Saturday 23 January 2021

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বন্দ্বের সমাধান বাইডেন প্রশাসনের হাতে নেই

২৩শে জানুয়ারি ২০২১

১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি ঔপনিবেশিক সময়ে কোরিয়দেরকে জোরপূর্বক কারখানায় কাজ করাবার ব্যাপারে আদালতের রায়ের পর জাপানি দূতাবাসের বাইরে কোরিয়দের বিক্ষোভ। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপান এবং কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। কিন্তু দুই দেশের দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সম্ভব নয়।


গত ৮ই জানুয়ারি জাপান সরকারের মন্ত্রীসভা দক্ষিণ কোরিয়াতে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কোয়িচি আইবোশিকে নিয়োগ দেয়। ‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তিনি ২০১৮ সাল থেকে ইস্রাইলে জাপানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আইবোশি এর আগে দু’বার কোরিয়াতে কূটনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি কোরিয়াতে জাপানি দূতাবাসের সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল থেকে তিনি সেখানে আবারও নিয়োগ পান রাজনীতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে। সেসময় কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোহ মুন হিউন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন তখনকার প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। জাপানি সরকার আইবোশির সেই অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইছে। তবে অনেকেই বলছেন যে, কোয়িচি আইবোশির কাজ খুব একটা সহজ হবে না। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জাপানের সাথে কোরিয়ার সম্পর্ক বেশ খারাপই যাচ্ছে। যেদিন আইবোশির নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেদিনই দক্ষিণ কোরিয়াতে জাপান বিরোধী আবেগ নতুন করে জেগে ওঠে। সিউলের জেলা আদালতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাদের যৌন সম্ভোগের জন্যে ব্যবহৃত ১২ জন মহিলার পক্ষে এক রায় দেয়া হয়। রায়ে জাপানি সরকারকে বেঁচে থাকা একেকজন মহিলাকে এবং মৃত মহিলাদের পরিবারকে ৯১ হাজার ডলার সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ২০১৩ সালে ‘কমফোর্ট উইমেন’ বলে পরিচিত এই মহিলারা জাপান সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে। আদালত বলে যে, জাপান রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দায় এড়াতে পারে না; এবং এটা মানবাধিকার বিরোধী। জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে শুগা এই মামলা বাতিল করে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন কোরিয়দের কাছে। শুগা বলেছিলেন যে, একটা স্বার্বভৌম রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের আদালতের রায় মানতে বাধ্য থাকতে পারে না। শুগা বলেন যে, জাপান এই রায় কোনভাবেই মানবে না; কারণ এটা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কোরিয় সরকার আদালতের রায়কে শ্রদ্ধা করে এবং অত্যাচারিত মহিলাদের সন্মান রক্ষার্থে সরকার সকলকিছু করবে। দুই দেশের পক্ষ হতে এই ইস্যুতে ভিন্নমত আসার কারণে এবং কোরিয়ার জনগণের কাছে এটা আবেগের ইস্যু হবার কারণে সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের সম্পর্কে উষ্ণতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আর একারণেই এ দ্বন্দ্বের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।

বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৫ সালে উভয় দেশ কোরিয়ার ‘কমফোর্ট উইমেন’দের ব্যাপারটা চিরতরে সমাধান করে বলে ঘোষণা দেয়। সেসময় তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ব্যক্তিগতভাবে এই মহিলাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাদের জন্যে জাপান সরকারের ৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবার ঘোষণা দেন। সেসময় কিছু মহিলার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করে বলা হয় যে, এই সিদ্ধান্ত তাদের সাথে কথা না বলেই নেয়া হয়েছে; এবং এতে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ব্যাহত হয়েছে। ২০১৭ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এব্যাপারে নতুন নীতিতে এগুলে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের অবণতি হয়। জাপান সরকার বলছে যে, ১৯৬৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী এই ইস্যু সমাধান হয়ে যায়। সেসময় কোরিয়াকে জাপান প্রায় ৩’শ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়; যার বর্তমান মূল্য প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। সেই অর্থ কোরিয়ার অর্থনীতি গড়ে তোলায় বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু মুন জে ইনএর সরকার বলে যে, সেই চুক্তিতে ব্যক্তিগত কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে কোরিয়ার ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতা ইউন মী হিয়াংএর বিরুদ্ধে ‘কমফোর্ট উইমেন’দের জন্যে জাপান থেকে আসা ফান্ড অন্য খাতে সরনোর অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও ২০১৮ সালে কোরিয়ার আদালতে কয়েকটা রায়ে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়াতে জাপানি ঔপনিবেশিক সময়ে কোরিয়ার জনগণকে জোরপূর্বক কারখানা এবং খনিতে কাজ করানোর জন্যে জাপানি কোম্পানিগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ২০১৯ সালে জাপান সরকার কোরিয়ার সাথে প্রযুক্তি সরবরাহে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেবার হুমকি দিলে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, দুই দেশ তাদের মাঝে স্বাক্ষরিত ইন্টেলিজেন্স আদানপ্রদানের চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মার্কিন হস্তক্ষেপে শেষ মুহুর্তে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটা দেশের আদালত আরেকটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। কিন্তু কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন বলছেন যে, আদালতের উপর তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র বিশ্লেষক লরেন রিচার্ডসন বলছেন যে, দুই দেশ এতটাই ভিন্নপথে চিন্তা করছে যে, এদেরকে কাছাকাছি আনাটা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানি কোম্পানিতে কোরিয়দের জোরপূর্বক কাজ করানোর ইস্যুটা দুই দেশের সম্পর্ককে বেশি পরীক্ষার মাঝে ফেলবে। কারণ কোরিয়ার আদালত জাপানি কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়ন করতে পারবে। জাপান সরকার জাপানি কোম্পানির বিরুদ্ধে কোরিয়ার ব্যবস্থা নেয়াকে ভালো চোখে দেখবে না। ‘কোবে ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর কান কিমুরা ‘জাপান টাইমস’কে বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসনের চোখে ভালো থাকার জন্যেই কোরিয়রা জাপানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হবে, যাতে উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখা যায়। অপরদিকে ‘ইউনিভার্সিটি অব শিজুওকা’র প্রফেসর সুসুমু কোহারি বলছেন যে, জাপানি প্রধানমন্ত্রী শুগা কোরিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ বাড়িয়ে কিছু করবেনা না। ২০১৫ সালের চুক্তি মান্য না করার কারণে শুগা কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনকে বিশ্বাস করেন না। তাছাড়া উভয় দেশের নেতারাই ছাড় দিয়ে নিজ দেশে ভোট ব্যাংক হারাতে চান না। ২০১৬ সালে ওবামা প্রশাসনের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন জো বাইডেন ‘দ্যা আটলান্টিক’এর সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন যে, দুই দেশের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাটা হলো ‘তালাকের আইনজীবী’র মতো। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপান এবং কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। কিন্তু দুই দেশের দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সম্ভব নয়।

No comments:

Post a Comment