Saturday 9 January 2021

সৌদি আরব এবং কাতারের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

০৯ই জানুয়ারি ২০২১

আল উলা, সৌদি আরব, জানুয়ারি ২০২১। বিমানবন্দরে কাতারের আমির আল থানিকে স্বাগত জানাচ্ছে সৌদি যুবরাজ বিন সালমান। বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারালেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর মার্কিন প্রভাব যে এখনও যথেষ্ট, তা কাতারের ইস্যু থেকে পরিষ্কার হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনপুষ্ট হয়েই সৌদিরা কাতারের উপর অবরোধ দিয়েছিল; আবার সেই একই প্রশাসন হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে আলোচনার পিছনে চাপ দিয়েছে।

গত ৭ই জানুয়ারি রাতে কাতারের রাজধানী দোহা থেকে ‘কাতার এয়ারওয়েজ’এর একটা ফ্লাইট সৌদি ভূখন্ডের উপর দিয়ে উড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ‘আল আরাবিয়া টিভি’ বলছে যে, সৌদি আরবের সাথে কাতারের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সাথে সাথে ২০১৭এর পর প্রথমবারের মতো কাতারের বিমান সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করে। এর আগে ৫ই জানুয়ারি সৌদি আরবের আল উলা শহরে ‘গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল’ বা ‘জিসিসি’র ৪১তম শীর্ষ বৈঠকে আরব দেশগুলি সর্বসম্মতিক্রমে কাতারের উপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান সাংবাদিকদের বলেন যে, সকলে মিলে নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব ভুলে যাবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে ইন্ধন দেবার অভিযোগে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশর কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দেশটার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্যে কাতারের কাছে সৌদি গ্রুপের মোট ১৩টা দাবি ছিল; যার মাঝে ছিল ‘আল জাজিরা’ টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া, কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা, ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা, এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে কাতারের সকল সম্পর্ক কর্তন। তবে সাড়ে তিন বছর পর দুই পক্ষের মাঝে মিলমিশ হয়ে যাবার কারণ কি? ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, উভয় পক্ষই এই দ্বন্দ্বকে চালিয়ে নেবার শক্তি হারিয়ে ফেলায় শান্তির পথ বেছে নিয়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।

‘জিসিসি’ বৈঠকে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’এর কথাগুলি কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। বিন সালমান তার বক্তব্যে বলেন যে, এই অঞ্চলের দেশগুলির একত্রিত হবার জন্যে একটা বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হবে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকল্পের হুমকি এবং স্যাবোটাজ ও ধ্বংসের পরিকল্পনা। ‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ২০১৭ সালে মার্কিন সরকার সৌদিদের পক্ষাবলম্বন করে এবং কাতারকে ‘সন্ত্রাসের অর্থায়নকারী’ হিসেবে আখ্যা দেয়; যদিও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি হলো কাতারের আল উদাইদ। ২০১৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের প্রচেষ্টায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কাতারের ভালো ভূমিকার কথা বলা হতে থাকে। ইরানকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত নীতির অংশ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন যখন উভয় পক্ষের উপর চাপ দিতে থাকে, তখনই আলোচনায় গতি আসে। ট্রাম্পের জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা ও জামাতা জ্যারেড কুশনার ডিসেম্বরে সৌদি আরব এবং কাতার সফর করেন। আল উলার বৈঠকেও তিনি ছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়।

‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি তেলের খনিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর থেকে সৌদিরা কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে মনোযোগী হয়। সৌদি এবং মার্কিনীরা হামলার জন্যে ইরানকে দায়ি করেছিল। সেবছরের অক্টোবরে সৌদি আরব সফরের পর ডিসেম্বরে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুররহিম আল থানি ‘সিএনএন’কে বলেন যে, সৌদিদের সাথে আলোচনার পর অন্ততঃ বন্ধ হয়ে যাওয়া কথাবার্তার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তবে কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখার কথা অস্বীকার করে এবং কাতারে তুর্কি ঘাঁটি বন্ধ করার ব্যাপারে অপারগতা জানায়। কাতারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, কাতারের খারাপ সময়ে যেসব দেশ সহায়তা দিয়েছে, তাদেরকে কাতার পিঠ দেখাবে না। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, সেই আলোচনাতেই সৌদিরা ‘আল জাজিরা’ বন্ধ করা এবং তুরস্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে নমনীয়তা দেখিয়েছিল। আর এই আলোচনার পিছনে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল, তা জানা যায় হোয়াইট হাউজের বিবৃতি থেকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে ফোনে বলেন যে, দুই দেশের মাঝে আলোচনা চলমান থাকলে তা উপসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যা নিরসণে ভূমিকা রাখবে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, কাতার হয়তো অত সহজে সৌদি গ্রুপের অবরোধের কথা ভুলে যাবে না। অপরদিকে আরব আমিরাত এখনও কাতারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না; বিশেষ করে ফিলিস্তিন এবং লিবিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে কাতারের সম্পর্ককে আমিরাত তার রাজতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে। নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে ২৭ লক্ষ জনগণের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তুরস্ক ও ইরানের সাথে কাতার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে। ‘জিসিসি’র দু’টা সদস্য দেশ কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, যারা হলো কুয়েত এবং ওমান। এর মাঝে কুয়েতই আলোচনার মধ্যস্ততাকারী ছিল।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব হারালেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর মার্কিন প্রভাব যে এখনও যথেষ্ট, তা কাতারের ইস্যু থেকে পরিষ্কার হয়। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থনপুষ্ট হয়েই সৌদিরা কাতারের উপর অবরোধ দিয়েছিল; আবার সেই একই প্রশাসন হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে আলোচনার পিছনে চাপ দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সৌদিদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও আসন্ন ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের আদর্শিক নীতির সাথে সৌদি সরকারের সম্ভাব্য বিরোধ আলোচনায় আসছে নিয়মিত। বিশেষ করে ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতি কি হবে, তা নিয়ে সৌদিরা চিন্তিত। মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’ বলছে যে, কাতারের সাথে সৌদি গ্রুপের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পিছনে মূল উদ্দেশ্য হলো বাইডেন প্রশাসনের ভালো নজরে আসা। তবে সৌদিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিষয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে, যেগুলি থেকে সৌদিদের পক্ষে বেরিয়া আসা কঠিন। কাতারের উপর সৌদি অবরোধ পারস্য উপসাগরে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির সুযোগ করে দেয়া ছাড়াও কাতারকে নতুন একটা সামরিক বাহিনী তৈরির অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে; যা গড়ে তুলতে তুরস্কের ভূমিকাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদিরা তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে; তুরস্কও সৌদি গ্রুপের পথ অনুসরণ করে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় নিজস্ব জাতীয় অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জোটের সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও স্বল্প মেয়াদে এগুলি আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিকে প্রভাবিত করবে।

No comments:

Post a Comment