২০শে নভেম্বর ২০২১
পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্যের হাজার হাজার শরণার্থীদের উপর যখন পোলিশ সেনারা জলকামান, পেপার স্প্রে এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করছে, তখন কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন যে, এর সমস্যার পিছনে শুধুমাত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই রয়েছেন কিনা। ব্রিটেনের ‘দ্যা স্পেকট্যাটর’ পত্রিকার এক লেখায় ‘বলকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং নেটওয়ার্ক’এর ফেলো ইয়ানিস বাবুলিয়াস বলছেন যে, এই ভূরাজনৈতিক খেলায় তুরস্ককে বাদ দিয়ে ভুল হবে। কারণ বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীরা পৌঁছেছে তুরস্কের ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’এর মাধ্যমে।
তুর্কি কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘হুরিয়েত ডেইলি নিউজ’ জানাচ্ছে যে, ১০ই নভেম্বর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউএর সাথে ফোনে কথা বলেন। এই কথোপকথনে কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক এই সমস্যার অংশ না হলেও কেউ কেউ তা বোঝাতে চাইছে। তিনি তুরস্ক এবং ‘টারকিশ এয়ারওয়েজ’এর বিরুদ্ধে অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেন। একইসাথে তিনি বলেন যে, জনগণকে এই অভিযোগের ব্যাপারে সত্যটা জানাতে হবে। তিনি পোল্যান্ডের টেকনিক্যাল তদন্ত দলকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানান। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন কথোপকথন মাত্র একমাস আগের বৈঠকের সময়েও অন্যরকম ছিল। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই কাভুসোগলু পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফর করেন এবং পোল্যান্ডের সীমান্ত ইস্যুতে তুরস্কের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যৌথ ঘোষণায় বলেন যে, তাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস একত্রে এধরণের হুমকি মোকাবিলায় এবং ইইউএর ভেতর ঢোকার উদ্দেশ্যে মানব পাচারের রুটগুলি খুঁজে বের করবে। জিবিগনিউ রাউ বলেন যে, তিনি কাভুসোগলুকে শরণার্থীদের বিমানে করে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে যাবার ব্যাপারে আরও মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, শরণার্থীদের নিয়ে আসা ফ্লাইটগুলি অনেক ক্ষেত্রেই ইস্তাম্বুলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। কাভুসোগলু বলেন যে, নয় মাসে ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ মিনস্কে ৬’শ ইরাকি নাগরিককে নিয়ে গিয়েছে; যাদের অর্ধেকই আবার ফিরে এসেছে। এই সফরের সময় পোলিশ মন্ত্রী রাউ বলেন যে, দুই দেশের বাণিজ্য এখন প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার; যা শীঘ্রই ৯ বিলিয়নে যাবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।
তুরস্কের প্রতি ইইউএর হুমকি
৮ই নভেম্বর ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, ইইউ খতিয়ে দেখছে যে, তৃতীয় কোন দেশের এয়ারলাইন্স, যারা কিনা “মানব পাচারে জড়িত” রয়েছে, তাদের উপর অবরোধ দেয়া বা তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করা যায় কিনা। ‘ইইউ অবজারভার’ বলছে যে, ভন ডার লেইয়েন যে তৃতীয় দেশের এয়ারলাইন্সের কথা বলেছে, তা হলো ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’। আর ‘পলিটিকো ইউরোপ’এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, মিনস্কে যাবার প্রধান বিমান রুটটাই হলো তুরস্ক থেকে। ১০ই নভেম্বর পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাটিউজ মোরাউইয়েকি পার্লামেন্টের এক জরুরি বৈঠকে অভিযোগ করে বলেন যে, পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, তুরস্কের কর্মকান্ডগুলি বেলারুশ এবং রাশিয়ার সাথে সমন্বয় করা; যা পোলিশরা পছন্দ করছে না। তিনি আরও বলেন যে, মাত্র এক বা দুইমাস আগেই তুরস্ক পোল্যান্ডের সাথে একসাথে কাজ করতে চায় বলে মনে হয়েছিল। তুরস্কের দাবানল ঠেকাতে সহায়তা এবং তুর্কি পর্যটন শিল্পে সহায়তা দেয়াটা খুব সম্ভবতঃ একমুখী সহায়তা ছিল। এই ব্যাপারটা তুরস্ক সরকারকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
একইদিন ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তারা সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংবেদনশীলতার সাথে সহযোগিতা করে আসছে। একইসাথে বিবৃতিতে বলা হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। ‘এএফপি’ জানাচ্ছে যে, বেলারুশের রাজধানীতে যাবার সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত আকাশ নেটওয়ার্ক হলো ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’। এছাড়াও তুরস্কে রয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থী এবং অভিবাসী। এবং এখনও দেশটা ইউরোপ অভিমুখী শরণার্থীদের যাতায়াতের একটা গুরুত্বপূর্ণ রুট। ‘মিডলইস্ট আই’এর এক প্রতিবেদনে ফ্লাইটের তথ্য দিয়ে বলা হয় যে, গত ৩১শে অক্টোবর থেকে ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ ইস্তাম্বুল থেকে মিনস্কে সাপ্তাহিক ফ্লাইটের সংখ্যা ১৪ থেকে ১০এ নামিয়ে আনে। ভিসা ফ্রি ট্রাভেল সুবিধা থাকার কারণে বেলারুশ তুর্কি পর্যটকদের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য।
তুরস্কের ‘ইউ টার্ন’
১২ই নভেম্বর তুরস্কের বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যের তিনটা দেশ ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের নাগরিকদের তুরস্ক থেকে বেলারুশে যাওয়া বন্ধ ঘোষণা করে। এই খবর পাবার পর ইউরোপিয়ান কাউন্সিনের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল এক টুইটার বার্তায় তুর্কি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। পরদিন বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’র সাথে এক সাক্ষাতে তুর্কি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিন বলেন যে, পোল্যান্ডের সীমান্তে মানবিক দুর্যোগের ব্যাপারে তুরস্ক বা ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’কে দোষারোপ করাটা সমীচিন নয়। ভ্রমণকারীরা বেলারুশ গিয়ে সেখান থেকে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া বা অন্যান্য ইইউ দেশে যাচ্ছে। এর জন্যে তুরস্ক বা ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’কে দোষারোপ করাটা পুরোপুরি অবান্তর। তিনি আরও বলেন যে, তারা নিশ্চিত করতে চান যে, যারা তুরস্ক হয়ে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে, তারা যেন যাওয়া এবং ফেরত আসার টিকিট সাথে রাখে; অর্থাৎ তারা যেন ফেরত আসে। কিন্তু কেউ যদি বেলারুশে গিয়ে হারিয়ে যায়, তাহলে সেটা তুরস্কের দায় নয়। ‘আল মনিটর’এর সাথে এক সাক্ষাতে ‘পোলিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’এর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান ক্যারল ওয়াসিলেউস্কি বলেন যে, যদিও তুর্কিরা বলছে যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনকিছু করেনি, তথাপি পোলিশ সমাজের কাছে ব্যাপারটা সেভাবে ঠেকেনি। তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। পোল্যান্ডের কৌশলগত সংস্কৃতিতে এর একটা প্রভাব থাকবে। পোলিশরা মনে রাখবে যে, পোল্যান্ডের দুর্যোগের সময় তুরস্ক পাশে থাকেনি। ওয়াসিলেউস্কি মনে করছেন যে, বর্তমানের এই বিরোধ স্বল্প সময়ই স্থায়ী হবে; কূটনীতির মাধ্যমে তা সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু পোল্যান্ডের কর্মকর্তাদের মাঝে যারা একসময় তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষপাতি ছিলেন না, তারা এখন এই উদাহরণ টেনে বলতে পারবে যে, তুরস্ক প্রকৃতপক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য বন্ধু নয়।
কেউ কেউ বলছেন যে, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মাঝে সমন্বয় করে তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে বেলারুশে তুর্কি বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করেছে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স নিউজ’এ মতামত দিতে গিয়ে তুর্কি পার্লামেন্টের প্রক্তন সদস্য এবং বর্তমানে ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসিস’এর সিনিয়র ডিরেক্টর আইকান এরদেমির বলছেন যে, যদিও ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলস কেউই সরাসরি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ নিয়ে কথা বলেনি, তথাপি আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, হুমকি দিয়েই ফ্লাইটগুলি বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ভন ডার লেইয়েনের হুমকির দু’দিনের মাথায় মেভলুত কাভুসোগলু যেমন দায় স্বীকার করেননি, তেমনি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ও বলেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবান্তর। অথচ এর দু’দিনের মাথাতেই ইস্তাম্বুল থেকে মিনস্কে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশের নাগরিকদের যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।
তুরস্ক আসলে কি চাইছে?
কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত মে মাসেই যেখানে পোল্যান্ডের সাথে তুরস্কের ২৪টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান কেনার চুক্তি হয়েছে, সেখানে মাত্র কয়েক মাসের মাঝেই তুরস্কের সাথে পোল্যান্ডের সম্পর্ক এই পর্যায়ে কিভাবে আসতে পারে? আর পোল্যান্ডের সীমান্তে তুরস্কের স্বার্থই বা কি? কেনই বা আরেকটা ন্যাটো সদস্য দেশের সাথে তুরস্কের সমন্বয় এত কঠিন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক ফোকাসের দিকে তাকালেই। পোল্যান্ডের সীমান্ত সমস্যায় তুরস্কের প্রভাব খাটাবার চেষ্টার আলোচনাটা এমন সময়ে এলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ফোকাস হলো চীন। মার্কিনীরা ইউরোপ সহ দুনিয়ার সকল অঞ্চলে তাদের সামরিক অবস্থান কমিয়ে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করছে। আর এমন একটা অবস্থায় পূর্ব ইউরোপে উত্তেজনা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যে, ইউরোপিয়রাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিক। তথাপি যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সীমান্তে একটা দ্বন্দ্বে আটকে থাকলে তা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নীতিকে প্রভাবিত করবে।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তুরস্ক যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপের ঢাল হিসেবে কাজ করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কাছে তুরস্কের যে মূল্য ছিল, তা এখন নেই। কারণ বর্তমানে রুশ হুমকিকে ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলি ততটা বড় হিসেবে দেখছে না। ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে জার্মানি এবং তার পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ডের মাঝে চিন্তার ব্যাপক ফারাক রয়েছে। ইইউএর প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি তার বেশিরভাগ গ্যাস আমদানি করে থাকে রাশিয়া থেকে। অপরদিকে রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় পোল্যান্ড চাইছে তাদের দেশে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন থাকুক। ইইউএর এই বিভাজনের সময়েই ইউরোপ এবং রাশিয়ার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ব্যালান্স দেখতে চায়। ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনও সেটাই চায়; তাই তারাও পোল্যান্ডকে সীমান্ত শক্তিশালী করতে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। সেই জায়গাটাতেই তুরস্ক জড়িত থাকতে চাইছে, ঠিক যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একটা শূন্যস্থান রেখে যাচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষেও একুশ শতকের ধ্বসে পরা বিশ্বব্যবস্থায় তুরস্ক পশ্চিমাদের কাছে তার মূল্য ধরে রাখতে চাইছে। অন্ততঃ ইইউএর সীমান্তে প্রচন্ড শীতের মাঝে শরণার্থীদের উপর জলকামানের ব্যবহার ইইউএর মানবাধিকারের স্তম্ভকে যতক্ষণ নাড়া দেবে, ততক্ষণ তুরস্ক ইইউএর সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির সুযোগ পাবে। আর তুরস্কের সাথে ইইউএর দ্বন্দ্বের তালিকা এখন বেশ বড়। তবে যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজ বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়, বরং নিজস্ব বেসামরিক এয়ারলাইন্স ব্যবহার করেই তুরস্ক এই কাজটা করেছে। একুশ শতকে যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞায় শরণার্থীরা যেমন বেলারুশ এবং রাশিয়ার কাছে অস্ত্র, তেমনি ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ হয়েছে তুরস্কের অস্ত্র।
No comments:
Post a Comment