Saturday 29 October 2022

ফ্রান্স ও জার্মানি… বন্ধু, না প্রতিযোগী?

২৯শে অক্টোবর ২০২২
 
যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে জার্মানির দূরত্ব বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিলেও, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি প্যারিস ও বার্লিনকে এক করছে। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে এক হলেও ইইউএর সমন্বিত নীতি সহজ নয়। কারণ ইউরোপের এই দুই বড় দেশের স্বার্থ যে ভিন্নমুখী, তা দুই দেশের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিষ্কার।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো ইউরোপ। ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে আলোচনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল উৎসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে, দুই নেতা একমত হয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ইউরোপকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ।তারা আলোচনা করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন এক্ট’এর মাধ্যমে কর্পোরেটদের উপর থেকে কর কমিয়ে দিয়ে এবং জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়ে নিজ দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইছে। শুধু তাই নয়; এই আইনের মাধ্যমে মার্কিন ভোক্তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা ইলেকট্রিক গাড়ি কেনে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইউরোপের গাড়ি বিক্রি করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

২৬শে অক্টোবর ফরাসি টিভি চ্যানেল ‘ফ্রান্স ২’এর সাথে সাক্ষাতে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেন যে, ইইউএর উচিৎ ইউরোপের ভোক্তারা যাতে ইউরোপে তৈরি জিনিস কেনে, সেটা অনুপ্রাণিত করে আইন প্রণয়ন করা এবং ইউরোপিয় কোম্পানিগুলির জন্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা। তিনি প্রশ্ন করেন যে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই যখন নিজেদের বাজারকে সুরক্ষা দিচ্ছে, তখন ইইউ কেন মুক্ত বাজার থাকবে? এক সপ্তাহ আগে জার্মান চ্যান্সেলরও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের নতুন আইন নিয়ে ‘গভীরভাবে’ কথা বলতে হবে। তবে ‘পলিটিকো’ বলছে যে, ইইউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে ইউরোপ এবং আমেরিকার মাঝে নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। একইদিনে জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানি ‘বিএএসএফ’ জার্মানিতে তাদের কর্মকান্ড কমাবার এবং কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দেয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় জার্মানিতে গ্যাসের মূল্য ছয় গুণ। তবে ইইউ কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান যে, ইইউ যে পদক্ষেপই নিক না কেন, সেটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ‘ডব্লিউটিও’র আইনের সাথে যেতে হবে। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ হবে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ের মতো আবারও বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে পতিত হওয়া।

তবে দুই দেশের এই আকাত্মতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি; বিশেষ করে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতির বিষয়ে ফ্রান্স এবং জার্মানির বিরোধ এখন পরিষ্কার। অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ফ্রাঙ্কো-জার্মান মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক হঠাৎ করেই আগামী বছরের জানুয়ারিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে যখন ফ্রান্স ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দরকষাকষি করতে চাইছে, তখন সেই স্বার্থের দ্বন্দ্বই জার্মানি এবং ফ্রান্সের সম্পর্কের মাঝে দাগ টেনেছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি সংকটের মাঝে জার্মানি গ্যাসের উপরে ১’শ ৯৭ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে। এবং একইসাথে ইইউএর সদস্য দেশগুলি যখন গ্যাসের মূল্যের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কথা বলেছে, তখন জার্মানি তা এড়িয়ে গেছে। এছাড়াও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে সমঝোতা নিয়েও জার্মানির সাথে ফ্রান্সের টানাপোড়েন চলছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে জার্মানি তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিলেও তা ইউরোপিয় নেতাদের খুশি করতে পারেনি। কারণ এই বাজেট বৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপিয় বা ফরাসি অস্ত্র না কিনে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান এবং ‘প্যাট্রিয়ট’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনছে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইইউএর মূল চালিকাশক্তি হলো ফ্রান্স এবং জার্মানি। এই দুই দেশের মাঝে বিরোধ ইইউএর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্যারিসে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও বিশ্লেষকদেরকে খুশি করতে পারেনি। জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফ্রাঙ্কো জার্মান ইন্সটিটিউট’ বা ‘ডিএফআই’এর ডেপুটি ডিরেক্টর স্টেফান সাইডেনডরফ ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, যদিও দুই দেশের মন্ত্রীসভার বৈঠকে খুব বড় কোন সিদ্ধান্ত হয় না, তথাপি এই বৈঠক ইইউএর কর্মকান্ড ঠিকভাবে চলার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৩ সালে প্রথম বৈঠকের পর থেকে ২০২২ সাল ছাড়া আর কখনোই এই বৈঠক বাতিল করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং মনে করতে পারে যে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করবে। কিন্তু ইউরোপের ব্যাপারটা আলাদা। এখানে কেউই অপরের কথা চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ইইউএর সবচাইতে বড় দুই দেশ ফ্রান্স ও জার্মানি আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়; যা বাকি ইউরোপিয় দেশগুলি অনুসরণ করে।

‘ডয়েচে ভেলে বলছে যে, জার্মানি জ্বালানির ব্যাপারে যে ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে, তা ফ্রান্সকে জানানোটা ছিল একটা সাধারণ ভদ্রতা; কারণ এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। অপরদিকে ফ্রান্স স্পেনের সাথে গ্যাস পাইপলাইনের একটা চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে বার্সিলোনা থেকে মার্সেই পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফ্রান্স ও স্পেনের মাঝে আরেকটা প্রকল্প বাইপাস করা হলো, যা পীরেনিজ পর্বতের মাঝ দিয়ে ফ্রান্স হয়ে জার্মানি পর্যন্ত যেতো। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানিসহ ন্যাটোর ১৫টা দেশ ‘ইউরোপিয়ান স্কাই শিল্ড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘ইএসএসআই’ নামে একটা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমতে পৌঁছায়। ফ্রান্সকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ফ্রান্স ইতালির সাথে যৌথভাবে ‘মামবা’ নামে একটা যৌথ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ডেভেলপ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে জার্মানির দূরত্ব বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিলেও, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি প্যারিস ও বার্লিনকে এক করছে। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে এক হলেও ইইউএর সমন্বিত নীতি সহজ নয়। কারণ ইউরোপের এই দুই বড় দেশের স্বার্থ যে ভিন্নমুখী, তা দুই দেশের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিষ্কার। স্টেফান সাইডেনডরফ বলছেন যে, জার্মানি চাইছে ইউরোপের ছোট দেশগুলিকে নিজের পক্ষে এনে ফ্রান্সকে বাইপাস করতে। অপরদিকে ফ্রান্স চাইছে যে, জার্মানি ফ্রান্সের নীতির সাথে একমত পোষণ করে ইউরোপের মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধি করুক। ম্যাক্রঁ পুরো ইউরোপের একটা বাজেট, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং কর ব্যবস্থার ব্যাপারে বলছেন। বার্লিনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’এর সিনিয়র ফেলো রনইয়া কেমপিন ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ম্যাক্রঁ সর্বদাই ইইউএর বর্ধিতকরণের বিরোধিতা করেছেন। তিনি ইইউকে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধির পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন। অপরদিকে জার্মানি মনে করেছে ইইউএর বর্ধিতকরণের মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

No comments:

Post a Comment