Friday 29 January 2021

‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত দেয়

২৯শে জানুয়ারি ২০২১

 
‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর পরিস্থিতি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় আদর্শ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থই সকল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসাথে মানুষের জীবন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির উপর প্রভাবই জাতীয় সিদ্ধান্তের পিছনে মূল প্রেরণা।


করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে ব্রিটেন এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব এখন বেশ পরিষ্কার। ব্রিটিশ সুইডিশ কোম্পানি ‘এসট্রাজেনেকা’ বলছে যে, তারা ইইউএর কাছে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ২৬শে জানুয়ারি ইতালিয় পত্রিকা ‘লা রিপাবলিকা’র সাথে এক সাক্ষাতে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পাসকাল সোরিঅট বলেন যে, চুক্তি অনুযায়ী ‘সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা’ দেয়ার জন্যে কোম্পানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে; তবে নির্দিষ্ট তারিখের মাঝে সকল ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ইইউ ‘এসট্রাজেনেকা’র এই বক্তব্য মানতে নারাজ। ইইউএর স্বাস্থ্য কমিশনার স্টেলা কিরিয়াকিদেস ২৭শে জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন যে, কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানাগুলি ইইউএর সাথে করা চুক্তির অংশ। যেহেতু ব্রিটিশ কারখানাগুলির সরবরাহ ভালোমতো চলছে, তাই কোম্পানি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য। পরদিন এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন যে, ইইউ ‘এসট্রাজেনেকা’র চলমান অস্বচ্ছ সরবরাহ শিডিউলে ব্যাথিত। কিরিয়াকিদেস সাংবাদিকদের বলেন যে, কোম্পানি চুক্তিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, তা ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য। এর সপ্তাখানেক আগে কোম্পানি বলে যে, মার্চের মাঝে তারা তাদের প্রতিশ্রুত ৮ কোটি ভ্যাকসিনের মাঝে মাত্র ৩ কোটি ১০ লক্ষ সরবরাহ করতে পারবে। কারণ হিসেবে কোম্পানিটা বলছে যে, তাদের ইইউএর ভূমিতে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলি সরবরাহ দিতে হিমসিম খাচ্ছে। এছাড়াও কোম্পানির দু’টা কারখানা রয়েছে ব্রিটেনে। ইইউএর সাথে ‘এসট্রাজেনেকা’র দ্বন্দ্বের মাঝে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট অফিসের মন্ত্রী মাইকেল গোভ বলেন যে, ইইউএর সাথে ‘এসট্রাজেনেকা’র যে দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন, ব্রিটিশ জনগণের ভ্যাকসিন পেতে কোন সমস্যাই হবে না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, ব্রিটেনের কাছে ‘পূর্ণ নিশ্চয়তা’ রয়েছে যে, ব্রিটেন তার ভ্যাকসিন ঠিকমতোই পাবে। আর ব্রিটেনের ভ্যাকসিন প্রকল্প সম্পূর্ণ সফলতা পাবার পরই ইইউএর দেশগুলিকে সহায়তা দেবার কথা আসবে। তিনি আরও বলেন যে, ইউরোপিয়ান কমিশনের চাপ সত্ত্বেও ‘এসট্রাজেনেকা’ ব্রিটেনকে নিশ্চিত করেছে যে, তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখবে। ভ্যাকসিন নিয়ে ইইউ এবং ব্রিটিশ সরকারের পরস্পরবিরোধী কথাগুলি ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসছে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।

ইইউ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবং ভ্যাকসিন প্রকল্প বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইইউ তার প্রায় ৪৫ কোটি জনসংখ্যার জন্যে এখন পর্যন্ত মোট ২’শ ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন অর্ডার করেছে। এর মাঝে ‘এসট্রাজেনেকা’র কাছ থেকে অর্ডার করেছে ৪০ কোটি। ইইউ কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইইউএর কাছ থেকে কোম্পানি যে অর্থ পেয়েছে, তা দিয়েই কোম্পানির ব্রিটিশ কারখানার উন্নয়ন করা হয়েছে। ইইউএর সাথে চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, কোম্পানির মূল কারখানা ব্রিটেনে; বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের কারখানাগুলি দ্বিতীয় সারির। ‘এসট্রাজেনেকা’ ছাড়াও মার্কিন কোম্পানি ‘ফাইজার’ ও জার্মান কোম্পানি ‘বায়োএনটেক’এর জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে ইইউ অর্ডার করেছে ৬০ কোটি ডোজ; আর মার্কিন কোম্পানি ‘মডার্না’র কাছ থেকে অর্ডার করেছে ১৬ কোটি ডোজ। ‘ফাইজার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২০এর ডিসেম্বরের মাঝে তারা ১ কোটি ২৫ লক্ষ ডোজ সরবরাহ করবে। কোম্পানির বেলজিয়ান কারখানা সম্প্রসারণের কাজ চলায় তারা সিডিউলে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে রয়েছে বলে বলছে। এর ফলাফলস্বরূপ স্পেন সরকার ২৭শে জানুয়ারি ঘোষণা দেয় যে, ভ্যাকসিনের অভাবে মাদ্রিদ এলাকায় ভ্যাকসিন দেয়ার কর্মকান্ড দুই সপ্তাহের জন্যে স্থগিত করা হয়েছে। কাতালোনিয়াতেও ভ্যাকসিন কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতালি সরকার ইতোমধ্যেই ‘এসট্রাজেনেকা’র বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে। অপরদিকে জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেন্স স্পাহন ইউরোপিয়ান কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন যাতে ভ্যাকসিন কারখানাগুলি ইইউএর যে সদস্য রাষ্ট্রের সীমানার মাঝে অবস্থিত, তাদের সরকারের অনুমতি ব্যাতীত যেন ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে না পারে।

‘এসট্রাজেনেকা’ এবং ইইউএর দ্বন্দ্ব বলে দিচ্ছে যে, ভ্যাকসিনের কারখানা কোন দেশের জাতীয় সীমানার মাঝে রয়েছে, তা এখন যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব দেশের মাটিতে তো কারখানা নেই; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। ২৬শে জানুয়ারি ‘প্যান আফ্রিকানিস্ট’ সাংবাদিক সন্মেলনে ধনকুবের বিল গেটস বলেন যে, মহামারি থেকে উদ্ধার পেতে আরও অনেক ভ্যাকসিন কারখানা চালু করতে হবে এবং সব দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। গেটস বলেন যে, তিনি বিশ্বের ভ্যাকসিন কারখানাগুলিকে অর্থায়ন করছেন, যাতে করে ভ্যাকসিন ডেভেলপ করা বায়োটেকনলজি কোম্পানিগুলির ভ্যাকসিন অনেকগুলি কারখানায় তৈরি করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র ডেভেলপ করা ভ্যাকসিন তৈরি করছে ‘এসট্রাজেনেকা’; আর ‘এসট্রাজেনেকা’র সহায়তা নিয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে ভারতের ‘সিরাম ইন্সটিটিউট’। তবে গেটস বিশ্বের সকল স্থানে কারখানা তৈরিকেও আবার সমর্থন করছেন না। এক প্রশ্নের জবাবে গেটস বলেন যে, আফ্রিকায় একটা ভ্যাকসিন কারখানা করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে; কাজেই এটা বরং ভবিষ্যতের কোন মহামারির প্রস্তুতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশেগুলির বড় কারখানাগুলির উপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভ্যাকসিন কারখানার জন্যে ধনী দেশগুলির বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন।

‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স’এর গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী সব দেশে ভ্যাকসিন প্রকল্প চালু করা না গেলে বিশ্ব অর্থনীতি ৯ হাজার ২’শ বিলিয়ন বা ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার হারাবে। বিল গেটস বলছেন যে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব যেখানে ২৮ হাজার বিলিয়ন বা ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে, সেই তুলনায় ভ্যাকসিনের জন্যে নতুন কারখানার পিছনে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ কিছুই নয়। কিন্তু গেটসএর কথায় এটা পরিষ্কার যে, কেউই আসলে এই মুহুর্তে আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলে ভ্যাকসিন কারখানার কথা চিন্তা করছেন না। আর ‘এসট্রাজেনেকা’র কোন কারখানা কোন দেশের সীমানার মাঝে অবস্থিত, তা যখন ব্রিটেন এবং ইইউএর মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে, তখন আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভ্যাকসিন কারখানা তৈরি করাটা অবাস্তবই শোনাবে। ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’এর এই পরিস্থিতি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যাবস্থায় আদর্শ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থই সকল সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসাথে মানুষের জীবন নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির উপর প্রভাবই জাতীয় সিদ্ধান্তের পিছনে মূল প্রেরণা।

5 comments:

  1. পরিবতীত বিশ্বব্যবস্থা বলতে কি বোঝায় ও আগের বিশ্ব ব্যবস্থা কি ছিল

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিশ্ব ব্যবস্থা হলো কিছু নিয়মের সমষ্টি। এর মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দেয়া নিয়ম। এই নিয়মগুলি যাতে সকলে মেনে চলে, সেটা নিশ্চিত করে কিছু কর্তাব্যক্তি এবং সংস্থা, যাদের পিছনে থাকে রাষ্ট্রীয় শক্তি বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের স্থলাভিষিক্ত হয় এই শক্তি হিসেবে। এই শক্তি দুর্বল হতে থাকলে বিশ্ব ব্যবস্থাও হুমকির মাঝে পড়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল হবার সাথে সাথে সেটাই হচ্ছে।

      আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন -
      "মার্কিন দুনিয়ায় পরিবর্তনের হাওয়া",
      "যুক্তরাষ্ট্রের পর..." এবং
      "ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্প ২০২০"

      Delete
  2. বইগুলো কোথায় পাবো

    ReplyDelete
    Replies
    1. বইগুলি পাবেন -
      পাঠক সমাবেশ, শাহবাগ
      বাতিঘর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা মোটর
      রকমারি ডট কম
      Bookends, inside Unimart superstore (Gulshan-2 and Dhanmondi Shat Masjid Road)

      Delete