Saturday 26 September 2020

ইরানের সাথে চীনের কৌশলগত চুক্তির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতখানি?

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়; কারণ চীনে একটা বড় বাজার এবং চীন বিভিন্ন পণ্যের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস। কেউই চীনকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছুক নয়। অপরপক্ষে চীনও এই অঞ্চলে ইরান এবং সৌদি গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাতে চীনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই চীন এখানে সকলকে ব্যালান্স করেই চলতে চাইবে।



সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে বিষয়টা সবচাইতে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। তবে এর মাঝে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পিছনে পড়ে যাচ্ছে, যা হলো ইরানের সাথে চীনের কৌশলগত চুক্তি। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর তেহরান সফরের সময় দুই দেশের মাঝে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জুলাই মাসে ‘ফাঁস হওয়া’ নথির উপর ভিত্তি করে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলে যে, ২৫ বছর মেয়াদী এই বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে ৪’শ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ইরানের জন্যে নতুন একটা জীবন দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। আর যদিও সেই চুক্তিতে সামরিক ব্যাপারে আলাদাভাবে কিছু বলা ছিল না, ইরানের বিরোধী নেতা ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এবং তার সমর্থকেরা বলতে থাকেন যে, চুক্তি মোতাবেক ইরান খুব সম্ভবতঃ পারস্য উপসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দ্বীপ চীনকে লিজ দিতে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও ‘ফক্স নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইরানে চীনের বিনিয়োগের কারণে ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের হাতে প্রচুর অর্থ যাবে এবং তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। একসাথে তা ইস্রাইল, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিরাপত্তাকে ব্যাহত করবে। অর্থাৎ ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থীরা উভয়েই ইরানে চীনের বিনিয়োগের বিরোধিতা করছেন।

এই চুক্তির ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা প্রিন্ট’ বলছে যে, সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইরানে ছুটে গিয়েছেন এটা নিশ্চিত করতে যে, ইরানে ভারতের চাবাহার সমুদ্রবন্দর প্রকল্প যেন চীনারা ব্যবহার করতে না পারে। ভারত এই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করেছে, যার মাঝে ছিল চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করা। তবে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের মাঝে ছিল চাবাহার থেকে তুর্কমেনিস্তানের সীমানা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা; যা বাস্তবায়িত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের হুমকির মুখে ভারত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারছে না; তাই ইরান চাইছে প্রকল্পটা নিজেরাই এগিয়ে নিতে। ভারতের ভয় হলো, চীনারা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। ব্যাপারটাকে আরও একধাপ এগিয়ে বৃহত্তর দ্বন্দ্বের অংশ হিসবে বলছেন কেউ কেউ। ‘আয়েল প্রাইস’ পত্রিকার এক লেখায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে, চাবাহার বন্দরে চীন এবং রাশিয়ার সহায়তায় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। আসলেই কি ইরান এবং চীনের এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে?

‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক ক্যারেন ইয়াং ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের কাছে চীন দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে উঠছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের উত্থান সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিচ্ছে, এই কথাগুলি প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তাদেরকে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকতে হবে, নতুবা চীনের সাথে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনেকে পুরোপুরি বাদ দেয়াটা একেবারেই অবাস্তব। তিনি বলছেন যে, চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর বিনিয়োগ প্রতিটা দেশই পেতে চাইছে; এবং ‘বিআরআই’এ যুক্ত হতে গিয়ে অঞ্চলিক একটা প্রতিযোগিতাও দেখা যেতে পারে। চীন এই প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে নেই; কিন্তু এটাকে বাইপাস করার পদ্ধতিও সে জানে না।

ভারতীয় মিডিয়া ‘স্ট্রাটেজিক নিউজ গ্লোবাল’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি বলেন যে, ইরানের সাথে চীনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের একটা দরকষাকষির সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন যে, মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় সৌদি আরবে চীনা পারমাণবিক বিনিয়োগের ব্যাপারে রিপোর্ট করে মার্কিন জনমতকে চীনের বিপক্ষে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে। একই সুরে ইরানে চীনের বিনিয়োগ বা লাদাখে ভারতের সাথে সীমান্ত দ্বন্দ্ব যে মার্কিন স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে, তা কেউ কেউ মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। তবে কামরান বোখারি বলছেন যে, চীনের এই বিনিয়োগগুলিকে তাদের ‘বিআরআই’এর অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। চীনারা পাকিস্তানে বড় বিনিয়োগ করছে, এবং একইসাথে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতেও বিনিয়োগ করছে। চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে অত্র অঞ্চল যদি স্থিতিশীল থাকে, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়। অর্থাৎ চীনা অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের অখুশি থাকার কথা নয়। তবে একইসাথে তিনি এও বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে দীর্ঘ মেয়াদে অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাব অনেক বেড়ে যাক।

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিও চীনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়; কারণ চীনে একটা বড় বাজার এবং চীন বিভিন্ন পণ্যের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য উৎস। কেউই চীনকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছুক নয়। অপরপক্ষে চীনও এই অঞ্চলে ইরান এবং সৌদি গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে অত্র অঞ্চলের রাজনৈতিক সংঘাতে চীনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই চীন এখানে সকলকে ব্যালান্স করেই চলতে চাইবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন উপস্থিতি কমে যাবার কারণে বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ইরানে চীনের বিনিয়োগকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিস্থাপন বা আঞ্চলিক হুমকি বলে দেখাতে চাইছে। একদিকে ওয়াশিংটনের কট্টরপন্থীরা যেমন চাইছে ব্যাপারটাকে আলোচনায় এনে চীনের বিরুদ্ধে শক্তি জড়ো করতে, অন্যদিকে ইরানের কট্টরপন্থীরা চাইছে এই চুক্তিকে জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়ে তেহরানের বর্তমান সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে স্বল্প মেয়াদে চিন্তিত নয়; কারণ অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে চীনা প্রভাব বৃদ্ধিকেও সে দেখতে চায় না।



2 comments:

  1. সত্যিই কি চিন, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক কার্য্যকলাপে জড়াতে চাইছে না?
    চিনের expansionism (border issue) তে দেখে মনে হচ্ছে, যে তারা এখন তাদের আগের অবস্থান ( সামরিক বা রাজনৈতিক হস্থক্ষেপ) থেকে সরে আসছে বা এসেছে।
    আপনার অভিমত জান্তে চাই ।
    thank you.

    ReplyDelete
    Replies
    1. মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের কি স্থলসীমানা রয়েছে? মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের সরকারের উপর চীনের রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বা কোন দেশের সরকারকে চীন টিকিয়ে রাখার বা ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা রাখে বা কোনকালে চেষ্টা করেছে?

      ভারতের উপর চীনের অর্থনৈতিক নির্ভরতা কতটুকু? চীন কবে ভারতের সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে বা দিল্লীতে তাদের নিজেদের লোক বসাবার চেষ্টা করেছে?

      এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজুন। আশা করি বুঝতে পারবেন যে, চীন রাজনৈতিকভাবে কতটা প্রভাব রাখে। পশ্চিমা দেশগুলির ব্যাপারে উপরের সবগুলি প্রশ্ন প্রযোজ্য। এই সবগুলি দেশের ভিত্তিও তাদেরই তৈরি করা; তাদের সংবিধানও তাদেরই লিখে দেয়া। এসব কোন কর্মকান্ডেই চীনের অংশীদারিত্ব নেই; সামনের দিনগুলিতেও হবার সম্ভাবনা নেই।

      Delete