Monday 4 January 2021

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার নিয়ে ভোটাভুটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

৪ঠা জানুয়ারি ২০২১

ডিসেম্বর ২০১৯। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মিয়ানমারের মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। তিনি সরাসরিই রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্ণনা থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ বলে আখ্যা দেয়। শরণার্থী প্রত্যাবাসন যে একটা সময়ক্ষেপণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না।


৩রা জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ একে আব্দুল মোমেন নিজ অফিসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে জাতিসংঘে পাস হওয়া রেজোলিউশনের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ এই ব্যাপারটাকে একটা কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছে। তিনি বলেন যে, যেসব দেশ রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোন অসন্তোষ নেই। তিনি তাদের ভোট না দেবার সিদ্ধান্তগুলিকে ‘কৌশলগত সিদ্ধান্ত’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, দেশগুলি তাদের এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে বাংলাদেশকে জানিয়েছিল। এই দেশগুলি অন্য পদ্ধতিতে মিয়ানমারের উপর প্রভাবকে ব্যবহার করতে চাইছে বলে বলেন তিনি। তবে তিনি এও বলেন যে, এই দেশগুলি জাতিসংঘে আরও ভালো ভূমিকা রাখতে পারতো। জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে গত ৩১শে ডিসেম্বর ‘দ্যা সিচুয়েশন অব হিউম্যান রাইটস অব দ্যা রোহিঙ্গা মুসলিমস এন্ড আদার মাইনরিটিজ ইন মিয়ানমার’ নামে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়। মোট ১’শ ৩০টা দেশ এই রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়; ৯টা দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়; ২৬টা দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। আরও ২৮টা দেশ ভোটাভুটির সময় উপস্থিত ছিল না।

কারা কোন পক্ষে ভোট দিয়েছে

ভোটাভুটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ অমুসলিম দেশই রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি; এরা হয় বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে। একমাত্র আলাদা দেশ ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। রাশিয়া এবং তার প্রভাবের মাঝে থাকা ইউরেশিয়ার দেশগুলিও ভোট দেয়নি; যেমন বেলারুশ, কাজাখস্থান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান। সাহারান আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ভোট দেয়নি; যাদের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ছিল নাইজেরিয়া এবং ইথিওপিয়া। ইউরোপে শুধুমাত্র হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়া পক্ষে ভোট দেয়নি। এমনকি গ্রিস এবং আর্মেনিয়াও পক্ষে ভোট দিয়েছে!

 
৩১শে ডিসেম্বর ২০২০। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমার বিষয়ে ভোটাভুটির ফলাফল। বিশ্বের সবচাইতে বড় দেশগুলির চারটা মিয়ানমারের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছে।




পক্ষে ভোট না দেয়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির বেশিরভাগই ‘আসিয়ান’ অর্থনৈতিক জোটের অংশীদার। আসিয়ানের তিন মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনাই পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই দেশগুলিতে মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে সরকারের উপর, যা বিগত বছরগুলিতে রাস্তায় মিয়ানমার বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল দেখলেই বোঝা যায়। মধ্য এশিয়াতে হয়েছে পুরো উল্টাটা। এই দেশগুলির কট্টর রুশপন্থী সরকারগুলি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের বন্ধু দেশগুলিও রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দেয়নি, যেমন শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান। পশ্চিমা দেশগুলি পক্ষে ভোট দেবে এটা প্রায় জানাই ছিল; কারণ তাদের আদর্শিক কারণে তারা এটা করবে।

এই ভোটাভুটিতে সবচাইতে বড় ভূমিকা ছিল রাশিয়া, চীন, ভারত এবং জাপানের। এরকম চারটা দেশ এবং আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার সকল অমুসলিম দেশ যদি মিয়ানমারের পক্ষে থাকে, তাহলে এই রেজোলিউশন যে মিয়ানমারকে ভয় দেখাতে পারবে না, তা নিশ্চিত। কয়েক দশক বিশ্ব থেকে আলাদা থাকা মিয়ানমারের জন্যে এরকম ভোটাভুটি এমনিতেই মূল্যহীন। তার উপর সেখানে যদি পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির চারটা মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে মিয়ানমার এতে আশহত হওয়া তো দূরে থাকুক, যথেষ্ট উল্লসিতই হবে।

মিয়ানমারের অস্ত্র ক্রয়ের জোয়ার

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার রাশিয়া, ভারত এবং চীন থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ক্রম করেছে। এই সরঞ্জামের অনেকটাই মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে নয়; যেমন বিমান বাহিনীর ৪র্থ জেনারেশনের যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জন্যে সাবমেরিন ও ফ্রিগেট। জাতিসংঘের ভোটাভুটির এক সপ্তাহ আগে ২৪শে ডিসেম্বর মিয়ানমার নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত থেকে পাওয়া সাবমেরিন কমিশনিং করে। মিয়ানমারে ভারতের রাষ্ট্রদূত সৌরভ কুমার বলেন যে, সাবমেরিনের কমিশনিং দুই দেশের সম্পর্কে একটা মাইলফলক। এর মাধ্যমে দুই দেশের ম্যারিটাইম বন্ধুত্ব বহু এগিয়ে গেলো। একই অনুষ্ঠানে মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে নিজস্ব ডকইয়ার্ডে নির্মিত একটা স্টেলথ ডিজাইনের মিসাইল ফাস্ট এটাক ক্রাফট, দু’টা ৬৩ মিটার এন্টি সাবমেরিন ভেসেল, একটা ৫৬ মিটার লম্বা ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং দু’টা সমুদ্রগামী টাগবোট কমিশনিং করা হয়। চীনা সহায়তায় মিয়ানমারের ইয়াঙ্গনে তৈরি করা হয় ‘থিলাওয়া ডকইয়ার্ড’; যেখানে গত তিন দশক ধরে চলছে এক বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। এখানে ২০টা ৪৭ মিটার প্যাট্রোল ক্রাফট ও মিসাইল বোট, ২টা ৪৯ মিটার স্টেলথ ফাস্ট এটাক ক্রাফট, ৬টা ৫৬ মিটার লম্বা ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি, ২০টা ২৯ মিটার ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাঙ্ক, ৮টা ২৬ মিটার লম্বা সমুদ্রগামী টাগবোট তৈরি করা হয়েছে। ২০০১ সালে এর উন্নয়ন কাজ শেষ হবার পর থেকে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জন্যে ১’শ ৮মিটার লম্বা তিনটা ফ্রিগেট, ৭৭ মিটার লম্বা তিনটা কর্ভেট যুদ্ধজাহাজ এবং একটা ৮১ মিটার অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল তৈরি করা হয়েছে। এই যুদ্ধজাহাজগুলির ইলেকট্রনিক্স সরবরাহ করে ভারত; যার মাঝে রয়েছে জাহাজের মূল এয়ার ডিফেন্স রাডার এবং সাবমেরিন খোঁজার সোনার, যেগুলির প্রযুক্তি মূলতঃ পশ্চিমা। জাহাজগুলিতে সাবমেরিন ধ্বংসের জন্যে টর্পেডোও সরবরাহ করে ভারত। জাহাজের উপর থেকে অপারেট করার জন্যে ড্রোন কেনা হয়েছে অস্ট্রিয়া থেকে। অস্ট্রিয়া জাতিংসঘের রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ২০১৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এক ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায় যে, মিয়ানমার গোপনে অস্ট্রিয়া থেকে অত্যাধুনিক ‘শাইবেল ক্যামকপ্টার এস১০০’ ড্রোন কিনেছে। এক হিসেবে বলা হয় যে, এই ক্রয়ের মূল্য ছিল প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। এরকম একটা ড্রোনের মূল্য প্রায় ৪ লাখ ডলার; আর এর কন্ট্রোল স্টেশন ও ট্রেনিংসহ পুরো সিস্টেমের খরচ প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। কাজেই মিয়ানমার আসলে কতগুলি ড্রোন কিনেছে, তা বলা কঠিন।

 

মিয়ানমার নৌবাহিনীর জন্যে অস্ট্রিয়া থেকে কেনা অত্যাধুনিক ‘শাইবেল ক্যামকপ্টার এস১০০’ ড্রোন। দন্তহীন সংস্থা জাতিসংঘের ভোটাভুটি পশ্চিমাদের লোক দেখানো কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। গোপনে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বলাটা কপটতার শামিলই বটে। মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দও আদর্শিক দিক থেকে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করছে না। বরং বাস্তবতাকে চিন্তার ভিত ধরে মিয়ানমারকে আরও কাছে টানার নীতিতে এগুচ্ছে।


এই অস্ত্রগুলি অন্ততঃ সংখ্যার দিক থেকে হলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার নৌবাহিনীর সবচাইতে বড় যুদ্ধজাহাজ উভচর ডক ল্যান্ডিং শিপ তৈরি করে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, যারা কিনা পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে রেজোলিউশনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। গত ডিসেম্বরেই খবর বেরোয় যে, মিয়ানমার মুসলিম দেশ জর্দানের বিমান বাহিনীর কাছ থেকে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দু’টা ‘এয়ারবাস সি২৯৫’ সামরিক পরিবহণ বিমান ক্রয় করছে। বিমানগুলি ইউরোপে তৈরি এবং এর ইঞ্জিনগুলিও কানাডার কোম্পানি ‘প্র্যাট এন্ড হুইটনি’র তৈরি। মিয়ানমারের মিডিয়া ‘ইরাবতী’ বলছে যে, ২০১১ সালে ইউ থেইন সেইন প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার বিমান বাহিনীতে ৯৬টা নতুন বিমান যোগ করা হয়েছে; যার মাঝে দশ প্রকারের ৭৯টা বিমান এবং পাঁচ প্রকারের ১৭টা হেলিকপ্টার রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের মাঝে ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে রাশিয়া মিয়ানমারের সবচাইতে বড় সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একই সময়ে চীনের কাছ থেকে মিয়ানমার পেয়েছে ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। মিয়ানমারের কয়েক’শ সেনা যেকোন মুহুর্তে রাশিয়াতে সামরিক শিক্ষা নিচ্ছে।

অবাক ব্যাপার হলো, ১৯৮৮ সাল থেকে মিয়ানমারের উপর পশ্চিমা অস্ত্র অবরোধ রয়েছে। ‘ইরাবতী’ বলছে যে, ২০১৯এর ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিং অং হাইং বিমান বাহিনীর ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ১০টা বিমান কমিশনিং করেন; যার মাঝে ছিল পাকিস্তানে তৈরি ২টা ‘জেএফ১৭বি’ মাল্টিরোল ফাইটার, রাশিয়ায় তৈরি ৬টা ‘ইয়াক১৩০’ এডভান্সড ট্রেইনার বিমান এবং ২টা ‘এমআই৩৫’ এটাক হেলিকপ্টার। ৭০তন প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতেও মিয়ানমার বিমান বাহিনীর জন্যে ১০টা বিমান কমিশনিং করা হয়; যার মাঝে ছিল ৬টা ‘ইয়াক১৩০’, হল্যান্ডে তৈরি দু’টা ‘ফকার ৭০’ বিমান এবং ফ্রান্সে তৈরি দু’টা ‘এটিআর ৪২’ বিমান। এভাবে প্রতি বছরই মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর জন্যে যুদ্ধবিমান কমিশনিং করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন টুন বলছেন যে, মিয়ানমার ভারত বা চীনের সাথে হয়তো প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, কিন্তু অন্য তিন প্রতিবেশী থাইল্যান্ড, লাওস এবং বাংলাদেশের সাথে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারে। অস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্য হিসেবে তারা বলছে যে, এগুলি মূলতঃ বিদেশী হুমকিকে বাধা দেয়ার জন্যে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীরা এসে যাতে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন না করতে পারে সেজন্য, আর দেশের সম্পদ রক্ষা করার লক্ষ্যে আকাশ পাহাড়া দেবার জন্যে। ২০০১ সালে থাইল্যান্ডের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত যুদ্ধে মিয়ানমারের ব্যাপক পরাজয়ের পর মিয়ানমার রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়ে মনোযোগী হয় বলে বলা হয়। বহুবছর সামরিক শাসনের সময় পশ্চিমা অবরোধের মাঝে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার একটা চিন্তা ছিল যে, পশ্চিমারা হয়তো যেকোন সময় মিয়ানমারের উপর সামরিক হামলা করতে পারে। এছাড়াও বহু দশক ধরে নিজ জনগণের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যস্ত মিয়ানমার। একারণেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি যথেষ্ট এডভান্সড। উদাহরণস্বরূপ, স্যাটেলাইট ছবিতে মিয়ানমারের কোন বিমান ঘাঁটির রানওয়েতেই সামরিক বিমান পার্কিং করা দেখা যায় না।

মিয়ানমারের সামরক বাহিনীর বরাত দিয়ে ‘ইরাবতী’ বলছে যে, চীনাদের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমাবার লক্ষ্যেই মিয়ানমার রাশিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, ভারত, ইস্রাইল এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে থাকে। মিয়ানমারের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলতঃ রাশিয়া থেকে আসে। একটা বড় সংখ্যক যুদ্ধবিমান ছিল চীনা নির্মিত ‘এফ৭’ যুদ্ধবিমান। মিয়ানমারের সামরিক মুখপাত্র বলছেন যে, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের হুমকি মোকাবিলা করতে মিয়ানমার একটা সাবমেরিন ফ্লিট গড়ে তুলতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে ভারতের কাছ থেকে কেনা রুশ নির্মিত ‘কিলো ক্লাস’এর সাবমেরিনটা মূলতঃ ব্যবহৃত হবে ট্রেনিংএর উদ্দেশ্যে। ২০১৮ সালে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ঘোষণা দেন যে, রাশিয়া ২’শ ৪ মিলিয়ন ডলারে মিয়ানমারের কাছে ৬টা ‘সুখোই ৩০’ ফাইটার বিমান বিক্রি করছে। একই বছর জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা কেনতারো সোনোউরা বলেন যে, জাপান মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে সহায়তা দেবে। সেই হিসেবেই জাপানের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি’তে এখন মিয়ানমারের ক্যাডেট নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা খাতে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন টুন বলছেন যে, ভারত এবং চীনের মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বঙ্গোপসাগর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের বিমান এবং নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা ছাড়া সামনের দিনে কোন পথই খোলা নেই।

 
সেপ্টেম্বর ২০১৭। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরের সময় ঘোষণা দেন যে ভারত মিয়ানমারের সাথেই রয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্বে গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন মূল লক্ষ্য, তখন রোহিঙ্গাদের মতো মুসলিম শরণার্থীরা ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবেই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে সকলেই শক্তিশালী অবস্থান চাইছে; আর তাদের ঢোকার রাস্তা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা।

নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

মিয়ানমারে সামরিক যজ্ঞের ফিরিস্তি দেখলে বোঝা দুষ্কর যে দেশটা আসলে মানবাধিকারের ব্যাপারে চাপের মাঝে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সকল দেশ যেভাবে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে, তাতে মিয়ানমারই শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে; তারা যা চাইছে, তাই পাচ্ছে। দন্তহীন সংস্থা জাতিসংঘের ভোটাভুটি এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের লোক দেখানো কর্মকান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। গোপনে মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বলাটা কপটতার শামিলই বটে। মুসলিম দেশগুলির নেতৃবৃন্দও আদর্শিক দিক থেকে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করছে না। বরং বাস্তবতাকে চিন্তার ভিত ধরে মিয়ানমারকে আরও কাছে টানার নীতিতে এগুচ্ছে। কেউ হয়তো সরাসরি মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে; যার মাঝে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি রয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলি অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে ভীষণ কঠোর হলেও মিয়ানমারের ক্ষেত্রে ততটা নয়। জাতিসংঘের অধিবেশনে তারা কিন্তু ন্যায়ের পক্ষেই নিজেদের নাম লেখাচ্ছে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার পর ২০১৯এর ডিসেম্বরে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি সরাসরিই রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। মিয়ানমার খুব ভালো করেই জানে যে, তারা বাংলাদেশের জন্যে কতটা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্ণনা থেকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ বলে আখ্যা দেয়। একইসাথে যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেবার তাদের কোনরকম সদিচ্ছাই দৃশ্যমান নয়, কাজেই শরণার্থী প্রত্যাবাসন যে একটা সময়ক্ষেপণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না। মিয়ানমার বাংলাদেশকে মূলতঃ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের কথা শুনতে বাধ্য নয়। উল্টো বিশাল অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলে তারা বাংলাদেশকে একপ্রকার হুমকিই দিচ্ছে এবং শান্তির পথকে করছে সংকীর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা নতুন বছরের বার্তায় বলেন যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে অশান্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অশান্তি হলে সবার জন্যে অসুবিধা। ডঃ মোমেনের এই বার্তায় যে অশান্তির আভাস দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু মিয়ানমার এখনও টের পাচ্ছে না ভূরাজনৈতিক কারণেই। পরিবর্তিত বিশ্বে গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন মূল লক্ষ্য, তখন রোহিঙ্গাদের মতো মুসলিম শরণার্থীরা ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হিসেবেই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে সকলেই শক্তিশালী অবস্থান চাইছে; আর তাদের ঢোকার রাস্তা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় এই সমস্যার সমাধান হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকলেও বঙ্গোপসাগরে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যে আরও তীব্র হবে, তা সন্দেহাতীত। সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছে আসন্ন দ্বন্দ্বের জন্যে।

3 comments:

  1. এখন বাংলাদেশের কি করা উচিৎ বা কি করতে পারে? কূটনৈতিক রাস্তা পরায় বন্ধই ধরে নিচ্ছি। যুদ্ধ করতে হলেওতো একটা প্রস্তুতকারক ব্যাপার আছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুদ্ধ এবং কূটনীতি উভয়ই প্রকৃতপক্ষে পররাষ্ট্রনীতির অংশ। বাংলাদেশ যেহেতু দুনিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই বাকি বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে; তাই সকলেই সেহিসেবে নিজেদের অবস্থানকে পূণর্মূল্যায়ন করছে। চীনের উত্থান এবং এর সমান্তরালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হারানো দুনিয়ার সামনে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থাকে উপস্থাপন করেছে। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি সেই বাস্তবতাগুলিকে উপেক্ষা করে নয়। মিয়ানমার এখানে কোন খেলোয়াড় নয়; কিন্তু তাকে খেলোয়াড় হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। অর্থাৎ এটা মিয়ানমারের সত্যিকারের চেহারা নয়।

      বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের অবস্থান যেসব কারণে সুসংহত মনে হচ্ছে, সেই কারণগুলিই বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক ব্যালান্স পরিবর্তন করবে। ভারত মহাসাগর, তথা বঙ্গোপসাগরে নতুন কয়েকটা শক্তি নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করার পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে, যাদের মাঝে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া (উভয়েই গ্লোবাল ব্রিটেনের অংশ), তুরস্ক এবং জাপান রয়েছে। সামনের দিনে দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবকেও আরও সরব দেখা যেতে পারে। কারণ একেকটা শক্তি নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে তাদের বন্ধুদের নিয়ে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, চীনকে ব্যালান্স করতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে জাপান এখানে থাকুক; আবার তুরস্ককে ব্যালান্স করতে সৌদিরাও থাকুক। জাপানকে ব্যালান্স করতে কোরিয়ানরাও আসতে চাইবে। তুর্কিরা নিয়ে আসবে পাকিস্তানকে; ভারত চাইবে ইন্দোনেশিয়াও থাকুক। তুর্কিরা মালয়েশিয়াকেও চাইবে। আর এই পুরো খেলার মূলে থাকবে রোহিঙ্গা ইস্যু। সকলেই নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে চাইবে; তা যেকোন ধরনের শক্তিই হোক।

      Delete
  2. এই রোহিংগা ক্রাইসিসের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পেল। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কূটনৈতিক দক্ষতা যে আমাদের চেয়ে বেশী সেটা বলাই বাহুল্য। "সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়" এই নীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আধুনিক সমরাস্ত্র যোগাড়ের প্রচেষ্টা আরও আগে থেকেই করা শুরু করা উচিৎ ছিল। বিএনপি সরকার মিগ-২৯ বিমানের কনট্রাক্ট বাতিল করে না দিলে এখন আমাদের বহরে থাকতো ১৬ টি মিগ-২৯্ প্লাস এবং বংগবন্ধু ক্লাসের ৩টি ফ্রিগেট। এটা নিশ্বিত মিয়ানমার সরকারকে রোহিগাদের ঠেলে বের করার আগে আরও হিসাব নিকাশ করতে হত।

    যাই হউক, এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ এখন কিভাবে ক্রাইশিস মোকাবেলা করে। এটা অনন্ত কাল ধরে চলতে পারে না। এতদিন আমরা বিনীতভাবে মিয়ানমার এবং অন্যদেরকে এর সমাধানের উপায় বের করার জন্য বলতাম। এই অবস্থান থেকে সরে এসে ক্রমান্বয়ে কঠোরতম অবষ্থানে যেতে হবে।

    ReplyDelete