Thursday 6 October 2022

দক্ষিণ এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন কেন?

০৬ই অক্টোবর ২০২২
 
অক্টোবর ২০২২। ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বাজওয়াকে স্বাগত জানাচ্ছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। এতকাল যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। এখন আবার ভারতকে শাসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যখন রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রাখার কারণে দিল্লীকে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে, ঠিক তখনই খবর এলো যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন পর হঠাৎ করেই পাকিস্তানের কাছে প্রায় সাড়ে ৪’শ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। ইসলামাবাদের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে দুই দেশের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যখন ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হবার সময় বলেন যে, ওয়াশিংটনের ইচ্ছানুযায়ী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হবার এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া গত ৩রা এপ্রিল এক সেমিনারে বলেন যে, ঐতিহাসিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করেছে এবং ট্রেনিং দিয়েছে। পাকিস্তানের সেরা সামরিক সরঞ্জামও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। কথাগুলির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে চাইছে; তাদের সাথে চীনের অত ভালো চলছে না। কিন্তু এটা ঘটলে ভারত তা পছন্দ করবে না। গ্রসম্যানের এই কথাগুলিই ছয় মাস পর আলোচিত হচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা উইলসন সেন্টার’এর দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ক’দিন আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী; যারা ভিন্ন ভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাইসের এই কথাগুলি জর্জ বুশ হোয়াইট হাউজে থাকার সময় থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে মার্কিন নীতিকে প্রতিফলিত করছে। এই নীতির অধীনে ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানের সাথে কথা বলছে, তখন ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে আলাদা রাখছে; আবার ভারতের সাথে যখন কথা বলছে, তখনও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের বিষয়টাকে সেখানে যুক্ত করছে না। এই নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মির ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছে। ইসলামাবাদ এখন বুঝতে পারছে যে, তারা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে আশা করতে পারে না যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেও একইভাবে দেখবে। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া বন্ধ রেখেছে। এমতাবস্থায় নিরাপত্তা সহায়তা স্থগিত রেখে পাকিস্তানের পুরোনো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের উন্নয়নের জন্যে সরঞ্জামাদি বিক্রয় করাটা নতুন নীতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পাকিস্তানের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করার জন্যে ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেন। কুগেলম্যান বলছেন যে, এস জয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়াটা অবাক করার মতো; যখন এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চাইতে অনেক বেশি উচ্চতায়। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদের সখ্যতা দেখা গেলেও দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যথেষ্টই অনিশ্চিত। অপরদিকে চীনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ভারত ওয়াশিংটনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। যদি দিল্লী থেকে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী, তাহলে ওয়াশিংটনও বলতে পারে যে, মস্কোর সাথে দিল্লীর সম্পর্ক ওয়াশিংটনে স্বার্থের পরিপন্থী। এই ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে করতে গেলে ওয়াশিংটনকে আরও সাবধানে এগুতে হবে।

পাকিস্তান বিষয়ে ওয়াশিংটনের নীতি নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের সমন্বয়ে গঠিত ‘পাকিস্তান স্টাডি গ্রুপ’এর ৪ঠা অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পাকিস্তানকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পাকিস্তানের অবস্থান হলো দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে এবং পাকিস্তানের সাথে চীন এবং ইরানের সীমানা ছাড়াও দেশটার সাথে রাশিয়ারও সুসম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থের কারণেই তারা পাকিস্তানকে একঘরে করা অথবা সম্পর্ককে পুরোপুরিভাবে কর্তন করতে পারবে না। পাকিস্তান যাতে স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করে যেতে থাকে, সেটা নিশ্চিত করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের অংশ। সেখানে বলা হচ্ছে যে, যদিও আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান ভিন্ন চশমা দিয়ে দেখতে থাকবে, তদুপরি উভয়ের স্বার্থেই আফগানিস্তানে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা এবং সেদেশের মানুষের সমস্যা লাঘবের জন্যে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মাঝে সহযোগিতা চলতে পারে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স অনেক এজেন্ট হারাবার পর পাকিস্তানের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার প্রভাব ধরে রাখতে পারে। তবে দুই দেশের জনমত সম্পর্কোন্নয়ের ক্ষেত্রে বেশ বড় বাধা। পাকিস্তানের কৌশলগত চিন্তাকে পরিবর্তন করাবার চেষ্টা করার উপর প্রতিবেদনে জোর দেয়া হয়। এই মুহুর্তে চীনের ব্যাপারে পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন নীতি থাকার কারণে প্রতিবেদনে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌসুলী হবার জন্যে ওয়াশিংটনকে উপদেশ দেয়া হয়। কারণ সুবিধা প্রদান করা বা হুমকি দেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের কৌশলগত দিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রতিবেদনে চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যেন জনগণের সামনে আরও তথ্য উপস্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে সেক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়।

পাকিস্তানের পত্রিকা ‘দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই প্রতিবেদন এমন সময়ে প্রকাশ করা হলো, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বাজওয়া ওয়াশিংটন সফর করছেন। আর এর মাত্র এক সপ্তাহ আগেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ওয়াশিংটন ঘুরে এসেছেন।

কুগেলম্যান বলছেন যে, ওয়াশিংটন যেমন পাকিস্তানকে ছাড়তে পারছে না, তেমনি ভারতও রাশিয়াকে ছাড়তে পারছে না। এগুলি ওয়াশিংটন এবং দিল্লীর বাস্তবতার অংশ। এই বাস্তবতা অপছন্দের হলেও মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতির কারণে দিল্লী-মস্কো এবং ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্ক দিল্লী-ওয়াশিংটন সম্পর্কের চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশি অনিশ্চয়তার মাঝে পড়বে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বার্তা দিয়েছে যে, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখে চলার একটা মূল্য রয়েছে; যদিও নিশ্চিতভাবেই, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বড় কোন শাস্তি দেবে না। এই কথাগুলির মাঝ দিয়ে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, এতকাল যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। এখন আবার ভারতকে শাসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে।

13 comments:

  1. বিশ্বব্যবস্থা ধসে পড়ার সাথে সাথে, আমেরিকা তার মন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় কতটা শক্তি প্রদর্শন করতে পারবে?
    বিশেষ করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিশ্বব্যবস্থা ধ্বসে পড়ার অর্থ এই নয় যে, এই বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। মূলতঃ এই নিয়ন্ত্রক (যুক্তরাষ্ট্র) আদর্শিক দিক থেকে দুর্বল হয়েছে বলেই বিশ্বব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়ন এই দুর্বল হবার একটা লক্ষণ মাত্র। দুই দশকেও যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারেনি এবং সেখানে নিজেদের মতাদর্শের একটা সরকারকে বসাতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই এখনও খুব বেশি আশা করাটা ঠিক নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র জানে সে কি করছে। আফগানিস্তান নীতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যথেষ্ট বিভেদ রয়েছে। যারা পশ্চিমা আদর্শকে তুলে ধরার পক্ষপাতি, তারা বাস্তবতা মানছে না। আর যারা বাস্তবতাকে তুলে ধরছে, তারা আদর্শকে রক্ষা করাটা তাদের দায়িত্ব মনে করছে না।

      এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ যে জিনিসটা করতে পারে তা হলো, পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানিস্তানের উপর প্রভাব ধরে রাখা; যাতে করে তালিবান সরকারের নীতিগুলিকে যতটা সম্ভব পশ্চিমাদের সাথে সমান্তরালে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেটা করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানের সমস্যা হলো, পাকিস্তানের জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেই। এমতাবস্থায় সেনাবাহিনী ইচ্ছে করলেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেকোন সহযোগিতায় যেতে পারবে না। অভ্যন্তরীণ চাপের কারণেই সেনাবাহিনীর ওয়াশিংটন-বান্ধব নীতি খুব সহজে বাস্তবায়নযোগ্য হবে না।

      Delete
    2. "এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ যে জিনিসটা করতে পারে তা হলো, পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানিস্তানের উপর প্রভাব ধরে রাখা; যাতে করে তালিবান সরকারের নীতিগুলিকে যতটা সম্ভব পশ্চিমাদের সাথে সমান্তরালে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। যদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেটা করতে পারবে। "
      এখানে প্রশ্নঃ
      তালিবানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কি কি উপায়ে প্রভাবিত করতে পারবে?২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কথা মত পাক সেনাবাহিনী ২০০১ এর মত ওয়াজিরিস্তান সহ আফগানিস্তানের ভিতরে যুদ্ধ লাগাতে পারে?
      পশ্চিমা নীতির সমান্তরালে, তালিবান কে নিয়ে আস্তে পারবে পাক সেনাবাহিনী?
      এখানে বেসামরিক পাক সরকারের কি ভুমিকা থাকতে পারে?

      Delete
    3. "পাকিস্তানের জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেই।"
      সামরিক বাহিনীর জনপ্রিয়তা কতটা কমেছে?
      এমন অবস্থায় পৌঁছেচে কি যে, বাহিনী তার ইচ্ছা মত নীতি বাস্তবায়ন করতে পারবে না?

      Delete
    4. আরেকটা যুদ্ধকে অর্থায়ন করার সক্ষমতা না আছে পাকিস্তানের, না আছে যুক্তরাষ্ট্রের। কাজেই কোন যুদ্ধ কেউই চাইবে না।

      কতটুকু পারবে, সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। কিন্তু চেষ্টা করবে।

      বেসামরিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাজগুলিকে বৈধতা দেবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যখন পাকিস্তানকে সহায়তা দেবে, তখন সেটা 'ভালো' দেখা যাবে। সামরিক সরকার থাকলে ব্যাপারটা কেমন যেন লাগতো।

      Delete
    5. পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যদি এমন নীতিতে চলতে চায়, যেটা দেশের জনগণ পছন্দ করে না, তাহলে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধার সন্মুখীন হবে। দেশ চালাবার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সমর্থন লাগে। সেটা না থাকলে জনগণ রাস্তায় নামবে এবং সেনাবাহিনী মানুষের শত্রু হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে, সেনাবাহিনী তাদের রিক্রুট পায় সাধারণ জনগণের মাঝ থেকে।

      Delete
    6. এবং অবশ্যই ধন্যবাদ, আন্তরিক ভাবে প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার জন্য।

      Delete
  2. ১. পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন এবং কিভাবে আমেরিকার অনুগত সেনাবাহিনী হয়ে গেল?
    ২. চীনের সাথে এত গভীর সম্পর্ক থাকার পরেও ইম্রান খানের পরাজয় চীন কেন ঠেকাতে পারেনাই।
    ৩. কোন একটা একক গ্রেট পাওয়াররের উপর সম্পুর্ন নির্ভরশীলতা কিভাবে পাশ কাটানো যায়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে। সেসময় থেকেই তারা ব্রিটেনের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল যাতে ব্রিটেন ভারত ছেড়ে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের ভারত ছেড়ে যাওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সহায়তা দেয়ার মূল শর্ত ছিল। ভারত ছেড়ে যাবার সাথেসাথে ব্রিটেন তার সুপারপাওয়ারের অবস্থান হারিয়ে ফেলে।

      পাকিস্তানের প্রথম দিককার সকল রাজনীতিবিদই ছিলেন ব্রিটিশ ঘরানার এবং তাদের বেশিরভাগই ছিল কোলকাতার রাজনীতিবিদ। মার্কিনীরা এই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের চক্র ভেঙ্গে ফেলতে নিজেদের আলাদা চক্র তৈরি করে - সেনাবাহিনী। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মাঝে নিজেদের সমর্থক গড়ে তোলে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আরোহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়।

      আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলির মাধ্যমেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপরে প্রভাব ধরে রাখে। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে থাকলেও পাকিস্তানের মূল সামরিক সহায়তা আসতো চীন থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এব্যাপারে কোন সমস্যা ছিল না; যতক্ষণ পাকিস্তানের নীতি ওয়াশিংটনের পক্ষে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র বুঝেছিল যে, চীনারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোন ভূমিকা রাখবে না। বরং ১৯৭১-৭২ সালে পাকিস্তানকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের কমিউনিস্ট সরকারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগায়।

      ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের উপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সোভিয়েত আগ্রাসন পাকিস্তানকে ওয়াশিংটনের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে ফেলে। সেসময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক ওয়াশিংটনের নীতি বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখেন।

      ঠান্ডা যুদ্ধের পর ২০০১ সাল থেকে পাকিস্তান আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান নীতি বাস্তবায়নে ব্যাপক সহায়তা দিতে থাকে। এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় ভূমিকা রাখেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। তার পরবর্তীতে বেসামরিক সরকারগুলিও ওয়াশিংটনের নীতিকে বাস্তবায়ন করে যেতে থাকে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণেই পাকিস্তানের সাথে ওয়াশিংটনের নীতির পার্থক্য শুরু হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য যে, এখানে চীনের কোন ভূমিকা নেই। পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। চীন কখনোই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেনি। এবং যুক্তরাষ্ট্রও কখনও পাকিস্তানকে চীনা অস্ত্র বর্জনের কথা বলেনি। চীন সর্বদাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই সেখানে খেলোয়াড় ছিল। চীন যুক্তরাষ্ট্রের এই খেলাগুলিতে দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র।

      একটা গ্রেট পাওয়ারের উপরে নির্ভরশীলতাকে এড়াতে সমাধান একটাই - নিজে সুপারপাওয়ার হওয়া।

      Delete
  3. অনেক ধন্যবাদ গুছিয়ে লেখার জন্য। আচ্ছা চীন তাইলে অন্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা কেন নাকি করতে অনিচ্ছুক? এভাবে সে যদি সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জন না করে তাইলেত সে সুপার পাওয়ার হতে পারবেনা।
    আর একটা বিষয়। বিশ্বব্যাপি রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের উপায় কিকি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটা রাষ্ট্র কেন শক্তিশালী হয়? সেটা কি তার প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে? সেটা হলে তো দুনিয়ার কাজাখস্তান এবং কঙ্গো দুনিয়ায় অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে পারতো। আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই অত্যধিক গরীব; যদিও তাদের সম্পদের অভাব নেই। একটা রাষ্ট্রের আকার বা জনসংখ্যা কি তাকে শক্তিশালী করে? সেটা শক্তিশালী হতে সহায়তা দিতে পারে; কিন্তু শক্তিশালী হবার জন্যে শর্ত নয়। ইউরোপের দেশগুলি জনসংখ্যার দিক থেকে খুব ছোট হওয়ার পরেও শক্তিশালী হয়েছে; আর ভারত ও চীন বিশাল জনসম্পদের অধিকারী হয়েও পশ্চিমাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তাহলে কিসে একটা রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে?

      একটা রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় তার চিন্তার কারণে। একটা মৌলিক চিন্তার উপর ভর করে যখন একটা রাষ্ট্র তৈরি হয়, তখন সেই রাষ্ট্র তার সেই চিন্তাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েও দিতে চায়। কারণ সে মনে করে যে, তার চিন্তাটা সবচাইতে উন্নত এবং সেটা সকলেরই উচিৎ গ্রহণ করা। এই চিন্তা এবং চিন্তাকে বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে একত্রে বলে আদর্শ বা আইডিওলজি (আইডিয়া + মেথডলজি)। পশ্চিমা দেশগুলি তাদের আদর্শকে (ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদ) দুনিয়াতে ছড়িয়েছে উপনিবেশ তৈরির মাধ্যমে। এর পরবর্তীতে বিংশ শতকে সোশালিজম তার আদর্শকে ছড়িয়েছে গণুভ্যুত্থান বা রেভোলিউশনের মাধ্যমে।

      এই আদর্শ একটা রাষ্ট্রকে শুধু বেঁচে থাকা নয়, আদর্শকে বহণ করার লক্ষ্য দেয়; এবং ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রটা শক্তিশালী হয়ে যায়; যেমনটা হয়েছে পর্তুগাল, স্পেন, হল্যান্ড, ব্রিটেন, ফ্রান্সএর মতো দেশগুলির ক্ষেত্রে। জনবল ও সম্পদের প্রাচুর্য্য না থাকার পরেও এরা সারা বিশ্বে তাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছে উপনিবেশের মাধ্যমে। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর সমাজতন্ত্র সারা বিশ্বের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ইন্ধন যুগিয়েছে। চীন ১৯৫০-৭০এর দশকে বিভিন্ন দেশে কৃষক আন্দোলনে (ক্লাস-লেস সোসাইটি) ইন্ধন যুগিয়েছে। সেসময় চীনারা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুই ছিল না, সোভিয়েত ইউনিয়নেরও শত্রু ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাবের সময় এবং এর পরেও এই দ্বন্দ্বটা খুবই প্রবল ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই তারা তাদের পথ থেকে সড়ে আসে। পরবর্তীতে চীনারা অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কাছে টানতে থাকে। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাবকে কমাতে চীনের সহায়তা নিতে থাকে।

      চীন কখনোই সুপারপাওয়ার হতে পারেনি; চায়ও নি; কাজেই পারবেও না। কারণ চীনের কোন আদর্শ নেই; যা কিনা তারা সারা দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এধরনের দেশগুলি বড়জোড় তাদের নিজস্ব এলাকায় প্রভাবশালী হয় এবং আশেপাশের দেশগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন - ভারত, রাশিয়া, চীন। এই দেশগুলির রাজনৈতিক লক্ষ্য অপেক্ষাকৃত ছোট। তারা ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুনিয়াটাকে নিজের মনে করতে পারে না। একারণেই ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সারা দুনিয়ার সকল দেশে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব রাখতে পারে, চীন বা রাশিয়া বা ভারত তা পারে না। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র হলো আদর্শিক শক্তি। তারা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মালিক; এটা ব্রিটেন তৈরি করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তা বর্তমানে কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণ করছে।

      কাজেই বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রভাব অর্জনের একটাই উপায় রয়েছে - একটা মৌলিক চিন্তা এবং আদর্শের উপরে রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করা এবং বর্তমানে দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিস্থাপিত করা; ঠিক যেমনটা চেষ্ট করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন; যদিও সেটা তারা করতে সক্ষম হয়নি।

      Delete
    2. অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর রেপ্লাই দেবার জন্য। তাহলে ধরে নিচ্ছি ভারত, রাশিয়া, চায়না, তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এরা সবাই একেক্টা গ্রেট পাওয়ার বা আঞ্চলিক শক্তি। এদের ভিতর কিছু রাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা রয়েছে। অন্যদিকে বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এরা সবাই এক। আর তাদের মোড়ল আমেরিকা।

      Delete
    3. আপনি ভুল বুঝেছেন। আপনি যেকোন আঞ্চলিক শক্তিকে গ্রেট পাওয়ার ধরে নিয়েছেন। সকলেই গ্রেট পাওয়ার নয়। গ্রেট পাওয়ার ঐসব দেশ, যেগুলি বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব রাখে এবং সামরিক দিক থেকেও শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম। চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স - এগুলি গ্রেট পাওয়ার। বাকিরা কেউই গ্রেট পাওয়ার নয়। তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি; সৌদি আরবও - তবে এরা আরেকটা শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র) উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইরান গ্রেট পাওয়ার নয়; তবে আঞ্চলিক শক্তি। অস্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অংশ; তারা ব্রিটেনের নীতিতেই চলে। ভারত শুধুমাত্র আঞ্চলিক শক্তি; যদিও তাদের পারমাণবিক বোমা রয়েছে। জার্মানি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তি; আঞ্চলিক শক্তিও নয়।

      সুপারপাওয়ার শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র। কারণ একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই একটা আদর্শকে সারা দুনিয়াতে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছে এবং সেটাকে রক্ষা করার মতো শক্তি তার মোটামুটিভাবে রয়েছে।

      ব্রিটেনের উদ্দেশ্য রয়েছে; শক্তি নেই। তাই সে যুক্তরাষ্ট্রের উপর শক্তির জন্যে নির্ভরশীল। তাই ব্রিটেনও আদর্শিক শক্তি; তবে সুপারপাওয়ার নয়।

      ফ্রান্স ব্রিটেনের পর্যায়ে নেই; কারণ ফ্রান্সের লক্ষ্য ব্রিটেনের চাইতে অনেক কম। শুধুমাত্র কিছু বিশেষ এলাকাতেই (যেখানে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল) ফ্রান্স প্রভাব রাখে।

      রাশিয়া প্রভাব রাখে তার আশেপাশের এলাগুলিতে; যেমন - পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস, মধ্য এশিয়া, কোরিয়া, ইত্যাদি। এর বাইরেও রাশিয়া তার অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এবং বিশাল পারমাণবিক ভান্ডার থাকার কারণে রাশিয়া সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে যতটা হুমকি প্রদানে সক্ষম, ততটা হুমকি দুনিয়ার আর কোন দেশের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।

      চীন গ্রেট পাওয়ার; কারণ সে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এবং তার সামরিক ও প্রাযুক্তিক সক্ষমতা এখন যথেষ্ট। একইসাথে তার আরও শক্তিশালী হবার ইচ্ছা রয়েছে। তবে রাজনৈতিকভাবে চীন নিতান্তই শিশু। সে তার আশেপাশের দেশগুলির উপরেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়।

      Delete