Monday 15 November 2021

ইরানের লক্ষ্য আসলে কি?

১৫ই নভেম্বর ২০২১

ইরানের 'আইআরজিসি'র ছোট ছোট বোটগুলি মহড়া দিচ্ছে। ইরানের কৌশলের মাঝে রয়েছে মাইন, জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং শতশত ছোট বোট ব্যবহারের মাধ্যমে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে ফেলা; যাতে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। ইরানের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’র উদ্দেশ্য হলো একটা ‘গ্রে জোন’ তৈরি করা; যা যুদ্ধ এবং শান্তির মাঝামাঝি থাকবে। এতে ভীতি প্রদর্শন এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অগ্রগামী অবস্থান নেয়া হবে; এবং একইসাথে দ্বন্দ্বকে পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়া থেকে বিরত রাখা হবে। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত করা হবে যাতে নিজেদের উপর বড় কোন প্রতিশোধমূলক হামলা না আসে।

 
ইরানের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য অর্জনে ইরান কি কি কর্মকান্ড চালাচ্ছে, তা নিয়ে ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মাঝে মোটামুটি ঐকমত্য থাকলেও লক্ষ্যটা আসলে কি, সেব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে। মার্কিন চিন্তাবিদেরা ইরানের লক্ষ্যকে আগ্রাসী মনে করলেও ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা সেটাকে ডিটারেন্ট হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ মার্কিনীরা যেখানে আলোচনা করছেন যে, ইরানের আগ্রাসী কর্মকান্ড কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব ক্ষুন্ন করছে, সেখানে ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত হতে ইরান তার ডিটারেন্ট তৈরিতে বাধ্য হচ্ছে। মূলতঃ ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখতে ইচ্ছুক নয় বলেই দুই ঘরানার চিন্তাবিদদের মাঝে মতপার্থক্য থেকে যাচ্ছে।

ইরান ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’ কৌশল কি আগ্রাসী?

ইরানের আঞ্চলিক কৌশল নির্ধারণের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে নিয়ে ‘মিডলইস্ট স্টাডিজ এসোসিয়েসন’এর এক আলোচনায় কথা বলেছেন মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর আমর ইয়োসেফ। তিনি বলছেন যে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টাটা আঞ্চলিক সুযোগের কারণে যতটা হয়েছে, তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণেও ততটা হয়েছে। তিনি ইরানের রাজনীতিতে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ইসলামিক রিপাবলিকান গার্ড কোর’ বা ‘আইআরজিসি’র সাথে পুনর্গঠনকামী রাজনৈতিক গ্রুপের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেন। তিনি বলছেন যে, ২০০৫ সাল থেকে মার্কিন হুমকি মোকাবিলায় ইরান ‘মোজাইক ডিফেন্স’এর কৌশল অবলম্বন করেছে। এই কৌশলের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত এবং অপ্রচলিত বাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন করে ফেলা। তবে আরব বসন্ত শুরুর পর ২০১২ সাল থেকে ইরান তার কৌশলের মাঝে আক্রমণাত্মক অংশটা যুক্ত করেছে। ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’ নামে পরিচিত এই কৌশলে বলা হয় যে, ইরানের উচিৎ ইরানের সীমানার বাইরে যুদ্ধ করা, যাতে ইরানের অভ্যন্তর নিরাপদ থাকে। ‘হাইব্রিড’ ধরনের এই কৌশলে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক প্রক্সি গ্রুপ, ড্রোন, নৌ গেরিলা এবং সাইবার যুদ্ধ। এই কৌশলের মূলে প্রথমতঃ রয়েছে গেরিলা, সন্ত্রাস এবং স্পেশাল অপারেশনের মাধ্যমে চালিত অপ্রচলিত যুদ্ধ এবং সাথে রয়েছে ইন্টেলিজেন্স অপারেশন, তথ্য ও সাইবার যুদ্ধ। আর দ্বিতীয়তঃ এতে রয়েছে আক্রমণাত্মক অংশ, যার স্তম্ভ হলো নিজেদের দুর্বলতা। এভাবে চালিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’র উদ্দেশ্য হলো একটা ‘গ্রে জোন’ তৈরি করা; যা যুদ্ধ এবং শান্তির মাঝামাঝি থাকবে। এতে ভীতি প্রদর্শন এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অগ্রগামী অবস্থান নেয়া হবে; এবং একইসাথে দ্বন্দ্বকে পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়া থেকে বিরত রাখা হবে। শুধু তাই নয়, নিশ্চিত করা হবে যাতে নিজেদের উপর বড় কোন প্রতিশোধমূলক হামলা না আসে। এই কৌশল বাস্তবায়নে সবচাইতে বড় ভূমিকা হলো ‘আইআরজিসি’র। ইরানের জন্যে সিরিয়া এবং ইরাকে আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবার সমান্তরালেই ইরানের রাজনীতিতে ‘আইআরজিসি’র ক্ষমতা বেড়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আয়াতুল্লাহ খামেনি ‘আইআরজিসি’র নেতাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন যে, নিজেদের সীমানার মাঝে সীমাবদ্ধ থেকে সীমানার প্রতি হুমকিকে অবহেলা করা যাবে না। ‘আইআরজিসি’র দায়িত্ব হলো সুদূরপ্রসারী আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন; যা হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’।

 
ইরানের প্রযুক্তি সহায়তায় হিযবুল্লাহর নিজস্ব নির্মিত রকেট। এই রকেটগুলি কি ইরানের আগ্রাসী নীতির অংশ, বাকি ডিটারেন্স, তা নিয়ে পশ্চিমাদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ব্রিটিশরা বলছে যে, শত্রুদেরকে মোকাবিলায় ইরান শক্তিশালী ডিটারেন্স তৈরি করেছে। এই ডিটারেন্সের অংশ হলো ইরান এবং লেবাননে অবস্থিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট; যেগুলি যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা, আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং ইস্রাইলের শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে।

ইরানের কৌশল কি শুধুই ডিটারেন্ট?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের জাতিরাষ্ট্রগুলির সৃষ্টি যেহেতু ব্রিটেনের হাতেই হয়েছে, তাই ব্রিটিশ চিন্তাবিদদের মধ্যপ্রাচ্যের ধারণা বাকিদের থেকে আলাদা। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ইরানের কৌশল মূলতঃ ডিটারেন্স। ইরানের অভ্যন্তরে দু’টা গ্রুপ রয়েছে, যার একপক্ষ মূলতঃ জাতীয়তাবাদী; যাদের লক্ষ্য হলো ইরানকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দেখা। অপরপক্ষ হলো বিপ্লবী; যারা চাইছে ইরানকে শিয়া মুসলিমদের নেতৃত্বে দেখতে। এই দু'টা লক্ষ্যই বহিঃশত্রুর হুমকির মাঝে রয়েছে; কারণ ইরান মনে করে যে, এই হুমকির মাধ্যমে ইরানের স্বাধীনভাবে কাজ করাকে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইরানের মূল লক্ষ্য হলো বিপ্লব পরবর্তী ইরানের সংবিধান এবং তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইরানের সামনে প্রধান বাধা হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইল। এই শত্রুদেরকে মোকাবিলায় ইরান শক্তিশালী ডিটারেন্স তৈরি করেছে। এই ডিটারেন্সের অংশ হলো ইরান এবং লেবাননে অবস্থিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট; যেগুলি যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা, আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং ইস্রাইলের শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এছাড়াও ইরাকে অবস্থিত ইরানের মিলিশিয়ারা ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির উপর হামলা করবে; এবং ‘আইআরজিসি’র নৌবাহিনী হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন নৌশক্তির অবাধে চলাচলকে বিঘ্নিত করবে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিনীরা আঞ্চলিকভাবে নিজেদের সামরিক কর্মকান্ডকে চালিয়ে নিতে পারবে না। ইরান মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই কৌশলের ফলে ইরানের মূল ভূখন্ডে স্থলসেনার হামলার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে সম্ভাবনা রয়েছে বড় ধরনের বিমান হামলার; কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা বা ভৌগোলিক অঞ্চল দখল করার সম্ভাবনাও রয়েছে; এছাড়াও ইরানের অভ্যন্তরে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা হতে পারে। ইরান সরকার মনে করে যে, সে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে সক্ষম। একইসময়ের মাঝে তারা আঞ্চলিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি আরোপ করে জয়পরাজয় অনিশ্চিত করে ফেলতে পারবে। ফলশ্রুতিতে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হবে প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুরা। এই শক্তিশালী ডিটারেন্ট সক্ষমতা রেখেই ইরান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্রাইল, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে লেবানন এবং ইয়েমেনের মতো আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে ব্যস্ত রেখে তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে সিরিয়া এবং ইরাকে প্রভাব ধরে রাখাটা ইরান নিজস্ব নিরাপত্তার একটা বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখে; যেখানে অবস্থান ধরে রাখতে ইরানকে নিজস্ব সম্পদ খরচ করতে হচ্ছে।

আক্রমণাত্মক, নাকি প্রতিরক্ষামূলক কৌশল?

ইরানি চিন্তাবিদেরাও প্রায় একইভাবে চিন্তা করছেন। তেহরানের ‘আলামেহ তাবাতাবাঈ ইউনিভার্সিটি’র এসিসট্যান্ট প্রফেসর হাদি আযিলি এবং ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর রিসার্স ফেলো মাহসা রুহি ‘আইআইএসএস’এর এক লেখায় বলছেন যে, পশ্চিমারা কেউ কেউ মনে করেন যে, ইরানের কৌশল মূলতঃ আক্রমণাত্মক; বাকিরা মনে করেন যে, আসলে তা প্রতিরক্ষামূলক। তারা বলেন যে, নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যে ইরানের পারসিক সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার কথা পশ্চিমারা যখন বলেন, সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ইরানের কৌশল পুরোপুরি প্রতিরক্ষামূলক, সেটাও পুরোপুরি সঠিক নয়। তাদের কথায়, ইরানের কৌশলের মাঝে রয়েছে ‘ফরওয়ার্ড ডিফেন্স’, তথাপি এটা মূলতঃ ডিটারেন্ট ভিত্তিক বা প্রতিরক্ষামূলক। নিজেদের প্রচলিত সামরিক সক্ষমতার মারাত্মক ঘাটতি মোকাবিলা করতে গিয়েই ইরান অপ্রচলিত পদ্ধতির দিকে ধাবিত হয়েছে; যার মাঝে রয়েছে রাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপের সাথে জোট বাঁধা। এই পদ্ধতিগুলিকেই ইরান নিজেদের রক্ষায় ডিটারেন্ট হিসেবে দেখেছে। মূল উদ্দেশ্য হলো ইরানের উপর কেউ হামলা করার চিন্তা করলে হামলাকারীর খরচ অত্যধিক বৃদ্ধি করে দেয়া; যার ফলশ্রুতিতে হামলার পরিকল্পনাকারী সহজে হামলা করবে না। এধরনের চিন্তার জন্ম হয়েছে ১৯৭৯এর বিপ্লবের পর থেকে। বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ইরানের শাহএর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের বন্ধু রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু বিপ্লবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব দেশগুলি ইরাকের পক্ষ নেয়। কারণ ইরানের আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি সরকারের বিপ্লবের মাধ্যমে শিয়া ধর্মীয় চিন্তাগুলি আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার কথাগুলি আরব সরকারগুলির জন্যে হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। যুদ্ধের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাককে ‘স্কাড বি’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে; যা সাদ্দাম হোসেনের সরকার ইরানের শহরগুলির উপর ব্যবহার করে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হবার এই বিভীষিকাই পরবর্তীতে ইরানকে একইধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে উৎসাহিত করে। তবে ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরান পরবর্তীতে নিজস্ব সামরিক শিল্প তৈরির দিকে মনোযোগী হয়। তবে নতুন সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক চাপে ইরানকে সেসব অস্ত্রই ডেভেলপ করতে হয়েছে, যেগুলি স্বল্প খরচে বেশি কৌশলগত সুবিধা দেবে। ইরানের মূল সামরিক লক্ষ্য হলো ‘এন্টি একসেস, এরিয়া ডিনাইয়াল’ বা ‘এটুএডি’ কৌশল বাস্তবায়ন করা। এই কৌশলের মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিকভাবে কোন আগ্রাসী শক্তির সামরিক অবস্থান নেয়া কঠিন করে ফেলবে; যাতে করে সেই শক্তির পক্ষে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই কৌশলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও কৌশলের মাঝে রয়েছে মাইন, জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং শতশত ছোট বোট ব্যবহারের মাধ্যমে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে ফেলা; যাতে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বাজারে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। তবে আযিলি এবং রুহি বলছেন যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পারমাণবিক অস্ত্র বহণ করার জন্যে তৈরি করা হয়নি কখনোই; এবং তারা মনে করেন না যে, এই কৌশল পরিবর্তিত হবার আদৌ কোন সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বলছেন যে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমিয়ে আনলেই যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি ইরানের সরকারকে দুর্বল করা বা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। অপরদিকে আঞ্চলিক অবস্থান ধরে রাখতে পারলে তা ইরানের ডিটারেন্টকে শক্তিশালী করছে। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনে প্রক্সি মিলিশিয়া তৈরি করার মাধ্যমে ইরান তার ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’ বৃদ্ধি করেছে; যা কিনা ইরানের মূল ভূখন্ডের উপর হুমকি কমিয়েছে।

 
ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মানচিত্র। ইরানের মূল সামরিক লক্ষ্য হলো ‘এন্টি একসেস, এরিয়া ডিনাইয়াল’ বা ‘এটুএডি’ কৌশল বাস্তবায়ন করা। এই কৌশলের মাধ্যমে ইরান আঞ্চলিকভাবে কোন আগ্রাসী শক্তির সামরিক অবস্থান নেয়া কঠিন করে ফেলবে; যাতে করে সেই শক্তির পক্ষে ইরানের মূল ভূখন্ডে হামলা করাটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এই কৌশলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

‘আলসার স্ট্র্যাটেজি’

‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মার্কিন ‘নেভাল ওয়ার কলেজ’এর ‘জে সি উইলি চেয়ার অব ম্যারিটাইম স্ট্র্যাটেজি’ জেমস হমস বলছেন যে, ইরানের কৌশল হলো ‘আলসার’এর মতো। স্বল্প সক্ষমতার কারণেই ইরান ‘ওয়ার বাই কনটিনজেন্ট’ কৌশল অবলম্বণ করছে; যা দু’শ বছর আগে ব্রিটেন করেছিল ন্যাপোলিয়নের অধীনে পুরো ইউরোপের বিরুদ্ধে। এই কৌশলের মাধ্যমে ব্রিটেন তার প্রধানতম লক্ষ্যগুলি অর্জন করার পর তার হাতে যতটুকু সম্পদ রয়েছে, সেই সম্পদটুকুই ব্যয় করেছে ন্যাপোলিয়নের বাহিনীর সাথে সরাসরি স্থলযুদ্ধে। এই যুদ্ধটা ব্রিটেন করেছিল ফ্রান্সের অধীনে থাকা স্পেনের মাটিতে। স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করেই ব্রিটেন স্প্যানিশ জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ন্যাপোলিয়নের কয়েক লাখ সেনার বিশাল সেনাবাহিনীকে ১৮০৮ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের জন্যে স্পেনে আটকে রেখেছিল। এই বাহিনী বাকি ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল; যা পরবর্তীতে ন্যাপোলিয়নের পক্ষে ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা কঠিন করে ফেলেছিল। ন্যাপোলিয়ন নিজেই স্পেনের অবস্থাকে “স্প্যানিশ আলসার” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। হমস বলছেন যে, ইরানও ব্রিটিশদের কৌশল অবলম্বণ করে মার্কিন নৌবাহিনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে মধ্যপ্রাচ্য টহল দিতে বাধ্য করছে; যখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই জাহাজগুলিকে বিশ্বের অন্য স্থানগুলিতে মোতায়েন রাখতে। তিনি হিসেব করে দেখাচ্ছেন যে, মার্কিন নৌবাহিনীর মোট ১১টা বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। খুব ভালো কোন দিনে হয়তো এগুলির চারটাকে সমুদ্রে পাওয়া যাবে অপারেশনের জন্যে; বাকিগুলি হয় মেইনটেন্যাস, বা ওভারহলিংএ রয়েছে, অথবা মিশনের জন্যে রেডি হচ্ছে, অথবা সবেমাত্র লম্বা মিশন শেষ করে বিশ্রামে যাচ্ছে। এছাড়াও ছোট আকারের উভচর বিমানবাহী জাহাজ রয়েছে ৮টা; যার মাঝে সর্বোচ্চ ৩টা অপারেশনে থাকে। এর মাঝে একটা জাহাজ আবার কিছুদিন আগেই আগুনে ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই ধরনের মিলিয়ে মোট সাতটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ যেকোন সময়ে অপারেশনের জন্যে পাওয়া যাবে; যার দু’টা মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। অর্থাৎ মার্কিন নৌবাহিনীর শক্তির মূলে থাকা ৭টা জাহাজের মাঝে ২টা মোতায়েন থাকছে মধ্যপ্রাচ্যে; বাকি ৫টা দিয়ে বাকি বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। এই সমীকরণটা বর্তমানে শুধুমাত্র ইরানের কারণেই বাস্তবতা হয়ে রয়েছে মার্কিনীদের জন্যে।

মার্কিন বনাম ব্রিটিশ চিন্তার পার্থক্য

ইরানের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণেই পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মাঝে মত পার্থক্য রয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে মার্কিনীরা ব্রিটিশ প্রভাবের জায়গাগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার যে চেষ্টাটা করেছে, তা আটলান্টিকের দুই পাড়ের দুই শক্তির মাঝে টানাপোড়েন তৈরি করেছে। যদিও ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন একপক্ষে থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করেছে, তথাপি দু’শ বছর ধরে নিজের শাসনে থাকা বিশ্বব্যবস্থাকে মার্কিনীদের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটেন প্রস্তুত ছিল না। ব্রিটেন নিশ্চিত করেছে যে, বিশ্বব্যাপী অনেকগুলি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ওয়ারশ’ জোটে যেমন যোগ দেবে না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা জোটেরও বাইরে থাকবে। ‘নিরপেক্ষ’ এই দেশগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্যে ঠান্ডা যুদ্ধের দুই মেরুর জোটের মাঝে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে। এখানেই ছিল ব্রিটেনের প্রভাব ধরে রাখার রাজনৈতিক সক্ষমতা। এই দেশগুলিকে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে যাওয়া থেকে বিরত রাখার বিনিময়ে ব্রিটেন বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে। এখন একুশ শতকে বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলির সামনে যখন মার্কিন এবং চীনা ক্যাম্পে যোগদান করার অপশন দেয়া হচ্ছে, তখন ব্রিটেন নিশ্চিত করতে চাইছে যে কিছু দেশ কোন পক্ষেই থাকবে না। অর্থাৎ ঠান্ডা যুদ্ধের মতোই কিছু দেশ কোন জোটেই যোগ দেবে না। এই দেশগুলির ‘নিরপেক্ষতা’ একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদকে বিভাজিত করে ওয়াশিংটনের জন্যে বিরক্তির কারণ হবে, অন্যদিকে তা লন্ডনের জন্যে ভূরাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখার হাতিয়ার হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবে, ততদিন ব্রিটেন মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে। ‘রুসি’র জ্যাক ওয়াটলিং যখন বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে একটা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়ে আলোচনায় এগুনোই পশ্চিমাদের জন্যে শ্রেয়, তখন তা বহুদিনের ব্রিটিশ চিন্তাটাকেই প্রতিফলিত করে। জেমস হমস ইরানের কৌশলকে যথার্থই ‘আলসার স্ট্র্যাটেজি’ বলেছেন। আর ব্রিটিশরা চায় পরিবর্তিত বিশ্ব ভূরাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের এই ‘আলসার’ যেন মার্কিনীদের বৈশ্বিক নীতিকে প্রভাবিত করে যেতে থাকে।

4 comments:

  1. চমৎকার লেখা।

    এই দেশগুলির ‘নিরপেক্ষতা’ একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদকে বিভাজিত করে ওয়াশিংটনের জন্যে বিরক্তির কারণ হবে, অন্যদিকে তা লন্ডনের জন্যে ভূরাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখার হাতিয়ার হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান ধরে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবে, ততদিন ব্রিটেন মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে।
    ১. কিভাবে লন্ডনের জন্যে ভূরাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখার হাতিয়ার হবে?
    ২. কিভাবে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছে। এখানে কোথায় কোথায় কয়টা দেশ হবে, সেই পুরো চিন্তাটাই ছিল ব্রিটেনের। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউই এই দেশগুলিকে পরিবর্তন করার সাহসও দেখাতে পারেনি। সর্বোচ্চ যে ব্যাপারটা ঘটেছে তা হলো ইস্রাইলের সীমানা বড় হয়েছে।

      মধ্যপ্রাচ্যের আরব, তুর্কি, কুর্দি, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, খ্রিস্টান, আলাওয়াতি, ইত্যাদির মাঝে জটিল রাজনীতি কোন দেশে কতটুকু হবে এবং সেগুলি কার কার মাঝে দ্বন্দ্ব এবং বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে এই দেশগুলির সীমানা এবং দেশগুলির রুলিং ক্লাসের উপর। ব্রিটেন এই দুইটাই তৈরি করেছে। বাকিরা কোন অবস্থাতেই ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে এই এলাকা নিয়ে চিন্তা করতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক।

      Delete
  2. ইরানের মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণ বা খেলাফত জাতীয় কিছু তৈরির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?

    শিয়াদের ধর্মীয় চেতনার পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে আহলে বাইতের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার উপর। ইরান কি যথেষ্ট ধর্মপরায়ণ শক্তি নাকি স্বার্থই মূল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইরান হলো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নামই যেখানে রিপাবলিক, সেখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। গণতন্ত্র মানেই হলো মানুষের তৈরি আইন দিয়ে রাষ্ট্র চলবে। ইরানের আইনের মাঝে কিছু আইন রয়েছে শরীয়া আইন; ঠিক যেমনটা রয়েছে সৌদি আরবে। ইরান এবং সৌদি আরব উভয়েই ইসলামিক আমিরাত। এদের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী এবং নির্দিষ্ট ভূখন্ড রয়েছে। সেই ভূখন্ডের বাইরের অঞ্চলকে তারা নিজেদের দেশের অংশ হিসেবে মনে করে না। অথচ দেশের সীমানার আইন হলো ইউরোপের ১৬৪৮ সালের 'ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেম'এর অংশ। এই সিস্টেম মেনে চলে বলেই এই দুই দেশ জাতিসংঘের সদস্য এবং চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলি তাদের সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে। এই দেশগুলি তাদের সীমানার বাইরের কোন জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেবে না; নিতে পারবে না। এটাই আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা এই দেশগুলি বর্তমান ব্যবস্থা বাদ দিয়ে অন্য কোন ধরনের রাষ্ট্র গঠন করবে না।

      Delete