Sunday 9 October 2022

ক্রিমিয়ার কার্চ সেতুর উপর হামলার গুরুত্ব কতখানি?

০৯ই অক্টোবর ২০২২
 
কার্চ সেতুর উপর হামলা যা দিয়েই করা হোক না কেন, এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক অপারেশন। আর ইউক্রেনিয়রা এই হামলার ফল কতটা ভোগ করতে পারবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর। পশ্চিমা সরঞ্জামের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও ইউক্রেনের সেনাদেরকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তারা রুশ সেনাদের চাইতে অধিকতর দক্ষ।

০৮ই অক্টোবর রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কার্চ সেতুর একাংশ এক হামলায় ধ্বসে পড়ে। সড়কপথের দু’টা লেনের মাঝে একটা লেনের তিনটা স্প্যান দু’জায়গায় পানিতে পড়ে যায়। একইসাথে এই সেতুর সমান্তরালে রেলসেতুর উপর দিয়ে চলা রেলগাড়ির কয়েকটা তেলের ট্যাঙ্কারে আগুন লেগে যায়; যা পরের দিন পর্যন্ত চলে এবং সেতুর বেশ খানিকটা এতে পুড়ে যায়। রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে যে, এই ধ্বংসযজ্ঞ খুব সম্ভবতঃ একটা ট্রাক বোমার মাধ্যমে ঘটানো হয়। সকলেই এই আক্রমণের জন্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকেই সন্দেহ করলেও ইউক্রেন সরকার এই হামলার জন্যে দায় স্বীকার করেনি। তবে ইউক্রেনের জনগণ এই হামলাকে উৎসব হিসেবে পালন করছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি সোশাল মিডিয়াতে এক ভিডিও বার্তায় ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলেন যে, ইউক্রেনের আকাশে ঝলমলে সূর্য থাকলেও ক্রিমিয়ার আকাশ মেঘে ঢাকা রয়েছে। আর মেঘে ঢাকা থাকলেও ইউক্রেনিয়রা জানে যে, কি করতে হবে। জেলেন্সকি ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ বলে ঘোষণা দেন যে, ভবিষ্যতে ক্রিমিয়া এবং অন্যান্য দখলীকৃত অংশ ইউক্রেনের হাতে ফেরত আসবে। ব্রিটেনের পত্রিকা ‘দ্যা সান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি করা এই সেতু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে খুবই গর্বের একটা বিষয় ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন সরকার এই সেতুতে হামলার জন্যে হুমকিও দিয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে, একটা ২২ চাকার ট্রাক লরির কাছাকাছি বিস্ফোরণের শুরু। রুশ কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, এই ট্রাক সেতুর রুশ প্রান্ত থেকে চেকপয়েন্ট অতিক্রম করছে এবং সেখানে সেনারা ট্রাকটা পর্যবেক্ষণ করছে। রুশরা বলছে যে, এই হামলা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসবিইউ’এর কাজ। রুশ বিশ্লেষক ইউরি পদোলিয়াকা বলছেন যে, ট্রাকটা খুব সম্ভবতঃ রুশ চালকই চালাচ্ছিলেন। তিনি হয়তো জানতেন না যে, তার ট্রাকে কি ছিল। ইউক্রেনিয়রা হয়তো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকতে পারে। তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ টনি স্পামার ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’কে বলছেন যে, বোমার উৎস ট্রাক নাও হতে পারে। কারণ ট্রাকে বোমা থাকলে রাস্তার উপর গর্ত তৈরি হতো; সেতুর একাংশ পানিতে পড়ে যেতো না। এরকম ধ্বংসযজ্ঞের জন্যে সেতুর পুরো প্রস্থ জুড়ে আঘাত করতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে যে, বোমাটা সেতুর নিচ থেকেই ফাটানো হয়েছে। এটা একটা দৈত্যাকৃতির বিস্ফোরণ ছিল। স্পামারের থিউরির সমর্থক কেউ কেউ সিসিটিভি ফুটেজে বিস্ফোরণের সময় সেতুর নিচে রহস্যজনক জলযানের উপস্থিতি খুঁজে পাচ্ছেন। তবে টনি স্পামারএর মতের সাথে অনেকেই এক হতে পারেননি, যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর নিচ থেকে তোলা ছবি সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সেতুর নিচের দিকে কোন বিস্ফোরণের আলামত দেখা যায় না। কংক্রিটের পিলারগুলি শক্তিশালী হলেও অনেকেই সেতুর স্প্যানগুলির নিচে ধাতুর কাঠামোর হাল্কা কনস্ট্রাকশনের সমালোচনা করেন; যা হয়তো স্প্যানগুলি ধ্বসে পড়তে সহায়তা দিয়েছে।

কেউ কেউ অবশ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দিতে নারাজ। ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর প্রাক্তন ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, এই ঘটনা হয় ইউক্রেনের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ঘটিয়েছে, অথবা এটা একটা ক্ষেপণাস্ত্রের কাজ; যা কিনা এই মুহুর্তে ইউক্রেনের হাতে রয়েছে বলে জানা নেই। মোটকথা, বিশ্লেষকেরা কেউই এই মুহুর্তে নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, এই ঘটনা কিভাবে ঘটানো হয়েছে। হয়তো প্রকৃত ঘটনা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহুর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যুদ্ধের উপরে এই হামলার প্রভাব কতটুকু হতে পারে।

 
কার্চ সেতু কিছুদিনের মাঝেই হয়তো মেরামত করা হয়ে যাবে। এর আগ পর্যন্ত দক্ষিণের খেরসনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ রসদ মারিউপোল এবং বেরদিয়ানস্ক সমুদ্রবন্দর হয়ে সেখান থেকে রেলযোগে মেলিটোপোল হয়ে খেরসন পৌঁছাবে। ক্রিমিয়াতে রসদ পৌঁছাতে মেলিটোপোলের রেল জংশনের গুরুত্ব বাড়ার সাথেসাথে মেলিটোপোলের ১’শ ২০ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত জাপোরিজজিয়া বরাবর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে; যদিও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আরও আগেই এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, এই সেতু কিছুদিনের মাঝেই হয়তো মেরামত করা হয়ে যাবে। এর আগ পর্যন্ত দক্ষিণের খেরসনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ রসদ মারিউপোল এবং বেরদিয়ানস্ক সমুদ্রবন্দর হয়ে সেখান থেকে রেলযোগে মেলিটোপোল হয়ে খেরসন পৌঁছাবে। এই রেললাইনের একাংশ ইউক্রেনের দূরপাল্লার আর্টিলারি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তখন খেরসনে ইউক্রেনের আক্রমণ আরও শক্তিশালী হবে। রুশরা সামরিক রসদ পরিবহণে সড়কের চাইতে রেলের উপরে বেশি নির্ভরশীল। তবে যেহেতু কার্চ সেতুর রেল অংশটা ধ্বসে পড়েনি; শুধু ক্ষতি হয়েছে কিছুটা, তাই ইউক্রেন খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় পাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্যে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস’ বা ‘সিএসআইএস’এর ফেলো এবং অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল মিক রায়ান এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, কার্চ সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মেলিটোপোল হয়ে স্থলভাগের উপর দিয়ে রেললাইনটা এখন বেশি ব্যবহৃত হবে। আর এর বাইরেও কার্চ প্রণালি পার হবার জন্যে ফেরিও রয়েছে। তবে এই ঘটনার ফলে মেলিটোপোল অধিকারে রাখাটা রুশদের জন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো। আর রুশরাও হয়তো একারণে দক্ষিণের দিকে তাদের সেনা মোতায়েন বাড়াতে পারে। এর ফলে যুদ্ধের অন্যান্য ফ্রন্টে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জন্যে সুযোগ তৈরি হবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো এবং প্রাক্তন মার্কিন ম্যারিন কোর সদস্য রব লী টুইটারে জেনারেল মিক রায়ানএর মতামত সমর্থন করে বলছেন যে, ক্রিমিয়াতে রসদ পৌঁছাতে মেলিটোপোলের রেল জংশনের গুরুত্ব বাড়ার সাথেসাথে মেলিটোপোলের ১’শ ২০ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত জাপোরিজজিয়া বরাবর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে; যদিও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আরও আগেই এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

২৭শে জুলাই খেরসন এবং ৬ই সেপ্টেম্বর খারকিভের অপারেশন শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যুদ্ধের গতিপথের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। খেরসনে ইউক্রেনের অপারেশন শুরুর আগ থেকেই রুশরা পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ফ্রন্ট থেকে সেনা সড়িয়ে খেরসনে মোতায়েন করে। এর ফলে ইউক্রেনিয়রা যখন খারকিভে অপারেশন শুরু করে, তখন কয়েক দিনের মাঝেই রুশরা কয়েক হাজার বর্গ কিঃমিঃ এলাকা ছেড়ে দিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এখন ইউক্রেনিয়রা আবারও খেরসন অভিমুখে অপারেশনের দিক পাল্টাবার ফলে রুশরাও সেদিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। এমনই একটা সময়ে কার্চ সেতুর উপর হামলার ঘটনাটা ঘটলো। এতে রুশদের দীর্ঘমেয়াদে কোন ক্ষতি না হলেও রুশ গর্ব এতে যথেষ্টই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৫ই মে ভ্লাদিমির পুতিন নিজে ট্রাক চালিয়ে ১৭ কিঃমিঃ লম্বা রাশিয়ার দীর্ঘতম সেতুটা উদ্ভোধন করেছিলেন। সেতুর উপর আক্রমণে রুশদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কার্চ সেতুর উপর হামলা যা দিয়েই করা হোক না কেন, এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক অপারেশন। আর ইউক্রেনিয়রা এই হামলার ফল কতটা ভোগ করতে পারবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর। পশ্চিমা সরঞ্জামের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও ইউক্রেনের সেনাদেরকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তারা রুশ সেনাদের চাইতে অধিকতর দক্ষ।

No comments:

Post a Comment