Wednesday 17 November 2021

চীনারা কি গুলি না চালিয়েই যুদ্ধ জিতে যাচ্ছে?

১৭ই নভেম্বর ২০২১

চীনা মাছ ধরার জাহাজের বহর। চীনারা মিলিশিয়া জাহাজগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চলে পাঠিয়ে অন্য দেশের জাহাজকে সমস্যায় ফেলে বলতে পারে যে, এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার মিলিশিয়াদের কেউ হতাহত হলে চীনা সরকার তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে জনমত তৈরি করতে পারবে। চীনাদের এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’র কোন প্রত্যুত্তর এখনও মার্কিনীরা দিতে পারেনি। উল্টো মার্কিন সহায়তা না পেয়ে ছোট দেশগুলি মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি হতাশাই ব্যক্ত করেছে।


ফিলিপাইনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফিলিপাইন কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স’এর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল এডিলবার্তো আদান ‘দ্যা ম্যানিলা টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীনারা সাগরে কোন গোলাগুলি ছাড়াই যুদ্ধ জিতে চলেছে। চীনারা ফিলিপাইনের ‘এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন’ বা ‘ইইজেড’এর মাঝেই ভয় দেখিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করছে; যাকে তিনি ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। চীনা হুমকি মোকাবিলায় তিনি ফিলিপাইনের জন্যে শুধু বন্ধু বা পার্টনারই চাইছেন না, এমন কোন মিত্র চাইছেন, যে কিনা চীনারা আক্রমণ করলে ফিলিপাইনকে রক্ষা করতে যুদ্ধ করবে এবং চীনাদের ‘গ্রে জোন’ কৌশল মোকাবিলায় ফিলিপিনোদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ‘গ্রে জোন’ হলো এমন একটা কৌশল, যার মাধ্যমে যুদ্ধ আর শান্তির মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন হয়ে যায়। অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে তথ্য যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, হাল্কা প্রকৃতির কিছু সহিংস কর্মকান্ড এতে থাকতে পারে। এছাড়াও নতুন প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার হামলার মাধ্যমে একটা দেশকে অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব। ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন ভাইস চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আদান ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ বছর আগে স্বাক্ষরিত ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’ বা ‘এমডিটি’কে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন করার পক্ষপাতি। ‘এমডিটি’ চুক্তিকে আগ্রাসী রাষ্ট্রের অপ্রচলিত এবং ‘হাইব্রিড’ কৌশলের বিরুদ্ধে ডিটারেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। ফিলিপাইনের উপর প্রচলিত সামরিক হামলা হলে চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দেবে। কিন্তু ‘গ্রে জোন’ কৌশল অবলম্বণ করার ফলে চীনারা ‘এমডিটি’ চুক্তিকে বাইপাস করতে পারছে। এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’ চীনারা তাদের ‘ম্যারিটাইম মিলিশিয়া’কে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে; যারা মূলতঃ সরকারি বাহিনী। ফিলিপাইনের জাহাজে ধাক্কা দেয়া এবং দল বেঁধে চীনা জাহাজের ইইজেডএর ভিতরে ঢুকে অবস্থান করার মতো ঘটনার ব্যাপারে ফিলিপাইন সরকার বেইজিংএর কাছে প্রতিবাদ করেছে; কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। জেনারেল আদান বলছেন যে, একারণেই ফিলিপাইনের উচিৎ ‘এমডিটি’র মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া।

গত মার্চে ২’শ চীনা মাছ ধরার ট্রলার একত্রে দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের কাছাকাছি এসে হাজির হয়। ফিলিপাইন বলছে যে, সেই জায়গা ফিলিপাইনের ইইজেডএর মাঝে পড়ে। তাদের কথায়, ট্রলারগুলি দেখে মনে হয় না যে, এগুলি মাছ ধরতে এসেছে। এগুলি বরং চীনের ‘ম্যারিটাইম মিলিশিয়া’ দ্বারা পরিচালিত। ‘বিবিসি’ বলছে যে, পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ এলাকাকে চীনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে রায় দেয়। তবে বেইজিং তাদের নিজেদের আঁকা ‘নাইন ড্যাশ লাইন’এর মাঝে সকল সমুদ্রাঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে। এই অঞ্চলের মাঝে চীনারা কৃত্রিমভাবে দ্বীপ উন্নয়ন করেছে এবং নিয়মিত সামরিক প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করেছে। এর আগে ২০১৯এর ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার কাছে নতুনা সাগরে চীনা মাছ ধরার ট্রলারের বড় একটা বহর কোস্ট গার্ডের জাহাজের পাহাড়ায় হানা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার সরকার এই হুমকি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে নৌবাহিনীর জাহাজ প্রেরণ করে। কিন্তু উভয় পক্ষ সমুদ্রে বেশ কিছুদিন ধরে উত্তেজনাকর অবস্থানে থাকে। পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়া সেই অঞ্চলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজেদের মাছ ধরার জাহাজের বহর মোতায়েনের পরিকল্পনা শুরু করে বলে দেশটার মিডিয়া ‘মঙ্গাবে’ জানায়।

শুধু কাছের সমুদ্রেই নয়, চীনারা পাড়ি জমিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কিঃমিঃ দূরের দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে প্রায় ৩’শ চীনা মাছ ধরার জাহাজ হাজির হয় দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর সমুদ্রসীমায়। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জাহাজগুলি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কাছে মাছ ধরার পর পেরুর উপকূলে হাজির হয়। ইকুয়েডরের নৌবাহিনীর অপারশনসএর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল ড্যানিয়েল গিনেজ বলেন যে, এভাবে মাছ ধরলে কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। চীনারা এখানে প্রতিবছরই মাছ ধরতে আসছে। একই বছরের জুন মাসে ৩’শ ৪০টা জাহাজ একত্রে গালাপাগোস এবং ইকুয়েডরের কাছে মাছ ধরতে এসেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু এবং ইকুয়েডরের অর্থনীতি সামুদ্রিক মাছ ধরার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। চীনাদের কর্মকান্ড এই দেশগুলির অর্থনীতিকে আঘাত করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের হিসেবে এই দুই দেশ মিলে বছরে প্রায় ৪৫ লক্ষ টন মাছ ধরে; যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। তবে চীনারা এক বছরে এরও চার গুণ মাছ ধরে। পুরো বিশ্বের মোট মৎস্য সম্পদের তিন ভাগের এক ভাগই চীনারা খাচ্ছে। লন্ডনের ‘ওভারসীজ ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট’এর হিসেবে চীনাদের রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার জাহাজের বিশাল মাছ ধরার বহর। তাদের জাহাজের আকৃতিও বড় হচ্ছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার উপকূলে চীনারা ৬টা জাহাজ পাঠিয়েছে বলে ২০২০এর জুলাইএ আফ্রিকার মিডিয়াগুলি প্রতিবেদন করে। তারা বলে যে, এই জাহাজগুলি বছরে ১২ হাজার টন পর্যন্ত মাছ ধরতে সক্ষম, যা লাইবেরিয়ার স্বাভাবিক মাছ ধরার সক্ষমতার দুই গুণ!

সমুদ্র এখন চীনের অর্থনীতিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনাদের সাথে বাকিদের চলছে ব্যাপক দ্বন্দ্ব। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি চীনের কৌশলকে ‘গ্রে জোন’ বা ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ বলছে। সামরিক ম্যাগাজিন ‘মিলিটারি রিভিউ’এর এক লেখায় গবেষক শুজিয়ান লুও এবং জনাথন প্যানটার বলছেন যে, চীনারা তাদের ম্যারিটাইম মিলিশিয়া ব্যবহার করে ‘গ্রে জোন’ কর্মকান্ড চালাচ্ছে; কারণ পরিস্থিতি বুঝে বেইজিং বলতে পারে যে, এদের সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। চীনারা মিলিশিয়া জাহাজগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চলে পাঠিয়ে অন্য দেশের জাহাজকে সমস্যায় ফেলে বলতে পারে যে, এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার মিলিশিয়াদের কেউ হতাহত হলে চীনা সরকার তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে জনমত তৈরি করতে পারবে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনারা ট্রলারের বহরের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠায়। নৌবাহিনীর জাহাজ না পাঠিয়ে সাদা রঙএর কোস্ট গার্ডের জাহাজ পাঠানোটাও ‘গ্রে জোন’ কৌশলের অংশ। এই জাহাজগুলি স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি চীনা জাহাজগুলি অনেক নৌবাহিনীর ফ্রিগেটের চাইতেও বড়। প্রতিপক্ষের মাছ ধরার ট্রলার বা ছোট প্যাট্রোল বোটকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। চীনাদের এই ‘হাইব্রিড যুদ্ধে’র কোন প্রত্যুত্তর এখনও মার্কিনীরা দিতে পারেনি। উল্টো মার্কিন সহায়তা না পেয়ে ছোট দেশগুলি মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি হতাশাই ব্যক্ত করেছে।

No comments:

Post a Comment