Sunday 17 January 2021

ভূরাজনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব কতটুকু?

১৭ই জানুয়ারি ২০২১


করোনা মহামারির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ৯ কোটি ৫০ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে; যার মাঝে ২০ লক্ষ ৩২ হাজার ৭’শ ৫০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র ১৫ই জানুয়ারি এক দিনেই মৃত্যুবরণ করেছে ১৪ হাজার ৯’শ ১৩ জন। এর তুলনায় গত এপ্রিলের ১৭ তারিখে মৃতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৫’শ ২৭ জন। অর্থাৎ প্রথম ঢেউএর তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউএ মৃতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত জুলাই মাসে এই সংখ্যা বেশ বাড়লেও তা ২২শে জুলাইএর ৭ হাজার ৩’শ ২৬ জনের বেশি ছিল না। সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; ৪ লক্ষ ৫ হাজার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্রাজিলে; ২ লক্ষ ৯ হাজার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ভারতে; ১ লক্ষ ৫২ হাজার। চতুর্থ সর্বোচ্চ মেক্সিকোতে; ১ লক্ষ ৪০ হাজার। এরপর রয়েছে ব্রিটেন ৮৮ হাজার; ইতালি ৮২ হাজার; ফ্রান্স ৭০ হাজার; রাশিয়া ৬৫ হাজার; ইরান ৫৭ হাজার; স্পেন ৫৩ হাজার; কলম্বিয়া ৪৮ হাজার; জার্মানি ৪৭ হাজার; আর্জেন্টিনা ৪৫ হাজার; পেরু ৩৯ হাজার; দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৭ হাজার; পোল্যান্ড ৩৩ হাজার। প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যার মাঝে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে বেলজিয়ামে; ১’শ ৭৫ জন মানুষের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্লোভেনিয়া ১’শ ৫৩ জন; ইতালি ১’শ ৩৫ জন। জনসংখ্যার বিচারে মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপে সবচাইতে বেশি। প্রথম ১০টা দেশের সবগুলিই ইউরোপের। ১১তম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও ১৫তম স্থানে পেরু, ১৮তম স্থানে পানামা এবং ১৯তম স্থানে মেক্সিকো ছাড়া প্রথম ২০টা দেশের ১৬টাই ইউরোপের। বলাই বাহুল্য যে, ইউরোপ এবং আমেরিকা করোনা মহামারিতে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

করোনা মহামারির প্রভাব সারা বিশ্বের উপর পরলেও সকল ক্ষেত্রে এর প্রভাব এক নয়। ভূরাজনীতিতে মহামারির প্রভাব হিসেব করতে গেলে ইউরোপ এবং আমেরিকার কথাই আসবে শুরুতে। একইসাথে সেই অঞ্চলগুলিতে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের কথাগুলি আসবে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। তবে করোনার সরাসরি প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধ্বস নামায় বিশ্বের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলির কথাও চলে আসবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনকে নিয়ে থাকবে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে সবচাইতে বড় সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়েও কথা হবে। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার নিম্নগামিতাকে করোনাভাইরাস আরও দ্রুতগামী করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুর্বলতার সময়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলি ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থানগুলি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এতে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও প্রবল হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার অনেকটাই মহামারির আগে থেকেই চললেও এর উপর মহামারির প্রভাব উল্লেখ করার মতো।

মহামারির মাঝেও চলেছে লিবিয়ার যুদ্ধ; যেখানে তুরস্ক হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে। নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে চলেছে যুদ্ধ; সেখানেও তুরস্ক হস্তক্ষেপ করেছে। হিমালয়ের পাদদেশে ভারত এবং চীনের মাঝে হয়েছে সংঘর্ষ; যদিও তা পুরোদস্তর সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়নি। ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র ইথিওপিয়াতে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি গ্রুপের দেশগুলিও তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে। এই ঘটনাগুলির উপর মহামারির সরাসরি প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষ প্রভাব কিছুটা হলেও ছিল।

পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এন্ড সাসটেইনেবাল ডেভেলপমেন্ট’এর এক লেখায় বলছেন যে, মহামারির সমাধান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাছে চাওয়া হলেও তারা সেই মুহুর্তে কোন প্রতিষেধক বা ঔষধ দিতে সক্ষম হয়নি। তদুপরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন ভেন্টিলেটর, মাস্ক এবং টেস্টিং কিটের মতো জিনিসগুলি চাওয়া শুরু করলো, তখন তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক ব্যবস্থাকেও চাপের মাঝে ফেলে দিলো। আর পুরো ব্যাপারটার দায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও চাপের মাঝে পড়ে গেলো। মহামারি মারাত্মক আকার ধারণ করায় তখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে আসা সামাজিক সমাধানকেই বেছে নেয়া হলো; যেটাকে বলা হলো লকডাউন। কিন্তু এর ফলে অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো। অর্থাৎ এই মুহুর্তে সহজলভ্য মেডিক্যাল সমাধান অর্থনৈতিক ধ্বস ডেকে আনছে। তবে জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, অর্থনীতি স্থবির করে ফেলার ফলাফল হলো দীর্ঘমেয়াদে পুরো অর্থনীতিকেই ধ্বংস করে ফেলা। কাজেই মেডিক্যাল সমাধানের চাপ সহ্য করার জন্যে স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে দেয়া হলো অর্থনৈতিক প্রণোদনা। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, অর্থনীতি স্থবির করে দিয়ে লকডাউনের সমাধান কোন টেকসই সমাধান নয়। জনগণকে ঘরের মাঝে আটকে থাকতে বাধ্য করলে অর্থনৈতিক, পারিবারিক, মনস্তাত্বিক এবং সামাজিক চাপে পড়ে একসময় তারা নিয়ম ভেঙ্গে বের হয়ে আসবেই। জোরপূর্বক লকডাউন বাস্তবায়নের ফলাফল হবে ভয়াবহ সামাজিক অসন্তোষ। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি ছাড়াও সামাজিক সংস্থাগুলির উপর মানুষের আস্থা বিলুপ্ত হবে। মানুষের কাছে মনে হতে থাকবে যে, এর কোন সমাধান কেউ দিতে পারেনি।

‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব শুধু ব্যাপকই ছিল না, এটা হবে সুদূরপ্রসারী। আর চীনে যখন রোগের প্রদুর্ভাব শুরু হয়, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে, ‘লকডাউন’এর মতো একটা সমাধানের পথে এগুলে রোগের সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো যে, লকডাউন পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে মোটামুটি কাজ করলেও ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে তেমন সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ব্রাজিল মিলেই গোটা বিশ্বের মোট সংক্রমণের এক তৃতীয়াংশ হয়ে গিয়েছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক বিশ্লেষণে করোনা পরবর্তী বিশ্বের একটা মলিন ছবি আঁকা হয়। সেখানে লেখা হয় যে, মার্কিন নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে। এই বিশ্বব্যবস্থার মাঝে রয়েছে লিবারাল গণতান্ত্রিক ভাবধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইনের শাসন, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলির মদদে গড়ে ওঠা কতগুলি আন্তর্জাতিক সংস্থা। পশ্চিমা দেশগুলির অর্থনীতি সমস্যায় পতিত হবার সাথেসাথে চীনের উত্থান হচ্ছে। এবং একইসাথে বৈশ্বিক মহামন্দার মাঝে একেকটা দেশ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিতে তৈরি করা সংস্থাগুলি নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকাতে সক্ষম হয়নি। আটলান্টিকের দুই পাড়ের দেশগুলি নিজেকে বাঁচাতে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। বিশ্বে আইনের শাসন, চিন্তার স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই সেরকম পদক্ষেপ নেবার সক্ষমতা রাখে? অন্ততঃ ২০২০এর নভেম্বরে চরম বিরোধপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এক বিভক্ত রাষ্ট্রকে মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র সেই সক্ষমতা কতটুকু দেখাতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

 

অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সামাজিক অসন্তোষ

অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগেই বিশ্ব অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, জিডিপির নিম্নগামিতা, ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের ব্যাপক বৃদ্ধি, এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপক পার্থক্য, ইত্যাদি সমস্যা বিশ্বে সামাজিক অসন্তোষ তৈরি করার ক্ষেত্র তৈরি করেই রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর পর যে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল, তার ভিতও ছিল মূলতঃ অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং মহামারির মাঝে ব্যাপক বেকারত্বের করাল গ্রাসের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই বিক্ষোভ এবং সহিংসতার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যেগুলির ফলাফল অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে; আর একনায়কোচিত দেশগুলিতে সরকারগুলি হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিবাদী জনগণের উপর আরও বেশি করে চড়াও হবে।

তুরস্কের আনতালিয়া বিলিম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর তারিক ওগুজলু ‘ডেইলি সাবাহ’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বহুগুণে বেড়ে যাবার কারণেই মূলতঃ করোনাভাইরাস সারা দুনিয়াতে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণে চীনের অর্থনীতি স্থবির হবার সাথে সাথেই চীনের সাপ্লাই চেইনের উপর নির্ভরশীল দেশগুলিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা

‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বিশ্বায়নের বিরুদ্ধাচরণ করে জাতীয়তাবাদের উত্থান মহামারির আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের একে অপরকে দোষারোপ করে দ্বন্দ্বে জড়ানোটা করোনার কারণে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। তবে প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, ২০০৮ সালে বৈশ্বিক মন্দার পরপর যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজের অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করাতে এবং বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ জড়িয়ে ব্যস্ত ছিল, সেই সুযোগে চীন শূণ্যস্থান পূরণে মনোযোগী হয়েছিল। ঠিক একইভাবে করোনা মহামারির মাঝে পশ্চিমা শক্তিরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সেসময় চীনারা দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে নিতে চাইছে। এর সমান্তরালে হংকংএর আন্দোলনকারীদের যখন চীনা সরকার জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, তখন পশ্চিমা দেশগুলি আন্দোলনকারীদের পক্ষাবলম্বণ করে চীনের সাথে দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করছে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন কোম্পানিগুলি চীন ছাড়তে শুরু করেছে এবং ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমছে। তবে হংকংএর আন্দোলন চীনের উইঘুর এবং তিব্বতের মতো অঞ্চলগুলিতে যেনো ছড়িয়ে না পড়ে, সেব্যাপারে চীনা সরকার যথেষ্ট সাবধান থাকতে চাইবে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, করোনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের প্রযুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। চীনারা করোনা নিয়ন্ত্রণে ‘বিগ ডাটা’, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’, ‘ফেশিয়াল রেকগনিশন’ এবং ড্রোনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীনকে প্রযুক্তিতেই শুধু এগিয়ে নেবে না, নিজ জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরও বৃদ্ধি করবে। চীনারা ‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্পের অধীনে অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকার উদ্দেশ্যে আরও বিনিয়োগ করবে। আর উল্টোদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি চীনের উপর প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা কমাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে থাকবে। তবে মার্কিনীরা চীন থেকে তাদের শিল্পগুলিকে সরিয়ে নেবার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করছে, তা বাস্তবায়ন করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুব সহজ হবে না। আর চীনের বড় বাজার হারিয়ে কোন কোম্পানিই নিজেদের আয় কমাতে চাইবে না।

তারিক ওগুজলু বলছেন যে, মহামারির কারণে ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা বিশ্বায়ন হয়তো কিছুটা স্থবির হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার কারণে চীন আঞ্চলিকভাবে নিজস্ব একটা ‘বিশ্বায়ন’এর দিকে এগুবে। সাপ্লাই চেইনের মাঝে নিজেদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ না হলে কঠিন সময়ে তা কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দেখেছে। সেই হিসেবেই তারা চাইবে পারস্পরিক একটা নির্ভরশীলতা তৈরি করতে, যাতে ভবিষ্যতে আবারও বিপদে পড়তে না হয়। চীনের আশেপাশের দেশগুলি চীনের আগ্রাসী তৎপরতাতে ভীত হলেও এটা তারা বুঝতে পারছে যে, মহামারির পর অর্থনৈতিকে পুনরায় জাগাতে চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউএর উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করাটা মোটেই সমীচিন নয়। বৈশ্বিকভাবে চীনা এবং মার্কিনী মডেলের প্রতিযোগিতা হবে। স্বাস্থ্য, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন, ইত্যাদি বিষয়ে এই প্রতিযোগিতা হবে। উভয় দেশই নিজেদের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করতে চাইবে। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ আলোচনায় আসতেই থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘মার্শাল প্ল্যান’এর মতো কোন পরিকল্পনা নিয়ে আসতে না পারে, তাহলে চীনকে সরিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কষ্টকরই হবে।

এশিয়ায় ব্রিটেনের প্রত্যাবর্তন

করোনা মহামারির মাঝে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাবার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকেনি। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিতে এবং একইসাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ব্রিটেন ইইউএর গন্ডি থেকে বের হয়ে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে। ব্রিটেনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেন ইন্দোপ্যাসিফিককে আরও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ইন্দোপ্যাসিফিকের জন্যে নতুন একজন ডিরেক্টর জেনারেল নিয়োগ দিচ্ছে। একইসাথে ব্রিটেন তার ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলকে একটা ‘ফ্রেমওয়ার্ক’এর মাঝে সাজাচ্ছে। এশিয়াতে সামরিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্যে ব্রিটিশ সরকার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করেছে। এই সামরিক অবস্থানের মূল কেন্দ্রবিন্দু ভারত মহাসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য হলেও তা দক্ষিণ চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে দ্বন্দ্ব এবং তেলের বাজারে অস্থিরতা

‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ঘোষণা করার ঠিক আগে আগেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কুদস ফোর্সের জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করে। এছাড়াও লেবানন এবং ইরাকের রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে রেখেছিলো আরও আগ থেকেই। শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং নিম্নগামী অর্থনীতি মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিলো। এছাড়াও সিরিয়া, ইয়েমেন এবং লিবিয়ার যুদ্ধও চলমান ছিলো। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ইরানের সাথে সৌদি আরব এবং তুরস্কের সাথে আমিরাতের দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছিল। ইরান এবং তুরস্ক উভয়েই আঞ্চলিকভাবে তাদের প্রভাব বিস্তারে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে একইসাথে তেলের বাজারে দরপতনের কারণে তেল রপ্তানির উপর নির্ভরশীল ধনী দেশগুলির অর্থনীতি যেমন ধাক্কা খেয়েছে, তেমনি এই দেশগুলিতে মানবসম্পদ রপ্তানির উপর নির্ভরশীল দেশগুলিও সমস্যায় পতিত হয়েছে। আর অর্থনৈতিক দৈন্যতা ও অব্যাবস্থাপনার ফলশ্রুতিতে শাসকশ্রেণীর উপর জনগণের আক্রোশ বেড়েই চলেছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব পুরো অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, করোনা মহামারি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ এবং ভাইরাসের চাপে পড়ে ইরান হয়তো আঞ্চলিকভাবে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এতে সৌদি গ্রুপের দেশগুলির সাথে যেমন ইরানের সংঘাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে, একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইলও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।

‘ইউনিভার্সিটি অব ডেনভার’এর এর প্রফেসর হায়দার খান ‘আল জাজিরা’তে এক লেখায় বলছেন যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ব্যাপক দরপতনের সময় রাশিয়া নিজেকে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে বেশ কিছুটা বহুমুখীকরণ করে নিয়েছে। তেলের মূল্য কমে যাবার কারণে আমদানিকারক হিসেবে চীন বেশ লাভবান হয়েছে। অপরদিকে করোনার কারণে স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণে তেলের বাজার নিয়ে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামিতা গতিশীল হতে পারে এবং চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা ঢুকে পড়তে পারে। চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্তগুলি সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাড়িতে দিতে পারে।

 

উদ্দেশ্যবিহীন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান

‘হাডসন ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, করোনাভাইরাস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্তিত্বকেই হুমকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। ইইউ তৈরি হয়েছিল এমন একটা সমঝোতার মাঝ দিয়ে, যার মাধ্যমে ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে কোন ঝামেলা থাকবে না। সদস্য দেশগুলি এটা মেনে নেবে কারণ এর বিনিময়ে তারা ইইউএর অন্য দেশগুলির বাজারে কোন বাধা ছাড়াই ঢুকতে পারবে। কিন্তু বর্তমান ইইউএর মূল সমস্যা হলো জনগণের আনুগত্য ইইউএর প্রতি নয়, বরং তাদের নিজ দেশের প্রতি। যতদিন ইইউ তার সদস্য দেশগুলিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে, ততদিন তারা ইইউএর সদস্য থাকার পিছনে শক্তিশালী কারণ পেয়েছে। তবে সিরিয়া, লিবিয়া ও মালির যুদ্ধের ফলে ইউরোপে শরণার্থীর ঢল এবং অর্থনৈতিক মহামন্দায় ইইউএর অস্তিত্ব প্রশ্নের মাঝে পড়েছে। উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলির মাঝে বৈষম্য সকলের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপ জুড়ে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে, যারা বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলছে। ইউরোপের দেশগুলিতে রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের ভোট পেতে জাতীয়তাবাদকেই ব্যবহার করবে। তারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ইউরোপিয় সমাধান নয়; জাতীয় সমাধানের পথ খুঁজবে। মহামারি ব্যবস্থাপনায় ইইউএর দুর্বল পদক্ষেপগুলি জনগণের কাছে ইইউএর চিন্তাটাকে অবান্তর করে তুলবে। আর করোনাভাইরাসের কারণে মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উপর নির্ভরশীল ইউরোপের অর্থনীতি, বিশেষ করে জার্মানির অর্থনীতি, চাপের মুখে পড়বে।

জর্জ ফ্রীডম্যান আরও ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, মহামারির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ইউরোপের জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দিকেই তাকাবে; কারণ সেই নেতৃবৃন্দের তাদের জনগণের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। ব্রাসেলসের ইইউ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে জনগণ এই সমস্যার সমাধান আশা করে না। জাতীয় দুর্যোগের সময় জনগণের কাছে জাতীয় পরিচয় এবং স্বশাসনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেকারণেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি জাতীয় নেতৃবৃন্দই নিচ্ছে; ইইউ নিচ্ছে না। যদিও ইইউএর সব দেশেই মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে, তথাপি তারা নিজেদের জান মালের নিরাপত্তা দিতে অন্য দেশের সাথে সীমানা আটকে রাখার পথেই এগিয়েছে। এক্ষেত্রে ইইউএর সীমানাবিহীন চিন্তা কাজ করেনি। একটা জোট কতটা ভালোভাবে কাজ করছে, তা বুঝতে হলে দেখতে হবে তারা খারাপ সময়ে কিভাবে কাজ করে। কঠিন সময়ে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের স্বার্থকেই প্রথমে দেখেছে; তারপর অন্যের স্বার্থ দেখেছে। নিজ ভাষা, ইতিহাস এবং বিশ্বাসের মাঝেই ইউরোপিয় দেশগুলি নিজেদের গন্ডিকে সীমাবদ্ধ করেছে। বাকিরা সবসময়ই কম প্রাধান্য পেয়েছে। ইইউ তৈরি হয়েছিল এই দেয়ালগুলি ভেঙ্গে ফেলার জন্যে; তা সফল হয়নি। ইউরোপিয়ান পরিচয় তৈরি করার চেষ্টাটা যতটা সফল হবে বলে ভাবা হয়েছিল, তা হয়নি।

ফ্রীডম্যান শুধু ইইউএর মাঝেই দেয়াল তোলার কথা বলেননি। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একটা রাজ্য আরেকটা রাজ্যের সাথে প্রায় একই ধরণের ব্যবহার করেছে। যেমন টেক্সাসের গভর্নর পার্শ্ববর্তী লুইজিয়ানা রাজ্যের সাথে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ টেক্সাসের চাইতে লুইজিয়ানায় সংক্রমণ বেশি ছিল তখন। কিন্তু লুইজিয়ানার সাথে সীমানা বন্ধ করেও টেক্সাস তার সংক্রমণ থামাতে পারেনি। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, দেয়াল তুলে দেয়ার ব্যাপারটা ইউরোপের একার নয়। তবে ইউরোপের ক্ষেত্রে এর পিছনে একটা লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এক দেশ আরেক দেশের সাথে যুদ্ধ করেছে; সর্বদা সংঘাতের ভয় তাদের গ্রাস করেছে। টেক্সাস এবং লুইজিয়ানার মাঝে মনোমালিন্য খুব বেশিদূর হয়তো যাবে না; তবে ইইউএর সদস্য দেশগুলির জন্যে এই বিভেদ মারাত্মক। একইসাথে মার্কিনীদের চোখে বাকি বিশ্বের প্রতি অবিশ্বাসও হবে মারাত্মক। বৈশ্বিক সংস্থাগুলির উপর মানুষের আস্থাটাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

1 comment:

  1. যাকাআল্লাহ আপনার রিপোর্ট পড়ে মনে পড়ল একটা কথাই আল্লাহর ইচ্ছাই সব। মহানবী(সঃ) এর ভবিষ্যত বাণীর প্রতিফলন।

    ReplyDelete