Monday 7 September 2020

ইউরোপে উগ্রপন্থীদের উত্থান প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা আদর্শের সংকট

৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০
বার্লিনে করোনা বিরোধী প্রতিবাদের বিশেষত্ব ছিল উগ্র ডানপন্থীদের অংশগ্রহণ এবং জার্মান পার্লামেন্টে হামলার চেষ্টা। যে উগ্রপন্থী চিন্তাকে পুঁজি করে ডানপন্থীরা ইউরোপজুড়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে, তার পিছনে জনগণের সমর্থন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ধারাতেই উগ্রপন্থীরা ইউরোপে আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। সেই হিসেবে জার্মান পুলিশের উগ্রপন্থীদের টার্গেট করে চাপের মাঝে ফেলার চেষ্টাখানা যথেষ্টই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রকে পুঁজি করে পরস্পরবিরোধী এই কার্যকলাপ ইউরোপের আদর্শিক সংকটেরই চিত্র, যা থেকে বের হবার কোন পথ কেউ দেখাতে পারছেন না। 




অগাস্টের শেষে জার্মান রাজধানী বার্লিনে ৩৮ হাজার মানুষের এক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। করোনাভাইরাস বিষয়ে জার্মান সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল। পুলিশ এদের মাঝ থেকে প্রায় ৩’শ প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তারও করে। পরবর্তীতে কয়েক’শ ডানপন্থী প্রতিবাদকারী জার্মান পার্লামেন্ট ‘রাইখস্টাগ’এ হামলা করার চেষ্টা করে। জার্মান রাজনীতিবিদেরা অনেকেই এই হামলাকে ‘লজ্জাজনক’ এবং ‘অগ্রহনীয়’ বলে আখ্যা দেন। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, প্রতিবাদকারীদের মাঝে অনেকেই উগ্রপন্থী কথা লেখা টি শার্ট বা পতাকা বহন করছিল। ‘ল্যাটেরাল থিংকিং ৭১১’ নামের একতা সংগঠন বলে যে, সরকারের করোনাভাইরাসের নিয়মকানুন জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাতের স্বরূপ। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে অনেকেই করোনাভাইরাস বলে কিছু আছে, সেটাই বিশ্বাস করে না। তারা মনে করছে যে, করোনাভাইরাস একটা ষড়যন্ত্র; এবং সরকার করোনাভাইরাসের নামে মানুষের উপর গোয়েন্দাগিরি করছে। একই রকমের চিন্তার মানুষের লন্ডন, প্যারিস, ভিয়েনা এবং জুরিখ শহরেও বিক্ষোভ করে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানিতে মোট ২ লক্ষ ৪২ হাজার মানুষের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে, যা কিনা অন্যান্য ইউরোপিয় দেশ থেকে কম। ৯ হাজার ৩’শ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটাও ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি বা রাশিয়ার চাইতে কম বলে বলছে ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র গবেষণা। ‘ইসিডিসি’র হিসেবে অগাস্ট মাসে পুরো ইউরোপেই সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। জার্মানিতেও তাই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার। ২৭শে অগাস্ট চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের সরকার জনসমক্ষে মাস্ক না পড়ার জন্যে ৫০ ইউরো জরিমানা ধার্য্য করে। আগামী বছর পর্যন্ত জনসমাগমের উপরে নিষেধাজ্ঞা বলবত করা হয়েছে। বার্লিনের করোনা বিরোধী প্রতিবাদের বিশেষত্ব ছিল উগ্র ডানপন্থীদের অংশগ্রহণ এবং জার্মান পার্লামেন্টে হামলার চেষ্টা। করোনা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ডানপন্থীরা নিজেদের অবস্থান সংহত করতে চাইছে কিনা, তা নিয়েও কথা শুরু হয়েছে। কারণ জার্মানিতে উগ্রবাদী, বিশেষ করে নিও নাজিদের কর্মকান্ড নিয়ে উদার ও মধ্যপন্থীরা যারপরনাই চিন্তিত।

গত মার্চে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘বিএফভি’এর প্রধান থমাস হালডেনওয়াং এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, ডানপন্থী উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ জার্মানির গণতন্ত্রের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি। তিনি বলেন যে, উগ্র ডানপন্থীদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজারের মতো; এর মাঝে ১৩ হাজারের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াবার সম্ভাবনা বেশি। তিনি আরও বলেন যে, জার্মানির ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ড’ ‘এএফডি’ বা ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’র সবচাইতে উগ্রবাদী অংশের নেতৃবৃন্দকে গোয়েন্দা নজরে রাখা হয়েছে। এই অংশটার নাম ‘ডের ফ্লুগেল’ বা ‘দ্যা উইং’; যার সদস্যসংখ্যা আনুমানিক ৭ হাজারের মতো। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, এই গ্রুপের গুরুত্ব তাদের সংখ্যার চাইতেও আরও বেশি; কারণ এরা পুরো দলের নীতি নির্ধারণেও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। জার্মান পুলিশ এবং তাদের কথাবার্তা শুনতে এবং রেকর্ড করতে পারবে। হালডেনওয়াং বলেন যে, জার্মানিতে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন হামলার ঘটনাই বলে দিচ্ছে যে, উগ্রবাদী গ্রুপগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে হানাউ শহরে একতা শিশা বারে এক উগ্রপন্থী বন্দুকধারী ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে অক্টোবরে হাল শহরে ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগে হামলায় দুই জন নিহত হয়। তারও আগে জুন মাসে হেস রাজ্যে ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থানে থাকা এক রাজনীতিবিদ ওয়াল্টার লুবেককে এক উগ্রপন্থী ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে।

  
জার্মানির ‘এএফডি’ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আলেক্সান্ডার গল্যান্ড ছিলেন একজন সরকারি আমলা এবং পরবর্তীতে পটসড্যামের একটা পত্রিকার সম্পাদক। জার্মানির উগ্রপন্থী রাজনীতিবিদেরা জার্মানির স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাঝ থেকেই উঠে এসেছে। এদের অনেকেই সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’এর সদস্য ছিল; কেউ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর; সরকারি কর্মকর্তা; বা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সাংবাদিক বা কলামিস্ট। জার্মান গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়েই এই উগ্রপন্থী চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে। 



‘এএফডি’ তৈরি হয় ২০১২ সালে। দল গঠনের পিছনে মূল যুক্তি ছিল জার্মানিকে ইউরো থেকে নিজস্ব মুদ্রা ডয়েচ মার্কে ফিরিয়ে নেয়া। তাদের বক্তব্য ছিল যে, ইউরোর চাপে দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলি দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং তারা ক্রমান্বয়ে জার্মানির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। ২০১০ সালে গ্রীসের দেউলিয়া হবার ঘটনায় জার্মানির অর্থনৈতিক সহায়তা দেবার প্রতিশ্রুতি দল গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। দলের উদ্যোক্তা হিসেবে তিনজনের নাম বলা হয়েছিল। এর মাঝে আলেক্সান্ডার গল্যান্ড ছিলেন একজন সরকারি আমলা এবং পরবর্তীতে পটসড্যামের একটা পত্রিকার সম্পাদক। গল্যান্ড একইসাথে এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’ বা ‘সিডিইউ’এর সদস্য ছিলেন। ‘সিডিইউ’ হলো জার্মানির সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল। জার্মান পার্লামেন্ট ‘বুন্দেস্টাগ’এর ৭’শ ৯টা আসনের মাঝে ‘সিডিইউ’এর আসন রয়েছে ২’শ। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা বার্ন্ড লাক ইউনিভার্সিটি অব হামবুর্গের অর্থনীতির প্রফেসর। তিনি বিশ্ব ব্যাঙ্কের একজন উপদেষ্টার পদে থাকা ছাড়াও কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভিজিটিং স্কলার ছিলেন। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা কোনরাড এডাম মূলতঃ সাংবাদিক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘ফ্রাঙ্কফুটার আলেমাইন জাইটুং’ এবং ‘ডাই ওয়েল্ট’এর সাথে কাজ করেছে। ২০০৭ সাল থেকে তিনি পত্রিকাতে কলামিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। ‘এএফডি’ গঠনের পূর্বে তিনিও ‘সিডিইউ’এর সদস্য ছিলেন। গত সাত বছরে দলটা রও বেশি উগ্রবাদী ধারণা পোষণ শুরু করে এবং নিজেদের নেতৃত্বে বেশ কয়েক দফা পরিবর্তন হয়। ২০১৫ সালে ইউরোপে শরণার্থী আগমণ শুরু হলে ‘এএফডি’ চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের সীমান্ত খুলে রাখার নীতির ব্যাপক সমালোচনা করে। বর্তমানে ‘এএফডি’ই হলো ক্ষমতাসীন ‘সিডিইউ’এর সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। পার্লামেন্টে এখন তাদের ৮৮টা আসন রয়েছে; ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টেও এদের ১১টা আসন রয়েছে। কাজেই এই দলকে এড়িয়ে যাওয়া কারুর পক্ষেই সভব নয়। গোয়েন্দা সংস্থার বিবৃতির পর ‘এএফডি’র মুখপাত্র জোর্গ মিউথেন বলেন যে, দলের বিরুদ্ধে এই কর্মকান্ড দলটার কন্ঠরোধ করার একটা চেষ্টা। এই প্রচেষ্টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

‘ডের ফ্লুগেল’ শাখার নেতা বিয়র্ন হোক হলেন জার্মানির পূর্বাংশের থুরিঞ্জিয়া রাজ্যের ‘এএফডি’র রাজনীতিবিদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদি নিধনের স্মৃতি স্তম্ভকে তিনি ‘লজ্জার স্মৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে এই স্মৃতি রোমন্থনের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, গত অক্টোবরে থুরিঞ্জিয়ার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ ‘এএফডি’কে ভোট দিয়েছে। সিরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদেরকে জার্মানিতে ডুকতে দেবার নীতির সমালোচনা থেকেই ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের কথা হলো, চ্যান্সেলর মার্কেল একনায়কের মতো দেশ চালান এবং তাদের মতামতকে কোন মূল্যই দেন না। বিয়র্ন হোক অভিযোগ করেন যে, আফ্রিকা থেকে আগত মানুষেরা জার্মানির সমাজকে কলুষিত করে ফেলছে। তার কথার ধরণ অনেকেই পছন্দ না করলেও তিনি যা বলছেন, সেগুলিকে যুক্তিযুক্ত বলছেন তারা। অনেকেরই ধারণা রয়েছে যে, জার্মানিতে যথেষ্ট গরীব মানুষ রয়েছে; সরকারের উচিৎ বাইরে থেকে আসা মানুষের পিছনে অর্থ ব্যয় না করা। তবে জার্মান গোয়েন্দারা শুধুমাত্র বিয়র্ন হোককে টার্গেট করার কথা বললেও ‘এএফডি’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দও উগ্রপন্থী বক্তব্যে পিছিয়ে নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা রাজনীতিবিদ আলেক্সান্ডার গল্যান্ড মন্তব্য করেন যে, জার্মান ফুটবল দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় বোয়াটেং খেলার মাঠে জার্মানির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হলেও জার্মানির অনেক মানুষই তাকে নিজেদের প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চাইবে না। তিনি আরও বলেছিলেন যে, শিশুদের চেহাড়া দেখে শরণার্থীকে জার্মানিতে ঢুকতে দেয়াটা ব্ল্যাকমেইলের শামিল। ২০১৭ সালে তিনি বলেন যে, তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ আইদান উজুগুজকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো উচিৎ। ২০১৬ সালে ‘এএফডি’র রাজনীতিবিদ ফ্রাউকা পেট্রি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, শরণার্থীদের থামাতে সীমান্ত পুলিশের দরকার হলে গুলি করা উচিৎ। বিয়াট্রিক্স ভন স্টর্ক আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে শরণার্থীদেরকে আক্রমণকারী হিসেবে আখ্যা দেন। ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যের ‘এএফডি’র প্রধান আন্দ্রেয়াস কালবিতজ ২০০৭ সালে গ্রীসে এক নিও নাজি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে স্বস্তিকা সংবলিত পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।

  
২০১৬ সালে জার্মান ডানপন্থীদের একটা সমাবেশ। উগ্র ডানপন্থী দল ‘এএফডি’ এখন জার্মান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল; তাদের রয়েছে লাখো সমর্থক। পুলিশি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই উগ্রপন্থী চিন্তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। স্বাধীনচেতা ইউরোপের কাছে কিছু রাজনীতিবিদদের উপর ধরপাকড়ের বিষয়টা মানুষের বাকস্বাধীনতার উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তা সমাজকে যে বিভক্ত করবে, তা নিশ্চিত।



যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, জার্মানির উগ্রপন্থী রাজনীতিবিদেরা জার্মানির স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাঝ থেকেই উঠে এসেছে। এদের অনেকেই সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল এঙ্গেলা মার্কেলের ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’এর সদস্য ছিল; কেউ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর; সরকারি কর্মকর্তা; বা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সাংবাদিক বা কলামিস্ট। জার্মান গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়েই এই উগ্রপন্থী চিন্তার আবির্ভাব ঘটেছে। ‘ডের ফ্লুগেল’এর নেতাদের নজরদারির মাঝে আনার কথা বলা হলেও পুরো ‘এএফডি’র নেতারাই তো প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে উগ্রপন্থী কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, ‘এএফডি’ এখন জার্মান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল; তাদের রয়েছে লাখো সমর্থক। পুলিশি কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই উগ্রপন্থী চিন্তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। স্বাধীনচেতা ইউরোপের কাছে কিছু রাজনীতিবিদদের উপর ধরপাকড়ের বিষয়টা মানুষের বাকস্বাধীনতার উপর হামলা বলে বিবেচিত হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে তা সমাজকে যে বিভক্ত করবে, তা নিশ্চিত।

আর জার্মানি কেন, বাকি ইউরোপেও ডানপন্থী চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে সহিংসতার সংখ্যা বেড়ে গেছে। উদাহরণসরূপ, মাস্ক পড়তে বলার কারণে কিছু বাসযাত্রীর হাতে এক বাস ড্রাইভারের প্রাণ গিয়েছে। ফরাসী ফুটবল দল প্যারিস সাঁ জার্মেই জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে যাবার পর রাস্তায় কিছু লোক ভাংচুর করে। বিভিন্ন শহরের মেয়ররাও জনগণকে মাস্ক পড়তে বলার কারণে হামলার শিকার হয়েছে। ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থী নেতা ম্যারিন লা পেন ৬ই সেপ্টেম্বর জনসমক্ষে এক ভাষণে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সরকার অপরাধের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর হতে পারছে না। আর ফ্রান্স ধীরে ধীরে আরও ‘হিংস্র’ হয়ে যাচ্ছে। লা পেন ২০১৭ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ম্যাক্রঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০২২ সালের নির্বাচনেও তিনি ম্যাক্রঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইছেন। তিনি মনে করছেন যে, ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো আর কেউই এখন ফ্রান্সে নেই। ২০১৭এর নির্বানের দ্বিতীয় ধাপে তিনি ৩৪ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়েছিলেন। লা পেনের অভিবাসন নীতি জার্মান ডানপন্থীদের মতোই। তিনি ঘোরতরভাবে মুসলিম বিদ্বেষী এবং শরণার্থীদের ফ্রান্সে ঢোকার যারপরনাই বিরোধী। ফ্রান্সে মুসলিম অভিবাসী আসা থামাতে তিনি ফ্রান্সের সীমানা বন্ধ করে দেবার কথা বলেন। একজন উগ্র ডানপন্থী নেতার জন্যে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে এক তৃতীয়াংশ ভোট অর্জন বলে দেয় যে, পুরো জাতির মাঝেই ডানপন্থী চিন্তা কতটা বাসা বেঁধেছে। জার্মানি এবং ফ্রান্সের চাইতেও ডানপন্থীরা বেশি শক্তিশালী ইতালিতে। সেখানে ডানপন্থী কোয়ালিশন ক্ষমতায়ও গিয়েছে। হাঙ্গেরিতেও ডানপন্থী ভিক্টর অরবান বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। গতবছর পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ডানপন্থীরা তাদের ভোট ৩৮ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে বাড়িয়ে নিয়েছে।

জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপে ডানপন্থীদের উত্থান শুধু ইউরোপিয় ইউনিয়নের ঐক্যের জন্যেই যে হুমকি তা নয়; ব্যক্তিস্বাধীনতায় কঠোরভাবে বিশ্বাসী ইউরোপিয়দের আদর্শিক অবস্থানকেও তা আঘাত করেছে। ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পুলিশি গোয়েন্দাগিরি চালনা করাটা সেই আঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে যে চিন্তার স্বাধীনতা থেকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মাঝে উগ্রপন্থী ধারণা বাসা বাঁধছে, সেই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজেদের আদর্শকেই খাঁচায় পুরতে হচ্ছে ইউরোপিয়দের। একইসাথে যে উগ্রপন্থী চিন্তাকে পুঁজি করে ডানপন্থীরা ইউরোপজুড়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে, তার পিছনে জনগণের সমর্থন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ধারাতেই উগ্রপন্থীরা ইউরোপে আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। সেই হিসেবে জার্মান পুলিশের উগ্রপন্থীদের টার্গেট করে চাপের মাঝে ফেলার চেষ্টাখানা যথেষ্টই অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রকে পুঁজি করে পরস্পরবিরোধী এই কার্যকলাপ ইউরোপের আদর্শিক সংকটেরই চিত্র, যা থেকে বের হবার কোন পথ কেউ দেখাতে পারছেন না।


2 comments:

  1. তার মানে অনেকটা ভারতের মতই অবস্থা

    ReplyDelete
  2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত নয়া বিশ্বব্যবস্থা গভীর সংকটে, নিজের জন্মস্থানেই শুধু নয়; করোনা পরবর্তী বিশ্বে প্রায় সব দিক দিয়ে, প্রতিটি ধাপে সংকটে।
    শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ, এই রকম লেখনির জন্য।

    ReplyDelete