Wednesday 13 January 2021

রাশিয়া কেন মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে?

১৪ই জানুয়ারি ২০২১ 

রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার জন্যে কিছু প্রযুক্তি যোগাড় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যেগুলি মহাকাশে রাশিয়ার পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক স্যাটেলাইট রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া চাইছে মহাকাশে হুমকি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে। যুক্তরাষ্ট্র বহুবছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো এই সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট যখন চীন, তখন রাশিয়া তার দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে সবকিছুই করবে। 


গত ১৬ই ডিসেম্বর মার্কিন সামরিক বাহিনীর স্পেস কমান্ডের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, রাশিয়া মহাকাশকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করার দিকে এগুচ্ছে। রাশিয়া নতুন করে একটা স্যাটেলাইট ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এটা ২০২০ সালে রাশিয়ার এরকম তৃতীয় পরীক্ষা। স্পেস কমান্ড বলছে যে, এরকম ক্ষেপণাস্ত্র নিম্ন কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে সক্ষম। আর এরকম একটা স্যাটেলাইট ধ্বংস হলে এর ধ্বংসাবশেষ আশেপাশের স্যাটেলাইটের জন্যে হুমকি তৈরি করবে। মার্কিন স্পেস কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল জেমস ডিকিনসন এক বিবৃতিতে বলেন যে, রাশিয়া মুখে বলছে যে তারা মহাকাশে যুদ্ধ চায় না; কিন্তু তারপরেও তারা মহাকাশ এবং ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন সক্ষমতা তৈরি করছে, যা স্যাটেলাইটের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতাকে দুর্বলতা হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছে যে, রাশিয়া দুই ধরনের স্যাটেলাইট ধ্বংসী অস্ত্র ডেভেলপ করছে। এর একটা হলো ‘ডিরেক্ট এসেন্ট এন্টি স্যাটেলাইট’, যা মূলত ভূমি থেকে ছোঁড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র। আর দ্বিতীয়টা হলো ‘কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট’, যার মাধ্যমে মহাকাশে একটা স্যটেলাইট আরেকটা স্যটেলাইটের উপর হামলা করে। রাশিয়ার মহাকাশ ভিত্তিক এই পরীক্ষাগুলির উদ্দেশ্য বুঝতে হলে এই প্রকল্পগুলির বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

গত জুলাই মাসে মার্কিন স্পেস কমান্ড জানায় যে, রাশিয়া আরও একটা স্যাটেলাইট ধ্বংসী ব্যবস্থার পরীক্ষা চালিয়েছে। ‘কসমস ২৫৪৩’ নামের এই স্যাটেলাইট মহাকাশে গিয়ে আরেকটা বস্তুকে মহাকাশে ছেড়েছে। এর মাধ্যমে কোনকিছু ধ্বংস করা ছাড়াই রুশরা একটা ‘কো অরবিটাল এন্টি স্যাটেলাইট’ ব্যবস্থার পরীক্ষা চালালো। এর আগে এপ্রিল মাসে রাশিয়া ডিসেম্বরের মতোই একটা এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছিল। ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা বলে যে, দু’টা রুশ স্যটেলাইট মহাকাশে মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের উপর নজরদারি করছে। এর মাঝে একটা স্যাটেলাইট ছিল সেই ‘কসমস ২৫৪৩’, যা নিজের পেটের ভেতর থেকে আরেকটা স্যাটেলাইটের ‘জন্ম’ দেয়। রুশ স্যাটেলাইটগুলি মার্কিন স্যাটেলাইটের মাত্র ১’শ ৬০ কিঃমিঃএর মাঝে চলে আসে। মার্কিন জেনারেল জন রেইমন্ড ‘টাইম’ ম্যাগাজিনকে বলেন যে, রুশ স্যাটেলাইটের এহেন কর্মকান্ড খুবই অদ্ভুত এবং বিরক্তিকর। তিনি বলেন যে, মার্কিনীরা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে রুশদের কাছে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। রুশ কর্মকর্তারা রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’কে বলছেন যে, এই স্যাটেলাইট ছিল ইন্সপেক্টর স্যাটেলাইট, যার কাজ হলো অন্য রুশ স্যাটেলাইটের টেকনিক্যাল অবস্থা পরীক্ষা করা।

মহাকাশ গবেষক মাইকেল থম্পসন প্রথমবারের মতো রুশ স্যাটেলাইটের এই কর্মকান্ডকে অবলোকন করে টুইটারে পোস্ট দেন। তিনি বলেন যে, রুশ স্যটেলাইট মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ‘ইউএসএ ২৪৫’এর কাছাকাছি কক্ষপথে নিজের অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন স্যাটেলাইটটা হলো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল রেকনাইস্যান্স অফিস’এর ‘কেএইচ ১১’ স্যাটেলাইট। ‘কীহোল’ প্রকল্পের অধীন এই স্যাটেলাইটের কাজ হলো মহাকাশ থেকে ভূমির হাই রেজোলিউশন অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড ছবি তোলা। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’র ওয়েবসাইট বলছে যে, ২০১৩ সালে মহাকাশে পাঠানো এই স্যাটেলাইটের কর্মকান্ড গোপনীয়। ক্রিস পীটের ব্যবস্থাপনায় চলা স্যাটেলাইট মনিটরিং ওয়েবসাইট ‘হেভেন্স এবাভ’এর এক বিশ্লেষণে দেখানো হচ্ছে যে, মার্কিন স্যাটেলাইট ‘ইউএসএ ২৪৫’এর কক্ষপথ রাশিয়ার পূর্বদিকের শ্বেত সাগর থেকে শুরু করে কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলির উপর দিয়ে যায়। দিনে ১৫ বার এটা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক লেখায় রাশিয়া বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলছেন যে, রাশিয়া মহাকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ‘ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েনটিস্টস’এর হিসেবে মহাকাশে ২ হাজার ২’শর বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে, যার মাঝে ১ হাজারের বেশি মার্কিন। তন্মধ্যে ১’শ ৮৯টা সামরিক স্যাটেলাইট। রাশিয়ার ১’শ ৬০টা স্যাটেলাইটের মাঝে সামরিক স্যাটেলাইট ১’শটার মতো। চীনের ৩’শ ২০টা স্যাটেলাইটের মাঝে ১’শ ৫টা সামরিক। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের অর্থনীতি স্যাটেলাইটের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল; তবে রাশিয়া ততটা নয়। রাশিয়ার সামরিক স্যাটেলাইটগুলির মাঝে ৫১টাই যোগাযোগ স্যাটেলাইট; আর মাত্র ১৬টা হলো ভূমির ছবি তোলার স্যাটেলাইট। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে রয়েছে ৫৬টা ছবি তোলা স্যাটেলাইট, যোগাযোগ স্যাটেলাইট রয়েছে মাত্র ৪৯টা। চীনের ক্ষেত্রেও ছবি তোলার স্যাটেলাইট ৫৭টা হলেও যোগাযোগের স্যাটেলাইট মাত্র ৩টা। অর্থাৎ ছবি তোলার স্যাটেলাইট, যেগুলি মূলত ইন্টেলিজেন্সের জন্যে ব্যবহৃত হয়, সেখানেই রাশিয়া প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছে। লুজিন বলছেন যে, রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার জন্যে কিছু প্রযুক্তি যোগাড় করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, যেগুলি মহাকাশে রাশিয়ার পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক স্যাটেলাইট রাখাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া চাইছে মহাকাশে হুমকি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দরকষাকষি করতে। রাশিয়া জ্যামিং এবং এন্টি স্যাটেলাইটের মতো প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে চাইছে, যেগুলির উদ্দেশ্য হবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্ক ব্যবহারে বাধা প্রদান করা।

প্রতিপক্ষের শতশত স্যাটেলাইট টার্গেট করাটা একটা অর্থহীন কর্মকান্ড। ‘ইউনাইটেড নেশনস ইন্সটিটিউট ফর ডিজআর্মামেণ্ট রিসার্চ’এর সিরিয়র রিসার্চ ফেলো পাভেল পডভিগ এক সেমিনারে মত দিচ্ছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই এন্টি স্যাটেলাইট ব্যবস্থা ডেভেলপ করতে চেয়েছিল। কিন্তু উভয়েই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, এরূপ ব্যবস্থা ডেভেলপ করে ফলাফল পাওয়া কঠিন। কেননা প্রতিপক্ষ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এন্টি স্যাটেলাইটের সফলতাকে কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে। এরপরও উভয়েই এন্টি স্যাটেলাইটের প্রযুক্তি একেবারে ফেলে দেয়নি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘এসএম ৩’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একটা কক্ষপথচ্যুত স্যাটেলাইট ধ্বংস করেছিল। ২০২০ সালের এপ্রিলে রাশিয়ার পরীক্ষা করা ‘নুডল’ এন্টি স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রও এধরণেরই একটা অস্ত্র। তবে মহাকাশ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘সিকিউর ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’এর ডিরেক্টর ব্রায়ান উইডেন মনে করছেন যে, বিভিন্ন কারণে একটা দেশের পক্ষে নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবস্থাকে আঘাত সহ্য করার মতো করে তৈরি করাটা খুব সহজ হয় না। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুবছর ধরে চেষ্টা করেও তাদের স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। হয়তো এই সুযোগটাই রাশিয়া নিতে চাইছে। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল টার্গেট যখন চীন, তখন রাশিয়া তার দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাতে সবকিছুই করবে। 

No comments:

Post a Comment