Saturday 5 September 2020

সৌদি পাকিস্তান টানাপোড়েন মুসলিম নেতৃত্বের বিভাজনকেই দেখিয়ে দেয়

০৫ই সেপ্টেম্বর ২০২০
   

কাশ্মির ইস্যুতে অনৈক্য মুসলিম দেশগুলির পারস্পরিক সাংঘর্ষিক জাতীয় স্বার্থের বেড়াজালে আটকে রয়েছে। সৌদি নেতৃত্বের দেশগুলির সাথে তুর্কি নেতৃত্বের দেশগুলির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে, মুসলিম নেতৃত্বের কাছে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন বা উইঘুরের মতো সমস্যাগুলি ছোট হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা পাওয়ায় পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের সাথে মনোমালিন্য কাটিয়ে ওঠা সহজতর হবে। তবে কাশ্মির ইস্যুতে চীন, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার সমর্থন পেলেও এখানেও যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে না, তার নিশ্চয়তা পাকিস্তানের কাছে নেই। আদর্শগত অবস্থান নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এগুচ্ছে পাকিস্তানসহ সকলে। অপরদিকে কোন পথে এগুলে কাশ্মির সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে, সেটার উত্তরও পাকিস্তানের কাছে নেই।

 

পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক বেশ গভীর বলেই সকলে জানে, কিন্তু তারপরেও হঠাত করেই সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন দেখা দেয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন পাকিস্তানের পরররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী গত ৪ঠা অগাস্ট পাকিস্তানের একটা টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি আবারও ‘ওআইসি’কে আহ্বান করছেন যাতে তারা কাশ্মির ইস্যুতে কাউন্সিল অব ফরেন মিনিস্টার্সএর একটা আলোচনার ডাক দেয়। যদি ‘ওআইসি’ সেটা করতে ব্যর্থ হয়, তবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বলতে বাধ্য হবেন যে, তিনি যেন এমন একটা আলাদা আলোচনার ডাক দেন, যেখানে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে দাঁড়াবে এমন মুসলিম দেশগুলি যোগ দেয়। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের নিজস্ব কিছু অবস্থান রয়েছে যেগুলি ‘ওআইসি’ এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলিকে বুঝতে হবে। কোরোশীর এই বক্তব্যের পরপরই ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলে যে, সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্যে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা স্থগিত করেছে। একইসাথে তারা পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ ফেরত দিতে বলে। চীনাদের জরুরি সহায়তায় পাকিস্তান এই ঋণ ফেরত দেয়। এই ঋণ ২০১৮ সালের নভেম্বরে দেয়া হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভয়াবহ রকমের কমে গিয়েছিল। সৌদি আরব থেকে তেল কেনার মূল্য দেরিতে পরিশোধ করার ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে যে চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তিও সৌদি আরব নবায়ন করা বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা যায়। ১৭ই অগাস্ট পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া সৌদি আরব সফরে গেলে পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা বলে যে, অনেকেই মনে করছেন যে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ওআইসি’র আরব নেতৃত্বের সমালোচনা এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারটার সাথে সেনাপ্রধানের এই সফরের সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই সফরকে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবেই আখ্যা দেয়। এর কয়েকদিন পরেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে কাশ্মিরের ব্যাপারে ‘ওআইসি’র ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশীও সাংবাদিকদের বলেন যে, কাশ্মির ইস্যুতে ‘ওআইসি’ বহু রেজোলিউশন পাস করেছে, যার ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। আর সেই ব্যাপারগুলি পাকিস্তানের অবস্থানের সাথে মিল রেখেই হয়েছিল। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেন যে, পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের কোন মতপার্থক্য নেই। এতো অল্প সময়ের মাঝে পরস্পরবিরোধী এই খবরগুলির গুরুত্ব আসলে কোথায়?

সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মাঝে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। গত বছর দুই দশের মাঝে বাণিজ্য ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার; যার মাঝে ৭৪ শতাংশই ছিল সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানের তেল আমদানি। পাকিস্তানের এক চতুর্থাংশ তেল আসে সৌদি আরব থেকে। এছাড়াও প্রায় ২৫ লক্ষ পাকিস্তানি সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছে; যাদের কাছ থেকে পাকিস্তানের মোট রেমিট্যান্স আয়ের ৩০ শতাংশ আসে। অপরদিকে সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীর গঠন এবং প্রশিক্ষণের পিছনে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তথাপি কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরবের পক্ষে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াটা অতটা সহজ নয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারতের সাথে সৌদি আরবের বার্ষিক বাণিজ্য এখন প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরব এতবড় বাণিজ্যকে ছেড়ে দিয়ে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিতে চাইবে না। ভারতের সাথে সৌদিদের সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের অসন্তোষ থাকলেও সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের দরকষাকষির সুযোগ খুব কমই রয়েছে। অন্ততঃ পরবর্তীতে সৌদিদের ব্যাপারে পাকিস্তানের সুর পাল্টে ফেলার ব্যাপারটা সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউট’এর ফেলো মাদিহা আফজাল বলছেন যে, দুই দেশের নির্ভরশীলতার মাঝে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাগুলি বেশ অদ্ভূতই ঠেকেছে। তবে এতে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এটা এর আগেও একবার হয়েছে, যখন গতবছর কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং পাকিস্তান আলাদাভাবে ‘ওআইসি’কে বাইপাস করে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্ব নেবার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির দিকে এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেই বৈঠক থেকে শেষ মুহুর্তে নিজের নাম সড়িয়ে নিয়ে সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’এর অধীনে সৌদি আরব তুরস্ক, ইরান এবং কাতারকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হিসেবে দেখছে; পাকিস্তানের সাথে এই দেশগুলির সম্পর্কোন্নয়নও তাই সৌদি আরবের কাছে ভালো ঠেকছে না।

‘উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্স’এর দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলমান ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, পাকিস্তানের পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন হচ্ছে যে, পাকিস্তানের কাশ্মির নীতি কাজ করছে। এই প্রচেষ্টা যদি ফলাফল না নিয়ে আসে, তাহলে তারা কি করবে? ইসলামাবাদের ‘কায়েদ এ আজম ইউনিভার্সিটি’র এসিসট্যান্ট প্রফেসর রাজা কায়সার আহমেদ বলছেন যে, এখন পর্যন্ত কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তান শুধুমাত্র চীন, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়াকে পাশে পেয়েছে। এর থেকে বের হতে পাকিস্তানের আরও আক্রমণাত্মক কূটনীতিতে যেতে হবে। কুগেলমান বলছেন যে, সৌদিদের সাথে সমস্যা খুব সহজেই মুছে যাবে না; তবে চীন এবং আরবের বাইরে অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান।

কাশ্মির ইস্যুতে অনৈক্য মুসলিম দেশগুলির পারস্পরিক সাংঘর্ষিক জাতীয় স্বার্থের বেড়াজালে আটকে রয়েছে। সৌদি নেতৃত্বের দেশগুলির সাথে তুর্কি নেতৃত্বের দেশগুলির দ্বন্দ্ব এতটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে, মুসলিম নেতৃত্বের কাছে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন বা উইঘুরের মতো সমস্যাগুলি ছোট হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে চীনের কাছ থেকে ব্যাপক সহায়তা পাওয়ায় পাকিস্তানের জন্যে সৌদি আরবের সাথে মনোমালিন্য কাটিয়ে ওঠা সহজতর হবে। তবে কাশ্মির ইস্যুতে চীন, তুরস্ক বা মালয়েশিয়ার সমর্থন পেলেও এখানেও যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবে না, তার নিশ্চয়তা পাকিস্তানের কাছে নেই। আদর্শগত অবস্থান নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এগুচ্ছে পাকিস্তানসহ সকলে। অপরদিকে কোন পথে এগুলে কাশ্মির সমস্যার সত্যিকার সমাধান হবে, সেটার উত্তরও পাকিস্তানের কাছে নেই।

1 comment:

  1. হায় রে মুসলিম বিশ্ব, তোদের রাষ্ট্রগুলি পরিচালনা করছে মুনাফিকরা। এ থেকে আশু মুক্তির ও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

    ReplyDelete