Saturday 12 September 2020

পশ্চিম আফ্রিকার মালির অভ্যুত্থান... ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রভাব হারাচ্ছে ফ্রান্স

১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২০

‘ফ্রাঙ্কোফোন’ প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ মালির রাজনৈতিক সমস্যায় ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার ভূমিকা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। মালির অভ্যুত্থান নেতারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ধারণে ‘এংলোফোন’ নাইজেরিয়ার অবস্থানই যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব হবার ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।

১৮ই অগাস্ট পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে। ১১ই সেপ্টেম্বর মালির সামরিক সরকারের নিযুক্ত ২০ সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নতুন এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করে, যার মেয়াদ হবে দুই বছর; প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করবে সেনাবাহিনী। আর প্রেসিডেন্ট নিজে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব করা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। এই প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টকে সামরিক বা বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মালির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বেসামরিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং গ্রুপের কয়েক’শ সদস্যকে সেনাবাহিনী রাজধানী বামাকোতে তিনদিনের এক আলোচনায় ডাকে। এই আলোচনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় এক চার্টারে বলা হয় যে, মালির সমস্যার গভীরতার কথা চিন্তা করেই দুই বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’ মালির সেনাবাহিনীকে ১৭ই সেপ্টেম্বরের মাঝে একজন প্রেসিডেন্ট এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর নাম প্রকাশ করার জন্যে সময় বেঁধে দেয়। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, বামাকোর আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছেন, তারা দু’টা ব্যাপারে বেশ বিভক্ত। প্রথমতঃ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে; আর দ্বিতীয়তঃ সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা এক্ষেত্রে কি হবে। সেনাবাহিনী প্রথমে প্রস্তাব করেছিল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হবে তিন বছর। অর্থাৎ সেনাবাহিনী হয়তো তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা কোন ছাড় যে দেয়নি তা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পুরো পশ্চিম আফ্রিকার উপর মালির রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব কতটুকু হবে, সেটাই হবে ভূরাজনৈতিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

মালির সেনাবাহিনীর একাংশ এমন একটা সময়ে ক্ষমতা দখল করে, যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বুবাকার কেইতার বিরুদ্ধে এক মাস ধরে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা অভিযোগ আনা হয়েছিল। মালির উত্তরাংশে ২০১২ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে; এবং এই সংঘাত ইতোমধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ নিজের, বুরকিনা ফাসো এবং আইভোরি কোস্টে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে পুরো অঞ্চল অস্থির হওয়া ছাড়াও মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। মালির এই রাজনৈতিক সমস্যা অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করবে, এই যুক্তিতেই অঞ্চলিক জোট মালির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে।

মালিতে মাসব্যাপী সহিংস বিক্ষোভের মাঝেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটা আলোচনায় আসতে থাকে। বিরোধী ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়। সমস্যা সমাধানে ‘একোওয়াস’এর একটা প্রতিনিধিদল জুলাইএর মাঝামাঝি মালি রওয়ানা দেয়। নাইজেরিয়ার পত্রিকা ‘প্রিমিয়াম টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে ‘একোওয়াস’এর কমিশন প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ কাসি ব্রুএর স্বাক্ষরিত এক চিঠির বরাত দিয়ে বলা হয় যে, নাইজেরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনকে এই মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। জনাথন তার মিশনের মাধ্যমে একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রস্তাব করেন, যেখানে বিরোধী দল এবং বেসামরিক ব্যক্তিত্বরাও থাকবেন। তবে জনাথনের প্রস্তাবে ‘জুন ফাইভ মুভমেন্ট’ রাজি হয়নি। জনাথনের ব্যর্থতার পর ‘একোওয়াস’এর পাঁচটা দেশ নাইজেরিয়া, ঘানা, আইভোরি কোস্ট, নিজের এবং সেনেগালের প্রেসিডেন্টরা মালিতে গিয়ে উপস্থিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেইতা যেমন ক্ষমতা ছাড়তে ছিলেন নারাজ, তেমনি বিরোধী গ্রুপের নেতা ইব্রাহিম ডিকোও ছিলেন নিজের অবস্থানে অটল। ‘একোওয়াস’এর এই প্রচেষ্টাও হয় ব্যর্থ।

মালির সমস্যার পিছনে শক্তিশালী দেশগুলির বড় ভূমিকা রয়েছে। মালির গৃহযুদ্ধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে দেশটার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স। মালিতে ফ্রান্সের ৫ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে। অপরদিকে দেশটার রাজনৈতিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে আঞ্চলিক সংগঠন ‘একোওয়াস’। এই সংস্থার ১৫টা সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে ৮টা দেশই ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ; যেগুলির রাষ্ট্রীয় ভাষা ফরাসী; এগুলিকে বলা হয় ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ দেশ। চারটা ব্রিটেনের উপনিবেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা একটা রাষ্ট্রের অফিশিয়াল ভাষা ইংরেজি; এগুলিকে বলা হয় ‘এংলোফোন’ দেশ। বাকি দু’টা দেশ পর্তুগালের উপনিবেশ হওয়ায় তাদের অফিশিয়াল ভাষা পুর্তুগীজ। তবে জনসংখ্যার দিক থেকে ‘একোওয়াস’এর প্রায় ৩৫ কোটি জনগণের মাঝে ইংরেজি ভাষাভাষি দেশগুলির জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। এর মাঝে আবার এক নাইজেরিয়ার জনসংখ্যাই প্রায় ২০ কোটি। অর্থনীতির আকারের দিক থেকেও পুরো অঞ্চলে নাইজেরিয়ার ধারেকাছেও কোন দেশ নেই। ‘একোওয়াস’এর মোট প্রায় ৬’শ ৭৫ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির মাঝে নাইজেরিয়ার একার জিডিপিই প্রায় ৫’শ বিলিয়ন ডলার। ‘একোওয়াস’এর মাঝে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার অবস্থান অতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে সংস্থার উপর ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম এবং ফ্রান্স ‘একোওয়াস’এর ব্যাপারে সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ‘একোওয়াস’এর মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে নাইজেরিয়ার নেতৃত্ব নেয়াকে ফ্রান্স তার প্রাক্তন উপনিবেশগুলির উপর ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হিসেবেই দেখেছে।

‘মিডল ইস্ট মনিটর’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, পশ্চিম আফ্রিকার মূল সমস্যা হলো ফ্রান্স। যতদিন ফ্রান্স আফ্রিকার দেশগুলির উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ না সরিয়ে নেবে, ততদিন আফ্রিকার সমস্যাগুলির সমাধান হবে না। এই মন্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যাবে আফ্রিকার দেশগুলির মুদ্রার দিকে তাকালেই। পশ্চিম আফ্রিকার ৮টা এবং মধ্য আফ্রিকার ৬টা দেশের মুদ্রা ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’, যা ফরাসী মুদ্রা ফ্রাঙ্কের সাথে যুক্ত; যেকারণে এই দেশগুলির অর্থনীতি বহুলাংশেই ফ্রান্সের উপর নির্ভরশীল। নাইজেরিয়ার নেতৃত্বে ‘একোওয়াস’এর চাপের মুখে ২০১৯এর শেষের দিকে পশ্চিম আফ্রিকার ৮টা ফরাসী ভাষাভাষী দেশ ২০২০ সাল থেকে ‘সিএফএ ফ্রাঙ্ক’ থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। তবে ফ্রান্স এর মাধ্যমে তার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবার পরিস্থিতিই দেখছে। ফরাসী নেতৃত্বে দীর্ঘ আট বছর ধরে মালির যুদ্ধ চলতে থাকার ফলে অত্র অঞ্চলে ফ্রান্সের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ‘ফ্রাঙ্কোফোন’ প্রাক্তন ফরাসী উপনিবেশ মালির রাজনৈতিক সমস্যায় ‘এংলোফোন’ প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়ার ভূমিকা অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করছে। মালির অভ্যুত্থান নেতারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নির্ধারণে ‘এংলোফোন’ নাইজেরিয়ার অবস্থানই যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখন পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব হবার ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।


2 comments:

  1. অনেক কিছু স্পস্ট হয়ে গেল এই পোষ্ট টি পড়ে, বিশেষ করে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ভূমিকা প্রসংগে। তবে আমার ধারনা ইউরোপিয়ানরা সরে আসলেও মাথামোটা আফ্রিকানরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করেই যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য।

      যেহেতু অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তাহলে বাকি কিছু ছোট ব্যাপারও পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভালো। প্রথমতঃ ইউরোপিয়দের আফ্রিকা ছেড়ে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই; যদিনা পশ্চিমা পুঁজিবাদ পুরোপুরি ধ্বসে যায়। ঔপনিবেশিকেরা একজন অপরজনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ফ্রান্স দুর্বল হচ্ছে বিধায় ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র তার স্থান নিতে চাইছে। দ্বন্দ্বটা সেখানেই।
      দ্বিতীয়তঃ আফ্রিকার দেশগুলি কৃত্রিম রাষ্ট্র। এগুলি তৈরি করেছে ইউরোপিয়রা; তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যে। ইউরোপিয়রা আদর্শিক দিক থেকে দুর্বল হবার সাথেসাথে এই দেশগুলির কৃত্রিম সীমানাও দুর্বল হচ্ছে। মোটকথা, পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আফ্রিকার এই দেশগুলির স্থানে নতুন কোন আফ্রিকা তৈরি হবে। হয়তো উপনিবেশিকদের আগমণের আগের আফ্রিকায় ফেরত যেতে পারে। আফ্রিকার সকল সংঘাত পশ্চিমাদের তৈরি করা; তারা আসার আগে আফ্রিকাতে এতো কলহ ছিল না। বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকা বেশ সম্পদশালী ছিল।

      Delete