Wednesday 2 November 2022

সুইসাইড ড্রোন … এটাই কি যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

০২রা নভেম্বর ২০২২
 
সুইসাইড ড্রোনগুলির অধিকাংশেরই টার্গেট ছিল ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনা। এই হামলার ফলে শীতকাল আসার ঠিক আগেআগেই ইউক্রেনের শহরগুলিতে জ্বালানি ও খাবার পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। বেসামরিক টার্গেটের উপর হামলা করে প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টাটা পশ্চিমা যুদ্ধচিন্তারই ফসল; যা নতুন নয়। এই লক্ষ্যের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ চিন্তার কারণেই এর আকর্ষণ এখনও দুর্নিবার।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের শহরগুলির উপরে রুশ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াগুলি ব্যাপক সরব রয়েছে। রাশিয়া এবং ইরান অস্বীকার করলেও রুশদের ব্যবহৃত ‘কামিকাজি’ বা ‘সুইসাইড’ ড্রোনগুলি যে মূলতঃ ইরানের সরবরাহ করা ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন, সেব্যাপারে অনেকেই একমত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন যে, এই ড্রোনগুলি রাশিয়া ইরান থেকে কিনলেও সেগুলির গাইড্যান্স সিস্টেমকে তারা নিজেদের সুবিধামত পরিবর্তন করে নিয়েছে। এই ড্রোনগুলি ছেড়ে দেয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেটের এলাকায় পৌঁছে টার্গেটের কাছাকাছি উড়তে থাকে এবং নিশ্চিত হবার পরে টার্গেটের উপর আত্মঘাতী হামলা করে। ‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বেশ ছোট আকৃতির এই ড্রোনগুলি প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কেজি ওয়ারহেড বহণ করে প্রায় ২ হাজার কিঃমিঃ দূরত্বের টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম।

তবে ইউক্রেনিয় এবং রুশ উৎস থেকে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, এই সুইসাইড ড্রোনগুলির অধিকাংশেরই টার্গেট ছিল ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনা; বিশেষ করে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সেতু, রাস্তা ও রেল নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সেবা ও স্থাপনা। এই হামলার ফলে শীতকাল আসার ঠিক আগেআগেই ইউক্রেনের শহরগুলিতে জ্বালানি ও খাবার পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। আসন্ন শীতে ইউক্রেনের বেশিরভাগ মানুষকেই বাড়িতে হীটার ছাড়া বাস করতে হবে। সরকার মানুষকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে নির্দেশ দিয়েছে। আর জ্বালানি সরবরাহে সংকটের কারণে ইউক্রেন সরকার দেশের বাইরে থাকা ইউক্রেনিয়দেরকে দেশে ফিরতে নিষেধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একদিকে সুইসাইড ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেট নির্ধারণ করা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে।

‘কার্নেগি কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো আর্থার হল্যান্ড মিশেল ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, খুবই কম খরচে তৈরি ছোট্ট এই ড্রোনগুলি ভূমির খুব কাছ দিয়ে ওড়ে বলে এগুলি সহজে রাডারে ধরা পড়ে না এবং একারণে এগুলির অনেকগুলিই টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। প্রচলিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত বিমান হামলা ঠেকাতে অনেক সময় ধরে প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে পেরেছে। সেই তুলনায় ড্রোনের হুমকিটা অনেক নতুন। বেশিরভাগ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাই এগুলিকে খুঁজে বের করতে বা ভূপাতিত করতে ডিজাইন করা হয়নি। ইউক্রেন এই ড্রোনগুলির বেশ কয়েক’শ ভূপাতিত করলেও সেগুলিকে ধ্বংস করার খরচ অত্যধিক বেশি ছিল। কয়েক হাজার ডলারের একটা ড্রোনকে ধ্বংস করতে মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আর ইউক্রেন রুশদের দখল করা ভূমি যতই পুনরুদ্ধার করুক না কেন, দূরপাল্লার হবার কারণে এই ড্রোনগুলি ইউক্রেনের যেকোন স্থানে হামলা করতে সক্ষম হবে। আর যতক্ষণ ইউক্রেনিয়রা এই ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করার সাশ্রয়ী কোন পদ্ধতি বের করতে না পারবে, ততক্ষণ এগুলি যুদ্ধের উপরে অনেক বড় প্রভাব রাখবে। এই অস্ত্রটার ধরণটাই এমন যে, এগুলি বিশ্বব্যাপী জনমতের উপরে একটা মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে।

 
রাশিয়া এবং ইরান অস্বীকার করলেও রুশদের ব্যবহৃত ‘কামিকাজি’ বা ‘সুইসাইড’ ড্রোনগুলি যে মূলতঃ ইরানের সরবরাহ করা ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন, সেব্যাপারে অনেকেই একমত হয়েছেন। আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের সুইসাইড ড্রোনের কার্যক্ষমতা ইতোমধ্যেই অনেকেই প্রভাবিত করছে তাদের সমরচিন্তাতে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ইউক্রেনে ব্যবহৃত সুইসাইড ড্রোনগুলি সিরিয়ার যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেই যুদ্ধের ফলেই এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির কাছ থেকে ড্রোন কিনতে না পেরে অনেক দেশই নিজস্ব ড্রোন ডেভেলপ করতে শুরু করেছে। এর মাঝে তুরস্ক সকলের চাইতে এগিয়ে রয়েছে। ‘আল জাজিরা’কে দেয়া এক সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটি’র ‘স্কার স্কুল অব পলিসি এন্ড গভর্ন্যান্স’এর ফেলো জাকারি কেলেনবর্ন বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ দিয়েছে যে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলিও যুদ্ধে ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার করবে। এগুলির সামরিক ব্যবহার সকলের সামনে উন্মুক্ত হবার কারণে এই দেশগুলি চিন্তা করবে যে, এগুলিকে কিভাবে আরও উন্নত করা যায় এবং অন্যান্য কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে এগুলিকে আরও কর্মক্ষম করা যায় বা টার্গেটিং কিভাবে আরও ভালো করা যায়।

বিংশ শতকের যুদ্ধের ইতিহাসে শত্রুপক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের উপরে ব্যাপক বোমাহামলার উদাহরণ রয়েছে অনেক। মূলতঃ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ফলগুলি ব্যবহার করে এধরণের যুদ্ধচিন্তার জন্ম দিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা উপনিবেশ থেকে সৃষ্ট নতুন জাতিরাষ্ট্রগুলিও এধরণের চিন্তাকে আলিঙ্গন করতে শুরু করে। ‘জেরুজালেম পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনার উপর রুশদের ড্রোন হামলাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘কারপেট বম্বিং’এর সাথে তুলনা করা হয়। ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনী সেই বোমা হামলাকে ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বিং’ বা কৌশলগত বোমাহামলা বলে আখ্যা দিলেও এর মাধ্যমে মূলতঃ বেসামরিক নাগরিকই হতাহত হয়েছে। এছাড়াও রুশদের ড্রোন হামলা অনেকটাই ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ে ‘শহরের যুদ্ধ’এর মতো; যখন উভয় দেশই একে অপরের শহরের উপরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় রুশদের এই হামলাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ‘ভি-১’ ‘ফ্লাইং বম্ব’ বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানরা ব্রিটিশ শহরগুলির উপরে নতুন ডেভেলপ করা এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে; যা কিনা পাইলটবিহীন জেট বিমানের মতো এবং যা টার্গেটের উপর আত্মঘাতী হামলা করে। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর প্রফেসর মাইকেল ক্লার্ক ব্রিটেনের ‘দ্যা টাইমস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মাত্র আড়াই মাস আগে প্রায় হেরে যাওয়া জার্মানির ড্রেসডেন শহরের বেসামরিক মানুষের উপরে মিত্র বাহিনীর মারাত্মক বিমান হামলা থেকে শুরু করে ভিয়েতনামে মার্কিন বোমা হামলা পর্যন্ত ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বিং’ আখ্যা দেয়া হামলাগুলি ভালো কোনো ফলাফল বয়ে আনেনি।

আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের সুইসাইড ড্রোনের কার্যক্ষমতা ইতোমধ্যেই অনেকেই প্রভাবিত করছে তাদের সমরচিন্তাতে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো আলরিকা ফ্রাঙ্কা ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, রুশ সুইসাইড ড্রোনগুলি ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও দুর্বল করে ফেলছে। তবে বেসামরিক টার্গেটের উপর হামলা করে প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টাটা পশ্চিমা যুদ্ধচিন্তারই ফসল; যা নতুন নয়। এই লক্ষ্যের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ চিন্তার কারণেই এর আকর্ষণ এখনও দুর্নিবার।

No comments:

Post a Comment