে ইরানের জন্যে নতুন সুযোগ তৈরি হয়। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র গত নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৭ সাল থেকে পশ্চিম ইরাকের সাথে সিরিয়ার সীমান্ত শহর আল বুকামাল ইরানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এটা এখন ইরানের জন্যে দ্বিতীয় লজিস্টিক্যাল করিডোর। এখানে ইউফ্রেতিস নদীর পূর্ব তীরের দখলে রয়েছে মার্কিন সমর্থিত কুর্দি গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’ বা ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস’; আর নদীর পশ্চিম তীরের দখলে রয়েছে সিরিয়ার বাশার বাহিনী এবং ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলি। তবে এই করিডোর ইরাকের সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাওয়ায় তা ইরানের জন্যে খুব একটা চিন্তামুক্ত নয়। অপরদিকে সিনজার হয়ে যাওয়া রাস্তাটা কুর্দিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রিত এলাকার ঠিক বাইরে দিয়ে যায়। বেশ ঘুরতি পথে হলেও সিনজারের রাস্তাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প দিচ্ছে ইরানকে। এই রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা; প্রধানতঃ ‘পিএমএফ’ বা ‘হাশদ আল শাবি’।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসিস’র এক প্রতিবেদনে ইরান থেকে ইরাক ও সিরিয়ার মাঝ দিয়ে যাওয়া স্থল করিডোরকে ইস্রাইলের জন্যে হুমকি হিসেবে দেখানো হয়। একইসাথে এটা আশংকা প্রকাশ করা হয় যে, উত্তর সিরিয়া বা ইরাকে তুর্কি সামরিক অভিযান হলে মার্কিন সমর্থিত ‘এসডিএফ’ বা ‘ওয়াইপিজি’ মিলশিয়ারা সিরিয়ার বাশার সরকার এবং ইরানের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। এজন্যেই সিরিয়া বা ইরাকে ‘পিকেকে’ বা ‘ওয়াইপিজি’র বিরুদ্ধে তুর্কি অভিযানের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়।

সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র

গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি তুরস্ক, ইরান এবং রাশিয়া সিরিয়ার ইদলিবে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে সমঝোতায় পৌঁছেছে। ২০২০ সালের মার্চে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মাঝে আস্তানা আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে রাশিয়া এবং তুরস্ক উভয়েই ইদলিবের কাছাকাছি নিজেদের অবস্থানগুলিকে নতুন করে সমন্বয় করছে। ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, রাশিয়া ২৪শে ফেব্রুয়ারি কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই কৌশলগত শহর সারাকিবের কাছ থেকে সেনা অবস্থান সরিয়ে নিয়েছে। গত বছর অক্টোবরে তুর্কি সেনাবাহিনীও ইদলিবে নিজেদের বেশকিছু সামরিক অবস্থান ছেড়ে দেয়। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন যে, এটা ইদলিবে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আভাস হতে পারে। এছাড়াও লিবিয়া এবং আজেরবাইজানে সামরিক সাফল্যের পর তুরস্ক সিরিয়াতে নতুন করে সামরিক সংঘাতে জড়াতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। তবে উত্তর ইরাকের সংঘাতই বলে দিচ্ছে যে, সিরিয়ার যুদ্ধকে ইরাক থেকে আলাদা করে দেখলে হবে না। কারণ একই আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা সিরিয়া এবং ইরাকে যুদ্ধরত।

তুরস্ক, ইস্রাইল এবং সৌদি আরব সকলেই জো বাইডেনের নতুন মার্কিন প্রশাসনের ইরান নীতি নিয়ে চিন্তিত রয়েছে। তেহরান থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ইরানের স্থল করিডোর এই তিন দেশই ভালো চোখে দেখছে না। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক এবং ইরানের মাঝে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে ককেশাসে নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধে তুরস্ক আজেরবাইজানের পক্ষ নেয় এবং ইরান সরাসরি ঘোষণা না দিলেও আর্মেনিয়ার পক্ষেই থাকে। এছাড়াও ইরানি নাগরিককে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক ইরানি কূটনীতিককে গ্রেপ্তার করে তুরস্ক। ইরান এই ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করলেও তুরস্কের সরকারি মিডিয়ায় খবরটা ফলাও করে ছাপা হয়। ‘ওয়াইপিজি’র ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের যদি সমঝোতা হয়ও, তথাপি ‘পিকেকে’র ব্যাপারে তুরস্কের নীতির পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা কম। উত্তর ইরাকে ‘পিকেকে’র বিরুদ্ধে তুর্কি সামরিক অভিযান শুরু হলে তা যে সিনজারের মাঝ দিয়ে যাওয়া ইরানের স্থল করিডোরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা নিশ্চিত। এতে সিরিয়ার বাশার সরকারকে সহায়তা দিতে গিয়ে ইরান বাধ্য হবে ইরাকের সুন্নি অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাওয়া করিডোরের উপর নির্ভরশীল হতে। কিন্তু একইসাথে উত্তর সিরিয়াতে ইদলিব বা আলেপ্পোর কাছাকাছি সিরিয় বাহিনীর সাথে তুর্কি বাহিনীর কোন সংঘাত শুরু হলে এই করিডোরগুলি চাপের মাঝে পড়বে। উত্তর সিরিয়া বা ইরাকে তুরস্কের সাথে সংঘাত ‘ওয়াইপিজি’ ও ‘পিকেকে’কে ইরানের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সিরিয়া এবং ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রকে আলাদা করা যাবে না। অর্থাৎ এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক সদস্য ও সরঞ্জামের আনানেয়া চোখে পড়বে; সিনজার ফ্রন্টের যুদ্ধ আলেপ্পো ফ্রন্টকে সরাসরি প্রভাবিত করবে। এরূপ পরিস্থিতিতে কুর্দিস্তানের ‘কেডিপি’ সরকারের ভূমিকা ছাড়াও ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া আঞ্চলিক খেলোয়াড় ইস্রাইল এবং সৌদি আরবের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ।

4 comments:

  1. তুরস্ক সৌদি ইস্ররাইল সবাই কেন বাইডেনের নীতি নিয়ে বিচলিত। বাইডেন কি ধরনের খেলা খেলতে চান। আমেরিকার চাওয়াটা কি

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই ব্লগের আগের লেখাগুলি পড়ে থাকলে জানবেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা আদর্শিক শক্তি; ব্রিটেনও তা-ই। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশই আদর্শকে বহণ করে। তাদের আদর্শ হলো সেকুলার পুঁজিবাদ। তবে তাদের মাঝ থেকে কেউ কেউ নেতৃত্ব দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটা আদর্শিক শক্তি তার সকল কর্মকান্ডই আদর্শকে কেন্দ্র করে সাজায়। উদ্দেশ্য ব্যাতীত সে কোনকিছু করে না।

      আদর্শিক রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো আদর্শকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া, বাস্তবায়ন করা এবং রক্ষা করা। রক্ষা করার অর্থ হলো বাইরের কোন শক্তি থেকে রক্ষা করা। একটা আদর্শের শত্রু হলো আরেকটা আদর্শ। একারণেই পশ্চিমা দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঠান্ডা যুদ্ধ চালিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে পশ্চিমাদের মূল শত্রু দাঁড়িয়েছে ইসলাম। তারা যেটা বুঝতে পেরেছে যে, ভবিষ্যতে ইসলাম পশ্চিমা সেকুলার পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। তাই তিন দশক ধরে তারা ইসলামের পুনরুত্থান ঠেকাতে ব্যস্ত। এই লক্ষ্যে তারা মুসলিমদের মাঝে বিভাজনকে জ্বালানি দেয়া এবং সেগুলিকে জিইয়ে রাখায় কাজ করে। শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে এরকমভাবেই তারা ব্যবহার করে। তারা আইসিস তৈরি করেছিল সেই উদ্দেশ্যেই।

      মার্কিনীদের মাঝে লিবারালরা তাদের আদর্শগুলিকে (গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সমকামিতা, ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠায় বেশি কাজ করে। ডেমোক্র্যাটরা বেশিরভাগই লিবারাল। তাই এদের সময়ে এই আদর্শগুলিকে নিয়ে বেশি কথা বলা হয়। কট্টরপন্থীরা যখন ক্ষমতায় আসে, তখন একপক্ষকে সমর্থন করা হয়; আর লিবারালরা ক্ষমতায় আসলে অন্য পক্ষকে সমর্থন করা হয়। এভাবে সকলেই ওয়াশিংটনের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। সকলেই তাদের নীতির উপরে নির্ভরশীল থাকে।

      Delete
  2. লিবারাল আর্দশ কি ধ্বংসের মুখে নয়

    ReplyDelete
    Replies
    1. মানুষের সমস্যার সমাধান না দিতে পারলে অথবা নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দিতে থাকলে একটা আদর্শ ধ্বংসের মুখে পড়তেই পারে। পশ্চিমা লিবারাল সেকুলাররা সেই সমস্যাতেই পড়েছে। সবচাইতে বড় উদাহরণ হলো করোনাভাইরাসের সমাধান হিসেবে 'লকডাউন'এর সমাধান। তবে এর বাইরেও হাজারো সমস্যা সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে; যেমন - আয় বৈষম্য, বর্ণবাদ, বেকারত্ব, হতাশা ও আত্মহত্যা, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা, সামাজিক অবিচার, নারী ও শিশুর উপর নির্যাতন, জাতিগত দ্বন্দ্ব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিইং, আত্মকেন্দ্রিকতা, ম্যাটেরিয়ালিজম, ইত্যাদি।

      Delete