Tuesday 2 November 2021

চীন কি আসলেই তাইওয়ান আক্রমণ করবে?

০২রা নভেম্বর ২০২১

অক্টোবর ২০২১। চীনা বেসামরিক রোরো জাহাজের ভিতরে সামরিক গাড়ির বহর। মার্কিন এডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসনের ছয় থেকে দশ বছরের ‘উইন্ডো’ এখন মার্কিনীরা ব্যবহার করছে তাদের নৌবহর নতুন করে তৈরি করার জন্যে জনসমর্থন আদায়ে। তবে চুলচেরা বিশ্লেষণে চীনাদের সক্ষমতা এবং আকাংক্ষার মাঝে একটা ফারাক রয়েই যায়। এই ফারাকটাই এখন মার্কিন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবাচ্ছে। তারা যে ব্যাপারটাতে নিশ্চিত নন তা হলো তাইওয়ান আক্রমণ করার মতো একটা সিদ্ধান্ত যে চীনের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে, সেটা জেনেও চীনারা এই মিশন বাস্তবায়ন করবে কিনা।

 
গত মার্চে মার্কিন নৌবাহিনীর ইন্দোপ্যাসিফিকের কমান্ডার এডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসন মার্কিন সিনেটের সামরিক সার্ভিস কমিটির সামনে বলেন যে, চীনারা আগামী ছয় থেকে দশ বছরের মাঝেই তাইওয়ান দখলের আকাংক্ষা বাস্তবায়নের দিকে যেতে পারে। তিনি আরও আশংকা করেন যে, ২০৫০ সালের মাঝে চীন যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসন এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। তার কথায়, চীনারা সবসময়ই বলেছে যে, ২০৫০ সালের মাঝে তারা এটা করতে চায়। তার আংশকা হলো, চীনারা সেই টার্গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন এডমিরালের সরাসরি জবাব না দিয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সাংবাদিকদের বলেন যে, তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের অবস্থান পরিষ্কার। দুনিয়ায় চীন একটাই এবং তাইওয়ান চীনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘এনবিসি’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা চীনের ক্ষমতা নিলে হেরে যাওয়া জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে গিয়ে একটা বিরোধী সরকার গঠন করে। অফিশিয়াল না হলেও তাইওয়ানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাইওয়ানে মার্কিন ক্যাবিনেট কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে চীনের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েছিলেন। জো বাইডেনের প্রশাসনও সেই পথেই রয়েছে। চীনারা তাইওয়ানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্কের ব্যাপারে সর্বদাই প্রতিবাদ করেছে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন সাম্প্রতিক নির্বাচনে জেতার পর চীনকে প্রতিরোধ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। চীনারাও তাইওয়ানের আশেপাশে তাদের সামরিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে তাইওয়ানকে প্রতিনিয়ত চাপের মাঝে ফেলছে। একারণেই প্রশ্নের জন্ম হয়েছে যে, চীন কি আসলেই তাইওয়ান আক্রমণ করে বসতে পারে কিনা।

তাইওয়ানের উপকূলে যথেষ্ট সেনা মোতায়েনের সক্ষমতা চীনের রয়েছে কি?

‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় প্রাক্তন মার্কিন নৌবাহিনী কর্মকর্তা এবং মার্কিং থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র সিনিয়র ফেলো থমাস শুগার্ট বলছেন যে, যারা মনে করছেন যে, চীনের পক্ষে খুব তাড়াতাড়িই তাইওয়ান আক্রমণ করা সম্ভব নয়, তারা একটা যুক্তি দিচ্ছেন যে, তাইওয়ান প্রণালি পেরিয়ে একটা বড় আকারের উভচর অভিযান চালাবার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা চীনের নেই। তবে তারা এই হিসেব কষেছেন চীনা নৌবাহিনীর বিশেষায়িত উভচর জাহাজগুলির সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। এখানে তারা চীনের বেসামরিক জাহাজের বহরের সক্ষমতাকে আমলে নেননি; অন্ততঃ একটা সম্ভাব্য উভচর হামলার প্রাথমিক ধাপে তো নয়ই। শুগার্ট বলছেন যে, যদি চীনাদের বেসামরিক জাহাজগুলিকে এখানে হিসেবে নেয়া হয়, তাহলে এডমিরাল ডেভিডসনের কথাগুলি হালে পানি পায়।

তবে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পেন্টাগনের করা এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, আপাতদৃষ্টিতে চীনের উভচর নৌবহরের মূল লক্ষ্য হয়তো চীন থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে মিশন পরিচালনা করা। তাইওয়ান প্রণালি পার হয়ে উভচর মিশন পরিচালনা করতে চীনের দরকার বিপুল সংখ্যায় ল্যান্ডিং শিপ এবং মিডিয়াম ল্যান্ডিং ক্রাফট; যেগুলি তাদের নেই এবং সেগুলি তৈরি করার উপর তারা কোন প্রাধান্যও দেয়নি। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও মনে করছে যে, তাইওয়ান আক্রমণ করার মতো যথেষ্ট ল্যান্ডিং ভেহিকল এবং লজিস্টিক্যাল সক্ষমতা চীনের নেই। মার্কিন সরকারের ‘ইউএস চায়না ইকনমিক এন্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশন’এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনেও তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্যে চীনের যথেষ্ট উভচর সক্ষমতা এবং বিমান পরিবহণ সক্ষমতা নেই বলে বলা হয়। তারা এই শূণ্যস্থান পূরণে বেসামরিক জাহাজ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেছে; যেগুলির মাধ্যমে তারা দ্বিতীয় ধাপে তাইওয়ানে সেনা পাঠাতে পারবে। প্রথম ধাপে তাইওয়ানের উপকূলে চীনা নৌবাহিনীর উভচর জাহাজগুলিকেই সেনা নামাতে হবে; যারা সমুদ্রবন্দরগুলি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বা অস্থায়ী জেটি তৈরি করে বেসামরিক জাহাজ ভেড়ার ব্যবস্থা করবে। তবে একই কমিশনের সামনে কথা বলতে গিয়ে প্রাক্তন মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা লনি হেনলি বলেন যে, হয়তো ২০২০ সালের মাঝেই চীনারা তাদের উভচর সক্ষমতার টার্গেট ধরে ফেলেছে। তিনি বলেন যে, এটা তারা হয়তো করতে পেরেছে বেসামরিক জাহাজ ব্যবহারের মাধ্যমে; যেগুলির পরিবহণ সক্ষমতা সামরিক উভচর নৌবহরের চাইতে অনেক বেশি।

 
১৯৮২ সাল। ফকল্যান্ডস যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে যাত্রীবাহী জাহাজ 'ক্যানবেরা'। জাহাজের ডেকের উপর একটা হেলিকপ্টারও দেখা যাবে। চীনারা বেসামরিক জাহাজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের উদাহরণ বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। তারা ব্রিটিশদের ফকল্যান্ডস মিশনকে একটা শিক্ষা হিসেবেই নিয়েছে।

চীনারা ব্রিটিশদের ফকল্যান্ডস অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে

‘ইউনাইটেড স্টেটস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর রিসার্চ প্রফেসর লাইল গোল্ডস্টাইন ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, চীনারা বেসামরিক জাহাজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের উদাহরণ বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। ২০১৭ সালে চীনাদের সামরিক জার্নাল ‘মিলিটারি ইকনমিক রিসার্চ’এর এক লেখায় ‘চায়না ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র দু’জন প্রফেসর ১৯৮২ সালে ব্রিটিশদের ফকল্যান্ডস অপারেশনের বিশদ ব্যাখ্যা দেন। সেখানকার বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশরা ৬৭টা বেসামরিক জাহাজ ব্যবহার করেছিল সেই মিশনে; যা সংখ্যায় সামরিক জাহাজের প্রায় সমান হলেও পরিবহণ সক্ষমতা ছিল সামরিকের দ্বিগুণ। ব্রিটিশরা যুদ্ধ শুরুর মাত্র দুই দিনের মাথাতেই বেসামরিক জাহাজগুলিকে প্রস্তুত করতে থাকে। জাহাজের উপর হেলিকপ্টার ডেক তৈরি, লম্বা সমুদ্রপথে জাহাজ থেকে জাহাজে জ্বালানি নেবার ব্যবস্থা, উন্নততর যোগাযোগের ব্যবস্থা করা এবং সমুদ্রে উদ্ধার কর্মকান্ড চালনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। তিন’শ বেসামরিক সংস্থাকে দিয়ে গড়ে মাত্র ৭২ ঘন্টার মাঝে এই পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়ন করা হয়। সম্ভাব্য সকল সমস্যা মোকাবিলায় ব্রিটিশদের প্রস্তুতির ব্যাপকতাকে এই মিশনের সাফল্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বলে উল্লেখ করে চীনারা। ব্রিটিশ লজিস্টিক্যাল কর্মকর্তারা, যাদেরকে রিটায়ারমেন্ট থেকে বা ঐচ্ছিক সার্ভিস দেয়ার জন্যে আনা হয়েছিল, তাদের ট্রেনিং এবং প্রেরণার ব্যাপারটা চীনাদের অবাক করে। চীনারা তাদের লেখায় জাহাজে খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে বেসামরিক কর্মকর্তাদেরকে কত ভাতা দেয়া হয়েছিল, তা নিয়েও আলোচনা করে। মোটকথা চীনারা ব্রিটিশদের ফকল্যান্ডস মিশনকে একটা শিক্ষা হিসেবেই নিয়েছে।

থমাস শুগার্ট বলছেন যে, চীনারা ইতোমধ্যেই তাদের সমস্যাগুলিকে এড়াতে বেসামরিক জাহাজ নির্মাণে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে; যার মাধ্যমে সেই জাহাজগুলি জাতীয় প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে পারবে। বেসামরিক নৌবহরকে তারা নৌবাহিনীর অক্সিলারি ইউনিটের অধীনে রাখতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘বোহাই ফেরি গ্রুপ’এর রোরো ফেরিগুলিকে কৌশলগত সাপোর্ট ফ্লিটের ৮ম ট্রান্সপোর্ট গ্রুপের মাঝে সংগঠিত করা হয়েছে। ‘হাইনান স্ট্রেইট শিপিং’কে দেয়া হয়েছে ৯ম গ্রুপের অধীনে। ‘সিএসসি রোরো লজিস্টিকস’ রয়েছে ৫ম ট্রান্সপোর্ট গ্রুপে। বেসামরিক ফেরি থেকে চীনারা ইতোমধ্যেই উভচর ক্রাফট পানিতে নামিয়ে সরাসরি উপকূলে সেনা নামাবার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। অর্থাৎ প্রথম ধাপেই বেসামরিক জাহাজ থেকে সেনারা উপকূলে নামতে পারবে। চীনাদের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতাকে এই হিসেবে নিয়ে আসলে আরেকটা চিত্র পাওয়া যাবে। ২০২০ সালে চীনারা ২ কোটি ৩০ লক্ষ টনের বেসামরিক জাহাজ তৈরি করেছে; যা মার্কিন গড়পড়তা জাহাজ নির্মাণের ১’শ ১৫ গুণ! শুগার্ট তার গবেষণায় বলছেন যে, চীনের বর্তমানের গাড়ির ফেরিগুলি ১১ লক্ষ টন সক্ষমতার; যেখানে চীনা নৌবাহিনীর উভচর এসল্ট জাহাজগুলির সক্ষমতা হলো ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টন। এছাড়াও হংকংএর গাড়ির ফেরিগুলি এর সাথে আরও ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টন যোগ করতে পারবে। সব মিলিয়ে চীনারা প্রায় ১৫ লক্ষ টনের সক্ষমতা জড়ো করতে পারবে। অপরদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর উভচর নৌবহরের সক্ষমতা হলো ৮ লক্ষ ৪০ হাজার টন। আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘মিলিটারি সীলিফট কমান্ড’এর অধীনে সকল রোরো জাহাজ যোগ করলে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতাও প্রায় একই রকম হবে।

তবে কেউ কেউ মত দিচ্ছেন যে, যথাযথ সমন্বয় না থাকলে বেসামরিক জাহাজ ব্যবহার করে তাইওয়ান আক্রমণ করতে গেলে চীনাদের বিপদ হতে পারে। বেসামরিক জাহাজকে রক্ষা করতে হয় এবং আক্রান্ত হলে সহজেই ডুবে যেতে পারে। তবে শুগার্ট বলছেন যে, বেসামরিক জাহাজ কেন, সামরিক উভচর জাহাজের ক্ষেত্রেও সমস্যার ঘাটতি থাকে না। আর এই সকল জাহাজকে ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট এবং যুদ্ধবিমান দিয়ে রক্ষা করতেই হয়। বেসামরিক জাহাজগুলি আক্রান্ত হলে সেগুলির ভেসে থাকার সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ। চীনারা এক্ষেত্রে তাদের বর্তমান অবস্থাকে আরও উন্নত করতে কাজ করছে।

 

মার্কিনীরা কিভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করার কথা চিন্তা করছে?

এডমিরাল ডেভিডসনের কথা ইতোমধ্যেই অনেকের মাঝে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। তার ছয় থেকে দশ বছরের হিসেবকে অনেকেই ‘ডেভিডসন উইন্ডো’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল গ্যালাগার ‘নেভি লীগ’এর এক ভাষণে মত দিচ্ছেন যে, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধপ্রস্তুতি নেবার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এখনই চীনকে মোকাবিলা করার মতো নৌশক্তি তৈরি এবং প্রস্তুত করা। তার কথায়, সমুদ্রশক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট শক্তভাবে নিজেদের অবস্থানকে তুলে না ধরে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকলে তা ভূরাজনৈতিক বিপর্জয়ের দিকে ধাবিত করবে এবং একসময় তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে অবান্তর করে ফেলবে। একমাত্র মার্কিন সমুদ্রশক্তিই তাইওয়ানকে চীনের দখলমুক্ত রাখতে পারবে। তিনি বলেন যে, চীনকে বাধা না দিলে তারা তাইওয়ানকে দখলে নিয়ে জাপানকে ঘিরে ফেলবে। তারা সারা বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এবং সারা বিশ্বে বার্তা ছড়িয়ে দেবে যে, যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুদের পাশে দাঁড়ায় না। গ্যালাগার শত বছর আগের মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের নৌশক্তি তৈরির নীতিকে অনুরসরণের পক্ষপাতি। তিনি বলছেন যে, রুজভেল্টের নেতৃত্বই পরবর্তীতে বিংশ শতকে মার্কিন নৌশক্তির স্তম্ভ হয়েছিল।

চীনের একটা বড় সুবিধা হলো তাইওয়ান তাদের মূল ভূখন্ডের অনেক কাছে। শুগার্ট বলছেন যে, উত্তরের পীত সাগর বা দক্ষিণের হাইনান দ্বীপের কাছ থেকে চীনারা তাদের সেনাদের জাহাজে উঠিয়ে সরাসরিই তাইওয়ানের উপকূলে নিয়ে আসতে পারবে। এতে সময় খুবই কম লাগবে এবং মার্কিনীদের কাছে আক্রমণের পূর্বাভাস আসতে আসতে চীনারা সৈন্য পরিবহণের প্রাথমিক কাজ করে ফেলতে পারবে। শুগার্ট ‘ইউএস চায়না কমিশন’এর সামনে তার বক্তব্যে বলেছিলেন যে, তাইওয়ানের উপর সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ বিপুল সংখ্যক জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে সেগুলি দিয়ে চীনা বেসামরিক ফেরিগুলিকে টার্গেট করা। এটা করতে পারার জন্যে মার্কিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সামরিক নেতৃত্বের অধীনে বেসামরিক জাহাজগুলিকে টার্গেটের জন্যে যেন কোন আইনী বাধা না থাকে।

মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকেরা যেব্যাপারে চিন্তিত, তা হলো চীনারা হয়তো সকলের চোখের সামনেই তাইওয়ান আক্রমণের পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। মার্কিন এডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসনের ছয় থেকে দশ বছরের ‘উইন্ডো’ এখন মার্কিনীরা ব্যবহার করছে তাদের নৌবহর নতুন করে তৈরি করার জন্যে জনসমর্থন আদায়ে। তবে চুলচেরা বিশ্লেষণে চীনাদের সক্ষমতা এবং আকাংক্ষার মাঝে একটা ফারাক রয়েই যায়। এই ফারাকটাই এখন মার্কিন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবাচ্ছে। তারা যে ব্যাপারটাতে নিশ্চিত নন তা হলো তাইওয়ান আক্রমণ করার মতো একটা সিদ্ধান্ত যে চীনের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে, সেটা জেনেও চীনারা এই মিশন বাস্তবায়ন করবে কিনা। এবছরে এপ্রিলে ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ তাইওয়ানের ভূখন্ডকে পৃথিবীর সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে আখ্যা দেয়। তারা বলে যে, তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধ হলে তাইওয়নের ‘টিএসএমসি’ সেমিকন্ডাক্টর কারখানা বন্ধ হয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। মার্কিন থিংকট্যাংক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ঠিক এই কারণেই চীনারা তাইওয়ান থেকে দূরে থাকবে। কারণ তারাও ‘টিএসএমসি’র সেমিকন্ডাক্টরের উপর নির্ভরশীল; ঠিক যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র। ব্রেমার বেশি চিন্তিত তাইওয়ানের উপর চীনের হুমকির ফলাফলের ব্যাপারে। তিনি প্রশ্ন করছেন যে, চীনাদের হুমকির মুখে তাইওয়ানের জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা ধরে রাখার ব্যাপারটাকে কিভাবে দেখবে? আর সেই জনমতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা বন্ধুরাই বা কি করতে পারবে? ব্রেমারের কথায় এটা পরিষ্কার যে, পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় এখন কোন নিয়ম নেই। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত এই ব্যবস্থায় অবশিষ্ট রয়েছে শুধুই অনিশ্চয়তা। পূর্ব এশিয়ায় স্থিতাবস্থা ব্যাহত হবার ব্যাপারে আলোচনাই বলে দিচ্ছে যে, সারা বিশ্ব এখন এই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থার আশাতেই রয়েছে।

No comments:

Post a Comment