Thursday 17 September 2020

তুরস্কের বঙ্গোপসাগরে অবতরণ?

১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০

হিমালয়ের উত্তেজনার মাঝে প্রতিবেশীদের সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে এতদিন ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চীন; এখন তুরস্কের আবির্ভাবে তা আরও অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরে চীন এবং তুরস্ক উভয়ের পক্ষেই একা সামরিকভাবে ভারতকে ব্যালান্স করা দুষ্কর। একারণেই উভয়েই চাইছে ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী বন্ধু তৈরি করতে; পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ভূমিকা একারণেই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।

১৬ই সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়, যা গত ৪ঠা অগাস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিশাল বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা এখন পুরোপুরি সচল। তুরস্কের আকসাজ নৌঘাঁটিতে জাহাজটার মেরামতের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এর মাত্র দু’দিন আগেই ১৪ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ককে নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শেখ হাসিনা আঙ্কারাতে ভিডিও কনফারেন্সিংএর মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন চান্সেরি কমপ্লেক্স উদ্ভোধন করার সময় মিয়ানমারের মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তুরস্কের সমর্থন দেবার জন্যেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একইসাথে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশের মাঝে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্কোন্নয়ের প্রচেষ্টার গুরুত্ব কতটুকু, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হতে শুরু করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাসকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে তুরস্কের স্বীকৃতির বহু আগে নিয়ে যান। তিনি বলেন যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মূহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী যখন বাংলা জয় করেন, তখনই তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শেখ হাসিনা এমন এক ইতিহাসের উদাহরণ টেনে এনেছেন, যা কিনা বর্তমান তুরস্ক এবং বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের চাইতে অনেক পুরোনো এবং গভীর। তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে আস্থা, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে আখ্যা দেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমেই বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এরপর থেকে আষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিকেরা নিয়ন্ত্রণ নেবার আগ পর্যন্ত বাংলার বেশিরভাগ শাসকই ছিলেন তুর্কি। অপরদিকে বর্তমান তুরস্ক উসমানি খিলাফতের ধ্বংসের পর প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। উসমানিরা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বশীল স্থানে আসার আগেই তুর্কি নেতৃত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বখতিয়ার খিলজীর ইতিহাসও সেসময়েরই। বাংলা বিজয়ের আরও প্রায় আড়াই’শ বছর পর উসমানিরা ১৪৫৩ সালে কন্সটানটিনোপল বিজয় করে; যা এখন ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। পরবর্তী সাড়ে ৪’শ বছর ইস্তাম্বুল ছিল উসমানি খলিফার রাজধানী। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা খলিফার সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের বিশ্বাসগত বন্ধন ছিল নিবিড়। ১৫১৯ সালে উসমানি খলিফা প্রথম সেলিম মধ্য এশিয়ার তুর্কি নেতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুরকে সমর্থন দেন। উসমানি আর্টিলারি জেনারেল উস্তাদ আলী কুলি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ম্যাচলক বিশেষজ্ঞ মুস্তাফা রুমিকে বাবুরের সহায়তায় প্রেরণ করা হয়। এই আর্টিলারি প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়েই ১৫২৬ সালে বাবুর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে জয়লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৪ সালে ইউরোপিয়রা উসমানি খিলাফত ভেঙ্গে ফেললে বর্তমান তুরস্কের জন্ম হয়; যা কিনা উসমানিদের অধীনে থাকা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। সেসময় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই ইতিহাসগুলিই বলে দেয় যে, জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং তুরস্কের চাইতেও অনেক গভীর সম্পর্ক রয়েছে দুই দেশের মানুষের; যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৈশ্বিক; আঞ্চলিক নয়।

  

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয়এর মেরামত কাজ সম্পন্ন করা হয় তুরস্কের আকসাজ নৌঘাঁটিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ককে নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামতের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন যে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মূহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী যখন বাংলা জয় করেন, তখনই তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শেখ হাসিনা এমন এক ইতিহাসের উদাহরণ টেনে এনেছেন, যা কিনা বর্তমান তুরস্ক এবং বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের চাইতে অনেক পুরোনো এবং গভীর।

 

২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঙ্কারা সফর করেন। তবে গত এক দশকে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক ওঠানামা করেছে। বিশেষ করে ১৯৭১এর স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’। ২০১৭ সালেও তুরস্কের সরকারি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘অবাধ্য রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। সেই অবস্থান থেকে ২০২০ সালের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই প্রয়াস বিরাট এক পরিবর্তন। দুই সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের মাঝে পার্থক্য থাকলেও দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সর্বদাই ভালো ছিল। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে সম্পর্ক বেশ গভীর। ১৯৮১ সালে দুই দেশের মাঝে সামরিক প্রশিক্ষণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্কে তৈরি ‘অতোকার কোবরা’ আর্মার্ড ভেহিকল ব্যবহার করে। বাংলাদেশি দূতাবাসের ভবন উদ্ভোধনের পর সংবাদ সন্মেলনে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, দুই দেশের বাণিজ্য এখন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মতো; তবে তিনি তা ২ বিলিয়ন ডলারে উঠিয়ে নেবার পক্ষপাতি। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর হিসেবে বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ তুরস্কে ৪’শ ৫৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন দূতাবাস উদ্ভোধন উপলক্ষে আঙ্কারা ভ্রমণ করেন। কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ ইনিশিয়েটিভ’ চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাংলাদেশ। এই চিন্তার অংশ হিসেবে তুরস্ক এশিয়ার দেশগুলির সাথে শিক্ষা, প্রতিরক্ষা শিল্প, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি বিষয়ে সম্পর্ক গভীর করতে চায়। তিনি আরও বলেন যে, খুব শিগগিরই ঢাকায় নতুন তুর্কি দূতাবাস উদ্ভোধন করা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার পত্নীকে দূতাবাস উদ্ভোধনের জন্যে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে শৈত্য প্রবাহ?

তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো, যখন বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। অগাস্ট মাসেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফর করে যান। করোনাভাইরাসের লকডাউন শুরুর পর থেকে এটা ছিল শ্রিংলার প্রথম বিদেশ সফর। ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই সফরের মাধ্যমে ভারত চাইছিল বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক করতে। সেখানে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের নেয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের অবকাঠামোতে চীনের বড় আকারের বিনিয়োগের ব্যাপারে ভারতের অস্বস্তির কথাও সেখানে বলা হয়। ভারতের ‘দ্যা উইক’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, শ্রিংলার সফর ছিল দুই দেশের সম্পর্কের ‘শীতলতা’ কাটাবার চেষ্টা। সেখানে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারত কেন নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করেছিল, তা তিনি বুঝতে পারেননি; যদিও শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এরপর অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ শুরুর সময়েও বাংলাদেশে উদ্বেগ দেখা দেয় বলে উল্লেখ করে পত্রিকাটা। যদিও সেসময়ও বাংলাদেশ সরকার বলেছিল যে, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু।

তবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সবচাইতে বড় ইস্যু ছিল চীনের ব্যাপারে নীতি। ভারতের ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, লাদাখে যখন ভারত এবং চীনের মাঝে উত্তেজনা চলছে, তখন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছিল। ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা ঢাকায় তাদের প্রভাব খাটিয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের পিছনে কাজ করছে। লাদাখের উত্তেজনার মাঝেই চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়। বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার বীনা সিক্রি বলেন যে, চীন সর্বদাই এধরনের কৌশল অবলম্বন করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে; এবং এতে তারা বেশ সফলও হচ্ছে। তিনি ভারত সরকারকে এব্যাপারে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেবার উপদেশ দেন। চীন থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির ব্যাপারেও ভারতের পত্রিকাগুলিতে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ফেলো কনস্টানটিনো জেভিয়ার বলেন যে, দিল্লী এখন ঢাকার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে যেন বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কিছুটা পিছিয়ে আসে।
   

২০১৯এর নভেম্বর। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ পরিদর্শনে। সোমালিয়া, কাতার এবং পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় যে, ভারত মহাসাগরে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তুরস্ক বঙ্গোপসাগরেও তার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।
 

ভারত মহাসাগরে তুরস্ক

গত নভেম্বরে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতার সফর করেন। কাতারে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি তৈরি শেষে বলা হয় যে, মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদের (রাঃ) নামানুসারে এই ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে। এখানে ৫ হাজার তুর্কি সেনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু’বছর আগে কাতারের উপর সৌদি অবরোধের সময় কাতারে সেনা পাঠায় তুরস্ক। কাতারের জয়েন্ট স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল হামাদ বিন আব্দুল্লাহ আল ফুত্তাইস ২০১৮ সালে ঘোষণা দেন যে, কাতারে তুরস্কের জন্যে একটা নৌঘাঁটি তৈরির জন্যে দুই দেশের মাঝে সমঝোতা হয়েছে। কাতার ছাড়াও সোমালিয়াতে একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে তুরস্ক। ‘ক্যাম্প তুর্কসোম’ নামের এই ঘাঁটিতে সোমালিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে তুর্কি রাষ্ট্রদূত মেহমেত ইলমাজ বলেন যে, সোমালিয়ার সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ সেনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে তুরস্ক; যা সংখ্যায় প্রায় ১৫ থেকে ১৬ হাজারের মতো। এছাড়াও জানুয়ারি মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, তিনি সোমালিয়ার সরকারের কাছ থেকে সোমালিয়ার উপকূলে সমুদ্রে তেল গ্যাস আহরণের একটা আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তুরস্ক তেল গ্যাস আহরণের জন্যে ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগরে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে এবং তা করতে গিয়ে প্রতিবেশী গ্রীসের সাথে তুরস্কের উত্তেজনাও চলছে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের এই আহরণের প্রচেষ্টাতে সরাসরি নিরাপত্তা দিচ্ছে তুর্কি নৌবাহিনী। তুরস্ক যদি সোমালিয়ার উপকূলে আহরণের কাজ শুরু করতে যায়, তাহলে সেখানেও তুরস্ক নিরাপত্তার কথা শুরুতেই চিন্তা করবে।

আদেন উপসাগর এবং আরব সাগরে জলদস্যু দমনের লক্ষ্যে তুরস্ক তার একটা নৌবাহিনী জাহাজকে টহলে রেখেছে। পাকিস্তানের সাথেও তুরস্কের রয়েছে গভীর সামরিক সম্পর্ক। ২০১৮ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্যে ৪টা ‘মিলজেম ক্লাস’এর ফ্রিগেট তৈরি করছে। ‘আনাদোলু এজেন্সি’ বলছে যে, গত জুনে পাকিস্তানের করাচিতে দ্বিতীয় ফ্রিগেটের কাজ শুরু হয়। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তুর্কি শিপইয়ার্ডে প্রথম ফ্রিগেটের কাজ শুরু হয়, তুর্কি প্রেসিডেন্ট নিজে যেটার উদ্ভোধন করেন। সোমালিয়া, কাতার এবং পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয় যে, ভারত মহাসাগরে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তুরস্ক বঙ্গোপসাগরেও তার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। অক্টোবরের ২৬ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত তুর্কিরা ‘ডিফেন্স পোর্ট টার্কি, সাউথ এশিয়া’ নামে একটা মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে। সেখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ৮০ জন সামরিক প্রতিনিধি যোগ দেবেন বলে তারা আশা করছেন। ‘ক্যাপিটাল এক্সিবিশন’এর প্রধান নির্বাহী হাকান কুর্ত বলছেন যে, আগামী এক দশকের মাঝে এই তিন দেশে তুরস্কের ৫ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রির টার্গেট রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের ভিত বিশ্বাসগত; জাতি রাষ্ট্রের স্বার্থের উপর নয়। রাজনৈতিক দলের স্বার্থ যখন রাষ্ট্রের স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে না পারে, তখন তার ভূরাজনৈতিক ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী। দক্ষিণ এশিয়াতে শুধুমাত্র পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক রাখাটা তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির একটা দুর্বল দিক ছিল। কাশ্মির ইস্যুতে তুরস্কের অবস্থান ছিল মূলতঃ পাকিস্তানের কারণেই। এখন মিয়ানমার ইস্যুতেও তুরস্ক তাদের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে পারে। সেকুলার জাতি রাষ্ট্র তুরস্ক তার আদর্শিক ইতিহাসকে মুছে ফেলতে পারছে না; যদিও জাতীয় স্বার্থের কারণে তুরস্ক মুসলিমদের বিভিন্ন ইস্যুতে আদর্শত শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। হিমালয়ের উত্তেজনার মাঝে প্রতিবেশীদের সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে এতদিন ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চীন; এখন তুরস্কের আবির্ভাবে তা আরও অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে। তুরস্কের নতুন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আনাদোলু’কে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ভারত মহাসাগরেও দেখা যেতে পারে বলে বলছে তুর্কি পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’। তবে ভারত মহাসাগরে চীন এবং তুরস্ক উভয়ের পক্ষেই একা সামরিকভাবে ভারতকে ব্যালান্স করা দুষ্কর। একারণেই উভয়েই চাইছে ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী বন্ধু তৈরি করতে; পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ভূমিকা একারণেই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাবে নিশ্চিত; তবে তুরস্কের বেলায় ভারতকে নতুন কোন কৌশলগত পার্টনার খুঁজতে হবে। পাকিস্তানের সাথে সৌদিদের সাম্প্রতিক মনোমালিন্যের পর তুর্কিদের মোকাবিলায় সৌদিদের ভারত নিজ পক্ষে আনার চেষ্টা চালাতে পারে। ভূমধ্যসাগরে তুর্কিদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্সও ভারত মহাসাগরে ভারতের পাশে থাকতে পারে। ২০২১ সাল থেকে ব্রিটেনও ভারত মহাসাগরে তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে যাচ্ছে। মোট কথা দিনে দিনে ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি আরও জটিল হচ্ছে।

2 comments:

  1. বাংলাদেশের কি কি করা উচিৎ এই ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা থেকে সর্বচ্চো ফায়দা নিতে? তুরস্কোর দিকে বেশী ঝুকলে সৌদি ও অন্যান্য আরব শাসকরা বেজার হতে পারে। ভারতের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এমনকি আংকেল স্যাম ও ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য।

      বাংলাদেশ, তুরস্ক, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র - সকলেই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আটকে আছে; ইচ্ছে করলেই যা চাওয়া তা-ই তারা করতে পারবে না। ভারত তার অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে; আরও বেশি উগ্রবাদী আচরণ এবং সাংঘর্ষিক নীতি আশা করা যায়। চীন তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারবে; তবে তারা নিজেদের আদর্শিক শূণ্যতাকে তারা মেনে নিতে পারবে কিনা, সেটা দেখতে হবে। তুরস্ক তার বাস্তবতাকে পরিবর্তন করতে চাইছে; সেকারণেই সে ভারত মহাসাগরে বন্ধু বাড়াতে চাইছে। তবে বন্ধুর উপর নির্ভরশীলতা তার নিজস্ব দুর্বলতার কারণেই তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে; যদিও সে এখনও সুপারপাওয়ার। অনেক কিছু সে মেনে নিতে বাধ্য হবে; যা হয়তো একসময় তার জন্যে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য হতো। বাংলাদেশ এই বাস্তবতাকে ব্যবহার করে আসছে; আরও করবে। জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সে সর্বদাই মানুষের আদর্শিক আকাংক্ষাকে পুঁজি করতে চাইবে। তবে তুরস্কের মতোই, এর পেছনে সীমাবদ্ধতা থাকবে আদর্শিক ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকা।

      Delete